শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২০

পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (পর্ব ৭: ফ্রেডেরিক শোপান, রবার্ট শুম্যান)

ফ্রেডেরিক শোপান

হেক্টর বার্লিওজ যখন প্যারিসে থাকতেন তখন আরেক বিখ্যাত সংগীতকার কেবল মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছিলেন: ফ্রেডেরিক শোপান (১৮১০-১৮৪৯)। রোগা পাতলা এই ওস্তাদ পিয়ানোবাদকের বাড়ি পোল্যান্ডে। শোপান একাই পিয়ানো সংগীতের দুনিয়ায় বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। পিয়ানোতে কী কী করা সম্ভব সেই সম্পর্কে তিনি সবার ধারণাই বদলে দিয়েছিলেন।

 

শোপান

পোল্যান্ডের শৈশব 

এই লেখার অন্যান্য সংগীতকারদের মতোই ফ্রেডেরিক শোপানও ছিলেন এক বিস্ময় বালক। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি পোল্যান্ডে প্রথম সংগীত রচনা করেন। এর মাত্র এক বছর পর, তিনি কনসার্ট পিয়ানো বাদক হিসেবে যাত্রা শুরু করেন। তাঁর শৈশব জুড়ে ছিল পোল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী নাচের সুরে ভরা, যেমন পোলানাইজ এবং মাজুরকা। এইসব সুর তাঁর বাদবাকি জীবনেও প্রভাব রেখেছিলো।

ফ্রেডেরিক তাঁর সমস্ত সংগীত পিয়ানোতে বসেই বানাতেন এবং তিনি সেগুলোর উপরে ইম্প্রোভাইজ করতেও খুব পছন্দ করতেন। আসলে তিনি স্বরলিপি লিখতে খুবই অপছন্দ করতেন কারণ তাঁর মনে হতো এতে গানের গঠন আটকে যায়। তবে দুর্ভাগ্য যে, শোপানের তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি গানগুলো আর পাওয়া যায় না।

একুশ বছর বয়সে শোপান যখন প্যারিসে যান তখন তাঁর দক্ষতা দেখে সবাই তাক লেগে গিয়েছিলো। কেউ আগে কখনো এইরকম সুর শোনেনি। দুর্ভাগ্যবশত, তিনি এতোই রোগা এবং অসুস্থ ছিলেন যে, খুব বেশী কনসার্টে বাজাতে পারতেন না। তবুও, তিনি তাঁর সংগীত বেচে এবং পিয়ানো শিখিয়ে মোটামুটি চালিয়ে নিতে পারতেন। তিনি সাধারণত কম চাপ সামলাতে হয় এইরকম ছোটো ছোটো ‘সেলুন’ কনসার্টগুলোতে বাজাতেন, মানে ঘরোয়া কনসার্টগুলোতে। এই কাজে তিনি অসম্ভব সফল হয়েছিলেন।


ছোট্ট আঙুল কিন্তু বড় হৃদয়

শোপানের হাতের আঙুলগুলো ছিল ছোটো ছোটো। কিন্তু ওই ছোটো আঙুল দিয়েই তরুণ ফ্রেডেরিক কিবোর্ডের সর্বত্রই হাত পৌঁছাতে পারতেন। তাঁর সংগীতে স্বরের ঠাসবুনট ছিল, যেন একটা ঘুর্ণি, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে চলছে। তাঁর সুর কোমল, রোমান্টিক এবং শান্ত। শোপানের সুরে খুব তীব্র ক্ষোভ বা দুঃখ দেখা যায় না।

প্যারিসে শোপানের বিখ্যাত প্রেম ছিলো জর্জ নামের এক লেখিকার সঙ্গে। তিনি জর্জ স্যান্ড ছদ্মনামে লিখতেন। তাঁর আসল নাম ছিলো আমান্দাইন অরোরে লুসিল ডুপিন।

জর্জ পুরুষদের মত কাপড় পরতে পছন্দ করতেন, মদ খেতেন এবং ধূমপান করতেন এবং ফ্রেডেরিকের উপর ছিলেন চরম কর্তৃত্বশীল। একবার তিনি তাঁর কুকুরকে নিজের লেজ নিয়ে খেলতে দেখে শোপানকে বলেছিলেন, ‘আমি যদি তোমার মত প্রতিভাবান হতাম তাহলে এই কুকুরের কাণ্ড নিয়ে একটা সুর তৈরি করতাম।’

শোপান সঙ্গে সঙ্গে পিয়ানোতে গিয়ে ওয়াল্টজ ইন ডি-ফ্ল্যাট মেজর বা দ্য লিটল ডগ ওয়াল্টজ বানিয়েছিলেন।

যদি ভেবে থাকেন শোপানকে কখনো শোনেননি তাহলে ভুল হবে। বিখ্যাত ফিউনেরাল মার্চ, এতোই বিষাদময় যে, রোড রানার বা বাগস বানি কার্টুনে প্রায়ই ব্যবহার করা হতো। এটি আসলে একটি সোনাটার অংশ। তাছাড়া, ব্যারি ম্যানিলো এর বিখ্যাত গান ‘কুড ইট বি ম্যাজিক’ থেকে ব্যারির কণ্ঠ ফেলে দিয়ে শুধু পিয়ানোটুকু শুনুন, দেখবেন পেছনে বাজছে শোপানের প্রিলুড ওপাস ২৮, নং ২০ ইন সি মাইনর।

শোপান শুনতে হলে এই সুরগুলো অবশ্যই শুনতে হবে:

24 Preludes, opus 28
Ballade no. 4 in F minor, opus 52
Piano Concerto no. 1 in E minor, opus 11
Piano Concerto no. 2 in F minor, opus 21


রবার্ট শুম্যান

শুম্যান

রবার্ট শুম্যান (১৮১০-১৮৫৬) প্রথম সারির জার্মান রোমান্টিক সংগীতকারদের একজন। যদিও সেইসময় সবাই এই ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। শুম্যান ছোটোবেলাতেই কিবোর্ডে তাঁর প্রতিভার সাক্ষর রাখেন। দুর্ভাগ্যবশত, মিসেস শুম্যান, মায়েরা যেমনটা চান আরকি, তাঁর পুত্রের জন্য আরও ভালো কোনো পেশার কথাই চিন্তা করেছিলেন, যেমন: আইন পেশা। রবার্ট কোনোমতে ইউনিভার্সিটি অফ লিপজিগের আইন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন ঠিকই। দুর্ভাগ্যবশত লিপজিগেই মিসেস শুম্যানের পুত্রের সঙ্গে ফেলিক্স মেন্ডেলসনের দেখা হয়ে যায় এবং তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। অতি দ্রুতই বার্লিওজের মতো শুম্যানও সংগীতকার হওয়ার জন্য পড়াশোনা ছেড়ে দেন।

রবার্ট ফ্রেডরিক ওয়েইক নামের এক অসাধারণ শিক্ষকের কাছে তিনি পুরোদমে পিয়ানো শিখতে শুরু করেন এবং যৌবনের তাড়নায় একেবারে হুড়মুড়িয়ে পড়ে যান শিক্ষকের মেয়ে ক্লারার প্রেমে।


ক্লারাকে পাবার বেপরোয়া অভিযান

ক্লারা নিজেও এক বিস্ময়কর সংগীত প্রতিভা ছিলেন। নয় বছর বয়সে তিনি পিয়ানোর ওস্তাদ হিসেবে জার্মানি ভ্রমণ করেন এবং তখন ষোলো বছর বয়সেই তাঁর বেশ নামডাক হয়েছিল। বাপ ওয়েইক জানতেন না যে, যুবক-যুবতীদের যে কাজটা করতে নিষেধ করা হয় তারা সেটাই অবধারিতভাবে করে বসে। তাই ক্লারা শুম্যানকে বিয়ে করে ফেললেন। এই কাজ করতে তাঁদের পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে এবং মামলাও করতে হয়েছিলো। তবে, শেষপর্যন্ত তারা বিয়েটা করতে পেরেছিলেন।

ব্যক্তিগতভাবে, শুম্যানের জীবনের পরবর্তী সময়গুলো ছিল সবচেয়ে আনন্দের। তবে পেশাগতভাবে ছিল আকাল। মানুষের বাম হাতের অনামিকা সবচেয়ে কম নড়াচড়া করানো যায়। তো, বাম হাতের অনামিকার শক্তির বাড়াতে শুম্যান এক বুদ্ধি করেছিলেন। তিনি ওই আঙুলের সাথে একটা সুতো বেঁধেছিলেন এবং ঘুমানোর সময় সেই সুতোটি ঘরের সিলিঙের সঙ্গে বেঁধে রাখতেন। তাঁর হিসাবমতে এতে আঙ্গুলের টেন্ডনের প্রসারণ হবে এবং আঙুলে আরও শক্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু, বাস্তবে দেখা গেল তার ওই আঙুলটি পুরোপুরি অকেজো হয়ে গেলো।

এভাবে পিয়ানো বাজানোর ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবার পর শুম্যান সংগীত রচনার দিকে পুরোপুরি মনোযোগ দিলেন। তিনি বেশীরভাগ পিয়ানোর সুরই লিখেছিলেন, সেইসঙ্গে এবার যুক্ত হলো সিম্ফোনি এবং দুর্দান্ত সব পিয়ানো কনসার্টো।


সত্যিকার রোমান্টিক

সত্যিকার রোমান্টিক যুগে, সুরের গঠন, ধাঁচ, তার পেছনের যুক্তি এইসবের চেয়ে সুরের মাধ্যমে অনুভূতিকে প্রকাশ করতে পারাটাই ছিল মুখ্য। আর শুম্যানের এই ব্যাপারে কোনো জুড়ি ছিলো না। তাঁর ব্যক্তিত্ব বিপরীতমুখী বৈশিষ্ট্যগুলোর মাঝে দুলতো - বহির্মুখীতা আর কঠোর পরিশ্রম, অবসন্নতা আর আত্মমগ্নতা। তাঁর মনে হত যেন তিনি দুজন ভিন্ন মানুষ - এমনকি, তিনি এদের নামও দিয়েছিলেন: বর্হিমুখী সত্তার নাম ফ্লোরেস্টান আর অন্তঃমুর্খী সত্তার নাম দিয়েছিলেন ইউসেবিয়াস।

আমরা এখন শুম্যানের এই সমস্যার ডাক্তারি নাম জানি, তিনি ছিলেন একজন বাইপোলার (সম্ভবত বেটোভেনও তাই)। দুর্ভাগ্যবশত, তাঁর ভয়াবহ বিষণ্ণতা পরে হ্যালুসিনেশন হয়ে সারাজীবন ভুগিয়েছে। চুয়াল্লিশ বছর বয়সে, মধ্যজীবনের যন্ত্রণায় গিয়ে শুম্যান রাইন নদীতে ডুবে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। বার্লিওজের জীবনী না পড়ার কারণে তিনি হয়তো বুঝতে পারেন নাই আত্মহত্যা করা কতো কঠিন। বার্লিওজের মতোই শুম্যানকেও জাল দিয়ে জ্যান্ত উদ্ধার করা হয়। দুঃখের কথা হল তাঁর জীবনের শেষ দুই বছর পাগলাগারদে কাটে।

শুম্যানের সেরা কাজ হল তাঁর কিছু একক পিয়ানো সংগীত। এছাড়া বিশেষ করা শুনতে হবে:

Carnaval
Fantasiestücke (Fantasy Pieces)
Kreisleriana
Kinderszenen (Scenes from Childhood)
Symphony no. 2 in C major, opus 61
Symphony no. 3 in E‐flat major (Rhenish), opus 97
Piano Concerto in A minor, opus 54

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন