ফ্রাঞ্জ শুবার্ট
বেটোভেনের বয়স যখন বিশ বছর বয়স তখন ফ্রাঞ্জ শুবার্টের (১৭৯৭-১৮২৮) জন্ম। সাধারণত যা দেখা গেছে, প্রায় সকল বিখ্যাত সংগীতকারই একসময় ভিয়েনাতে গিয়েছেন। তবে, শুবার্টের জন্মই কিন্তু ভিয়েনাতে।
মোৎসার্টের মতো শুবার্টের সুরেও যেন মধু ঝরে পড়তো। তিনিও অবলীলায় একটার পর একটা সুর তৈরি করে যেতে পারতেন। আর তাঁর সুরগুলো মাথায় একদম গেঁথে যেতো, এমনকি সিম্ফোনিগুলোও।
শুবার্ট ছিলেন নিপাট ভদ্রলোক পিয়ানোবাদক। তবে মোৎসার্ট বা বেটোভেনের মতো ওস্তাদ লোকদের মতো তিনি বাজিয়ে অতো পয়সা কামাই করতে পারেননি। তবে তিনি তাঁর সংগীতের বন্ধুদেরকে সান্ধ্যকালীন আড্ডায় বেশ বিনোদন দিতেন। এই আড্ডার নাম তো পরবর্তীতে শুবার্টায়ার্ডস হয়ে গিয়েছিল। তাঁরা একসাথে বসতেন, গুলতানি মারতেন আর শুবার্ট তৎক্ষণাৎ যেসব সুর তৈরি করতেন সেগুলোর সঙ্গে নাচতেন।
তাঁর এই বন্ধুবাৎসল্য এবং ফুর্তির মেজাজের কারণেই বন্ধু মহলে তিনি ছিলেন তুমুল জনপ্রিয়। অবশ্য তিনি দেখতে তেমন সুদর্শন ছিলেন না। মানে, একেবারেই সুদর্শন ছিলেন না দেখে বন্ধুরা তাঁকে ঠাট্টা করে ডাকত ‘মাসরুম’।
যাহোক, তাঁর বন্ধুরা কিন্তু শুবার্টের বেকার এবং কপর্দকশুন্য দুর্দিনে ফেলে যায়নি, বরং এগিয়ে এসেছিলো। তখন ভিয়েনা হেইডেনকে নিয়ে মেতে ছিলো। আর বেটোভেন তখন তাঁর সক্ষমতা কেবল দেখাতে শুরু করেছেন। কাজেই, সিম্ফোনির দুনিয়ায় শুবার্ট পাত্তা পাননি। অপরদিকে, আরেক তরুণ সংগীতকার গিয়াসিনো রোসিনি তখন দুর্দান্ত সব অপেরা তৈরি করছিলেন (যেমন: দ্য বার্বার অফ সেভিল)। কাজেই, অপেরার দুনিয়াতেও তাঁর জুত করা সম্ভব ছিলো না।
তবে, শুবার্টের সিম্ফোনিগুলো কিন্তু অতো তীব্র ছিলো না। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত সিম্ফোনি হলো সিম্ফোনি নম্বর ৮ বা আনফিনিশড সিম্ফোনি। তিনি এটাকে জীবনের কোনো বড় বিপর্যয় যেমন মৃত্যু বা অন্যকোনো কারণে শেষ করতে পারেননি তেমন নয়, বরং, কী কারণে তিনি কেবলমাত্র চারটা মুভমেন্টের জায়গায় মাত্র দুইটা মুভমেন্ট পর্যন্ত লিখেছিলেন তা কেউ বলতে পারেনা। তবে, তিনটা মত আছে এই নিয়ে:
এক নম্বর মত: তিনি মনে করেছিলেন দুইটা মুভমেন্টই যথেষ্ট।
দুই নম্বর মত: শুবার্ট ওই দুইটা মুভমেন্টের সঙ্গে যায় এমন কোনো মুভমেন্ট আর চিন্তা করতে পারেননি।
তিন নম্বর মত: তিনি হয়তো লিখেছিলেন কিন্তু হারিয়ে ফেলেছিলেন। তবে, তিন নম্বর মুভমেন্টের একটা খসড়া কাঠামো সত্যিসত্যিই কিন্তু আছে।
এমনকি, অন্য অনেকেই এই সিম্ফোনির জন্য তিন এবং চার নম্বর মুভমেন্ট তৈরি করেছিলেন। কিন্তু, সেগুলোর কোনোটাই শুনতে দুইটার সঙ্গে মানানসই মনে হয়নি।
আনফিনিশড সিম্ফোনির পরে, শুবার্ট সিম্ফোনি নম্বর ৯ লেখেন। এর চলতি নাম ডাই গ্রোস বা দ্য গ্রেট। এটা তাঁর সবচেয়ে লম্বা সিম্ফোনি।
সংমেইস্টার শুবার্ট
তবে শুবার্টের সিম্ফোনিগুলো যতোটা সুন্দর, তারচেয়েও বেশী সুন্দর হলো শুবার্টের ছোট ছোট সুর, যেমন: ছোট ছোট পিয়ানোর সুরগুলো যেগুলোকে বলা হয় ইমপ্রম্পটু বা মোমেন্ট মিউজিকাল।
সবচেয়ে বড়কথা, তিনি গান বাঁধার ওস্তাদ ছিলেন। সবমিলিয়ে তিনি ৬০০টিরও বেশী গান বানিয়েছিলেন। এগুলোকে তিনি বলতেন লিডার।
শুবার্ট তাঁর লিডারগুলোকে একক কণ্ঠে গাওয়ার জন্য তৈরি করতেন, সঙ্গে সঙ্গত হিসেবে পিয়ানো। আসলে সঙ্গত করা বললে ভুল হবে, কারণ, গানগুলোতে পিয়ানোর গুরুত্বও কম ছিলো না। গায়িকা গ্রেশেন যখন কণ্ঠটা ওঠানামা করিয়ে গাইতেন তখন পিয়ানোতেও সুরের ওঠানামা চলতো। এই ওঠানামা দিয়ে গাড়ির চাকার চলার সাথে সাথে তাতে সওয়ার যুবতী নারীর ভয় পাবার বিষয়টি বুঝানো হতো। যখন কোনো লোক এবং তার বাচ্চা ঘোড়া ছুটিয়ে চলছে এমন দৃশ্য বুঝানো হতো তখন পিয়ানো সঙ্গত এমভাবে বাজানো হতো যেন ঘোড়া ছুটছে। যখন গলার সুর স্থির পানিতে মাছেদের সাঁতার কেটে বেড়ানোর দৃশ্য তুলে ধরতো তখন পিয়ানোটা নদীতে পরিণত হতো। শুবার্টের গান যতোই শোনা যায় ততোই এইসব সূক্ষ্ণ বিষয়গুলো চোখে ধরা পড়ে।
সদাবৎসল শুবার্ট অসংখ্য পিয়ানো ডুয়েট লিখেছিলেন। এগুলো দুইজন বাজানোর উপযোগী সুর, বলতে গেলে, পিয়ানোতে চারহাতে বাজানোর জন্য লেখা।
ডুয়েট শুনতে খুবই মজা লাগতো। শুধুমাত্র এইজন্যই মানুষজন জড়ো হতো। প্রায়ই ডুয়েট বানানোর সময় শুবার্ট ইচ্ছা করেই এমনভাবে তৈরি করতেন যাতে বাদককে এক হাত ডিঙিয়ে আরেক হাত দিয়ে বাজাতে হয়। আর তারপর তিনি সেগুলো একসাথে বাজানোর জন্য কোনো সুন্দরী পিয়ানো বাদককে ডেকে আনতেন। বাকিটা অনুমেয়।
বেটোভেনের কফিন বয়ে নিয়ে যাবার এক বছরের মাথায় শুবার্ট মারা গেলেন টাইফয়েডে। মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে, নিঃস্ব অবস্থায়।
শুবার্টের উল্লেখযোগ্য কাজগুলো হল:
ফেলিক্স মেন্ডেলসন
ইত্যবসরে, জার্মানিতে আরেক মেধাবী বেড়ে উঠছিলেন। লিখছিলেন চমৎকার সব জিনিসপত্র, অত্যন্ত অল্প বয়সে মৃত্যু হবে বলেই হয়তো। তিনি ফেলিক্স মেন্ডেলসন (১৮০৯-১৮৪৭)।
ফেলিক্স জন্মেছিলেন সোনার চামচ মুখে নিয়ে। তাঁর বাবা ছিলেন একজন ব্যাংকার, দাদা ছিলেন দার্শনিক মোজেস মেন্ডেলসন। তাঁর বাবা-মা যখন বুঝতে পেরেছিলেন ফেলিক্সের ভিতরে সহজাত প্রতিভা রয়েছে, তাঁরা তখন তার বিকাশের জন্য চেষ্টা করেছিলেন। মোৎসার্টের মতোই তিনি শিশুকালেই সংগীত রচনা করতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু মেন্ডেলসনের সুর শুরু থেকেই অত্যন্ত পরিণত ছিল, বিশেষ করে ষোলো বছর বয়সে লেখা অক্টেট ফর স্ট্রিংস এবং শেকসপিয়রের নাটক আ মিডসামার নাইট’র ড্রিম-এর উপর তৈরি করা একটি ওভারর্চার (সতেরো বছর বয়সে লেখা)।
এর সতেরো বছর পর, মেন্ডেলসন শেকসপিয়রের ওই একই নাটকের জন্য আবহসংগীত তৈরি করেছিলেন। ওই নতুন সংগীতের মধ্যে একটি অংশ মেন্ডেলসনের লেখা যেকোনো সুরের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। নাটকে ‘আপনি এখন চাইলে কনেকে চুমু খেতে পারেন’ বলার পরে যে ওয়েডিং মার্চের সুরটি বাজে সেটি এতোটাই পরিচিত, মূলধারার সংস্কৃতিতে সেটা এতোটাই মিশে গেছে যে, মাঝে মাঝে মানুষ ভুলে যায় এটা কারও সৃষ্টি!
মোৎসার্টের মতোই, মেন্ডেলসনও তাৎক্ষণিক সুর তৈরি করতে পারতেন যেন আগে থেকেই সেটা তাঁর জানা ছিল। কোনো খসড়াও এজন্য তৈরি করতে হতো না তাঁর। হয়তো তিনি কোনো শিল্পী বন্ধুর সাথে কথা বলছেন তার মধ্যেই হঠাৎ কাগজে সুর লিখতে শুরু করে দিলেন।
নাছোড়বান্দা পিয়ানো
মেন্ডেলসন এক বিরল সংগীতকার যিনি জীবদ্দশাতেই নাম এবং অর্থ দুটোই অর্জন করেছিলেন। যেমন: তাঁর পিয়ানো কনসার্টো নং.১ ইন জি মাইনর এতোই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, বেশ কিছুদিনের জন্য এটা সবচেয়ে বেশীবার বাজানো পিয়ানো কনসার্টো হয়ে গিয়েছিলো। এমনকি, সংগীতকার হেক্টর বার্লিওজ এই বাজনাটির কথা প্যারিস কনজার্ভেটরিতে গল্প করেছিলেন। যে পিয়ানোটা দিয়ে ওই কনসার্টোটা বাজানো হতো সেটি নিয়ে একটা মজার গল্প প্রচলিত আছে। ওই পিয়ানোটা নাকি কখনো থামতো না, আপনাআপনি ওই কনসার্টো বাজিয়ে যেতো! তাই স্থানীয় পিয়ানো কারিগরেরা নাকি ওটাকে নিয়ে এসে থামানোর সবরকম চেষ্টা করেছিলেন। পবিত্র পানি ছিটিয়ে দিয়ে, জানালা দিয়ে ফেলে দিয়ে, কুপিয়ে পিয়ানোর চাবিগুলো টুকরা করার পরেও নাকি পিয়ানোটা বেজেই চলেছিলো। পরে বিষয়টা আয়ত্তের বাইরে চলে গেলে মেন্ডেলসন নাকি ওই পিয়ানোর অবশিষ্টাংশ আগুনে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন আর তারপরেই নাকি সেই বাজনা থেমেছিলো।
বাখ পুনরাবিষ্কার
ইহুদী পরিবারে জন্ম হলেও, মেন্ডেলসন একজন লুথারান হিসেবে ব্যাপটাইজ হন এবং তিনি ধর্মীয় বিষয়াদী নিয়েও অনেক সংগীত রচনা করেছিলেন।
বড় হয়ে মেন্ডেলসন জার্মানির লিপজিগে অর্কেস্ট্রা পরিচালনা করতেন। সেখানে এক শতাব্দী আগে বাখও তাঁর বিখ্যাত সব সুর রচনা করেছিলেন। সত্যি বলতে বাখের সংগীতকে জনপ্রিয় করতে মেন্ডেলসন একটা বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই, বাখ বিখ্যাত ছিলেন একজন অর্গান-বাদক হিসেবে, সংগীতকার হিসেবে নয়। তাঁর অসংখ্য সংগীত তাঁর মৃত্যুর পর ঘরের কোণে পড়ে ছিল।
ফেলিক্স মেন্ডেলসন সেসব খুঁজে বের করেন এবং বাখের মৃত্যুর পর প্রথমবারের মত বাখের স্মৃতিসৌধ সেন্ট ম্যাথু প্যাশনের সামনে সেসব পরিবেশন করেন। সেই সময় থেকে বাখকে আবার নতুন করে চিনতে শুরু করে মানুষ এবং সারা পৃথিবীব্যাপী মানুষ তাঁর প্রশংসা করতে এবং ভালোবাসতে শুরু করে।
মেন্ডেলসন বাখ এবং হ্যান্ডেলের পরম্পরা তাঁর নিজের ওরাটরিওতে রক্ষা করেছেন, বিশেষ করে এলিয়াহ এবং হাইম অফ প্রেইজে। কিন্তু মেন্ডেলসনের সিম্ফোনিগুলো তাঁর ওরাটরিওর থেকেও বেশী বিখ্যাত। বিশেষ করে তাঁর চতুর্থ সিম্ফোনি দ্য ইতালিয়ান। এটায় মেন্ডেলসন ইতালির গ্রামীণ অঞ্চলে ভ্রমণ করার সময় যে খোলা, উৎসবমুখর পরিবেশ দেখেছেন সেটি ফুটিয়ে তুলেছেন।
মেন্ডেলসনের এই অসাধারণ সৃষ্টিগুলো শোনা যেতে পারে:
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন