মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০

পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (পর্ব ১২: মিখাইল গ্লিংকা এবং মাইটি ফিস্টফুল, পিটার চাইকোভস্কি, সের্গেই রকমানিনফ)

মিখাইল গ্লিংকা এবং মাইটি ফিস্টফুল

একটা পুরাতন কথা আছে, ‘যেখানে কৃষকের লোকসংগীত আছে, সেখানে জাতীয়তাবাদী ধ্রুপদী সংগীতও আছে।’ রাশিয়ার বেলায় কথাটি সত্য। এইরকম লোকসংগীত এবং জাতীয়তাবাদী ধ্রুপদী সংগীতও, দুটোই রাশিয়ার পর্যাপ্ত আছে। 

মাইটি ফিস্টফুল

মিখাইল গ্লিংকা (১৮০৪-১৮৫৭) ছিলেন প্রথম সংগীতকার যিনি রাশিয়ান লোকসংগীতকে রাশিয়ান ধ্রুপদী সংগীতে প্রয়োগ করেছিলেন। হয়তো তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত সুর, রুসলান এন্ড লুদমিলা’র ওভার্চারটা আপনারা শুনেছেন। এটা অর্কেস্ট্রা কনসার্টগুলোর অন্যতম প্রধান একটা বাজনা কারণ এটা একটু হালকা চালের এবং এতে প্রচুর চড়া সুর আছে। এতে ভিয়োলা এবং চেলো’র বাজানোর জন্য চমৎকার সব সুর আছে এবং এটা বাজানো তেমন কঠিন নয়।

গ্লিংকা ছিলেন দীর্ঘ সুর রচনা করার ওস্তাদ এবং এইসব সুরগুলোর নিজস্ব রুশ গন্ধ আছে। রোমান্টিক যুগের রাশিয়ান সংগীতকাররা তাঁকে গুরু মানতেন। তাঁর অনুকরণ করতে গিয়ে মাইটি ফাইভ বা মাইটি ফিস্টফুল নামে সংগীতকারদের একটা দল তৈরি হয়েছিল যাঁরা তাঁদের সংগীতে পশ্চিম ইউরোপীয় প্রভাব দূর করে রুশ প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। মাইটি ফিস্টফুলের পঞ্চপান্ডবের নাম হল মিলি বালাকিরেভ (১৮৩৭-১৯১০), ইনিই সবাইকে একত্র করেছিলেন; সেজার চুই (১৮৩৯-১৯১৮); আলেক্সান্ডার বোরোডিন (১৮৩৩-১৮৮৭); মডেস্ট মাসার্গস্কি (১৮৩৯-১৮৮১) এবং নিকোলাই রিমস্কি-কোরসাকভ (১৮৪৪-১৯০৮)। 

এঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন সৌখিন সংগীতকার, কিন্তু শুধুমাত্র বালাকিরেভ ছিলেন পেশাদার সংগীতকার। চুই ছিলেন মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিঙের একজন অধ্যাপক, বোরোডিন রসায়নবিদ, মাসার্গস্কি প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং রিমস্কি-কোরসাকভ নৌবাহিনীর অফিসার। এঁরা সবাই ছিলেন সত্যিকার অর্থেই গ্রামের মানুষ।


পঞ্চপান্ডব

ছোটোবেলা থেকেই রিমস্কি-কোরসাকভ ছিলেন অসাধারণ পিয়ানোবাদক। কিন্তু তাঁর মন পড়ে রইতো সাগরে। বারো বছর বয়সে তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গের নাভাল একাডেমিতে পড়তে যান। গ্রাজুয়েশন শেষ করে তিনি বাইশ বছর নৌবাহিনীতে কাজ করেন - এগারো বছর নাবিক এবং বাকি এগারো বছর নেভি ব্যান্ডের প্রধান হিসেবে।

নৌবাহিনীর অফিসার থাকাকালীন তাঁর সাথে মিলি বালাকিরেভের দেখা হয়। বালাকিরেভের ভাষ্যে, সেইসময়কার সংগীতকারেরা ফরাসি এবং জার্মান সংগীতকারদের থিমের উপর বেশী নির্ভর করতেন। তাঁদের উচিত রুশ ঐহিত্যের দিকে মন দেওয়া। বালাকিরেভ রিমস্কি এবং অন্যান্য তরুণ প্রতিভাবানদের তাঁর দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করেন। এইভাবেই ‘মাইটি ফাইভ’ এর জন্ম হয়।

নেভির চাকরি শেষ হওয়ার পর, রিমস্কি সেন্ট পিটার্সবার্গ কনজার্ভেটরিতে কম্পোজিশনের অধ্যাপক হিসেবে কাজ পান। রিমস্কি-কোরসাকভ খুবই ভাল শিক্ষক ছিলেন। এমনকি নৌবাহিনীর চাকরির পরে তিনি নিজে নিজেও অনেক হারমোনি, কাঠামো, কাউন্টারপয়েন্ট নিয়ে পড়াশোনা করেন যাতে ছাত্রদেরও কিছু শেখাতে পারেন।

কালক্রমে, নিকোলাইয়ের বেশ কিছু প্রতিভাবান ছাত্র বিখ্যাত সংগীতকারও হন, যেমন সের্গেই প্রোক্রফিয়েভ এবং ইগর স্ট্রাভিনস্কি। রিমস্কি-কোরসাকভ তাঁদের সংগীতের সবধরনের বিষয় শেখালেও বিশেষ করে শিখিয়েছিলেন অর্কেস্ট্রেশন। এই বিষয়ে রিমস্কি একটা অসাধারণ বইও লিখেছিলেন যা আজও সংগীতকারদের কাছে পাঠ্য।

রিমস্কি-কোরসাকভের সেরা সুর হল শেহেরাজাদী। আলিফ লায়লার গল্পের সেই শয়তান সুলতান, যে কিনা প্রতি রাতে একটা করে বিয়ে করে এবং রাত শেষে তাকে মেরে ফেলে। কিন্তু, একবার শেহেরাজাদী নামের এক নারী তাকে বিয়ে করার পর একের পর এক অসাধারণ গল্প বলে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে। প্রতিটা গল্পের শেষেই তিনি একটা করে রহস্য রেখে দিতেন যাতে সুলতান পরের গল্প শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে। এভাবে ১০০১ রাত্রি পার হয়ে যায়। প্রায় আড়াই বছর এইরকম চলার পর সুলতান তাঁর হত্যা করার পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়।


একমুঠো মাইটি ফাইভ

মাইটি ফাইভের যেসব সুর শোনা যেতে পারে:

Rimsky‐Korsakov: Scheherazade, opus 35
Rimsky‐Korsakov: Russian Easter Overture, opus 36
Mussorgsky: Night on Bald Mountain 
Mussorgsky: Pictures at an Exhibition 
Borodin: Prince Igor: Polovtsian Dances
Borodin: Symphony no. 2 in B minor
Overture to Ruslan and Ludmila

পিটার চাইকোভস্কি

রাশিয়ার সবচেয়ে সেরা সংগীতকার কিন্তু মাইটি ফিস্টফুলের সদস্য ছিলেন না। তবে, তিনি ছিলেন আত্মমগ্ন এবং উন্মাদ, যাঁর পুরো জীবনটা কেটেছে নানান সমস্যায়। তাঁর নাম পিটার ইলিচ চাইকোভস্কি (১৮৪০-১৮৯৩)।

পিটার চাইকোভস্কি

চাইকোভস্কির সচ্ছল বাবা-মা তাঁর সহজাত প্রতিভার কথা বুঝতে পেরেছিলেন। তবে তাঁরা এটাও বুঝেছিলেন যে, কেউই সংগীত করে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামাতে পারে না। তাই তাঁরা ছেলেকে সেন্ট পিটার্সবার্গের আইন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। এবং যথারীতি, পিটার আইন পড়া ছেড়ে সংগীতে মনোনিবেশ করলেন এবং সেন্ট পিটার্সবার্গ কনজার্ভেটরিতে ভর্তি হলেন।

এক পর্যায়ে চাইকোভস্কি মস্কোতে নতুন গড়ে ওঠা একটা কনজার্ভেটরিতে শিক্ষকতার সুযোগ পেলেন। তখন তিনি কপর্দকশূন্য।

তাঁর জীবনে প্রথম যে সুযোগটি এসেছিলো তা হলো, রেললাইনের ব্যবসা করেন এক বিধবা মহিলা, নাম নাদেজদা ভন মেক, গান শুনে তাঁর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। এই বিধবা মহিলাটি তাঁকে খুব করে চাইতেন, কিন্তু সেটা সেইসময় সদ্য বিধবাদের পক্ষে একেবারেই সমর্থনযোগ্য ছিলো না। সুতরাং, মহিলা বারবার চাইকোভস্কিকে টাকা পাঠিয়ে দিতেন, কিন্তু কখনো দেখা করতেন না। বলাই বাহুল্য চাইকোভস্কি এই মহিলার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞ ছিলেন এবং তিনি তাঁর চতুর্থ সিম্ফোনি তার এই ‘সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে’ উৎসর্গ করেছিলেন।

নাদেজদার পয়সায় চাইকোভস্কির অর্থকষ্ট ছিলো না, কিন্তু অন্যান্য সমস্যাগুলো সবে দানা বাঁধতে শুরু করেছিলো। এর অন্যতম কারণ তিনি ছিলেন সমকামী। সমকামীতা তখন রাশিয়ায় নিষিদ্ধ এবং এর শাস্তি ছিলো সাইবেরিয়ায় নির্বাসন। চাইকোভস্কি অনেকদিন তাঁর এই সত্য লুকিয়ে রেখেছিলেন। এক সময় হয়তো সেরে উঠবেন ভেবে এক নারী ভক্তকে বিয়েও করেছিলেন। কিন্তু সেই বিয়ে তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। বিবাহ বিচ্ছেদ তাকে একেবারে নিঃস্ব, অসহায় এবং একা করে দিয়েছিলো।


ব্যথার দান

ব্যক্তিগত জীবনে দুঃখ থাকলেও, চাইকোভস্কির সংগীত, বিশেষ করে সিম্ফোনি, ব্যালে, অপেরা এবং ওভারর্চারগুলো অনেক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং তাঁর নামও পৃথিবীর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি তিনি ১৮৯১ সালে নিউ ইয়র্কের কার্নেগী হলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কনসার্টও পরিচালনা করেছিলেন।

চাইকোভস্কির সবচেয়ে বড় অবদান সুরে। গ্লিংকা যে ঐতিহ্য চালু করে দিয়েছিলেন, চাইকোভস্কি সে পথে না গিয়ে তাঁর সুরগুলোকে নিজের মতো করে গড়ে নিয়েছিলেন। আপনি অবশ্যই তাঁর সুর শুনেছেন। রোমিও এন্ড জুলিয়েট সিনেমায় যে উন্মাতাল সুরটা শোনা যায় সেটা চাইকোভস্কির সুর। আর দ্য নাটক্র্যাকারের কথা কে না জানে, এটা পৃথিবীর অন্যতম পরিচিত ব্যালে।

চাইকোভস্কির জীবনের বেশীরভাগ সময় দুঃখ দুর্দশায় কাটলেও, দ্য নাটক্র্যাকারের আনন্দদায়ক সুর লেখার ক্ষমতা আমাদের বিস্মিত করে। কিন্তু তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টিটি মোটেও আনন্দদায়ক নয়। সিম্ফোনি নম্বর ৬-এর আরেক নাম দ্য প্যাথেটিক। এটি তাঁর সবচেয়ে ব্যক্তিগত এবং গভীর বোধসম্পন্ন সুর। চাইকোভস্কির ভিতরের যুদ্ধই তাঁকে দিয়ৈ প্যাথেটিকের মত একটা সিম্ফোনি লিখিয়ে নিয়েছে। অনেক সংগীতকারই মনে করেন যে এর লম্বা এবং উন্মত্ত সুরগুলো তাঁর মনের ভিতরে একটা গোপন জীবনকে পুষে রাখার অন্তর্বেদনারই প্রকাশ। সবচেয়ে মারাত্মক হলো এটার শেষ মুভমেন্টটা, যেটা শুনে মনে হয় যেন চাইকোভস্কির আর বাঁচার কোনো আশাই নাই।

এই আত্মজীবনীমূলক সুরটাই চাইকোভস্কির সবচেয়ে বড় অর্জন। এটা প্রথমবার পরিবেশনের এক সপ্তাহের মধ্যেই চাইকোভস্কি মৃত্যুবরণ করেন।

চাইকোভস্কি শুরু করা যেতে পারে:

Romeo and Juliet Overture‐Fantasy
Suite from the ballet Swan Lake, opus 20
Piano Concerto no. 1 in B‐flat minor, opus 23
Violin Concerto in D major, opus 35
Symphonies no. 4, 5, and (especially) 6

সের্গেই রকমানিনফ

১৯৪৩ সাল অব্দি বেঁচে থাকার পরেও সের্গেই রকমানিনফকে (১৮৭৩-১৯৪৩) বলা যায় একজন সত্যিকার রুশ রোমান্টিক। তাঁর বেড়ে ওঠা সেন্ট পিটার্সবার্গে এবং সেখানকার কনজার্ভেটরিতেই সংগীত নিয়ে লেখাপড়া। রাশিয়ান ওস্তাদ চাইকোভস্কি আর মাইটি ফিস্টফুলেরা যা যা দিয়েছেন তার সবই তিনি শিখেছিলেন। গ্রাজুয়েশনে চাইকোভস্কি তাঁকে সবার থেকে বেশী নম্বর দিয়েছিলেন।

রুশ বিপ্লবের সময় রকমানিনফ যখন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান তখন তিনি তাঁর নিজ দেশের চেতনা সঙ্গে করেই নিয়ে গিয়েছিলেন।

সের্গেই রকমানিনফ

সম্মোহিত সের্গেই

সংগীত জীবনের শুরুর দিকে রকমানিনফ দীর্ঘ সময় ‘কম্পোজার’স ব্লকের’ মধ্যে ছিলেন। তাঁর সিম্ফোনি নং ১ এর ভয়াবহ নেতিবাচক সাড়ার পরে রকমানিনফ একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন, সমস্ত উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলেছিলেন। তখন তিনি আর একটা স্বরও লিখতে পারতেন না। তারপর একদিন এক সম্মোহকের কাছ থেকে ফেরার পরেই তাঁর ব্লক কাটে।

সেরে ওঠার পর রাকমানিনফের প্রথম কাজটা ছিল সেকেন্ড পিয়ানো কনসার্টো। এটাই তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত সুর। তিনি এই সুরটাকে ওই সম্মোহকের প্রতি উৎসর্গ করেছিলেন।

সের্গেই ছিলেন একজন সাড়া জাগানো পিয়ানোবাদক এবং তিনি তাঁর বেশীরভাগ সংগীতই কোনো নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানে নিজেই বাজানোর জন্য লিখতেন। আজও তিনি তাঁর পিয়ানোর সুরগুলোর জন্যই বেশী পরিচিত। সংগীতকাররা তাঁকে ডাকে ‘রকি’ বলে। তাঁর সেকেন্ড পিয়ানো কনসার্টোকে বলা হয় ‘রকি ২’ এবং তাঁর সাংঘাতিক জটিল পিয়ানো কনসার্টো ৩-কে বলা হয় ‘রাক ৩’ বা ‘রকি ৩’।


রাকমানিনফের আরও সেসব সংগীত শুনতে হবে:

Piano Concerto no. 2 in C minor, opus 18
Piano Concerto no. 3 in D minor, opus 30
Rhapsody on a Theme of Paganini, opus 43
Symphony no. 2 in E minor, opus 27
Prelude in C‐sharp minor, opus 3, no. 2
Prelude in D major, opus 23, no. 4
Piano Sonata no. 2 in B‐flat minor, opus 36


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন