মঙ্গলবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০

পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (পর্ব ৪: উলফগ্যাং আমেডিউস মোৎসার্ট, লুডউইগ ভ্যান বেটোভেন)

উলফগ্যাং আমেডিউস মোৎসার্ট

আমরা আগে একবার বলেছিলাম বাখ ছিলেন সর্বকালের সেরা সংগীতকার। তবে অনেকেই মনে করেন মোৎসার্ট (১৭৫৬-১৭৯১) হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। একেবারে শৈশবকাল থেকেই মোৎসার্টের মধ্যে যে সহজাত সংগীত প্রতিভা দেখা গিয়েছিল তার কোনো তুলনা আজও নাই। 

মোৎসার্ট

উলফগ্যাঙের বাবা, লিওপল্ডও ছিলেন একজন সম্মানীত সংগীতকার এবং সংগীতজ্ঞ। কিন্তু তিনি তাঁর নিজের সম্ভাবনাময় সংগীতজীবন উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর মেধাবী পুত্রের মেধার বিকাশের জন্য। তিনি তাঁর শিশুপুত্র উলফগ্যাংকে পিয়ানো, বেহালা এবং সংগীত তত্ত্ব পড়িয়েছিলেন অস্ট্রিয়ার সালসবার্গে থাকাকালীন সময়ে।

বাবার পরিচর্যায় থেকে শিশু উলফগ্যাং মাত্র চার বছর বয়সে নিজে কনসার্টো রচনা করেন। এর কিছুকাল পরে, তিনি তাঁর প্রথম সিম্ফোনিও লিখে ফেলেন। এরপর মাত্র এগারো বছর বয়সে তিনি বাস্টিয়ান এবং বাস্টিয়েনে অপেরাটি লেখেন।


সার্কাসের দল

লিওপল্ড যখন তাঁর পুত্রের মেধার ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হলেন, তখনই তিনি বাক্সো-প্যাটরা গুটিয়ে শিশু মোৎসার্ট এবং তাঁর বড়বোন নানার্লকে নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। তাঁরা সবখানেই গিয়েছিলেন, লিওপল্ড নিজের ছেলেকে প্রচার করতেন এক বৈজ্ঞানিক বিস্ময় হিসেবে। ইংল্যান্ডে তাঁদের একটা পোস্টারে লেখা হয়েছিল ‘বিজ্ঞানপ্রেমীদের বলছি: ইউরোপের সেরা মেধাবী এমনকি নিঃসন্দেহে বলা যায় মানবজাতির সেরা মেধাবী, জার্মান বালক উলফগ্যাং মোৎসার্ট’।

কিবোর্ডে শিশু মোৎসার্ট ইম্প্রোভাইজেশনের জবর খেলা দেখিয়েছিলেন। প্রথমে খুব কঠিন কঠিন সব সুর বাজিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর কাপড়ের নিচে হাত রেখে বাজিয়েছিলেন যাতে কিবোর্ডের চাবিগুলো দেখা না যায়। নার্নালও হার্পসিকর্ড বাজিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। একসাথে তাঁরা যেন একটা চলন্ত সার্কাস ছিলেন।


ঘাড়ধাক্কা খাওয়া

তেরো বছর বয়সে মোৎসার্ট সালসবার্গের আর্চবিশপের কোর্টে একটা চাকরি পান যেখানে তিনি বারো বছর কাজ করেছিলেন। সবসময় আরও ভালো কাজের আশায় তাঁর এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ানো দেখতে দেখতে আর্চবিশপ বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। অবশেষে, একদিন আর্চবিশপ মোৎসার্টকে চাকরিচ্যূত করেন। আর্চবিশপের সহকারী মোৎসার্টকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন।

মোৎসার্ট ভাগ্যান্বেষনের জন্য ভিয়েনা চলে আসেন। তিনি জানতেন ভিয়েনা হলো ইউরোপের সংগীত ভুবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। তিনি সেখানে শিশু প্রতিভা হিসেবে বাজিয়ে বেশ সফলও হয়েছিলেন একসময়। কিন্তু ততোদিনে মোৎসার্ট তো আর শিশু প্রতিভা নন, তিনি তখন বড় হয়েছেন। কাজেই তাঁর কাজ খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হলো। রাজদরবারের গানের ধরন-ধারণ পাল্টে গিয়েছিলো এবং তখন রাজকীয় ফরমায়েশও খুব কমই পাওয়া যেতো। কিন্তু মোৎসার্ট অন্য আরেকজনকে খুঁজে পেলেন: জোসেফ হাইডেন।

বাবা হাইডেন মোৎসার্টকে প্রথম দেখাতেই পছন্দ করে ফেললেন এবং তাঁদের বন্ধুত্ব চিরদিন ছিলো। মোৎসার্ট তাঁর গুরুকে উৎসর্গ করে একটা স্ট্রিং কোয়ার্টেট বানালে হাইডেন উচ্ছ্বসিত হয়ে মোৎসার্টের বাবা লিওপল্ডকে বলেছিলেন, ‘ঈশ্বরকে সাক্ষী মেনে এবং একজন সৎ মানুষ হিসেবে বলছি, আপনার পুত্র একদিন পৃথিবীর সেরা সংগীতকার হবে।’


জীবিকার সুযোগ

কোনো স্থায়ী চাকরি না থাকার কারণে মোৎসার্ট ভিয়েনায় অপেরা লিখে কোনোরকমে পেট চালাতে লাগলেন। এইসব অপেরা আজও জনপ্রিয় এবং চলচ্চিত্রেও বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

আমেদিউস চলচ্চিত্রে আমরা দেখেছি মোৎসার্টের মেধা দেখে তাঁর প্রতিপক্ষরা কেমন হিংসায় জ্বলতো। সুর তাঁর মাথায় সবসময় ঘুরঘুর করতো আর এমনভাবে সেগুলো তিনি লিখতেন যেন সব আগে থেকেই তাঁর জানা ছিলো।

এইসময় মোৎসার্ট এক সুশ্রী নারীর প্রেমে পড়েন। তাঁর নাম এলোসিয়া ওয়েবার। কিন্তু তিনি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলে, মোৎসার্ট এলোসিয়ারই ছোটবোন কন্সটান্সের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন এবং তাঁকেই বিয়ে করেন। বিয়ের সম্মানে মোৎসার্ট তাঁর বিখ্যাত সি-মাইনর মাস্‌ লেখেন।

মোৎসার্টের মর্ম না বোঝাদের মধ্যে শুধু এলোসিয়াই ছিলেন না। ভিয়েনার খামখেয়ালী জনগণও তাঁকে স্রেফ শনিবার রাতের বিনোদনের খোরাক হিসেবেই ধরে নিয়েছিলো।

মোৎসার্ট যেবার প্রাগে গেলেন তখন তাঁর একটু ভাগ্য ফিরতে আরম্ভ করলো। পুরো শহর তাঁর দ্য ম্যারেজ অফ ফিগারো অপেরায় পাগল হয়ে গেল। সেটার সাফল্যের এক বছর পর, ১৭৮৭ সালে প্রাগ শহর তাঁর উপর রাজার ভাগ্নীর বিয়ের সংগীত লেখার দায়িত্ব দিলো। আর তিনি সেই পবিত্র বন্ধন উদযাপনের জন্য কোনো গল্পটিকে সংগীতে রূপ দিবেন বলে বেছে নিয়েছিলেন জানেন? ডন হুয়ানের গল্প, যে কিনা এক যৌন বিকারগ্রস্থ লোক। অপেরাটির নাম ছিল ডন জিওভান্নি। এবং সেটা ছিলো একটা তুমুল জনপ্রিয় অপেরা।


মোৎসার্টের গতিময়তা

সংগীত রচনার গতি নিয়ে মোৎসার্টের সম্পর্কে নানা ধরনের গল্প প্রচলিত আছে। যেমন: দেখা গেল একজন ভিক্ষুক তাঁর সামনে দিয়ে যাচ্ছে অথচ তাঁর পকেটে টাকা নাই যে ভিক্ষা দিবেন। কোনো সমস্যা নাই, মুহূর্তেই একটা কাগজ নিয়ে তার উপরে স্টাফ লাইন এঁকে লিখে ফেললেন একটা মিনুয়েট বা ট্রায়ো। তারপর সেই সুরটা ভিক্ষুককে দিয়ে তাকে পাঠিয়ে দিলেন প্রকাশকের কাছে। আর প্রকাশকও সেটা তখনি কিনে নিয়ে কিছু পয়সা ধরিয়ে দিলো ভিক্ষুকের হাতে।

মোৎসার্টের চঞ্চল ব্যক্তিত্বের সঙ্গে এইরকম গতিময়তাই যেন মানানসই ছিল। কথার মাঝখানেই কখনো তিনি হোহো করে হেসে উঠতেন কিংবা লাফালাফি করে বেড়াতেন, ডিগবাজি খেতেন এমনকি উঁচু টেবিল বা চেয়ারে লাফিয়ে উঠতেন।


হেইডেনের সঙ্গে বিচ্ছেদ

সেইসময় তিনি তাঁর বন্ধু এবং গুরু জোসেফ হেইডেনের সংস্পর্শেই বেশী থাকতেন। ১৭৯০ সালে যখন হেইডেন আটান্ন বছরের বুড়ো এবং মোৎসার্টের বয়স সবে চৌত্রিশ। তখন তাঁরা প্রায় সারাদিনই একসাথে কাটাতেন। রাতের খাবারের পরে যখন বাড়ি যাবার সময় হতো, মোৎসার্ট প্রায়ই হেইডেনকে বলতেন’ ‘এই বিদায়ই বোধহয় শেষ বিদায়।’

তিনি ঠিকই বলতেন। এর এক বছরের মাথায় মোৎসার্ট মারা গেলেন।

পঁয়ত্রিশ বছরের জীবনাবসানের এক বছর পর গুজব ছড়ালো যে হিংসুক সংগীতকার এন্টোনিও স্যালিয়েরিই নাকি মোৎসার্টকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছেন। তবে, কথাটির কোনো সত্যতা পাওয়া যায় না। মোৎসার্ট সম্ভবত শারীরিক দুর্বলতার কারণেই মারা গিয়েছিলেন।

মোৎসার্টের সর্বশেষ সংগীতটি ছিল রিকোয়েম, যেটির ফরমায়েশ তিনি এক অচেনা আগন্তুকের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। সে যাহোক, শুরু থেকেই মোৎসার্ট বুঝতে পেরেছিলেন যে রিকোয়েমটি তিনি তাঁর নিজের মৃত্যু উপলক্ষ্যেই লিখছিলেন। তিনি জিনিসটা শেষ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন যা কেবল তাঁর অসুস্থতাকেই আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। শেষমেশ, তিনি শুধুমাত্র কয়েকটা মুভমেন্ট আর পুরোটার একটা কাঠামো দাঁড় করিয়ে যেতে পেরেছিলেন। মোৎসার্টের ছাত্র ফ্রাঞ্জ সস্যুমেয়ার তাঁর মৃত্যুর পরে এই সুর সম্পন্ন করেন। এই সংস্করণটিই এখন বেশীরভাগ জায়গায় শোনা যায়।

মোৎসার্টের মৃত্যুর পরে এই দুনিয়া আর তাঁর মতো দুর্লভ সংগীত প্রতিভা আর দেখেনি। তাঁর সংগীত করার দক্ষতা এবং ঐশী অনুপ্রেরণা আর কারও মাঝে দেখা যায়নি। তাঁর সংগীত স্বয়ং ক্লাসিকাল ধারার মূল নির্যাস যেন। সেগুলো একইসাথে সুরুচিপূর্ণ, কমনীয়, খাঁটি, উদ্যমপূর্ণ এবং সংযত আবেগ সম্পন্ন, তবে এর মধ্যে আছে নিগূঢ় কোনো বোধ।

মোৎসার্টের কোনো 'কম-ভালো' সংগীত নাই। তাই মোৎসার্ট শোনা যেতে পারে চোখ বুঁজে, তাঁর যেকোনো সুর, যেকোনো সময়। কাজেই, মোৎসার্টের সংগীতের সংক্ষিপ্ত তালিকা  তৈরি করা একটা দূরূহ ব্যাপার। তবে এই সুরগুলোর কথা উল্লেখ না করলেই নয়:

Clarinet Concerto in A major, K. 622
Piano Concerto no. 22 in E‐flat major, K. 482 
Piano Concerto no. 24 in C minor, K. 491
Violin Concerto no. 5 in A major (Turkish), K. 219
Sinfonia Concertante (concerto for violin and viola) in E‐flat major, K. 364
Symphony no. 38 in D major (Prague), K. 504
Requiem (completed by Franz Süssmayr), K. 626
Piano Sonata in G major, K. 283
Piano Sonata in F major, K. 332
Serenade in G major for Strings (Eine kleine Nachtmusik — or A Little Night Music), K. 525
Serenade no. 6 in D major (Serenata notturna — or Nocturnal Serenade), K. 239

লুডউইগ ভ্যান বেটোভেন

লুডউইগ ভ্যান বেটোভেন (১৭৭০-১৮২৭) ধ্রুপদী সংগীতের ইতিহাসকে যতোটা প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন ততোটা মোৎসার্টও পারেননি। জার্মানির বন শহরে জন্ম। বেটোভেন ছিলেন কোর্ট মিউজিশিয়ান জোহানের পুত্র। মোৎসার্টের বাবার মতো, জোহানও তাঁর পুত্রকে শিশু মেধাবীতে পরিণত করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে মোৎসার্টের বাবার পদ্ধতিতে নয়, জোহান ছিলেন আরও রূঢ়। তিনি যখনই বেটোভেনের মধ্যে আলসেমি দেখতেন সঙ্গে সঙ্গে মারধোর করতেন। এই অত্যাচারের পরেও বেটোভেন একজন অসামান্য পিয়ানোবাদক হয়ে উঠেছিলেন।

বেটোভেন

বাইশ বছর বয়সে বেটোভেন ভিয়েনায় যান। সেখানে তিনি বিভিন্ন ফরমায়েশি সুর বাঁধতেন, বিশেষ বিশেষ উপলক্ষ্য এবং কনসার্টগুলোতে তিনি নিজের সুর বাজাতেন। এইভাবে তিনি অবশ্য মোৎসার্টের থেকে ভালো কামাই করতেন।

বেটোভেন নিজে এবং তাঁর সুর, দুটোই ছিল টগবগে, আবেগতাড়িত এবং দ্রুতগামী। তাঁর মন দিয়ে পিয়ানো বাজানো দেখে লোকেরা খুবই আনন্দ পেতো। তবে, মঞ্চের বাইরে তাঁর চঞ্চল স্বভাবের জন্য বাড়িওয়ালা এবং প্রেমিকাদের সঙ্গে ঝগড়া লেগে যেতো। বেটোভেনের কোনোকিছুই বেশীদিন ভাল লাগতো না, সেটা বাসস্থানই হোক কিংবা নারী। এইরকম চরিত্রগুলোর সাথে আমরা অবশ্য সবাই কমবেশী পরিচিত: মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও যাদের বাগে রাখা কঠিন।


বাবা হেইডেনের কাছে দীক্ষা

তবে বেটোভেনের ভিয়েনা গমনের আসল উদ্দেশ্য ছিল জোসেফ হেইডেনের কাছে সংগীত শেখা। এই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের পরিণতিও অবশ্য বেটোভেনের আর দশটা সম্পর্কের থেকে ব্যতিক্রম কিছু হয়নি, তবুও, হেইডেন তাঁর এই বেয়াড়া ছাত্রকে অসম্ভব মেধার জন্য সবসময়ই প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন।

মোৎসার্টের মত বেটোভেনও দুটো জিনিসই শিখেছিলেন, কেমন করে সিম্ফোনি এবং স্ট্রিং কোয়ার্টেট লিখতে হয় ‒ হেইডেনের দুই ব্রহ্মাস্ত্র। আসলে, বেটোভেনের প্রথম দুটি সিম্ফোনিতে হেইডেনের প্রভাব ছিল স্পষ্ট। কাঠামো, গঠন এবং দৈর্ঘ্য, সবদিক দিয়েই সেগুলো যেন প্রায় হেইডেনেরই সিম্ফোনি বলে মনে হয়।

কিন্তু একটা ঘটনা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। একত্রিশ বছর বয়সে তিনি বুঝতে পারলেন যে তিনি আস্তে আস্তে শ্রবণশক্তি হারাচ্ছেন। যেকোনো সংগীতশিল্পীর কাছেই এরচেয়ে খারাপ সংবাদ আর হতে পারে না। ধেয়ে আসা বধিরতা বেটোভেনের উপর হতাশা নিয়ে চেপে ধরলো।

একদিন, বেটোভেন তাঁর বন্ধু এবং ছাত্র ফার্দিনানদ রাইজকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তা ধরে যাচ্ছিলেন। এমন সময় রাইজ দূর থেকে ভেসে আসা রাখালের বাঁশির একটা মিষ্টি সুর শুনতে পেলেন। কিন্তু বেটোভেন কিচ্ছু শুনতে পাননি। এই ঘটনায় তিনি যারপরনাই ভেঙ্গে পড়েন। তিনি পরবর্তীতে তাঁর এই দুঃখের কথা একটা কাগজে লিখেছিলেন, যেটা একইসাথে হৃদয় বিদারক এবং সাহসী। এই কাগজটি এখন শিল্পীদের কাছে হেলিজেনস্টাড টেস্টামেন্ট নামে পরিচিত:

ওহ, মানুষ, তোমরা যারা ভাবো এবং বলো যে আমি বদলোক বা অসামাজিক, কি নিদারুণ ভুলটাই না করো তোমরা। তোমরা এর পেছনের রহস্যটা জানোনা…..ছয় বছর হয়ে গেল, আমি এই কষ্টের মধ্যে আছি...আহ, কেমন করে আমি আমার এই স্নায়ুর দুর্বলতা সবাইকে বলবো যা কিনা অন্যদের চেয়ে আমারই সবচেয়ে সবল হবার কথা ছিলো, যে অনুভূতিকে একসময় আমি পরম যত্নে লালন করেছি? ওহ, আমি পারবো না; কাজেই যখন তোমার সাথে দুই দন্ড হেসে কথা বলার কথা তখনই যদি আমাকে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকতে দেখো, আমায় ক্ষমা করে দিও….আমাকে একা থাকতে হবে, ধরে নিও যেন আমি আর কোথাও নেই।

বেটোভেনের জীবনের এই সময়ের সংগীতগুলোতে এক বেপরোয়া লোকের আত্মনিয়ন্ত্রণের তুমুল প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। যদি আমরা তাঁর সময়টিকে অনুভব করতে পারি, তাহলে আমাদের কাছে তাঁর সংগীতও আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। নিজের ব্যথা প্রকাশ করতে গিয়ে বেটোভেন একা হাতে পুরো ক্লাসিকাল যুগকে এগিয়ে নিয়ে রোমান্টিক যুগের সূচনা করেছিলেন, যে যুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যটি হল অনুভূতি প্রকাশের প্রচেষ্টা।

যদি এমন একটা সুরের কথাও চিন্তা করতে হয় যেটা সংগীতের ইতিহাসে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে, তাহলে সেটা বেটোভেনের সিম্ফোনি নম্বর ৩, যা ইরোইকা সিম্ফোনি (মানে হিরোইক সিম্ফোনি) নামেও পরিচিত। এই সুরটির জন্য বেটোভেনের কপাল থেকে হাইডেন আর মোৎসার্টের অনুকরণকারীর খেতাব ঘুচে যায় এবং তাঁর স্বাতন্ত্র্য ফুটে ওঠে।

শুরু থেকেই বেটোভেন এই সিম্ফোনিটাকে একটা বিরাট বড় অধিক্ষেত্রের মধ্যে বসিয়েছিলেন, তাঁর উদ্দেশ্যটা ছিল এক বিখ্যাত বীরের জীবন এবং মৃত্যুকে ফুটিয়ে তোলা। আসলে, সেই বীরটি ছিলেন নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, কিন্তু ১৮০৪ সালে তিনি সেই চিন্তা থেকে সরে আসেন। বেটোভেনের বন্ধু ফার্দিনান্দ রাইজ এই ব্যাপারে লিখেছিলেন:

সেই সময় বেটোভেন বোনাপার্টের খুব প্রশংসা করতেন। আমি এই স্বরলিপিটা টেবিলের উপর পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। তার শিরোনামে লেখা ছিল ‘বোনাপার্ট’ এবং শেষে লেখা ছিল ‘লুইগি ভ্যান বেটোভেন’। এছাড়া আর কোনোকিছু লেখা ছিল না….

আমিই প্রথম তাঁকে জানাই যে বোনাপার্ট নিজেকে রাজা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি প্রচন্ড রেগে যান এবং চিৎকার করে বলেন: ‘তারমানে সেও সাধারণ মানুষের চেয়ে বড়কিছু নয়? এখন তো সেও মানুষের অধিকারে হস্তক্ষেপ করবে আর তার নিজের আখের গোছাতে শুরু করবে। সেও স্বৈরাচারী শাসকে পরিণত হবে!’ বেটোভেন তাঁর স্বরলিপির শিরোনামটি ছিঁড়ে ফেলেন এবং মেঝেতে ফেলে দেন। প্রথম পাতাটি পরে আবার লেখা হয়েছিল, আর তখন সেটার নাম হয়েছিলো শুধুমাত্র সিম্ফোনিয়া ইরোইকা বা হিরোইক সিম্ফোনি।

এর আগের সাধারণ যত সিম্ফোনি তার চেয়ে এই সিম্ফোনিটি ছিল দ্বিগুণ লম্বা এবং এর ভিতরকার আনুপাতিক দৈর্ঘ্যেও আসে বিরাট পরিবর্তন। বিশেষ করে ঢিমে লয়ের দ্বিতীয় মুভমেন্টটা একটু বেশীই অন্যরকম, যেন বিষন্ন শবযাত্রা, সঙ্গে ভয়াবহ শোক আর কষ্টের আবেগময় প্রকাশ।

বেটোভেন সর্বমোট নয়টি সিম্ফোনি লিখেছিলেন। প্রতিটিই সিম্ফোনিই বিদ্যমান সকল সিম্ফোনির গঠনকে চ্যালেঞ্জ করেছিলো এবং সিম্ফোনির গঠনের কলেবর বহুদূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। প্রতিটা কাজেই তিনি যেন আগের কাজকেও ছাড়িয়ে গেছেন, তাঁর সংগীত যেন আরও অনুভূতি প্রকাশে সক্ষম এবং ঋজু হয়ে উঠেছিলো যা ছিলো এক অভূতপূর্ব ঘটনা।

 

পঞ্চম সিম্ফোনি

নিঃসন্দেহে বেটোভেনের সবচেয়ে বিখ্যাত সিম্ফোনি হল পঞ্চম সিম্ফোনি। এই সিম্ফোনিটি কাঠখোট্টা সি-মাইনর কি-তে শুরু হয়, যার সঙ্গে রয়েছে সেই অতি বিখ্যাত চার-নোটের টুকরা: ‘ডা-ডা-ডা-ডাআআআআআআআআআআ!’

চারটা মুভমেন্ট জুড়ে নানান বিপজ্জনক কসরত দেখানোর পর সিম্ফোনিটি শেষ হয়। তবে তা সি-মাইনরে শেষ না করে বেটোভেন বরং বেছে নেন স্বস্তিদায়ক, বিজয়ী এবং উচ্ছ্বসিত সি-মেজর কি।

সাংগীতিকভাবে চিন্তা করলে, মাইনর কর্ড এবং মেজর কর্ডের মধ্যে পার্থক্য শুধুমাত্র একটা স্বরের। কিন্তু, আবেগের নিক্তিতে মাপলে, এই পার্থক্যটা বিরাট। যদি মাইনর থেকে মেজরে যাওয়া যায়, তাহলে মনে হয় যেন ঝড় শেষ হলো, মেঘ সরে গেল, সূর্য চিকমিক করে উঠলো আর হালে যেন পানি এলো। পুরো বিষয়টা বুঝতে গেলে অবশ্যই পঞ্চম সিম্ফোনির পুরোটা মন দিয়ে শুনতে হবে।


শেষ সিম্ফোনি

মোৎসার্টের মত বেটোভেন সহজাত সংগীতকার ছিলেন না। তাঁকে তাঁর সংগীতের খেরোখাতা নিয়ে সুরের সঙ্গে রীতিমতো কুস্তি করতে দেখা যেতো এবং মাসের পর মাস চলে যেতো তিনি তাঁর সুর নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারতেন না।

একটা খুব সাধারণ সুর বেটোভেনের খেরোখাতায় ঢুকে ইতিহাসের এক মহান সুর হয়ে বেরিয়ে এসেছিল: ‘ওড টু জয়’। এটাই হলো তার সর্বশেষ নবম সিম্ফোনির থিম। আমরা প্রত্যেকেই সম্ভবত এই সুরটা কমবেশী শুনেছি।

‘ওড টু জয়’ হল ফ্রেডরিখ শিলারের একটা দীর্ঘ এবং চমৎকার কবিতা। তেইশ বছর বয়স থেকেই বেটোভেনের মাথায় এটার উপর সুরারোপের চিন্তা ছিলো। বিশ বছর পর তিনি এটাকে ব্যবহার করার সঠিক জায়গাটি খুঁজে পান, নবম সিম্ফোনির শেষ মুভমেন্ট। 

ততদিন পর্যন্ত দুনিয়া যত সিম্ফোনি তৈরি হয়েছিলো প্রত্যেকটিই শুধুমাত্র অর্কেস্ট্রার সাথে বাজানোর উপযোগী করে তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু এই নবম সিম্ফোনিতে বেটোভেন প্রথমবারের মত সিম্ফোনিতে গানের বাণী যুক্ত করেন। শিলারের কবিতাটা গাইবার জন্য তিনি চারজন গায়ককে নিযুক্ত করেন এবং সঙ্গে জুড়ে দেন এক বিরাট কোরাস দল। সেই সময়ের সংগীত সমালোচকদের কাছে সিম্ফোনিতে কণ্ঠ যুক্ত করা ছিল দেশদ্রোহীতার সামিল। এই নিয়ে বিতর্ক চলেছে কয়েক দশক।

সৌভাগ্যবশত, মানুষ এইসব সমালোচকদের বিশেষ পাত্তা দিতো না। তাই, এর প্রথম পরিবেশনাটি সাফল্যের মুখ দেখেছিলো। বাজনা শেষে দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে বেটোভেনকে সম্মান জানিয়েছিলো। কিন্তু, ততোদিনে বেটোভেন সম্পূর্ণ বধির হয়ে গেছেন। তিনি দর্শকদের কাজকর্ম কিছুই টের পেলেন না, অর্কেস্ট্রার দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। একজন গায়ক দয়াপরবশত এগিয়ে এসে বেটোভেনকে ধরে দর্শকের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন।

বেটোভেন একজন বীরের বেশে মারা যান। তাঁর শেষকৃত্যে ত্রিশ হাজার মানুষ সামিল হয়েছিলো। তাঁর কফিন বহনকারীদের মধ্যে একজন ছিলেন ফ্রাঞ্জ শুবার্ট। তাঁর সম্পর্কেই আমরা সামনের অধ্যায়ে জানব।

বেটোভেনের সেরা সংগীত বাছাই করাও দুরূহ কাজ। তবে, এইগুলো না শুনলেই নয়:

সবগুলো সিম্ফোনি (১ থেকে ৯ নম্বর পর্যন্ত)
Piano Concerto no. 4 in G major, opus 58
Piano Concerto no. 5 in E‐flat major, opus 73
Violin Concerto in D major, opus 61
Piano Sonata no. 14 in C‐sharp minor, opus 27, no. 2 (Moonlight)
Piano Sonata no. 8 in C minor, opus 13 (Pathétique)
Piano Sonata no. 23 in F minor, opus 57 (Appassionata)
Sonata for Violin and Piano no. 9 in A major, opus 47 (Kreutzer)
Trio in B‐flat major for Clarinet (or Violin), Cello, and Piano, opus 11
String Quartets opus 59, no. 1‐3 (the Razumovsky Quartets)

1 টি মন্তব্য:

  1. তথ্যবহুল, গুছানো লেখা।উপস্থাপনের ধরন অনেক সাবলীল মনে হয়েছে। শুভ কামনা

    উত্তরমুছুন