সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০

পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (পর্ব ১১: এডভার্ড গ্রিগ, ইয়ান সিবেলিয়াস, কার্ল নিলসেন)

এডভার্ড গ্রিগ

স্মেটানা আর ডিভোর্জাক যেমন ছিলেন বোহেমিয়ায় বিখ্যাত,তেমনি নরওয়েতে বিখ্যাত ছিলেন এডভার্ড গ্রিগ (১৮৪৩-১৯০৭)। আত্মপ্রত্যয়ী যেকোনো বড় সংগীতকারের মতো গ্রিগও জার্মানির লিপজিগে বড় বড় ওস্তাদদের কাছে শিখতে গিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, তিনি এতোই কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন যে ফুসফুসে রোগ বাঁধিয়ে বসেছিলেন এবং সেই রোগ তাঁকে পরবর্তী জীবনে অনেক ভুগিয়েছিল।

গ্রিগ

নরওয়ের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান

নরওয়েতে ফেরার পর গ্রিগ মাতৃভূমির স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে গেলেন। ১৮১৪ সাল থেকে নরওয়ে শাসন করছিলো সুইডেন আর তখন থেকেই নরওয়েজীয়রা স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল হয়ে ছিলো। রাজনীতি সচেতন শিল্পীরা বিশেষ করে নাট্যকার হেনরিক ইবসেন গ্রিগকে আন্দোলনে যোগ দিতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। তিনিও মনেপ্রাণে এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। তিনি মন থেকে জার্মান সংগীতের ছিটেফোঁটা দূর করে দিলেন এবং নরওয়েজীয় লোকসংগীতের সুর এবং তাল ব্যবহার করে সংগীত রচনা করতে শুরু করলেন।

নরওয়ের শ্রোতারা তাঁর এইসব সংগীতকে ভালোবেসে ফেললো। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ, মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে নরওয়েজীয় সরকার তাঁর জন্য আজীবন পেনশনের ব্যবস্থা করে। মৃত্যুর দুই বছর আগে, গ্রিগদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফল এলো, নরওয়ে সুইডেনের শাসন থেকে মুক্ত হলো। নরওয়ের বার্জেনে তাঁর শেষকৃত্যে প্রায় ৪০,০০০ মানুষ জড়ো হয়েছিল।

গ্রিগের বেশীরভাগ সংগীতই উজ্জ্বল এবং আনন্দের। তাঁর চমৎকার সুর ছিলো পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন। এডভার্ড গ্রিগের কিছু বিখ্যাত সুর হলো:

Piano Concerto in A minor, opus 16
Peer Gynt Suites no. 1 and no. 2 (incidental music to a play by Henrik Ibsen; they include many familiar melodies)
Holberg Suite for strings, opus 40


ইয়ান সিবেলিয়াস

ইয়ান সিবেলিয়াস বিখ্যাত হয়েছিলেন তার আংশিক কারণ হল তিনি সঠিক সময়ে সঠিক দিকটি বেছে নিয়েছিলেন। ঠিক যেমন সুইডেন নরওয়ে শাসন করতো, তেমনি ১৯ শতকের শেষ পর্যন্ত ফিনল্যান্ড শাসন করতো রাশিয়া।

সিবেলিয়াস

সিবেলিয়াস কথা

আর দশজন সংগীতকারের মতোই, মাকে খুশী করার জন্য ইয়ানও একটা ‘সম্মানজনক’ পেশা বেছে নিতে চেষ্টা করেছিলেন, এক্ষেত্রে সেটা হল আইন পেশা। কিন্তু, যা হবার তাই হলো। ইয়ান এক বছর পড়ার পর আইনের স্কুল বাদ দিয়ে সংগীত শিখতে হেলসিঙ্কি কনজার্ভেটরিতে চলে গেলেন। কালক্রমে, তিনি বার্লিন এবং ভিয়েনাতে সংগীত শেখার জন্য একটা বৃত্তিও পেয়ে গেলেন।

কিন্তু অস্ট্রিয়া থেকে ফেরার পর, তিনি দেখলেন তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি ফিনল্যান্ড রাশিয়ার শাসনে চলে গেছে। তিনি ইয়ং ফিনস নামের এক বিদ্রোহী দলে ভীড়ে গেলেন এবং এডভার্ড গ্রিগের মতো তিনিও তাঁর সংগীত থেকে যাবতীয় জার্মান প্রভাব ঝেড়ে ফেলে দিলেন। যদিও সিবেলিয়াসের সুর শুনতে ঠান্ডা আবহাওয়ার মতো শোনায়, মনে হয় যেন ক্লান্তিকর দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী; বর্ণহীন, তুষার ঢাকা, হিম বাতাসে ক্ষয়ে যাওয়া মাটি; ফিনিস লোকেদের আত্মার ভিতরের দুঃখগাঁথা।

এইসব অনুভূতি চমৎকারভাবে ধরা দিয়েছে তাঁর টোন পোয়েম ফিনল্যান্ডিয়ায়। সেটার সাদাসিধা শুরু থেকে শুরু করে গভীর বাণীসমৃদ্ধ থিম, তার বয়ে চলা এবং বিজয়ীর মত শেষ হওয়া - সবকিছুই ফিনিসদের আত্মা ছুঁয়ে গিয়েছিলো এবং তা ফিনিস স্বাধীনতা আন্দোলনের গানে পরিণত হয়েছিলো। বলাই বাহুল্য, রাশিয়ানরা এই সুর নিয়ে মাতামাতি করেনি, তারা এটাকে নিষিদ্ধ করেছিলো। জার্মানি এবং ফ্রান্সে এটা পরিবেশনের সময় ঝামেলা এড়ানোর জন্য একে শুধু ‘ফাদারল্যান্ড’ নাম দিয়ে পরিবেশন করা হয়েছিলো।

সিবেলিয়াসের সুরগুলো সাধারণত গভীর এবং ঘোলাটে। সিবেলিয়াস শুরু করতে হলে এই সুরগুলো শোনা যেতে পারে:
Finlandia, opus 26
Symphony no. 1 in E minor, opus 39
Symphony no. 2 in D major, opus 43
The Swan of Tuonela (from Legends), opus 22, no. 2


কার্ল নিলসেন

গ্রিগ এবং সিবেলিয়াস দুজনেই তাঁদের নিজেদের দেশ ছাড়িয়ে পুরো পৃথিবীতেই সুনাম কুড়িয়েছিলেন জীবদ্দশাতেই। কিন্তু ড্যানিশ জাতীয়তাবাদী সংগীতকার কার্ল নিলসেনের (১৮৬৫-১৯৩১) বেলায় তা হয়নি। আজকের দিনেও অনেক সংগীতপ্রেমীই নিলসেনের সংগীত সম্পর্কে বিশেষ জানেন না।

নিলসেন

দ্বীপ জীবন

নিলসেনের জন্ম ডেনমার্কের আইল অফ ফিন নামের এক দ্বীপে। এই দ্বীপের বৈরী আবহওয়া, সাদাসিধে জীবন সবই কার্লের সংগীতকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। সতেরো বছর বয়সে তিনি সংগীত রচনা শুরু করেন এবং আঠারো বছর বয়সে তিনি কোপেনহেগেন মিউজিক কনজার্ভেটরিতে যান।

কিন্তু, সেখানে তাঁর সনাতন ধাঁচের শিক্ষকদের পরামর্শে তিনিও জামার্নিতে যান। কার্ল নিলসেনও জার্মান-অস্ট্রিয়ান ধারার সংগীত শেখেন এবং যথারীতি বাড়ি ফেরেন এবং সেসব একেবারে নাকচ করে দেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘যে যতো বেশী করে দেখাতে পারবে সেই ততো বেশী স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বেটোভেন, মিকেলএঞ্জেলো, বাখ, বার্লিওজ, রেমব্রান্ট, শেকসপিয়র, গোথে, হেনরিক ইবসেন এবং এইরকম আরও অনেককেই প্রথমে মানুষ চিনতে পারেনি।’

নিলসেনও করে দেখিয়েছিলেন, বিশেষ করে তাঁর ছয়টি সিম্ফোনি। প্রত্যেকটি সুর সংগীতের একেকটা নতুন এলাকা চিনিয়ে দিয়েছিল। যেমন: পঞ্চম সিম্ফোনিতে নিলসেন স্নেয়ার ড্রামারকে বলেছিলেন ‘সুরটা নষ্ট করে দাও’। এই সুরের মত স্নেয়ার ড্রামকে এতো দারুণভাবে আগে কখনো ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।

নতুন ধরনের শব্দ তৈরি ছাড়াও তাঁর সুরে অনেকসময় বেসুরো শোনায় এমন ভুল স্বর এবং অপ্রচলিত হারমোনির ব্যবহার দেখা যায়। নিলসেন ক্রমে পৃথিবীর কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তবে, আজকের দিনে এসে তাঁর সংগীত পৃথিবীব্যাপী সবচেয়ে বেশী সমাদৃত হচ্ছে। 

নিসলেনের সহজ সুরগুলো দিয়ে শোনা শুরু করাই উচিত হবে। তারপর ধীরে ধীরে জটিল সুরের দিকে যাওয়া যাবে। 

Little Suite, opus 1

Maskarade Overture

Symphony no. 3, opus 27 (Sinfonia Espansiva)

Symphony no. 4, opus 29 (The Inextinguishable)

Concerto for Flute and Orchestra

Concerto for Clarinet and Orchestra, opus 33


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন