ইগর স্ট্রাভিনস্কি
অনেকের কাছেই, রুশ সংগীতকার ইগর স্ট্রাভিনস্কি (১৮৮২-১৯৭১) হলেন বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগীতকার। স্ট্রাভিনস্কির পরে তাঁকে বাদ দিয়ে সুর করা আর কোনো সংগীতকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি। হয় তাঁদেরকে স্ট্রাভিনস্কির ধারণাগুলোকে গ্রহণ করতে হয়েছে অথবা বাদ দিতে হয়েছে।
স্ট্যাভিনস্কির তরুণ বয়স সাধারণ ক্লাসিকাল সংগীতকারদের জীবনের যে গল্প তার ব্যতিক্রম হয়নি: এক সচ্ছল পরিবারে জন্ম, আইন পড়তে যাওয়া, পড়া ছেড়ে সংগীত শিক্ষার জন্য বেরিয়ে পড়া। স্ট্রাভিনস্কি ছিলেন রিমস্কি-কোরসাকোভের ছাত্র।
ফায়ারবার্ড দিয়ে শুরু
স্ট্রাভিনস্কির শুরুটা হয় ব্যালে সংগীত দিয়ে। সের্গেই ডিয়াগিলেভ নামের এক বিখ্যাত রাশিয়ান প্রযোজক প্যারিসে ব্যালে রুশে নামে একটা দল তৈরি করেছিলেন। তিনি ফায়ারবার্ডের কাহিনী নিয়ে এই দলটির জন্য একটি ব্যালে তৈরি করার জন্য সংগীতকার খুঁজছিলেন। তিনি প্রথমে আনাতোল লিয়াদভ নামের একজনকে ঠিক করেছিলেন সেটা লেখার জন্য। কিন্তু রিহার্সাল শুরু হবার আগে যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো কাজ কেমন চলছে তিনি বললেন, ‘চমৎকার! আজই লেখার জন্য কাগজ কিনেছি।’ ডিয়াগিলেভ যা বোঝার বুঝে গিয়ে স্ট্রাভিনস্কিকে কাজটা দিয়ে দিলেন।
ফায়ারবার্ডে স্ট্রাভিনস্কির সংগীত ইতিহাসের এক মাইলফলক। প্যারিসে এর প্রথম পরিবেশনায় কেউ এইরকম জটিল তাল আর অদ্ভুত, ভয়াবহ বেসুরো সুর আগে কখনো শোনেনি। তবুও, শ্রোতারা সুরটার ভিতরকার উত্তেজনা আর স্ট্রাভিনস্কির নতুন সুর দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। ব্যালেটা সফল হয়েছিলো। স্ট্রাভিনস্কি ডিয়েগিলেভের প্রিয় সংগীতকার হয়ে গিয়েছিলেন এবং প্যারিসে তাঁর জীবিকাও পাকাপোক্ত হয়ে গিয়েছিল।
পেট্রুসকা কর্ড
এবারের আলোচনার বিষয় পেট্রুসকা। এটা যৌন অবদমিত পুতুলের ভগ্নাবশেষের গল্প নিয়ে ব্যালে। এই ব্যালেটা আগের চেয়েও বেশী বেসুরো। যেমন: স্ট্রাভিনস্কি ইচ্ছা করেই এমন দুটি হারমোনি লিখেছিলেন যারা পরস্পরের সঙ্গে সাংঘাতিকভাবে সংঘর্ষ তৈরি করে। এতে যে কর্ড ব্যবহার করা হয়েছিল সেটাকেই বলে পেট্রুসকা কর্ড:
এই সংঘর্ষটার পেছনে অবশ্য ব্যাখ্যা আছে। এটা পুতুলটার ভিতরের অন্তর্দ্বন্দ্বকে বুঝায়। শ্রোতারা এই বিষয়টা বুঝতে পেরেছিলে এবং এই নাচের সুরটাও সফল হয়েছিলো।
সংগীতের ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত প্রিমিয়ার
এরপর ১৯১৩ সালে ইগর স্ট্রাভিনস্কি এক বোমা তৈরি করলেন: দ্য রাইট অফ স্প্রিং। এই ব্যালেটির উপশিরোনাম হল ‘সিনস অফ পাগান রাশিয়া’। স্ট্রাভিনস্কি লিখেছিলেন, ‘আমার কল্পনায় এক পবিত্র পাগান রীতি ছিল। গোষ্ঠিপতিরা গোল হয়ে বসে আছেন এবং একটা বাচ্চা মেয়েকে নাচতে নাচতে মরে যেতে দেখছেন। তারা মেয়েটিকে আসলে বসন্ত দেবতার উদ্দেশে বলি দিচ্ছেন।’
এই দৃশ্যটিকে তিনি এক কর্কশ, ছোট্ট কিন্তু বারবার ঘুরে আসে এইরকম একটা বেসুরো সুরে বেঁধেছিলেন। বাদ্যযন্ত্রগুলো তারস্বরে চিৎকার করে ওঠে এবং পেছনে ভয়ংকর, বুক ধকধক করা নিষ্ঠুর একটা তাল বাজতে থাকে। এককথায় অপূর্ব। প্রথম পরিবেশনার রাতে শ্রোতারা হাতের কাছে যা ছিলো তাই ছুঁড়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলো।
তবে সবাই এটাকে অপছন্দ করেনি; এঁদের মধ্যে ছিলেন ক্লড ডেবুসিসহ প্যারিসের অনেক বিখ্যাত সংগীতকারগণ। এঁরা করতালি দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, এই করতালি ভক্তদের আরও উস্কে দিয়েছিলো, আরও সরব করে তুলেছিলো। এক পর্যায়ে হাতাহাতি শুরু হয়ে গিয়েছিলো, সবাই হুড়োহুড়ি করে বেরিয়ে গিয়েছিলো, এমনকি এক লোক আরেকজনকে ডুয়েল লড়ারও আহবান জানিয়েছিল। স্ট্রাভিনস্কি নিজে জানালা দিয়ে একটা ড্রেসিংরুমে পালিয়েছিলেন এবং পরে নিজেও মারামারি করছেন এমন ভঙ্গী করেছিলেন।
এর ঠিক এক বছর পরেই ব্যালেটি আবার পরিবেশন করা হয় এবং সেবার শ্রোতারা উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানায়।
আরও সংগীত
স্ট্রাভিনস্কি যখন এইসব দুনিয়া কাঁপানো ব্যালেগুলো তৈরি করছিলেন তখনো তিনি নিতান্তই তরুণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছুকাল পরেই রুশ বিপ্লব শুরু হয় এবং স্ট্রাভিনস্কি রাশিয়া থেকে পালান। প্রথমে সুইজারল্যান্ডে যান এবং সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেন। তিনি হলিউডেও একটা বাড়ি কিনেছিলেন।
পরবর্তী সময়ে, স্ট্রাভিনস্কি আরও বেশী নিরীক্ষামূলক কাজকর্ম শুরু করেন। তিনি বেশকিছু ধারা তৈরি করেন যার মধ্যে নিওক্লাসিকাল ধারা উল্লেখযোগ্য। সহজ কথায় নিওক্লাসিকাল হলো সনাতন ক্লাসিকাল সংগীত এবং আরও বেশকিছু ‘ভুল স্বরের’ ব্যবহারের মধ্যে একটা ভারসাম্য তৈরি করার চেষ্টা। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি সংগীত রচনা করেছিলেন বটে, কিন্তু রাইট অফ স্প্রিং এর মত আর কোনো ঐতিহাসিক রচনা তিনি আর করতে পারেননি। তিনি ১৯৭১ সালে নিউ ইয়র্কে মারা যান।
● Petrushka
● The Rite of Spring (also known as Le sacre du printemps)
● Pulcinella Suite
● Symphony of Pslams
সের্গেই প্রাকোফিয়েভ
নিওক্লাসিকাল ধারার রুশ সংগীতকারদের কথা বলতে গেলে যার কথা বলতেই হয় তিনি হলেন সের্গেই প্রাকোফিয়েভ (১৮৯১-১৯৫৩)। তাঁর সংগীতের ব্যাপারে সাধারণ শ্রোতারা তেমন কিছু জানেন না। তবে তাঁর বাচ্চাদের গল্প পিটার এন্ড দ্য উল্ফ সবার কাছে পরিচিত। তাঁর রোমিও এন্ড জুলিয়েটের ব্যালে সংস্করণ একটা মাস্টারপিস। এছাড়া রয়েছে বেশকিছু সিম্ফোনি, বিশেষ করে পঞ্চম সিম্ফোনি।
প্রাকোফিয়েভই হলেন একমাত্র সংগীতকার যিনি আইন স্কুল ছেড়ে পালাননি, কারণ তিনি কখনো আইনের স্কুলেই যাননি। তবে তিনি রুশ সংগীতের বেদনাকে ধ্রুপদী সংগীতে মধ্যে অপূর্বভাবে মিশিয়েছিলেন। কারণ চিরায়ত হারমোনির বিপরীতে ওইসব ‘ভুল স্বরের’ যে ব্যবহার শুরু হয়েছিলো সেই তুলনায় তাঁর সুর ছিল সোজাসাপ্টা এবং কখনো কখনো ব্যাঙ্গাত্মক।
প্রাকোফিয়েভের কাজ তাহলে শুনেই ফেলা যাক:
● Suites from Romeo and Juliet
● Symphony no. 1, opus 25 (also known as the Classical Symphony)
● Symphony no. 5, opus 100
● Alexander Nevsky Cantata (প্রাকোফিয়েভ এই সুরটি সের্গেই আইজেনস্টাইনের ছবি আলেক্সাজান্ডার নেভস্কি এর জন্য লিখেছিলেন)
● Piano Sonatas no.3 and 7
দিমিত্রি সস্তাকোভিচ
১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠিত হয়। দিমিত্রি সস্তাকোভিচ (১৯০৬-১৯৭৫) হলেন সোভিয়েত দেশের অন্যতম সেরা সংগীতকার। স্ট্রাভিনস্কির মত তিনি দেশত্যাগ করেননি, বরং তিনি পুরোটা সময় সোভিয়েত ইউনিয়নেই কাটিয়েছিলেন। সংগীতের আরেক বিস্ময় বালক সস্তাকোভিচ তাঁর প্রথম সিম্ফোনি ‘ফার্স্ট সিম্ফোনি’ লিখেছিলেন আঠারো বছর বয়সে। এটাকে এখনো তাঁর অন্যতম সেরা কাজগুলোর একটি বিবেচনা করা হয়। সিম্ফোনিটা শুনতে প্রাণবন্ত শোনালেও এতে হঠাৎ হঠাৎ বেসুরো সুরও ব্যবহার করা হয়েছে।
দিমিত্রির বিপদ
১৯৩০-এর দশকে ‘প্রাণবন্ত’ এবং ‘বেপরোয়া’ সংগীত সোভিয়েত কর্তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। সরকার বরং তার নিজের মহিমা বর্ণনা করে এইরকম সংগীতের দিকেই বেশী আগ্রহী ছিল।
১৯৩৫ সালে, সস্তাকোভিচ সোভিয়েত ইউনিয়নের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংগীতকার ছিলেন। তাঁর আধুনিক ধাঁচের অপেরা লেডি ম্যাকবেথ অফ এমটসেনস্ক তখন দেশে বিদেশে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে।
এরপরই, একদিন, সোভিয়েত সংবাদপত্র প্রাভদার সম্পাদকীয়তে তাঁর সংগীতের একটা সমালোচনা বেরোলো। সেখানে বলা হলো ‘সংগীতের বদলে বিশৃঙ্খলাই বেশী’, ‘সংগীতের উদ্দেশ্য হল মানুষকে জাগ্রত করা…...এই সুরগুলো বিপদজনক।’
লেডি ম্যাকবেথ অফ এমটসেনস্ক অপেরাটি তড়িঘড়ি করে বন্ধ করা হলো। অপরাপর সংগীতকারেরা তাঁকে একঘরে করে ফেললো, তাঁকে ‘গণশত্রু’ আখ্যা দেওয়া হলো। সস্তাকোভিচ একেবারে ভেঙে পড়লেন।
তবে সস্তাকোভিচ ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। তিনি ঠিক করলেন সোভিয়েতদের কাছে আবার নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন এবং তিনি সেটা করেছিলেন দারুণভাবে। দিমিত্রি ‘একজন সোভিয়েত শিল্পীর যথাযথ সমালোচনার উত্তর’ উপশিরোনামে তাঁর সিম্ফোনি নং ৫ লিখেছিলেন।
সমালোচকদের মুখের কথা বন্ধ হয়ে গেল। এইরকম সুরই তো সোভিয়েতরা এতোদিন খুঁজছিলো। স্টালিনের শাসনামলে সস্তাকোভিচ আবারো হারানো গৌরব ফিরে পেলেন। তিনি আবার তারকায় পরিণত হলেন এবং তাঁর সংগীতও সবখানে বাজতে শুরু করলো।
দিমিত্রির প্রতিশোধ
তবে শেষ হাসিটা সস্তাকোভিচই হেসেছিলেন। ওই উপশিরোনাম থাকা সত্ত্বেও সুরটা আসলে দেশের মধ্যে চলমান উদ্ভট কান্ডকারখানাকে উদ্দেশ্য করেই বানানো হয়েছিল। সুরটা খুব মন দিয়ে শুনলে, সাংগীতিক রূপকগুলো থেকে বোঝা যায় আমলাতন্ত্র কেমন করে সাধারণ মানুষের ইচ্ছাকে দমন করছিল তার একটা প্রকাশ রয়েছে। বেশ কয়েক বছর পর, তিনি স্বীকার করেছিলেন যে আসলে স্টালিনের সমালোচনা করেই সুরটা করেছিলেন।
বোঝাই যাচ্ছে, সস্তাকোভিচকে পরবর্তীতে সাবধানে সুর করতে হতো। এটা তাঁর সুরগুলো শুনলেও বোঝা যায়। প্রথম মহাকাশচারী ইউরি গ্যাগারিন তাঁর একটা গান মিশন কন্ট্রোলের রেডিও থেকে গেয়ে পাঠিয়েছিলেন।
এই সুরগুলো সস্তাকোভিচের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য ভালো উপায় হতে পারে:
● Piano Concerto no. 1, opus 35
● Symphony no. 5 in D minor, opus 47
● Symphony no. 1 in F minor, opus 10
● Cello Concerto no. 1, opus 107
● String Quartet no. 3 and no. 8
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন