ধ্রুপদী সংগীতে জাতীয়তাবাদ
১৮৫০-এর পুরোটা সময় ধরে জার্মানি এবং অস্ট্রিয়ার সব রুইকাতলারা ধ্রুপদী সংগীতে একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রেখেছিলেন। সারা পৃথিবীর সংগীতকারেরা এইসব ওস্তাদদের কাছ থেকে শিখতে তখন ভিয়েনা, লিপজিগ, ওয়েমার শহরগুলোতে গিয়ে ভীড় করতেন। কোনো সংগীতকার কোন দেশ থেকে এসেছেন সেসব নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা ছিলো না। যতোক্ষণ পর্যন্ত না তিনি জার্মান-অস্ট্রিয়ান ধাঁচটা রপ্ত করতে পারছেন ততোক্ষণ পর্যন্ত কোনো পরিচয়ও অবশ্য জুটতো না।
তবে ঊনিশ শতকের শেষাংশ সংগীতের ইতিহাসের অন্যতম কৌতূহলোদ্দীপক একটা সময়। এই সময়টায় সংগীতকারেরা পারস্পরিক যোগাযোগটাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নিজ নিজ দেশের সংগীতের দিকে মনোযোগী হয়ে ওঠেন।
প্রতিটি দেশেরই নিজ নিজ লোকসংগীত ছিলো। এতোদিন সেটা ‘উচ্চাঙ্গ’ সংগীত থেকে আলাদাই রাখা হতো। কিন্তু, এবার ধ্রুপদী সংগীতের বেলায় সেইসব লোকসংগীতই যেন অবলম্বন হয়ে উঠলো। যেভাবেই হোক, সংগীত জাতীয় মর্যাদার অংশ হয়ে গেলো। এই বোধটা অচিরেই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিলো।
বেডরিখ স্মেটানা
প্রথমদিককার একজন জাতীয়তাবাদী সংগীতকার ছিলেন বেডরিখ স্মেটানা। ঠিক যে সময়টায় ব্রামস পুরোনো জার্মান কাঠামো নিয়েই কাজ করছিলেন তখন সংগীতকার, পরিচালক ও পিয়ানোবাদক স্মেটানা (১৮২৪-১৮৮৪) সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের সংগীত করছিলেন - এমন সংগীত যেটা বোহেমিয়াকে তুলে ধরে।
স্মেটানার সময়ে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয় সাম্রাজ্য বোহেমিয়া শাসন করতো। স্মেটানা, এই বিদেশী শক্তির অধীনে থাকতে অপছন্দ করতেন। তিনি একদল বিদ্রোহীর সঙ্গে ভীড়ে গিয়েছিলেন যাঁরা স্বাধীন বোহেমিয়া কায়েম করতে চেয়েছিল। তাঁদের আঁতাত ব্যর্থ হলে, তিনি কিছুদিনের জন্য সুইডেনে পালিয়ে যান এবং তারপর ঠিক উল্টোপথে প্রাগে ফিরে আসেন।
নদী বয়ে যায়
স্মেটানার অন্যতম আবেদনময় একটি সুর হলো ছয়টি টোন পোয়েমের একটি সংকলন যার নাম মা ভ্লাস্ট বা মাই ফাদারল্যান্ড। ওই সংকলনের দ্বিতীয় টোন পোয়েমটি ছিল সবচেয়ে বিখ্যাতধ দ্য মোলডৌ। এটি হলো বোহেমিয়ার একটি প্রধান নদীর নাম।
স্মেটানা সুরের মধ্যে নদীকে সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। বাজনাটার শুরুটা হয় দুটো বাঁশির সুর দিয়ে। এখানে বাঁশিদুটি হল পাহাড়ের উৎপত্তিস্থল থেকে দুটি ধারা হয়ে নেমে আসা নদীর রূপক। মোলডৌ যতো বড় হয়, অর্কেস্ট্রার আওয়াজও ততো বাড়তে থাকে, একটার পর একটা বাদ্যযন্ত্র যুক্ত হতে থাকে। নদী বনের মধ্য দিয়ে বয়ে যায় তখন হান্টিং হর্ন বেজে ওঠে, মাঠের মধ্য দিয়ে গেলে শোনা যায় তার ধারে বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে, রাতের বেলায় পানিতে নেমে আসে জলপরীর দল, খরস্রোতা হয়ে তা প্রাগ শহরে ঢুকে পড়ে, এবং শেষ পর্যন্ত, বাণিজ্য স্থাপনার মধ্যে যেতে শুরু করার সাথে সাথে তা সরু হয়ে আসে আর বাজনাও কমে আসতে শুরু করে।
স্মেটানার সাথে পরিচিত হতে গেলে অবশ্যই দ্য মোলডৌ শুনতে হবে, সেইসঙ্গে মাই ফাদারল্যান্ডের বাদবাকি পাঁচটা টোন পোয়েমও। তারপর শুনতে হবে তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত অপেরা - দ্য বার্টারড ব্রাইড।
এন্টোনিন ডিভোর্জাক
এন্টোনিন ডিভোর্জাকও (১৮৪১-১৯০৪) ছিলেন বোহেমিয়ান। তাঁর শৈশব ছিলো লোকসংগীত, লোকনাচ আর আনন্দের কৃষিকাজের সুরে ভরা। বিখ্যাত ডিভোর্জাক কসাই পরিবারের সর্বশেষ কসাই ছিলেন তাঁর বাবা। তবে তিনি বিয়েতে জিথারও বাজাতেন। বাবার সঙ্গে সঙ্গে বেহালা বাজিয়ে বাজিয়েই তরুণ এন্টোনিনের সঙ্গীতে হাতেখড়ি হয়েছিলো।
ষোলো বছর বয়সে ডিভোর্জাক প্রাগে যান। সেখানেই তাঁর বেডরিখ স্মেটানার সংগীতের সঙ্গে পরিচয় হয়। এন্টোনিন বোহেমিয়ান লোক ভাষায় গান রচনা করে সবার টনক নড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর বুদ্ধিটা ছিল অতি সহজ কিন্তু ব্যবসা সফল। এই বুদ্ধির কারণেই ডিভোর্জাক একসময় প্রাগ কনজার্ভেটরিতে কম্পোজিশনের অধ্যাপক হয়ে গিয়েছিলেন।
হাসিখুশী ব্যক্তিত্ব
সংগীতের মাপকাঠিতে ডিভোর্জাক ছিলেন খামখেয়ালী। তিনি তাঁর বিখ্যাত ভাইদের মত (মানে বেটোভেন, বার্লিওজ, শুম্যানদের মত) বিষণ্ণ, নির্যাতিত কিংবা পাগল ছিলেন না। তিনি ছিলেন বেশ হাসিখুশী চরিত্রের। তাঁর এই হাসিখুশী চরিত্রের ছাপ সংগীতেও পড়েছিলো।
ডিভোর্জাক নিজেও ছিলেন খুবই সাদাসিধা ভদ্রলোক। তাঁর ভালোলাগাগুলো ছিল সাধারণ এবং ছিল ছয়টি সন্তান। তিনি পায়রা পুষতে পছন্দ করতেন, সেগুলোর ওড়াওড়ি দেখতে ভালোবাসতেন। তিনি মরার আগেই বিখ্যাত হয়েছিলেন। তাঁর সংগীত দ্রুতই জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো।
তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শ্রোতা ছিলেন স্বয়ং ব্রামস। তিনি ডিভোর্জাকের সংগীতের একজন বড় প্রচারক ছিলেন। তিনিই তরুণ ডিভোর্জাককে তাঁর প্রকাশকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁদের নৈকট্য ছিল বন্ধুত্বের চেয়েও বেশী। ডিভোর্জাকের কিছু সিম্ফোনিতে, বিশেষ করে সিম্ফোনি নং ৭ এ ব্রামসের প্রভাব স্পষ্ট। এমনকি সেখানে একবার জার্মানিক, পরক্ষণেই বোহেমিয়ান, তারপর আবার জার্মানিক, তারপর আবার বোহেমিয়ান এইরকম ধাঁচের পরিবর্তন দেখা যায়।
আমেরিকায় আমন্ত্রণ
একান্ন বছর বয়সে, ১৮৯২ সালে আমেরিকায় ডিভোর্জাককে নবগঠিত নিউ ইয়র্কের ন্যাশনাল কনজার্ভেটরি অফ মিউজিকের দায়িত্ব নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি তাঁর নিজের জাতীয় পরিচয়, উন্নত বোহেমিয়ান ঐতিহ্য, পরিবার এবং ভক্তদের ফেলে যেতে গড়িমসি করছিলেন। তখন তিনি খেয়াল করলেন যে প্রাগ কনজার্ভেটরিতে তাঁর যে বেতন তার প্রায় ২৫ গুণ বেশী বেতন তাকে সাধা হচ্ছে। কাজেই তিনি নিউ ইয়র্কের জাহাজ ধরলেন।
ডিভোর্জাক যুক্তরাষ্ট্রে তিন বছর ছিলেন। কিন্তু তিনি ঘরের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলেন এবং বেশীরভাগ সময় আইওয়ার বোহেমিয়ান কলোনিতেই পড়ে থাকতেন। যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীন আমেরিকান ইন্ডিয়ান এবং আফ্রো-আমেরিকান সংগীতের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটলেও তিনি সেই সময় তাঁর অন্যতম বিখ্যাত সিম্ফোনি নং ৯ (ফ্রম দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড) লেখেন। সংগীতকারের নিজের ভাষ্যে, শুরুর সলো হর্নের সুরটা আফ্রিকান আমেরিকান ঐতিহ্যকে এবং তৃতীয় মুভমেন্টের স্কের্জোটি জঙ্গলে ইন্ডিয়ান নাচের উৎসবকে বুঝিয়েছে।
নিউ ওয়ার্ল্ড সিম্ফোনি শুনলে মনে হবে যেন এটা আমেরিকান সংগীত। কিন্তু কোনো চেক লোকের সামনেও এটা বাজান, নিশ্চিতভাবে তিনি বলবেন এটা বেহোমিয়ান সংগীত। এটাই সংগীতকারের সার্থকতা।
ডিভোর্জাকের সংগীত যতো শোনা যায় ততোই আনন্দ পাওয়া যায়। যেমন:
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন