সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০

পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (পর্ব ৩: জোহান সেবাস্টিয়ান বাখ, ক্লাসিকাল যুগ, জোসেফ হেইডেন)

জোহান সেবাস্টিয়ান বাখ

বাখ

বেশীরভাগ সংগীতকারই জোহান সেবাস্টিয়ান বাখকে (১৬৮৫-১৭৫০) পৃথিবীর অন্যতম সেরা সংগীতকারদের একজন বলে মানেন। আর, কেউ কেউ মনে করেন তিনিই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সংগীতকার। কারণটা শুধুই এটাই নয় যে তাঁর সবগুলো সংগীতই অনন্য, বরং, তাঁর পরবর্তী সকল সংগীতকারই তাঁর কাছে কোনো না কোনোভাবে ঋণী।

বাখ কোর্ট মিউজিশিয়ান হিসেবে প্রথম কাজটি পান জার্মানির ওয়েমার শহরে। সেখানে থাকাকালীন তিনি দুর্দান্ত কিছু অর্গান পিস তৈরি করেন যেগুলো আজও সমাদৃত।

এই সুরগুলো এখনও এতোটা সমাদৃত হওয়ার পেছনে দুটো কারণ আছে: প্রথমত, সেই যুগে কোনো সংগীতই দীর্ঘদিন টিকে থাকার কথা মাথায় রেখে রচনা করা হতো না। সংগীতকারেরা কোনো নির্দিষ্ট উপলক্ষ্যকে সামনে রেখেই সংগীত তৈরি করতেন এবং সেটা যে আবার কখনো বাজানো হতে পারে সেই কথা মাথাতেও তাঁদের থাকত না। বাখের কিছু অসাধারণ সোনাটার স্বরলিপি ঠিক মাছ বাজারে মাছের প্যাকেট হিসেবে ব্যবহার হয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে উদ্ধার করা গিয়েছিল।

আর দ্বিতীয়ত, মানুষের নতুনকে গ্রহণ করার ব্যাপারে যে অনীহা আজও দেখা যায়, সেই অনীহার কারণে তখন বেশীরভাগ সংগীতকার এবং শিল্পীরা তাঁদের জীবদ্দশাতে অচেনাই থেকে যেতেন। তবে, বাখ সেদিক থেকে ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি ছিলেন সুপিরিচিত, বলা যায় সম্মানের পাত্র। তবে, তিনি পরিচিত ছিলেন অর্গান বাদক হিসেবে, কোনো সংগীতকার হিসেবে নয়।


অর্গানমেইস্টার বাখ

বাখ ছিলেন পৃথিবীর অন্যতম দক্ষ অর্গান বাদক। শুধুমাত্র তাঁর আঙ্গুলগুলোই দ্রুত চলতো না, তাঁর পা দুটোও চলতো সমান তালে। কয়েক মাইল দূর থেকেও মানুষ বাখকে দেখতে আসতো, তারা জানতো লোকটির অসম্ভব দ্রুত পায়ের ব্যাপারেও।

বাখ একজন দক্ষ ইম্প্রোভাইজারও ছিলেন। তিনি প্রায় যেকোনো সুরের উপরেই নতুন করে সুর আরোপ করতে পারতেন তৎক্ষণাৎ, ঠিক যেমনটা আজকের দিনের প্রাচ্য সংগীতে কিংবা জ্যাজ সংগীতে হয়ে থাকে। তবে দুঃখের কথা হলো, সেসব ইম্প্রোভাইজেশন কেউ লিখে রাখেনি। কাজেই আমরা জানতেও পারবো না বাখের ইম্প্রোভাইজেশন শুনতে কেমন ছিলো।


বাখের আরও গুণ

বাখ সংগীতকার হিসেবেও ছিলেন বিশাল। কারও পক্ষে বাখের সমস্ত সংগীত লিখতে গেলে কয়েক যুগ লেগে যাবে।

কিন্তু, বাখের আরও গুণ ছিলো। দুই স্ত্রীর গর্ভে বাখের ছিলো বিশ সন্তান। তাঁর বেশকিছু সন্তানও সংগীতকার হয়েছিলেন। উইলহেম ফ্রাইডম্যান বাখ, কার্ল ফিলিপ ইমানুয়েল বাখ এবং জোহান ক্রিস্টিয়ান বাখ এঁদের মধ্যে অন্যতম। এরা সবাই বাবাকে তাঁর সুরের প্রতিলিপি তৈরি করতে সাহায্য করতেন।

আটত্রিশ বছর বয়সে বাখ সর্বশেষ চাকরিটি পান। জার্মানির লিপজিগ শহরের সেন্ট থমাস চার্চের ক্যান্টরের পদ। এই কাজেও বাখের অবদান বিশাল। তিনি প্রতিটা রবিবারের প্রার্থনার জন্য একটা করে নতুন এবং বড় ক্যানটাটা বা বৃন্দ গান তৈরি করতেন। এভাবে তিনি টানা তিন বছর করেছেন। সর্বমোট ২১৫টা ক্যানটাটা তিনি লিখেছিলেন।

বাখের সংগীত ছিলো কাউন্টারপয়েন্টে ভরা। কাউন্টারপয়েন্ট হলো দুই, তিন, চার বা তারও বেশী সুর একসাথে বাজানোর কৌশল। এভাবে বাজালে মজার হারমোনি তৈরি হয়। তিনি ফ্যুগ ধারাটিকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ফ্যুগ অত্যন্ত জটিল একটা ধারা যেখানে একইসাথে সর্বোচ্চ চারটা সুর বাজতে থাকে। বিশেষত কণ্ঠ সংগীতের জন্যই এটি বানানো হয়ে থাকে। ফ্যুগে প্রতিটা সুরই একই রকমের কিন্তু কোনোটাই একসাথে শুরু হয় না। একটা শুরু হবার কিছু সময় পরে আরেকটা সুর শুরু হয়। বাখের ফ্যুগে সুরের অত্যন্ত জটিল কারুকাজ থাকতো। সেগুলো একেক সময় শুরু হলেও সব মিলিয়ে শুনতে খুবই সুন্দর শোনাতো। বাখের মাথার ভিতরটাও ছিলো এইরকমই, তাঁর মাথাটা এতোই পরিষ্কার ছিল যে তিনি যেকোনো সুরকে মুহূর্তেই ফ্যুগে রূপান্তর করতে পারতেন।

বাখের কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ হল:

Brandenburg Concertos, no. 1‐6, BWV 1046‐1051
Magnificat, a sacred oratorio for solo singers, chorus, and orchestra, BWV 243
The Passion According to St. Matthew, a sacred oratorio for soloists, chorus, and orchestra, BWV 244
Concerto for Violin, Oboe, and Orchestra in C minor, BWV 1060
Orchestral Suite no. 3 in D major, BWV 1068
Concerto for Harpsichord (or piano) in D minor, BWV 1052

ক্লাসিকাল যুগ

জোহান সেবাস্টিয়ান বাখের সংগীত হলো বারোক ঘরানার সর্বোৎকৃষ্ট সংগীত, এবং তাঁর সাথে সাথেই বারোক যুগেরও পরিসমাপ্তি হয়। এরপরের যুগের নাম হল ক্লাসিকাল যুগ।

ক্লাসিকাল বা ধ্রুপদ সংগীত বলতে আমরা সাধারণত এই আলোচনার সমস্ত সংগীতকেই বলছি। কিন্তু, ক্লাসিকাল যুগ একটি সুনির্দিষ্ট সময়কালকে বুঝায় (১৭০০-এর মাঝামাঝি থেকে ১৮০০ এর শুরুর সময় পর্যন্ত)। আর এই সময়কালের সংগীতকে বলা হয়ে ক্লাসিকাল ঘরানার সংগীত। 

ক্লাসিকাল ঘরানা একদিক থেকে দেখলে বলা যায় যেন বারোক ঘরানার প্রতিক্রিয়া। বারোক ঘরানা যেমন নকশাদার, বেপরোয়া এবং আবেগপ্রবণ ছিলো, ঠিক তার উল্টোটা হল ক্লাসিকাল ঘরানা। এই সময়ের সংগীত যেন কিছুটা সাধারণ, গম্ভীর এবং সংযত।

ক্লাসিকাল যুগে তিনটি ধারার সংগীত জনপ্রিয় হয়: সোনাটা, সিম্ফোনি এবং স্ট্রিং কোয়ার্টেট। ক্লাসিকাল যুগের তিনজন সেরা সংগীতকার হলেন হাইডেন, মোৎসার্ট এবং বেটোভেন। এই তিন মেধাবীর প্রত্যেকেই প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। তাঁরা সকলেই অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় কাটিয়েছেন। ভিয়েনাকে তখন পাশ্চাত্য সংগীতের রাজধানী বলা হতো।


জোসেফ হাইডেন

জোসেফ হাইডেন (১৭৩২-১৮০৯) ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক, আমুদে এবং রসিক লোক। তিনি অবিরাম মানুষের সাথে ঠাট্টা করে যেতেন, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রসিকতা করতেন; এমনকি নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা করতেও তাঁর বাঁধত না। তাঁর গানেও এর পরিচয় পাওয়া যায়।

হেইডেন

হাইডেনের জন্ম অস্ট্রিয়ার সীমান্তবর্তী এক গ্রামে। সেখানে ক্রোয়েশিয়া, স্লোভাকিয়া এবং হাঙ্গেরির সীমান্ত ছিলো। বাল্যকালে তিনি অসংখ্য লোকগান শুনেছিলেন এবং একসময় তিনি বুঝতে পারেন যে গানই তাঁর একমাত্র ভালোলাগার জিনিস। তাঁর ছিল অসাধারণ গানের গলা আর আট বছর বয়সেই তিনি ভিয়েনাতে সেন্ট স্টিফেন’স ক্যাথেড্রালের কয়ার দলে যোগ দেবার জন্য মনোনীত হন।

ভিয়েনায় হাইডেনের সাথে তৎকালীন সেরা সব সংগীতের সঙ্গে পরিচয় হয় এবং সেগুলো শুনেই তিনি সংগীতকার হওয়ার জন্য মনস্থির করেন। সোপরানো গায়ক হওয়ার জন্য তিনি প্রায় খোজা হয়ে যাবার উপক্রম থেকে ফিরে এসেছিলেন।

ভিয়েনার সেন্ট স্টিফেন’স ক্যাথেড্রালে হাইডেন ছিলেন বিস্ময়বালক। বয়স বাড়তে থাকলে, তাঁর শিক্ষক তাঁকে বলেন যে, তিনি যদি একটা ‘সামান্য অপারেশন করেন’ তাহলে নাকি তাঁর কণ্ঠ আরও চড়া এবং সুন্দর হবে। এই কথা শুনে বাচ্চা হাইডেন সেই অলৌকিক গলা পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। অপারেশন হবার মাত্র ঘন্টাখানেক আগে তাঁর বাবা তাঁকে উদ্ধার করেন এবং অপারেশন আটকে দেন। 

অন্যান্য সংগীতকারদের মতো হাইডেনেরও জীবিকা প্রাথমিকভাবে চলতো রাজার দরবারে শিল্পী হিসেবে কাজ করে। তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবন ছিল প্রিন্স এস্টারহাজির প্রাসাদে।


এস্টারহাজির প্রাসাদে

হাইডেনের পদের নাম ছিল সার্ভেন্ট কিন্তু তাঁকে রাজার মত খাতির করা হতো। তাঁর নিজের চাকরানী এবং ফুটম্যান ছিল, সেইসঙ্গে ছিল মোটা বেতন। তিনি দিন কাটাতেন নতুন সুর লিখে আর রাজকুমারকে সেগুলো বাজিয়ে শুনিয়ে। রাজকুমার নিজেও ছিলেন একজন শখের শিল্পী।

এই চাকরিটাই হাইডেনকে বিভিন্ন ধারার গান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলো। এস্টারহাজির প্রাসাদে ত্রিশ বছর কাজ করার সময় হাইডেন বলতে গেলে একা হাতে সিম্ফোনি এবং স্ট্রিং কোয়ার্টেটের কাঠামোর প্রমিতকরণ করেন এবং এই কারণেই বেটোভেন এবং অন্যান্যরা তাঁকে ‘বাবা’ বলে ডাকতেন। আজকের দিনেও অনেক সংগীত বিষয়ক লেখক তাঁকে ‘বাবা হাইডেন’ নামে অভিহিত করে থাকেন।


হাইডেনের সংগীত

দ্য সারপ্রাইজ সিম্ফোনি (নম্বর ৯৪) একটা অবশ্য শ্রবণীয় সুর। এটা হাইডেনের অন্যতম সেরা সুর এবং এটা হাইডেনের ধাঁচের সবচেয়ে সুন্দর উদাহরণ। এর পেছনে একটা গল্পও আছে। লন্ডনে কাজ করার সময় হাইডেন দেখলেন যে রাতের খাবারের পর হালকা চালের সুর বাজানোয় তাঁর শ্রোতারা সবাই ঘুমে ঢলে পড়ছে। এর শোধ নিতে তিনি একটা মুভমেন্ট রচনা করলেন যেটা শুরুতে খুবই হালকা চালে চললেও আস্তে আস্তে চড়তে থাকে। সেই অংশটুকু আসতেই সম্পূর্ণ অর্কেস্ট্রা যখন হঠাৎ করে উচ্চস্বরে বেজে উঠতো তখন তাঁর ঢুলুঢুল শ্রোতারাও ধড়মড় করে উঠে বসতেন। 

হাইডেনের বয়স বাড়তে শুরু করলে, তিনি বাল্যকালে শোনা লোকগানগুলো থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর সংগীতে সেসব প্রয়োগ করতে শুরু করেছিলেন। এর একটা মোক্ষম উদাহরণ হল তাঁর শেষ সিম্ফোনির শেষ মুভমেন্টটি (লন্ডন সিম্ফোনি নম্বর ১০৪)।

জোসেফ হাইডেনের আরও কিছু অসাধারণ অর্কেস্ট্রাল সংগীত হল:

Trumpet Concerto in E‐flat major, Hob. VIIe:1
Violin Concerto in G major, Hob. VIIa:4
Cello Concerto in C major, Hob. VIIb:5
Lord Nelson Mass, for soloists, chorus, and orchestra, Hob. XXII:11
Symphony no. 48 in C major (Maria Theresia)
Symphony no. 94 in G major (Surprise)
Symphony no. 104 in D major (London)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন