রিচার্ড ভ্যাগনার
লিস্ট তাঁর নিজের অপ্রচলিত হারমোনি আর গঠনে ভরা সুরকে ‘ভবিষ্যতের সুর’ বলতে পছন্দ করতেন। তবে সত্যিকারের ‘ভবিষ্যতের সুর’ তৈরি করেছিলেন রিচার্ড ভ্যাগনার (১৮১৩-১৮৮৩)। ভ্যাগনারের সাথে লিস্টের বন্ধুত্ব ছিলো এবং তাঁরা ছিলেন হরিহর আত্মা। আরও ভালোভাবে বলতে গেলে, ভ্যাগনার ছিলেন মেয়ের জামাই। ভ্যাগনার লিস্টের মেয়ে কোসিমাকে বিয়ে করেছিলেন।
অপেরার সুরকার
ভ্যাগনার অপেরা তৈরি করতেন। তিনি জার্মান লোকগাঁথায় সুর দিয়ে এক নতুন ধরনের গীতিনাট্য তৈরি করেছিলেন। ভ্যাগনারকে নিয়ে যীশুখ্রিস্টের পরেই সম্ভবত সবচেয়ে বেশী লেখা হয়েছে। এই লোকটি ছিলেন একজন উন্নাসিক, অসৎ, হিংসুক, জোচ্চোর, বর্ণবিদ্বেষী, নারীবিদ্বেষী লোক।
তবে এই লেখায় ভ্যাগনারকে স্থান দেবার তিনটি কারণ রয়েছে:
১. ভ্যাগনার মিউজিক অফ দ্যা ফিউচার নামের একটা আন্দোলন তৈরি করেছিলেন যেখানে অপেরাসহ বিভিন্ন ধারার সংগীতকারেরা ছিলেন। সেই সময় সংগীতকারদের দুটি স্পষ্ট দার্শনিক ভাগ হয়ে গিয়েছিলো: একদল ভবিষ্যতের দিকে দেখতে বেশী আগ্রহী ছিলেন (যেমন ভ্যাগনার, লিস্ট এবং বার্লিওজ) এবং একদল অতীত থেকে অনুপ্রেরণা নিতে বেশী আগ্রহী ছিলেন (যেমন ব্রামস। তাঁকে রক্ষণশীল ধারার সংগীতকার বলা যেতে পারে)।
ব্রামস এবং ভ্যাগনারই মূলত এই দ্বন্দ্ব আর বিভক্তির কেন্দ্রীয় দুটি চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন তাঁদের ভক্তদের আশীর্বাদে। ব্যক্তিগতভাবে, ব্রামস আসলে ভ্যাগনারের ভক্ত ছিলেন। আর লোকের সামনে, তিনি এইসব বিতর্ক উস্কে দিতেন। যখন কেউ ব্রামসকে জানাতো যে ভ্যাগনারের অর্কেস্ট্রার কোনো সদস্য মারা গেছে, তিনি ঠাট্টা করে বলতেন, ‘আরেকটা তাহলে মরলো।’
২. ভ্যাগনার তাঁর অপেরায় প্রতিটা চরিত্রের জন্য আলাদা আলাদা থিম তৈরি করতেন। প্রতিটি আলাদা আলাদা সুরকে বলা হত লাইটমোটিফ। সেগুলো বিভিন্ন চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গেই চলতো। বার্লিওজের ‘ফিক্সড আইডিয়া’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই চর্চাটি ভবিষ্যতের সংগীতকার রিচার্ড স্ট্রসকেও প্রভাবিত করেছিলো।
৩. ভ্যাগনারের অপেরায় দারুণ সব ওভার্চার থাকত। এগুলোকে কখনো কখনো প্রিলুডও বলা হতো। এগুলো আবার আলাদা করেও অর্কেস্ট্রার সঙ্গে বাজানোর মতো ছিল এবং বিভিন্ন কনসার্টে বাজানোও হতো।
ভ্যাগনারের কিছু অসাধারণ ওভার্চার হলো:
● Rienzi Overture
● Die Meistersinger Overture
● Tristan und Isolde: Prelude and Love‐Death (also known as Liebestod)
● Die Walküre: Ride of the Valkyries
স্ট্রস এবং মেহলার
রিচার্ড ভ্যাগনার যাঁদের সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত করেছিলেন তাঁরা দুজন হলেন রিচার্ড স্ট্রস (১৮৬৪-১৯৪৯) এবং গুস্তাভ মেহলার (১৮৬০-১৯১১)।
রিচার্ড স্ট্রস:
স্ট্রস দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ভ্যাগনারের যুগের পর, পুরাতন, প্রতিষ্ঠিত গঠন মেনে সংগীত তৈরি করা আর সম্ভব না। তিনি লিখেছিলেন, ‘এখন থেকে উদ্দেশ্যহীন সুরের টুকরা তৈরি করাই হবে চল আর কোনো সিম্ফোনিও থাকবে না।’
স্ট্রস মনে করতেন প্রোগ্রাম জাতীয় সংগীতের মধ্যেই সংগীতের ভবিষ্যত রয়েছে। প্রোগ্রাম হলো কোনো নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে গল্প সংবলিত এক ধারার সংগীত। তিনি এই জাতীয় সংগীতকে বলতেন টোন পোয়েম। স্ট্রস নিজে ছিলেন টোন পোয়েমের একজন পথিকৃত। তাঁর সেরা টোন পোয়েমগুলো হলো:
● Don Juan
● Don Quixote
● Ein Heldenleben (A Hero’s Life)
● Also Sprach Zarathustra (Thus Spoke Zarathustra)
● Tod und Verklärung (Death and Transfiguration)
স্ট্রসের সংগীত আমাদের সবার কাছেই চেনা। বিভিন্ন চলচ্চিত্রে এসবের বহুল ব্যবহার হয়েছে। বিশেষ করে ২০০১: এ স্পেস ওডিসিতে। ওই চলচ্চিত্রের শুরুতে যে ভীনগ্রহ থেকে আসা বানরগুলো একটা কালো বাক্সের দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকে সেই দৃশ্যটির কথা মনে পড়ে? সেই দৃশ্যে ট্রাম্পেটে তিনটি লম্বা স্বর বাজতে শোনা যায়, তারপরেই পুরো অর্কেস্ট্রা চড়ে যায় এবং কেটলড্রাম বেজে ওঠে। এটাই হল স্ট্রসের দাস স্পোক জরাথ্রুস্ট।
স্ট্রসের টোন পোয়েমের প্রতিটিতে একটা করে গল্প আছে। ডন হুয়ানে বোঝা যায় পৃথিবীর বিখ্যাত প্রেমিক একটার পর একটা রাজ্য জয় করে চলেছে। টড আন্ড ভার্কলারিং-এ বোঝা যায় এক বৃদ্ধের দুর্বল ও অনিয়মিত হৃদস্পন্দন আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে এবং তিনি মারা যাচ্ছেন। ডন কুয়োতে-তে বোঝা যায় ডন কখনো একপাল ছাগলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, কখনো উইন্ডমিলের সঙ্গে যুদ্ধ করছে বা কখনো ঘোড়া থেকে পড়ে যাচ্ছে। রিচার্ড স্ট্রস একবার দাওয়াতে গিয়ে এক বন্ধুকে বলেছিলেন, ‘আমি যেকোনকিছুকে শব্দে রূপান্তর করতে পারি। আমি সুর দিয়েও বুঝাতে পারি টেবিলের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চামচ সরিয়ে নিলে কেমন শোনাতে পারে।’
রিচার্ড স্ট্রস সংগীতের অনেক বুদ্ধি ভ্যাগনারের বই থেকে নিয়েছিলেন। যেমন: তিনি বিভিন্ন লিটমোটিভ একসঙ্গে করে একটা অপেরায় রূপান্তরিত করেছিলেন। তিনি ডিসেপটিভ কাডেন্সও ব্যবহার করেছিলেন। এই কাডেন্স হারমোনিগুলোকে অনেকদূর টেনে লম্বা করতে পারতো, ফলে মনে হতো এই বুঝি সবগুলো সুর মিলে যাবে, কিন্তু মিলতো না।
স্ট্রস একজন খ্যাতিমান পরিচালকও ছিলেন। তিনি একজন সংগীতপ্রতিভা হলেও তাঁর পরিচালনা দেখে তা বোঝার উপায় ছিল না। তিনি বসে বসে পরিচালনা করতেন, একেবারে ভাবলেশহীনভাবে তাঁর ব্যাটন চলতো।
সংগীতের কালক্রমে স্ট্রসের অর্ধেক জীবন কেটেছে বিশ শতকের সংগীত আবহে, কিন্তু, তিনি নিজে ছিলেন রোমান্টিক যুগের সংগীতকার। যদিও তিনি নতুন নতুন জিনিসপত্র নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছিলেন, কিন্তু কখনো টোনালিটি অর্থাৎ, হারমোনির প্রচলিত ধারণা ছেড়ে বের হননি। এমনকি, তাঁর যতো বয়স হচ্ছিলো ততোই তাঁর সুরও পুরাতন ধাঁচের দিকে ফিরে যাচ্ছিলো। তরুণ হিসেবে, তিনি ডেথ এন্ড ট্রান্সফিগারেশন সৃষ্টি করলেও ষাট বছর পরে, মৃত্যুর আগে সংগীতের এই চিত্রশিল্পী বলেছিলেন, ‘মৃত্যু, আমি ঠিক যেমনটা লিখেছিলাম, তেমনই।’
স্ট্রসের সংগীত:
● Don Juan
● Death and Transfiguration (also known as Tod und Verklärung)
● Suite for Wind Instruments in B‐flat major, opus 4
● Suite from Le Bourgeois Gentilhomme (music written to accompany the comedy by Molière)
● Horn Concerto no. 2 in E‐flat major
● Four Last Songs
গুস্তাফ মেহলার
স্ট্রস যেমন শান্ত-শিষ্ট, নিপাট ভদ্রলোক ছিলেন, ঠিক তার উল্টোটা ছিলেন ভ্যাগনারের সবচেয়ে কাছের ভক্ত, উন্মাদ প্রতিভাবান গুস্তাভ মেহলার (১৮৬০-১৯১১)।
বোহেমিয়ায় (বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্রের অংশ) জন্ম নেওয়া, ইহুদী মদ কারিগরের সন্তান মেহলার দুঃখ-কষ্টের মধ্যেই বড় হয়েছেন। তাঁকে যখন কেউ জিজ্ঞেস করতো, বড় হয়ে কী হতে চাও? তিনি উত্তর দিতেন, শহীদ হতে চাই।
তাঁর ইচ্ছা পূরণ হয়েছিল, নানান ট্রাজেডিতে ভরা ছিল তাঁর জীবন। তাঁর কন্যা মারা গিয়েছিল স্কারলেট ফিভারে। এইজন্য কুসংস্কারবাদী মেহলার নিজেকে দায়ী করতেন কারণ তিনি মৃত্যুর কিছুদিন আগে সঙস অন দ্য ডেথ অফ চিলড্রেন নামের একটা সুর করেছিলেন। আর মেহলারের নিজের হৃদয়ও ছিল অত্যন্ত দুর্বল। এই কারণে মৃত্যুর প্রতি তাঁর ছিল অসীম আগ্রহ। শুরু থেকেই মেহলার নিজেকে বড় একা মনে করতেন। তিনি বলতেন, ‘আমি তিনভাবে গৃহহীন: প্রথমত বোহেমিয়ান হয়েও অস্ট্রিয়ায় থাকি, অস্ট্রিয়ান হয়েও জার্মানদের মাঝে থাকি এবং তৃতীয়ত, সারা দুনিয়ার কাছে আমি একজন ইহুদী।’
তাঁর বেড়ে ওঠার সময়েও রয়েছে অসংখ্য অপ্রিয় ঘটনা। তাঁর নিষ্ঠুর বাবা নিয়মিতই স্ত্রী সন্তানদের মারধোর করতেন, বিশেষ করে মা’কে। একবার এইরকম নির্যাতনের পর আর সহ্য করতে না পেরে মেহলার বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। রাস্তায় উঠেই তিনি দেখতে পান হার্ডি-গার্ডিতে কে যেন বিখ্যাত ভিয়েনিজ মদ্যপানের গান করছে। পরে, সিগমুন্ড ফ্রয়েডের কাছে সাইকোথেরাপি নেওয়ার সময় মেহলার বুঝতে পারেন যে, এই ঘটনাটাই তাঁকে বিরাট ট্রাজেডির সঙ্গে আনন্দদায়ক সুর মেশাতে উদ্বুদ্ধ করেছিলো।
আসলে, মেহলারের বেশীরভাগ সুরেই এই ধরনের বৈপরীত্য ছিল। চড়া এবং হালকা, উঁচু এবং নিচু সুরের মধ্যে বারবার পরিবর্তন করা। তাঁর সুরের মধ্যে দেখা যেতো বাদ্যযন্ত্রগুলো তারায় চড়ে বিকট শব্দ করছে। দেখা যেতো সৌন্দর্য, ক্ষোভ এবং ধ্বংস আর বিজয়ের মুহূর্ত। তাঁর কিছু কিছু সিম্ফোনি শেষ হয়েছে গায়ের রোম খাড়া করে দেওয়া বিজয়ের অনুভূতি জাগিয়ে, যার মধ্যে রয়েছে সিম্ফোনি নং ১ বা দ্য রিসারেকশন সিম্ফোনি এবং সিম্ফোনি নং ৮ বা সিম্ফোনি অফ আ থাউজ্যান্ট। এই সিম্ফোনিটি প্রথমবার পরিবেশনার সময় ১৩৭৯ জন শিল্পী একসাথে বাজিয়েছিলেন।
ইতোমধ্যেই মেহলার একজন ব্যস্ত অপেরা পরিচালক হয়ে উঠেছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি একইসাথে ভিয়েনা স্টেট অপেরা এবং নিউ ইয়র্কের মেট্রোপলিটন অপেরা, দুটিই পরিচালনার ভার পেয়েছিলেন। তিনি শুধুমাত্র সংগীত পরিচালনাই করতেন না, তিনি একে একেবারে চেপে ধরতেন, নিজেই সেটাকে ধারণ করতেন।
সংগীতের সর্বোচ্চ শিখরে ওঠার প্রত্যয় তাঁকে ক্লান্ত করে ফেলেছিলো, কিন্তু তাতে তাঁর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং পরিচালক হিসেবে সাফল্যও মিলেছিলো। তাঁর সংগীত প্রথমদিকে কিন্তু অতোটা চলেনি। লিওনার্দ বার্নস্টাইনের মতো পরিচালক, যিনি ছিলেন মেহলারের পাঁড় ভক্ত, তাঁকে আন্তর্জাতিক সংগীতমহলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
মেহলারের সুর ভ্যাগনারের কৌশল অবলম্বন করেছিল, টোনালিটির কাছাকাছি যেতে যেতে আবার সেটাকে ভেঙে দেওয়ার প্রবণতা তিনিও গ্রহণ করেছিলেন। ভ্যাগনারের সময় প্রায় সমস্ত সুরই একটা কি মেনে চলতো, কিন্তু মেহলারের সুর এতোটাই ছড়িয়ে পড়তো যে মনে হতো তাতে যেন কোনো সুনির্দিষ্ট কি নাই।
মেহলার নয়টি সিম্ফোনি লিখেছিলেন এবং বেশকিছু জার্মান সং সাইকেল তৈরি করেছিলেন। মেহলারের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য তাঁর এই কাজগুলো সহায়ক হতে পারে:
● Symphony no. 1 in D major (The Titan)
● Symphony no. 2 in C minor (Resurrection)
● Symphony no. 5 in C‐sharp minor
● Rückert Lieder (songs based on texts by the poet Rückert)
● Symphony no. 8 in E‐flat major (Symphony of a Thousand)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন