শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২০

পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (পর্ব ৮: জোহানেস ব্রামস, নিকোলো পাগানিনি এবং ফ্রাঞ্জ লিস্ট)

জোহানেস ব্রামস

মোৎসার্ট আর বেটোভেনের মতো জার্মানির জোহানেস ব্রামসও (১৮৩৩-১৮৯৭) ছিলেন বিস্ময় বালক। সৌভাগ্যবশত, তাঁর বেজ-বাদক বাবা তাঁর প্রতিভার ব্যাপারে আঁচ পেয়েছিলেন এবং তাঁকে সেভাবেই গড়ে তুলেছিলেন।

ব্রামস

কিন্তু, তাঁর অপরাপর পূর্বসূরিরা যেমন ক্যাথেড্রাল, প্রাসাদ এইরকম বড় বড় জায়গায় কাজ করেছেন, ব্রামস কিন্তু চাকরি পেয়েছিলেন হামবুর্গের শুঁড়িখানা আর বেশ্যাপাড়ায়। তবুও, চাকরি তো চাকরিই। আর ব্রামস অনেক ধরনের সুরের সঙ্গেই পরিচিত হয়েছিলেন, বিশেষ করে নাচের সুর। এই সুরগুলোকে তাঁর যুবক বয়সে প্রায় প্রতিরাতেই বাজাতে হতো।


ভাগ্য ফেরা

বিশ বছর বয়সে রবার্ট শুম্যানের সাথে ব্রামসের দেখা হয়। ব্রামসের সুর শুনে শুম্যান বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি একজন প্রতিভাবানের সন্ধান পেয়েছেন।

তবে শুধুমাত্র রবার্ট শুম্যানের দৃষ্টিই যে ব্রামস কেড়েছিলেন তাই নয়, তাঁর সুন্দরী স্ত্রী ক্লারার নজরও কেড়েছিলেন তিনি। কতোটা নিবিড় ছিলো তাঁদের সম্পর্ক তা আর ইতিহাস থেকে জানা যায় না। শুধু জানা যায় রবার্ট শুম্যানের মৃত্যুর পর ব্রামস এবং ক্লারা একসাথে অনেক বেশী সময় কাটাতেন।

আস্তে আস্তে ব্রামস তাঁর সমকালীন অন্যতম প্রধান সংগীতকারদের একজন হয়ে উঠলেন, তাঁর খ্যাতি জার্মানি পেরিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।

তারকা জার্মান পিয়ানোবাদক ও পরিচালক হ্যানস ভন বুলো বলতেন ‘তিনটা ‘বি’ রয়েছে দুনিয়ায়: বাখ, বেটোভেন এবং ব্রামস।’ এই সম্মান নিশ্চয়ই ব্রামসের জন্য বিশাল ব্যাপার ছিল, কিন্তু এই কথা তাঁর ঘাড়ে জার্মান-অস্ট্রিয়ান সংগীতের ঐহিত্য বয়ে নিয়ে যাবার ভারও চাপিয়ে দিয়েছিল। তিনি ভিয়েনাতেও স্থায়ী হয়েছিলেন, যেখানে সংগীতের সমস্ত ওস্তাদেরা বাস করে গেছেন।

ব্রামস তাঁর দায়িত্ব খুব ভালোভাবে পালন করতে পেরেছিলেন। বারোক এবং ক্লাসিকাল ধারার সংগীতের গঠনের উপরে তিনি রোমান্টিক ধারার উষ্ণ, সমৃদ্ধ আবেগ যুক্ত করতে পেরেছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন আত্মসমালোচনাকারী সংগীতকার। তিনি তাঁর ডজন ডজন এমনকি শত শত কাজ কেউ দেখার আগেই ফেলে দিতেন। এমনকি, তিনি তেতাল্লিশ বছর বয়সের আগে তাঁর প্রথম সিম্ফোনিটি প্রকাশই করেন নাই। তুলনা করলে, মোৎসার্ট যখন তাঁর বয়সী ছিলেন তখন তিনি ৪১টি সিম্ফোনি প্রকাশ করে আট বছর হল গত হয়েছেন।

ব্রামসের সুরের সবচেয়ে চমৎকার দিকটি হলো, সেগুলো এতো ঘন হারমোনি সমৃদ্ধ আর কমনীয় যে, সেগুলোকে তখনকার সময়ের মানুষেরা কেতাবি, শ্রমসাধ্য, কর্কশ,  এমনকি কখনো কখনো বেসুরো বলেও মনে করতেন। 

এইরকম অভিযোগের কারণ মনে হয়, ব্রামসের কাছে সুরটা মুখ্য বিষয় ছিলো না। বেটোভেনের মতো, তিনিও ছোট ছোট সাংগীতিক ধারণা অর্থাৎ মোটিভ নিয়ে কাজ করতেন। এগুলো মাত্র দুটি বা তিনটি স্বর নিয়ে তৈরি করা সুর। তারপর সেগুলোর মধ্যেই বিভিন্নভাবে পারমুটেশন করে আর নানান সম্ভাব্য উপায়ে সাজিয়ে দুর্দান্তভাবে পরিবেশন করতেন। ফলাফল হতো অসাধারণ, কিন্তু সেগুলো সবসময় গাইবার যোগ্য থাকতো না। ব্রামস মাঝে মাঝেই আক্ষেপ করতেন তাঁর যদি সহজে মনে রাখার মতো সুর তৈরি করার ক্ষমতা থাকতো। তিনি বলতেন, ‘ব্লু দানিউব ওয়াল্টজের মতো কিছু একটা লিখতে পারলে আমি যা কিছু তৈরি করেছি সব বাতিল করে দিতাম।’

ব্রামসের যেকোনো সংগীতই শোনা যেতে পারে। তবে আমার পছন্দের কয়েকটি হলো:

চারটা সিম্ফোনি, তবে ২ নম্বরটি সবার আগে
Hungarian Dance No.5
Variations on a Theme by Joseph Haydn
Piano Concerto no. 2 in B‐flat major, opus 83
Violin Concerto in D major, opus 77
Ein Deutsches Requiem (also known as A German Requiem) for solo singers,chorus, and orchestra
Sonata for Violin and Piano no. 1 in G major, opus 78
Intermezzi for Piano, opus 118


পাগানিনি ও লিস্ট: দুই মহাতারকা

এলভিস না হলে বোধহয় রকস্টার ধারণাটির জন্ম হতো না। কিন্তু ১৮ শতকে লোকজনকে তাক করে দিয়ে আর যুবতী মেয়েদের চিৎকার করে করে অজ্ঞান করে দিতে এসেছিলেন দুই বিখ্যাত রকস্টার - নিকোলো পাগানিনি আর ফ্রাঞ্জ লিস্ট।

পাগানিনি

নিকোলো পাগানিনি (১৭৮২-১৮৪০) তাঁর সময়ে পৃথিবীর অন্যতম প্রতিভাবান বেহালাবাদক ছিলেন। তাঁর ছিলো অসাধারণ দক্ষতা, জাদুকরী হাত, ফুলকি ছড়ানো বো আর উষ্ণ ও আবেগময় বাজানোর ধরন যা তখনকার শ্রোতাদের পাগল করে দিতো।

পাগানিনি বেহালা বাজানোর রীতির খোল-নলচে বদলে দিয়েছিলেন। এটাও সত্য যে তিনি এমনসব সুরও বাজাতে পারতেন যেগুলো বেহালায় বাজানো অত্যন্ত কঠিন। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী সংগীতের এক মহাতারকা যিনি তাঁর সময়ে একজন বিস্ময় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। যেমন: কনসার্ট শুরু হবার আগে তিনি তাঁর বেহালাটির চারটা তারের মধ্যে তিনটা তারের উপরেই করাত ঘষতেন। কাজেই, পরিবেশনার সময় অবধারিতভাবে তাঁর তারগুলো ছিঁড়ে যেতো এবং তিনি কেবলমাত্র একটা তারেই বাজিয়ে যেতেন। 

মেয়েরা (এমনকি ছেলেরাও) সত্যিসত্যিই পাগানিনির কনসার্টে গেলে জ্ঞান হারাতেন। কখনো কখনো কোনো ভয়াল আবহের সুরের উপর ইম্প্রোভাইজ করার সময় তিনি মঞ্চের আলো কমিয়ে দিতেন। তারপর যখন আবার মোমবাতি জ্বলে উঠতো, দেখা যেতো দর্শকরা ভয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন।

তবে এইরকম মহাতারকা হলেই যে সবসময় ভক্তদের ভালোবাসা আর চিৎকার পাওয়া যাবে তা নয়। গুজব ছড়িয়েছিলো যে পাগানিনি তাঁর স্ত্রীর মাথা কেটে নিয়েছেন। আরও প্রচলিত ছিলো যে তিনি নাকি আট বছর কোনো এক অন্ধকূপের মধ্যে আত্মগোপনে  থেকে বেহালা বাজানো শিখেছিলেন কারণ তিনি নাকি তাঁর এক প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করেছিলেন। এমনকি এটাও ছড়িয়েছিলো যে তিনি তার আত্মা নাকি শয়তানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। 

তাঁর মুন্সিয়ানার সাক্ষর তিনি তাঁর ছয়টি ভায়োলিন কনসার্টোতে রেখে গেছেন। সংগীত হিসেবে, সেগুলোর কোনো তুলনাই হয় না, তবে সেগুলো আসলে একেকটা বিশেষ বিশেষ আবহের চোখ ধাঁধানো পরিবেশনা। কনসাটো ১ এবং ২ হল তাঁর অদ্যাবধি সবচেয়ে বিখ্যাত কনসার্টো।


পাগানিনির অনুগামী লিস্ট

লিস্ট

পাগানিনি যদি বেহালার জাদুকর হয়ে থাকেন তাহলে ভিয়েনায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ফ্রাঞ্জ লিস্ট হলেন পিয়ানোর জাদুকর। ইউরোপ ভ্রমণের সময় তাঁর কনসার্টগুলোর সমস্ত টিকিট বিক্রি হয়ে যেত। পাগানিনির মত, লিস্টও (১৮১১-১৮৮৬) মঞ্চ কাঁপানো শিল্পী ছিলেন। বাজাতে শুরু করার আগে নাটকীয় কায়দায় সাদা হাতমোজা খুলে ফেলা, মঞ্চের পেছনে একটা অতিরিক্ত পিয়ানো রেখে দেওয়া যাতে জোরে জোরে বাজাতে গিয়ে পিয়ানোর তার ছিঁড়ে গেলে আরেকটা পিয়ানো পাওয়া যায় আর তাঁর স্মৃতিশক্তির জোর সবাইকে দেখানোর জন্য বাজাতে বাজাতে হঠাৎ করে স্বরলিপির খাতা পিছনদিকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া, এইসবই ছিল তাঁর  ট্রেডমার্ক।

পাগানিনি তাঁর বাজনা দিয়ে নারী শ্রোতাদের অজ্ঞান করে দিতেন, কিন্তু লিস্ট ছিলেন আরও এককাঠি সরেস - তিনি নিজেই অজ্ঞান হয়ে যেতেন, বিশেষ করে খুবই আবেগময় কোনো বাজনা বাজাতে গিয়ে। আর তাতেই তার ভক্তরা পাগল হয়ে যেতো। যখন তাঁর মঞ্চের সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তখন তাকে বলা হত লিস্টোম্যানিয়া। এই শব্দটির প্রচলন করেছিলেন কবি হাইনরিখ হাইন।

নিজের প্রতিভা দেখানোর জন্য লিস্ট অসংখ্য পিয়ানো সলো তৈরি করেছিলেন যেগুলোর অনেকগুলো এখন পর্যন্ত লেখা সবচেয়ে কঠিন সুর। তাঁর আরও কিছু অসাধারণ সংগীতের মধ্যে রয়েছে হাঙ্গেরিয়ান র‍্যাপসোডিস ফর পিয়ানো এবং দি পিয়ানো সোনাটা ইন বি মাইনর।

সাঁইত্রিশ বছর বয়সে লিস্ট সবাইকে অবাক করে দিয়ে পিয়ানো বাজানো বন্ধ করে দেন। তিনি জার্মানির ওয়েমারে গিয়ে সংগীত পরিচালক হিসেবে থিতু হন। সেখানে তিনি অপেরা এবং সিম্ফোনি পরিচালনা করতেন এবং বেশকিছু টোন পোয়েম, দুটি সিম্ফোনি, দুটি পিয়ানো কনসার্টো রচনা করেছিলেন। পিয়ানো কনসার্টো নং ১ হল তাঁর অসাধারণ সৃষ্টির একটি।

সতেরো বছর পর, লিস্ট আবারও সবাইকে অবাক করে দিয়ে একজন পাদ্রী হিসেবে রোমে চলে যান। সমস্ত ভক্তের হৃদয় ভেঙে তিনি ধর্মকর্মে মন দেন।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন