মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০

পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (পর্ব ১৩: বিংশ শতাব্দীর সংগীত, ক্লড ডেবুসি, মরিস রাভেল)

বিংশ শতাব্দীর সংগীত

বিগত শতাব্দীর সংগীতকার যাঁরা পূর্বতন নিয়মকানুন ভাঙতে চেয়েছিলেন তাঁদের অন্তত এটুকু চিন্তা ছিল যে, আর যাই হোক, সংগীত ‘শুনতে ভালো হওয়া চাই’ কিংবা ‘তাতে সুর এবং তাল থাকা চাই’। কিন্তু, বিংশ শতাব্দীর সংগীতকারেরা এই নিয়মটুকুও ভেঙে দিয়েছিলেন। বিংশ শতাব্দীর সংগীত শুনতে তাই অদ্ভুত, অনেক বেশী বেসুরো। এই শতাব্দীর সংগীতকারদের দুর্দান্ত সব ধারণা মাথায় কিলবিল করেছে। এর ফলে একেবারেই আনকোরা, আগ্রহ জাগানিয়া, অপ্রচলিত অনেক সংগীত সৃষ্টি হয়েছে এই শতাব্দীতে। তবে, সংগীত আধুনিক হলেই যে তাকে বেসুরো হতে হবে এমন কোনো কথা কিন্তু নেই। এই শতাব্দীর অনেক সংগীতকারের সুরই কিন্তু সুরেলা এবং সেগুলোর সঙ্গে পূর্বতন সংগীতকারদের যোগসূত্র অনুভব করা যায়। 


ক্লড ডেবুসি

বিংশ শতাব্দীর যদি একজন সংগীতকারের নাম নিতে হয় তাহলে তিনি ক্লড ডেবুসি (১৮৬২-১৯১৮)। তবে তিনি সময়ের থেকে এগিয়ে ছিলেন। তিনি বিংশ শতাব্দীর সুর তৈরি করতে শুরু করেছিলেন ১৮৯৪ সাল থেকেই।

ক্লড ডেবুসি

ডেবুসি ছিলেন ইম্প্রেশানিস্ট নামের একদল সংগীতকারদের একজন অনুসারী। বিভিন্ন দৃশ্য, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ আমাদের মনের মধ্যে যে ছাপ ফেলে, ইম্প্রেশানিস্টরা সেই ছাপটাকেই শিল্পের মধ্যে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। ক্লড মনেঁ এবং পিয়েরে-অগাস্টিন রেনোঁ’র মত চিত্রশিল্পীরা যেমন চিত্রকলায় এইসব প্রতীতি ধরার চেষ্টা করেছিলেন, তেমনি ক্লড ডেবুসি চেষ্টা করেছিলেন সংগীতের বেলায়।

এইরকম প্রতীতিকে ধরার জন্য ডেবুসির প্রয়োজন ছিলো সংগীতের এক নতুন ভাষার। এতোদিনের প্রতিষ্ঠিত হারমোনি আর কর্ডগুলো দিয়ে তা সম্ভব ছিলো না। তাঁর দরকার ছিলো আলাদা কর্ড, আলাদা কর্ড প্রোগ্রেশন যা আলাদা ধরনের মাত্রা তৈরি করে।

এইরকম ধারণা নিয়ে ডেবুসি প্যারিস কনজার্ভেটরিতে টিকতে পারলেন না, কারণ সেখানে অপ্রচলিত হারমোনি নিয়ে কাজ করার কোনো উপায় ছিলো না। মজার কথা হলো, কয়েক বছর পর এক ছাত্র ডেবুসির স্বরলিপি নিজের কাছে রাখার অপরাধে বহিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো।

বোঝাই যাচ্ছে, প্যারিসের শ্রোতাদের এই নতুন শব্দ হজম করতে বেশ সময় লেগে গিয়েছিলো। আজকের শ্রোতারা ডেবুসির সুরকে আকর্ষণীয় বলে মনে করে, কিন্তু তখনকার শ্রোতাদের কাছে এসব চেঁচামেচি মনে হত।

ডেবুসির সবচেয়ে আগ্রহোদ্দীপক আবিষ্কার হলো হোল-টোন স্কেল। সাধারণত, সাধারণ স্কেলে পরপর একটা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে স্বরগুলো বাজাতে হয়। কিন্তু হোল-টোন স্কেলে সবগুলো স্বর পূর্ণ দূরত্ব রেখে বাজাতে হয়। এর ফল হলো জাদুকরী, স্বপ্নীল, অনেকটা হার্পের মত শব্দ। 

ডেবুসির প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সুরটি হলো স্টেফানি মালর্মের কবিতার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা প্রিলুড টু দ্য আফটারনুন অফ আ ফন। কবিতায় দেখা যায় এক মেষ শাবক দুপুরবেলা একা একা বেরিয়ে পড়ে। কবিতার সঙ্গে সুরের মেজাজ একদম মিশে গিয়েছিলো। শুনতে গেলে এক স্বপ্নীল, গভীর ইন্দ্রীয়গত অস্পষ্ট অনুভূতি তৈরি হয়।

ডেবুসির আরেকটি বিখ্যাত সংগীত হলো লা মার (দ্য সি)। এই সুরে, পানির উঠানামার অনুভূতি হয়, একটা ঢেউয়ের সাথে আরেকটা ঢেউ যেন খেলা করছে এবং সমুদ্রের উপর দিয়ে বাতাস যেন উন্মত্তবেগে বয়ে যাচ্ছে। 

ডেবুসি শুনতে হলে অবশ্যই প্রিলুড টু দ্য আফটারনুন অফ আ ফন এবং লা মার শুনতেই হবে। এরপর শুনতে হবে দৃশ্যময়, গভীর বিরাগময় সুর নাকচার্নস এবং ইমেজেস। আর তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত পিয়ানোর সংগীত ক্লেয়ার ডি লুন তো আছেই। 


মরিস রাভেল

মরিস রাভেলের (১৮৭৫-১৯৩৭) চোখে ক্লড ডেবুসি ছিলেন নায়ক। আরেক ফরাসি শিল্পী রাভেলও ছিলেন প্যারিস কনর্জাভেটরি থেকে শেখা একজন ইম্প্রেশানিস্ট সংগীতকার। তবে তাঁর সুর ডেবুসির মত ধোঁয়াশাপূর্ণ ছিলো না। রাভেলের সংগীত আমেরিকার জ্যাজ সংগীত দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিলো। জ্যাজের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ১৯২৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের সময়।

মরিস রাভেল

একটা নির্দিষ্ট সংগীত ছাড়া রাভেলের অন্যান্য সংগীতের সঙ্গে অনেকেই কম পরিচিত। তাঁর বিখ্যাত সুর হল বোলেরো। এই সুরটি স্প্যানিশ তালের উপর তৈরি হয়েছিল। এতে একটা খুব সাধারণ সুর বারবার ঘুরে ঘুরে চলতে থাকে এবং আস্তে আস্তে চড়তে থাকে এবং কিছুক্ষণ পরপর কিছু কিছু বাদ্যযন্ত্র যুক্ত হতে থাকে। প্রায় ১৫ মিনিট ধরে এটা চলতে থাকে। তারপর ক্লাইম্যাক্সে এসে সমস্তকিছু যেন ধুয়ে নিয়ে চলে যায়। এই বার বার একই জিনিস চলতে থাকা সুরটিকে একেবারেই পাগলামী মনে হবে নাকি দুর্দান্ত উত্তেজনাপূর্ণ বলে মনে হবে সেটা নির্ভর করবে আপনার দৃষ্টিভঙ্গীর উপর। এটা এতোই বেশী যৌনতার অনুভূতিপূর্ণ যে, হলিউডের সিনেমায় যৌনদৃশ্য দেখানোর সময় এই সুরটা বহুবার ব্যবহার করতে দেখা গেছে। 

রাভেলের আরেকটা সেরা সংগীত হল ল ভালস (দ্য ওয়াল্টজ) এবং এটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার কিছুদিনের মাঝে লেখা হয়েছিলো। শুরুতেই একটা ধোঁয়াশার মধ্য দিয়ে অর্কেস্ট্রা একটা খুব সাধারণ নাচের সুর বাজিয়ে চলে। এই সুরটা যুদ্ধের আগের শান্তশিষ্ট সমাজের কথা বুঝায়। কিন্তু সুরটা যতোই এগিয়ে চলে ততোই উদ্ভট এবং বেসুরো হতে থাকে। এটা ইউরোপের সমাজের ভাঙনকে বুঝায়। এবারও রাভেল একটা বিরাট ঝাপটা দিয়ে সুরটা শেষ করেন, পুরো অর্কেস্ট্রা একসাথে ভয়ংকরভাবে বেজে ওঠে সবার শেষে।

তবে ড্যাফনিজ এবং ক্লোয়ে ব্যালেটির কথা না বললেই নয়। তিনি এটি ব্যালে রুশে দলের জন্য লিখেছিলেন (সামনের অধ্যায়ে এটা নিয়ে আলাপ করা হয়েছে)। এই সুরটা পরীদের নিয়ে। এই সুরটা অবশ্যই শুনতে হবে। এছাড়া -

Boléro
La Valse
Rhapsodie espagnole

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন