শনিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০

পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (পর্ব ১: মুখবন্ধ, ভূমিকা, মধ্যযুগ, রেনেসাঁ)

মুখবন্ধ

ব্যক্তিগতভাবে একটু আগে থেকে হলেও, ২০১৭ সালে রাজশাহীতে স্বরসংকেত স্কুল তৈরি করার পর আমরা কয়েকজন মিলে পাশ্চাত্য সংগীতের ইতিহাস, তার গঠন, কাঠামো ইত্যাদি নিয়ে পড়তে শুরু করেছিলাম। আমি, উচ্ছ্বাস, ফারহান আর অথই মিলে শুরু। আমরা লুসিয়ানো এলবার্টি’র মিউজিক অফ দ্য ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ড পড়তে শুরু করেছিলাম। আমি পড়তাম, বাংলা করে বাকিদের বুঝিয়ে দিতাম। পরে যুক্ত হয়েছিল তানভীর, রূপমসহ আরও অনেকে। আমি যখন পড়তাম এবং বাংলা করে বুঝিয়ে দিতাম তখন পুরো জিনিসটা রেকর্ড করা হতো। পড়া শেষে পালাক্রমে একজন একজন করে সেই রেকর্ড বাড়ি নিয়ে যেতো এবং সেটা ট্রান্সস্ক্রিপ্ট করে এনে দিতো। এভাবে বইটার একইসাথে অনুবাদের কাজও চলছিলো। আমরা প্রায় অর্ধেকেরও বেশী পড়ে অনুবাদ করে ফেলেছিলাম।

বাঙালির আর দশটা কাজের মতোই এ কাজেও আমাদের বেশীদিন দম থাকলো না। সংগীতচর্চার ক্ষেত্রে এই ভাঙন তো নতুন কিছু না। অনেকেই ঝরে পড়লো। আমাদের পড়াতেও ভাটা পড়লো। ওই অমূল্য বইটি আমরা পেয়েছিলাম বরেন্দ্র মিউজকাল একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ও শিক্ষক জন থর্পের কাছ থেকে। থর্প ছিলেন আমাদের সবার পাশ্চাত্য সংগীতের গুরু। স্বরসংকেতের বেশীরভাগই বরেন্দ্র মিউজিকালেও বাজানো শিখতে যেতো। 

সেইসময় বাংলা ভাষায় পাশ্চাত্য সংগীতের ইতিহাস অনুবাদ করতে গিয়ে আমি যে বিপদে পড়েছিলাম তা হল সংগীতের পরিভাষা। আমাদের এদেশের সংগীত আর পাশ্চাত্য সংগীতের মধ্যে একটা বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। আমাদের সংগীত মূলত হরাইজেন্টাল সংগীত। এতে হারমোনির উপস্থিতি খুবই কম, বিশেষ করে ধ্রুপদী সংগীতের ক্ষেত্রে। কিন্তু, পাশ্চাত্য সংগীত ভার্টিকাল সংগীত, এতে রয়েছে জটিল হারমোনির কারুকার্য। এইযে হারমোনি শব্দটি আমাকে ব্যবহার করতে হচ্ছে, এর কোনো যুতসই বাংলা শব্দ আমি পাইনি। রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত একে স্বরসংগতি নাম দিয়েছিলেন কিন্তু এই সময়ের প্রেক্ষিতে স্বরসংগতি ব্যবহার করে লেখায় গতির সঞ্চার করা যায় না। এমনি আরও অসংখ্য সংগীতের ইতালিয়, ল্যাটিন, ইংরেজি শব্দের সঠিক বাংলা পরিভাষা পাওয়া যায় না। আসলে, এই অঞ্চলে এইসব পরিভাষা নিয়ে তেমন কোনো কাজই হয়নি। ঠিক যেমন সামগ্রিকভাবে কোনো কাজ হয়নি পাশ্চাত্য সংগীত ও তার ইতিহাস নিয়ে।

অথচ, আমাদের মূলধারার সংগীত থেকে শুরু করে লোকসংগীতেও পাশ্চাত্য সংগীতের প্রভাব অনস্বীকার্য। এখন তো আমরা হারমোনি আর পাশ্চাত্য যন্ত্রের সঙ্গত ছাড়া বাংলা গান কল্পনাই করতে পারিনা। রবীন্দ্রনাথের পরে সলিল চৌধুরীর কল্যাণে বাংলা গানে অর্কেস্ট্রেশনের শুভ সূচনা হয়েছিলো। এরপর তা গানের খোল-নলচে পাল্টে দিয়েছিলো। এতো বিপুল ব্যবহারের পরেও কেন আমাদের দেশের সংগীতে পাশ্চাত্য সংগীতের ইতিহাস এবং সেই ইতিহাস এবং ব্যাকরণ পাঠের জন্য অত্যাবশ্যক পরিভাষা নিয়ে কোনো কাজ হলো না সে এক বিস্ময়। 

যাহোক, এই পরিভাষা সংকট দেখে আমি এবং থর্প ঠিক করেছিলাম কিছু পরিভাষা নিজেরাই তৈরি করে নেবো। এই নিয়ে কিছুদূর এগোনোও গিয়েছিলো, কিন্তু তা আর শেষ হয়নি। থর্প বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেলেন, আমিও আলসেমি আর জীবিকার তাগিদে ফেলে রাখলাম কাজটা। তারপরেও মনটা খচখচ করছিলো, অন্তত যদি পাশ্চাত্য সংগীতের একটা ইতিহাস লেখা যেতো। পশ্চিমবঙ্গের কথা বলতে পারবো না, তবে বাংলাদেশে যে এই ইতিহাসও খুব ভালোভাবে, যত্ন নিয়ে লেখা হয়নি সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কিন্তু, পাশ্চাত্য সংগীতের ইতিহাস তো আর চাট্টিখানি কথা নয়, কয়েকশো বছরের ইতিহাস, যার শুরুটা করতে হবে আদিম যুগ থেকে। এরজন্য যতখানি বিদ্যা প্রয়োজন সেটুকু তো আমার নেই। সুতরাং, লিখতে হলে আগে পড়তে হবে। বা, পড়তে পড়তেই লিখতে হবে।

এরমধ্যে রিপন কুমার সরকার আমাকে চেপে ধরলো পাশ্চাত্য সংগীতের একটা ছোটোখাটো ইতিহাস বুঝিয়ে বলতে হবে। আমি বললে সে সেটা থেকে নোট করে ক্লাসে প্রেজেন্টেশন দিবে। তখন বোধ করলাম, বিস্তারিত না হোক, অন্তত অতি সংক্ষেপেও যদি একটা ইতিহাস বাংলা ভাষায় লেখা যেতো তো কিছু একটা হতো। সেই ভাবনা থেকেই এই লেখা। 

এটি পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এই ইতিহাস লিখতে গিয়ে আমাকে হাবুডুবু খেতে হয়েছে কাকে ছেড়ে কাকে রাখবো আর কোন বিষয়টা ছেড়ে কোন বিষয়টা লিখবো। আমি চেয়েছিলাম যেটুকু না জানলেই নয় সেটুকু লেখা। তবে, লিখতে গিয়ে আবারো সেই পারিভাষিক বিড়ম্বনায় পড়তে হলো। মন খচখচ করতে লাগলো যে, এমন অনেক শব্দ আসবে যেগুলোর সঙ্গে পাঠক হয়তো পরিচিত নন। সেগুলোর কোনো ব্যাখ্যা না দিয়েই এই ইতিহাস লেখা হলো। সেসব ব্যাখ্যা করার জন্য আস্ত আরও লেখা হয়ে যাবে। সেই লেখা হয়তো সামনে কোনোদিন লিখবো বা অন্যকেউ নিশ্চয়ই লিখবেন। আপাতত যেটুকু চাইছি সেইটুকুই বরং করা যাক।

এই লেখাটিকে আমি আমার মৌলিক লেখা বলে দাবী করব না, আবার অনুবাদও বলবো না। এতে ইতিহাসের কালক্রম এবং সংগীতের তালিকা নেওয়া হয়েছে এক অতি সহজপাঠ্য বই থেকে। বইটা হল ডেভিড পোগ এবং স্কট স্পেকের লেখা ক্লাসিকাল মিউজিক ফর ডামিস। আর সঙ্গী হিসেবে ছিলো ডেভিড গ্রাউট এবং পিটার বার্কহোল্ডারের এ হিস্ট্রি অফ ওয়েস্টার্ন মিউজিক। তাছাড়া ইন্টারনেট তো ছিলোই। এই বইদুটি পাইরেটেড বইয়ের অসামান্য লাইব্রেরি, লাইব্রেরি জেনেসিস থেকে পাওয়া। লাইব্রেরি জেনেসিস পৃথিবীতে ছিলো বলেই আমরা এইখানে বসে এতো দামী এবং মূল্যবান বইপত্র হাতের কাছে পেলাম। জেনেসিসের প্রতি ভালোবাসা।

পাশ্চাত্য সংগীতের আমি কোনো বোদ্ধা নই, একজন আগ্রহী নবীস শ্রোতা মাত্র। তবে, আমরা যখন স্বরসংকেতে বসে বই পড়তাম এবং আলাপ করতাম তখন সেই আলাপটা শুধুমাত্র সংগীতের ইতিহাসেই আটকে থাকতো না। খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই চলে আসতো তৎকালীন রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ এবং অন্যান্য শিল্পকলা নিয়ে আলাপ। আসলে সবকিছুর সাথেই সবকিছুর যোগ। ইতিহাসের বড় বড় সব ঘটনার ছাপ শিল্পকলার সমস্ত শাখাতেই পড়েছে। মানুষের মনস্তত্ত্বের গভীর চিন্তাও পড়েছে। আর তাই শিল্পকলা ও সংগীতের প্রতিটা যুগের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য মোটাদাগে বোঝা যায়। আবার, কোনো যুগই হঠাৎ একদিনে আলাদা হয়ে যায়নি। দিনের পর দিন একটু একটু করে পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তন হয়েছে কিছু সাহসী মানুষের জন্য, যাঁরা নিয়ম ও প্রথা ভেঙেছেন। সংগীত অবশ্যই একটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার, আবার একইসাথে একটি সামষ্টিক প্রচেষ্টারও ফল। তাই, সংগীতের যুগবিভাগ করা শুধু কঠিন কাজই নয়, অসম্ভবই বলা যায়। তবুও, পাশ্চাত্য সংগীতের কালকে কয়েকটি নির্দিষ্ট যুগে ভাগ করা গেছে এবং এই ভাগগুলো যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতাও পেয়েছে। সেই যুগবিভাগ ধরে শিল্পকলার অন্যান্য ধারাগুলোর তুলনামূলক পাঠও সহজ হয়ে যায়।

প্রাচ্যের ধ্রুপদী সংগীতে লোকসংগীতের প্রভাব আগে। লোকসংগীতই ধ্রুপদী সংগীতের জন্ম দিয়েছে এই হল হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বরাতে  আমার মত। কিন্তু পাশ্চাত্য সংগীতের বেলায় মূলধারার ইতিহাস জানাচ্ছে পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতে রোমান্টিক যুগে এসে লোকসংগীত মিশেছে। এখানেই সংগীতের রাজনীতি টের পাওয়া যায়। অনুরূপ একটি ইতিহাস প্রাচ্য সংগীতের বেলায়ও লেখা হয়েছে এবং সেটাই মূলধারার ইতিহাস হয়ে উঠেছে। কিন্তু, সংগত কারণেই লোকসংগীতই প্রতিটা অঞ্চলে প্রাচীনতম সংগীত। তাহলে, পাশ্চাত্য সংগীতের বেলাতেও যে লোকসংগীতের প্রভাব শুরু থেকেই নেই সেকথা নিশ্চিতভাবে কেমন করে বলা গেল? নিশ্চয়ই ইতিহাসের এই পাঠের বাইরেও কোনো পাঠ আছে, যা আমার গোচরীভূত হয়নি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি সেই পাঠও পাওয়া যাবে। 

এই বড় হবার লড়াই নিশ্চয়ই অনেক তাৎপর্য বহন করে। লোকসংগীত বনাম ধ্রুপদী সংগীতের এই দ্বন্দ্বই ক্ষমতা বনাম স্বাধীনতার আদি দ্বন্দ্ব। সেই হিসেবে সংগীতের ইতিহাস কোনো অ-রাজনৈতিক ইতিহাস নয়। আরও বড় করে বলতে গেলে, শিল্পকলার ইতিহাস অ-রাজনৈতিক ইতিহাস নয়। ধ্রুপদী সংগীতের পৃষ্ঠপোষণ করেছে রাজা ও ধনিক সম্প্রদায় এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো; এককথায় শাসক সম্প্রদায়। আর, লোকসংগীতের উপর তাদের আক্রমণ বহুবার বহুভাবে এলেও লোকসংগীত তার মুক্ততার জন্য বারবার নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছে আপন পরম্পরায়। লোকসংগীতের দ্বার উন্মুক্ত। সে সবার থেকে নিতে জানে এবং সবাইকে দিতেও জানে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস যেমনটা বলেছিলেন, ধ্রুপদী সংগীতের রয়েছে ঘরানা আর লোকসংগীতের বাহিরানা। এই ঘরানা আর বাহিরানার দ্বন্দ্ব চিরকালীন। তবে, পাশ্চাত্য সংগীতের ক্ষেত্রে রোমান্টিক যুগে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি ধ্রুপদী সুরকারগণ লোকসংগীতকে সাদরে গ্রহণ করছেন। একই ঘটনা আমরা এইখানেও দেখতে পাই। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখের পরম্পরায় আমরা দেখলাম লোকসংগীত এবং ধ্রুপদী সংগীতের মিলন, সময়কাল পাশ্চাত্য সংগীতের ঠিক রোমান্টিক যুগেই। এসব কাকতালীয় নয় একদম, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উত্থানও সেই সময়েই। এই মিলনের পেছনে জাতীয়তাবাদী চেতনা কাজ করেছে সচেতনভাবে। আবার সময়ের প্রয়োজনে যার যার মতো আলাদা পথও ধরেছে দুই ধারার সংগীত। ধ্রপদী সংগীত আপন মহিমায় আবার ব্রাত্যজনকে ভুলেছে, বেঁধেছে নিয়মকানুনের কঠিন বাঁধনে, তৈরি করেছে একদল কট্টর বিশুদ্ধবাদী সমর্থক। এখানেই সংগীতের রাজনীতি। এই রাজনীতি বুঝতে হলেও সংগীতের ইতিহাস তো জানতে হবে।

জানতে হবে ভবিষ্যতের সংগীতের স্বার্থেও। ইতিহাস থেকে করণীয় আঁচ করা যায়। ধ্রুপদী এবং পপ সংগীত চিরকালই বাজারের জিনিস ছিল। সে লোকসংগীতের কাছ থেকে যখন যেমন পেরেছে নিয়েছে বটে। আর তারপর তা পরিবেশন করেছে বাজারে। উপরন্তু কপিরাইট করেও তাতে আপন লভ্যাংশ নিশ্চিত করেছে। অপরদিকে লোকসংগীত সবসময় ফিরেছে মানুষের মুখে মুখে। মানুষের সমাজই একে দেখভাল করেছে, কদর করেছে। ভবিষ্যতের সংগীত কি বাজারের মধ্যেই থাকবে? নাকি কিছু মানুষ এগিয়ে আসবে বাজারের কবল থেকে সংগীতকে মুক্ত করতে? তবেই না পৃথিবী এবং মানুষের শিল্পকলা ও সমাজ আরেক নতুন যুগে প্রবেশ করবে। অন্যকোনোভাবে নয়। 


ইস্ক্রা

খুলনা



ভূমিকা

মানুষের সভ্যতা যেদিন থেকে শুরু হলো সেদিন থেকেই গান তার সাথী। আদিম মানুষ থেকে শুরু করে আজকের মানুষ অবধি যে যন্ত্রটি মানুষের গানের সবচেয়ে বড় সঙ্গী তা হলো তার গলা। আদিম মানুষ গলা দিয়ে যে আওয়াজ বের করতো তার মধ্যেও এক ধরনের সংগীতময়তা ছিল বৈকি। 

যুগের সাথে সাথে সংগীতের ভিতরকার গঠন আরও জটিল হয়েছে। মানুষ বাদ্যযন্ত্র আবিষ্কার করেছে। যতদূর মানুষের গলা পৌঁছাতে পারেনা বাদ্যযন্ত্র এখন ততদূর পৌঁছাতে পারে। পাইপ অথবা হুইসেলের মত বিভিন্ন ধরনের বাঁশি পাখির শব্দ নকল করতে পারে, বাতাসের মত আওয়াজও করতে পারে; আবার বিভিন্ন ধরনের ড্রাম অনুকরণ করতে পারে হৃৎপিণ্ডের ধুকুপুকানি। আধুনিক সময়ে গানের স্কেল বা স্বরগ্রামের প্রমিতকরণ হয়েছে। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে সামঞ্জস্য তৈরি করা হয়েছে। আর এইভাবেই জন্ম নিয়েছে ধ্রুপদী সংগীত। 

মানুষের প্রথমদিককার গানগুলোর বিষয়বস্তু ছিল ধর্মীয়। প্রতিকূলতার মধ্যে বাস করা আদিম ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষেরা পূজা অর্চনার সময় গেয়ে গেয়ে দেবতাদের উদ্দেশে প্রার্থনা করতো। তারা প্রকৃতির অনুকরণ করতো; যখন বাতাস বইতো, তারা বাতাসের শব্দের অনুকরণ করতো, যখন আকাশ মেঘে ছেয়ে যেতো, তারা বৃষ্টির শব্দের অনুকরণ করতো; বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে গান গাইতো। তারা নিজেদের বিভিন্ন সাফল্যেও গান গাইতো, ভাল শিকার জুটিয়ে দিলে দেবতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেও তারা গাইতো।

সংগীতের ইতিহাসে সবচেয়ে পুরাতন ধারণাটি হল তালের ধারণা। প্রতিদিনকার হাঁটাচলা, দৌড়, শিকারের কসরত, ভয় কিংবা আনন্দ প্রকাশে আদিম মানুষ বিভিন্ন তাল ব্যবহার করত। এই তালের সাথে সাথে তৈরি হয়েছিল বিভিন্ন নাচ - দেবতাদের উদ্দেশে সেসব নাচ নাচা হত। আর নাচের অনুষঙ্গ হিসেবেই সংগীতের আবির্ভাব হয়েছিল।

সেইসব আদিম দিনগুলোতে গানের পরম্পরা মুখে মুখে রক্ষা হতো। এমনকি, আজও প্রাচ্যের সংগীতে এই মৌখিক পরম্পরাই চলে আসছে। মাত্র এক হাজার বছর বা তারও একটু আগে মানুষ সংগীতের স্বরলিপি করতে শিখেছিল।


মধ্যযুগ

যে যুগকে মানুষ আজ মধ্যযুগ নামে ডাকে সেই যুগটা ছিল প্লেগ, মহামারী আর মারামারির যুগ। এসব বাদেও সেই যুগের একটা ইতিবাচক দিকও আছে। ইউরোপের বিভিন্ন বিহারগুলোতে যাজকেরা তখন করছিলেন সংগীতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ  এক সংস্কার - স্বরলিপিকরণ। 


গ্রেগরিয়ান চান্ট

ততদিনে সংগীতের নেহাত কম বয়স হয়নি, তবে তখনো কারও মাথায় আসেনি যে সুর লিখে রাখা উচিত। তবে, ৬০০ খ্রিস্টাব্দে পোপ প্রথম গ্রেগরি তৎকালীন চার্চগুলোতে যে সংগীত ব্যবহার হতো সেগুলোর স্কেলগুলোকে বোঝার সুবিধার জন্য একটা পদ্ধতি তৈরি করে ফেলেন। আজকাল গানের স্বরগুলোর যেসব নাম আমরা জানি যেমন: A, B, C, D এইসব কাল্পনিক নামকরণের কৃতিত্ব এই পোপ প্রথম গ্রেগরির। 

পোপ গ্রেগরির নাম থেকেই গ্রেগরিয়ান চান্ট নামের উৎপত্তি। এটা শুনতে অতি সরল কিন্তু অত্যন্ত চড়াই-উতরাইওয়ালা সুরের খেলা এর ভিতরে আছে। ল্যাটিন ভাষায় লেখা এইসব গান বাদামী গাউন গায়ে দিয়ে একদল চার্চের লোক একই সুরে একসাথে গাইতো। পোপ গ্রেগরি যদি জানতেন যে, বিশ শতকের শেষে এসে এই গ্রেগরিয়ান চান্টই সারা পৃথিবীতে অন্যতম জনপ্রিয় গান হিসেবে বিবেচিত হবে, তাহলে হয়তো তাঁর চোয়াল ঝুলে যেত। স্পেনের কোনো মঠের একদল ব্রাদারের গাওয়া ‘চান্ট’ নামের একটা রেকর্ডিং বের হওয়ার পর সেটা আমাদের সময়ে টপ চার্টে জায়গা করে নিয়েছিল।

গ্রেগরিয়ান চান্টের এই প্রত্যাবর্তনের পিছনে অবশ্যই কিছু কারণ ছিল। এর মধ্যে সত্যিই আধ্যাত্মিক গভীরতা আছে। আপনি যদি চোখ বুঁজে একমনে গ্রেগরিয়ান চান্ট শুনতে থাকেন তাহলে আপনার মনেও এক ধরনের প্রশান্তি আসতে বাধ্য।


সাধু গুইডোর কথা

গুইডো অফ আরেৎজো ছিলেন তখনকার দিনের এক মেধাবী সাধু। ইনি সংগীতের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেছিলেন, যেমন ‘ডো, রে, মি, ফা….’ বলে স্কেলের স্বরগুলোকে গাইবার পদ্ধতি। এইরকম নির্দিষ্ট স্বরের জন্য নির্দিষ্ট সিলেবল বেঁধে দিয়ে গলায় গেয়ে গেয়ে চর্চা করার শতাব্দী প্রাচীন রীতি অনুসরণ করতেন অপেরা গায়ক ও গায়িকারা। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের গায়ক-গায়িকারাও একইরকম পদ্ধতি অনুরসরণ করতেন। এই পদ্ধতিকে বলা হয় সোলফেজ। আমাদের ভারতীয় ঘরানাতেও একই পদ্ধতি আজও ব্যবহার করা হয়। 

গুইডো অফ আরেৎজো নতুন একরকম স্বরলিপি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। একে বলা হত গুইডোনিয়ান হাত। এই নিয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনা করছি না। পাশ্চাত্য স্বরলিপি নিয়ে কোনো আলাদা লেখায় সেই ইতিহাস নিয়ে আলাপ করা যাবে। মোদ্দাকথা, আধুনিক স্বরলিপির মূল জিনিসগুলো গুইডো অফ আরেৎজোর হাতেই পত্তন হয়েছিল।

গুইডোর আবিষ্কারগুলো ছাড়া গানের আজকের দুনিয়াটা কেমন হতো তা এক ভাবনার বিষয় বটে। সৌভাগ্যবশত, আমাদের তা আর ভাবতে হচ্ছে না। কারণ গুইডো সত্যিসত্যিই ছিলেন এবং তাঁর তৈরি স্বরলিপি পদ্ধতি আজও প্রাসঙ্গিক।


মাস্‌-এর কথা

তবে গানে যে শুধু সাধু-সন্ন্যাসীদেরই ব্যক্তিগত অবদান সেরকম নয় মোটেও। তাদের প্রার্থনার ধরন-ধারণ, বিশেষ করে ক্যাথলিক মাস্‌গুলোর অবদানও কম নয়। পৃথিবীর অন্যতম সেরা কোরাল এবং অর্কেস্ট্রাল সংগীতের বেশকিছু মাস্ জাতীয় সংগীত বা ধর্মীয় সংগীত।

ক্যাথলিক মাস্ (ল্যাটিন ভাষায় মিসা) নামটি এসেছে এর প্রতিটি গানের শেষে ব্যবহৃত ‘Ite, missa est’ (চলতি কথায় ‘শেষ হল, এবার সবাই আসতে পারেন’) বাক্যটি থেকে। প্রতিটা মাস্ এবং ক্যাথলিক মাস্-এর উপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া যাবতীয় সংগীতের শেষে এই একই বাক্য ব্যবহার করা হতো। আমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো কখনো কোনোদিন এই বাক্যগুলো শুনেছি নিশ্চয়ই: Kyrie eleison (প্রভু দয়া করুন); Gloria in excelsis (পরমেশ্বরের জয়); Sanctus, Sanctus, Sanctus (পবিত্র, পবিত্র, পবিত্র) এবং Agnus Dei (খোদার খাসি)। এগুলো সবই মাস্ জাতীয় সংগীতের বাক্য। রেনেসাঁর সময় থেকে আজকের সময় পর্যন্ত মাস্ সংগীতগুলো কেউ খেয়াল করে থাকলে এই বাক্যগুলো অবশ্যই শুনেছেন। 

পুনঃজন্মের কাল: রেনেসাঁ

গুইডোর মৃত্যু এবং তাঁর ধারার ধর্মীয় সংগীতের ক্রম অবলুপ্তির ৪০০ বছর পর, সমাজ এক নতুন সময়কালে এগিয়ে যায় যার আজকের নাম রেনেসাঁ (ফরাসি শব্দ, যার অর্থ পুনঃজন্ম)। রেনেসাঁর যুগে শিল্প-সংস্কৃতির অভূতপূর্ব উন্নতি হয়। এই উন্নতিতে অংশ নেন সমাজের শিল্পানুরাগী ধনিক শ্রেণী এবং রাজা-রাজড়ারা।
রেনেসাঁ যুগের অন্যতম জনপ্রিয় ইতালিয় সংগীতাকার হলেন জিওভানি দ্য প্যালেস্ট্রিনা (১৫২৫-১৫৯৪)। তৎকালীন পোপের চ্যালা এবং অন্যতম প্রিয়পাত্র প্যালেস্ট্রিনার অন্যতম দিক হলো তিনি শুধুমাত্র গলায় গাইবার জন্য, যন্ত্রানুষঙ্গবিহীন সংগীত রচনা করতেন। তবে গ্রেগরিয়ান চান্টের মতো তা সবাই একই সুরে একসাথে গাইতো না। তার বদলে, তিনি তৈরি করেছিলেন অবিস্মরণীয় সব হারমোনি বা স্বরসংগতি। এর মানে হল, সেসব গানের মধ্যে একসাথে একাধিক স্বতন্ত্র সুর একসাথে বাজতো, এবং সেগুলো একে অপরের সঙ্গে সুন্দরভাবে সামঞ্জস্য রেখে একটা অপূর্ব তান তৈরি করতো।
প্যালেস্ট্রিনা

প্যালেস্ট্রিনা মাস্ এবং অন্যান্য ধর্মীয় সংগীতের অন্যতম সেরা সংগীতকার ছিলেন। কিন্তু, সেই একই সময়ে সংগীতকারেরা ধর্মীয় সংগীতের বলয় থেকেও বের হতে চাইছিলেন। সেই সময় থেকে বিখ্যাত সব রোমান কবিদের কবিতা যেমন দান্তে’র ইনফার্নো এবং ধর্মীয় বলয়ের বাইরের অন্যান্য বিষয়বস্তুও গানের উপজীব্য হিসেবে ব্যবহার হতে শুরু হয়েছিল।

মাদ্রিগালের সূচনা

এইরকম বেশকিছু জনপ্রিয় সংগীতের ধারার একটি হলো মাদ্রিগাল। মাদ্রিগাল হলো এমন এক ধরনের গান যেখানে কমপক্ষে তিনটি কণ্ঠ দরকার হয়। সাধারণত, এতে কোনো যন্ত্রানুষঙ্গ থাকেনা। রেনেসাঁর কালে, পরিবারের সদস্যরা কিংবা বন্ধুবান্ধবরা একসাথে বসে এইসব মাদ্রিগাল গাইতো। প্রত্যেকে কণ্ঠ মেলানোর জন্য আলাদা আলাদা সুর বেছে নিতো এবং গাইবার সময় কেউ কোনো ভুল স্বর গেয়ে ফেললেই পাশেরজন তাকে কনুই দিয়ে গুঁতো দিতো।

মাদ্রিগাল গাইতে অত্যন্ত মজা লাগতো কারণ এতে এক বিশেষ ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করতে হতো। পদ্ধতিটির নাম ওয়ার্ড-পেইন্টিং। যখনই গানের কথায় কোনো বিশেষ কিছুর বর্ণনা করতে হতো, তখন গায়ককে সেটা সুরে সুরে অভিনয় করেও দেখাতে হত। যেমন, দীর্ঘশ্বাস বোঝাতে সাধারণত গায়ক চড়ায় সুর তুলে কণ্ঠটা আস্তে আস্তে খাদে নামিয়ে আনতো। অপরদিকে দৌড় এবং উড়ে বেড়ানো বুঝাতে কিংবা আনন্দ বুঝাতে গায়ক খুব দ্রুত অনেকগুলো স্বর গেয়ে ফেলত। 


অপেরার স্বর্ণযুগ

ইতালিয় রেনেসাঁর স্বর্ণযুগের সময় বাস করতেন সংগীতকার ক্লডিও মন্টেভার্ডি (১৫৬৭-১৬৪৩)। মন্টেভার্ডি জনপ্রিয় মাদ্রিগাল ধারায় আরও সুরেলা সুর আর যন্ত্রানুষঙ্গ যুক্ত করেছিলেন।
মন্টেভার্ডি

মন্টেভার্ডিই হলেন গীতি-নাট্য বা অপেরার জনক। রেনেসাঁর যে বিভিন্ন দিক, তাতে অপেরা ছিল প্রাচীন গ্রীসের হারানো ঐতিহ্যের কথাগুলো ফিরিয়ে আনার একটা প্রচেষ্টা। এক্ষেত্রে, গ্রীক নাটকগুলোই ছিল প্রথম পছন্দ। এই নাটকগুলোকে প্রাচীন গ্রীসে খোলা জায়গায় মঞ্চ বানিয়ে তার সঙ্গে বিভিন্ন বাঁশি আর তারযন্ত্রের অনুষঙ্গ ব্যবহার করে পরিবেশন করা হত। মন্টেভার্ডি আর তাঁর বন্ধুরা এই ধারাটিকেই তাঁদের সময়ে আবার ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। আর এর ফলে সংগীতও আর আগের মতো থাকলো না। তবে, দুঃখজনক হল এই কাজের জন্য মন্টেভার্ডি কখনো কোনো রাজা-রাজড়ার কাছ থেকে একটি কানাকড়িও পাননি।


২টি মন্তব্য:

  1. লেখাটা সম্পূর্ন পড়লাম পড়ে অনেক কিছু জানলাম ইস্কা ভাই,যা আগে জানাছিলো না,
    সঙ্গীতে না জানা আরো কতো কি যে আছে কে জানে,আপনি গুছিয়ে বই আকারে বের করুন, আমরা যরা সঙ্গীত জ্ঞান ও ইতিহাসে কাঁচা কিন্তু আমারদের জানার আগ্রহ আছে ইচ্ছা আছে আমরা ঘরে বসেই বইটা পড়ে অনেক কিছু জানতে পারবো...
    -
    আবু-সাঈদ(দিপ্তি)
    বর্তমান ঠিকানা খুলনা
    জন্ম:জামালপুর!

    উত্তরমুছুন