দ্বিতীয় ভিয়েনিজ স্কুল
বিংশ শতাব্দীর আগে, কয়েক মিলিয়ন সংগীতকার ভিয়েনায় থেকেছেন এবং সেখানে কাজ করেছেন। এঁদের মধ্যে আছেন হেইডেন, মোৎসার্ট, বেটোভেন, শুবার্ট, ব্রামস এবং তাঁদের পরিবারের লোকজন। এই ওস্তাদেরাই শত শত বছর ধরে ধ্রুপদী সংগীতের গঠন কাঠামো নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু, নতুন শতাব্দীর সূচনায়, ভিয়েনা নিবাসী একদল নতুন সংগীতকার সংগীতের খোল-নলচে পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। তাঁদেরকে মজা করে ‘সেকেন্ড ভিয়েনিজ স্কুল’ নামে ডাকা হয়। এঁদের দলপতি ছিলেন আরনল্ড শোয়েনবার্গ (১৮৭৪-১৯৫১)।
শোয়েনবার্গ শুরুতে ভ্যাগনার, স্ট্রস কিংবা মেহলারের মতো সুরেলা সুরই করতেন এবং তাঁর সুরগুলো কোন কি-তে তা চট করেই বলে দেয়া যেতো। কিন্তু কয়েক বছর পর তিনি সুরের টোনালিটি একেবারে ভাঙার উপক্রম করলেন। শোয়েনবার্গ অবশেষে সেটাকে চিরতরে ভেঙেই ফেলেছিলেন। তিনি এক নতুন ধরনের সংগীত রচনা শুরু করলেন যার কোনো কি নাই। এই জাতীয় সংগীতকে নন-টোনাল বা এটোনাল সংগীত বলে। এটোনাল সংগীত বেসুরো।
শোয়েনবার্গের তত্ত্বের ব্যাখ্যা
যদি পিয়ানোর মধ্য অক্টেভের ‘C’ স্বরটিকে সা মেনে পরবর্তী ‘C’ স্বর পর্যন্ত সবগুলো সাদা স্বর বাজানো যায় তাহলে C-এর কি-তে সারগাম বাজানো হল। পৃথিবীর প্রায় নিরানব্বই শতাংশ সংগীতকারই এইরকম কোনো না কোনো স্বরকে ‘সা’ মেনে সুর তৈরি করেছেন। এই কারণেই কিন্তু ধ্রুপদী সংগীতের বিভিন্ন সুরের নামকরণ করা হয় ‘সিম্ফোনি ইন ডি মেজর’ বা ‘সোনাটা ইন এফ মাইনর’ ইত্যাদি। ডি মেজর বা এফ মাইনর হলো ওই সুরের ‘কি’।
কিন্তু, এবারে ‘C’ এর স্বরগুলোর দিকে তাকানো যাক। দেখা যাচ্ছে, যে আমরা অনেকগুলো কালো রঙের বোতাম ছেড়ে দিয়ে বাজাচ্ছি। আরনল্ড শোয়েনবার্গ বললেন, এই কালো রঙের বোতামগুলোকে আমরা ‘কালো’ বলেই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানিয়ে দিতে পারিনা। আমার কাছে এদের সবার গুরুত্ব সমান। তাঁর নতুন ধরনের সংগীতের নাম হল ১২-টোন সংগীত। কারণ তিনি C থেকে C এর মধ্যকার ১২টা স্বরকেই সমান মর্যাদা দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন।
তিনি শুধুমাত্র ওই স্বরগুলোকে সমান মর্যাদাই দিলেন না, এদের ব্যবহারে জন্য নির্দিষ্ট নিয়মও নির্ধারণ করে দিলেন। তিনি বললেন, যদি কেউ C স্বরটা একবার ব্যবহার করেন, তাহলে পরবর্তী ১১টা স্বর ব্যবহার না করা পর্যন্ত তিনি আর C স্বরটা ব্যবহার করতে পারবেন না। আবার C ব্যবহার করতে হলে আগে বাকি ১১টা স্বর ব্যবহার করতে হবে!
এই নিয়ম করেই তিনি ক্ষান্ত হলেন না, আরও বহুদূর এগিয়ে গেলেন। তিনি ওই স্বরগুলোকে নতুন করে সাজালেন। যেমন: C, E-flat, G, A-flat, B, C-sharp, B-flat, D, F-sharp, F, A, E এবং নিজেকে বাধ্য করলেন একটা সুরে এই ক্রমেই স্বরগুলোকে বারবার ব্যবহার করবেন। যেকোনো তাল ব্যবহারের ব্যাপারে তাঁর আপত্তি ছিলো না, আপত্তি ছিলো না স্বরগুলোকে দিয়ে কর্ড বানিয়ে বাজাতেও, তবে শর্ত একটাই ওই ক্রম অনুসরণ করতে হবে।
যখন দেখা গেল এইভাবে কিছুই হচ্ছে না, তখন তিনি আরও কিছু নিয়ম তৈরি করলেন। প্রথমত, ১২টা স্বর উল্টো করে বাজানো যাবে (এটাকে বলে রেট্রোগ্রেড)। এমনকি তিনি এই ১২টা স্বরকে পাশাপাশি না বসিয়ে খাড়াভাবে বসাতেও রাজি হলেন। (একে বলে ইনভার্সন)। এবং বছরের পর বছর ধরে এই নিয়মগুলোকে নানাভাবে মিলিয়ে-মিশিয়ে তিনি বিভিন্ন ধরনের সুর তৈরি করতে শুরু করলেন। এই নতুন ধরনের সংগীতকে বলা হয় সিরিয়ালিজম।
সিরিয়াল সংগীত
বেশ কয়েক বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর, শোয়েনবার্গ আরও অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি কোন স্বরটা কাজে লাগাবেন সেটা বের করার জন্য গাণিতিক নিয়মকানুন প্রয়োগ করতে শুরু করেছিলেন। আজ আমরা এই জাতীয় সংগীতকে ১২-টোন সংগীত বা সিরিয়ালিজম বলে থাকি। এলবান বিয়ার্গ (১৮৮৫-১৯৩৫) এবং এন্টন ভেবার্ন (১৮৮৩-১৯৪৫) ছিলেন এই তরিকার লোক।
একগুচ্ছ সিরিয়াল সংগীত
দ্বিতীয় ভিয়েনিজ স্কুলের গবেষণা নিয়ে যদি আপনার আগ্রহ থাকে তাহলে এই সুরগুলো শুনতে পারেন:
● শোয়েনবার্গ: Pierrot Lunaire, opus 21: এই সুরে শোয়েনবার্গ একটা কৌশল খাটিয়েছেন, যেটার নাম স্প্রেশটিমে (স্পিক-ভয়েস)। এই পদ্ধতিতে গায়ক সঠিক স্বরে স্থির থাকেন না, বরং গলা কাঁপিয়ে স্বরের ওঠানামা করেন।
● বিয়ার্গ: Violin Concerto: এটা একটা ১২-টোন সংগীত। তবে এতে বাখ এবং অস্ট্রিয়ান লোকসংগীতের ছিটেফোঁটা আছে। যদিও এটা পুরোপুরি এটোনাল, তবুও এরমধ্যে একটা নিজস্ব ব্যক্তিগত গভীর রোমান্টিক বোধ আছে।
● ভেবার্ন: Six pieces for orchestra, opus 6: এক গুচ্ছ ছোট্ট ছোট্ট সুর, সব মিলিয়ে ১২ মিনিট দীর্ঘ। পুরোপুরি এটোনাল।
মার্কিন শিল্পীরা
দ্বিতীয় ভিয়েনিজ স্কুল যখন ইউরোপে জটিল, ধোঁয়াটে সংগীত তৈরি করছিলো তখন একেবারেই নতুন ধরনের আমেরিকান সংগীতও একটু একটু করে বেড়ে উঠছিলো। এই সংগীত আমেরিকার চেতনা নিয়ে আশাবাদী ও প্রত্যয়ী বার্তা তৈরি করেছিলো।
এরোন কোপল্যান্ড
এরোন কোপল্যান্ড (১৯০০-১৯৯০) হলেন আমেরিকার সবথেকে ভালোবাসা সিক্ত সংগীতকার। নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনের বাসিন্দা এবং রুশ অভিবাসী ঘরের সন্তান কোপল্যান্ড খাস আমেরিকার গ্রামাঞ্চলকে ধারণ করেছিলেন। তাঁর দুয়েকটা সুর শুনলেই মনে হয় যেন গমের ক্ষেতের নয়নাভিরাম দৃশ্য চোখে ভেসে উঠছে।
তাঁর পুরোনো সংগীত শুনলে অবশ্য মনে হয় যেন ইউরোপের ধারা তাঁর মধ্যেও কিছুটা বইছে। কিন্তু তিনি সেসব কাটিয়ে উঠেছিলেন। তিনি এমন একটা ধারা তৈরি করতে চেয়েছিলেন যেটা আমেরিকার মানুষদের কাছে ভালো লাগবে। তিনি তাঁর বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সুরের মধ্যে জ্যাজের তাল এবং হারমোনি প্রয়োগ করেছিলেন। তিনি বিখ্যাত আমেরিকানদের নিয়েও সংগীত রচনা করেছিলেন যেমন বিলি দ্য কিড।
কোপল্যান্ডের সবচেয়ে বিখ্যাত সংগীত হলো এপালাশেন স্প্রিং। এটি একটি ব্যালে যেখানে নব্য বিবাহিত কৃষকের এপালাশেন পর্বতের পাদদেশে নতুন খামারে যাবার গল্প বলা হয়েছে। এই সুরটা শুনে মনে হয় যেন গ্রামদেশে ভোরে শিশির পড়ছে, নব্য বিবাহিত বর-বউয়ের নতুন জীবন শুরু করার আনন্দ যেন ঝরে পড়ছে।
এপালাশেন স্প্রিং ১৯৪৪ সালে প্রথমবার পরিবেশনের পরে খুব নাম করেছিলো। সেই বছরই এর জন্য পুলিৎজার পুরষ্কার পান কোপল্যান্ড এবং আমেরিকান ধ্রুপদী সংগীতের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে যান।
জর্জ গ্রেশউইন
মার্কিন দ্বিতীয় বিখ্যাত সুরটি জর্জ গ্রেশউইনের (১৮৯৮-১৯৩৭)। তিনিও ব্রুকলিনে জন্ম নিয়েছিলেন। ঊনচল্লিশ বছর বয়সে ব্রেন টিউমারে গ্রেশউইন মারা যান, কিন্তু এই অল্প সময়েই তিনি একা একহাতে টিন প্যান এ্যালি এবং কার্নগী হলের মধ্যকার দ্বন্দ্ব মিটিয়ে যান।
যে সুরটি এই অসাধ্য সাধন করেছিল সেটা হল র্যাপসোডি ইন ব্লু, জ্যাজ ব্যান্ডের সঙ্গে বাজানোর উপযোগী পিয়ানো নির্ভর একটি ছোট্ট কনসার্টো। পরবর্তীতে এটি অর্কেস্ট্রার সাথেও বাজানো হয়েছে।
গ্রেশউইন এই সুরটি কনসার্ট শুরু হবার মাত্র এক সপ্তাহ আগে লেখেন। নিউ ইয়র্ক থেকে বোস্টন যাবার পথে ট্রেনের জানালা দিয়ে বিভিন্ন দৃশ্য দেখে আর শব্দ শুনে তিনি এই সুরটি লিখতে আগ্রহী হন। এই সুরটি ধ্রুপদী পিয়ানো কনসার্টোর সঙ্গে আমেরিকান জ্যাজ এবং ব্লুজকে মিলিত করেছে, কিন্তু গ্রেশউইন ধ্রুপদীর চেয়ে জ্যাজেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।
সংগীতের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকায় গ্রেশউইন খুবই অস্বস্তিতে ভুগতেন। তিনি এজন্য আরনল্ড শোয়েনবার্গের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। কিন্তু শোয়েনবার্গ তাঁকে শেখাতে রাজি হননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তোমাকে হয়তো বাজে শোয়েনবার্গ বানিয়ে ফেলব। কিন্তু তুমি গ্রেশউইন হয়েই দুর্দান্ত কাজ করছো।’
স্যামুয়েল বার্বার
স্যামুয়ের বার্বার (১৯১০-১৯৮১) আমেরিকান ধ্রুপদী সংগীতের তৃতীয় বিখ্যাত সুরটি রচনা করেছিলেন। আদাজিও ফর স্ট্রিংস নামের এই সুরটি আমাদের আবেগকে ছুঁয়ে যায়।
বার্বার ফিলাডেলফিয়ার কার্টিস ইন্সটিটিউট থেকে সংগীত শেখার পর এই সুরটি পঁচিশ বছর বয়সেই তৈরি করেছিলেন। ধীরে ধীরে এটা পুরো আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়েছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযু্দ্ধের সময় এটি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এবং মৃত সৈন্যদের স্মরণে এক অলিখিত সংগীতে পরিণত হয়।
সেই সময় ধ্রুপদী সংগীতের জগতে এটোনালিটি থেকে শুরু করে জ্যাজ, সবকিছু নিয়েই গবেষণা চলছিলো। ইউরোপীয় সংগীতকারদের মতো আমেরিকানরা ভিয়েনাতে যেতেন না। তবে, তাঁদের কেউ কেউ এই ধারায় বেশ সাফল্য পেয়েছিলেন। এই তালিকায় আরও রয়েছে:
● চার্লস আইভস (১৮৭৪-১৯৫৪): ইনি ছিলেন একজন বীমা বিক্রয় কর্মী। তিনি এস্টেট প্ল্যানিং ধারণার প্রবক্তা। তাঁর ছিলো শৌখিন সংগীত জীবন। তাঁর বেশীরভাগ কাজই ঘরের মধ্যেই হারিয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু যখন সেগুলো প্রকাশ পেল তখন চারিদিকে জয়জয়কার পড়ে গিয়েছিলো। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত সুর হলো দ্য আনএনসার্ড কোশ্চেন এবং সিম্ফোনি নং ২।
● লিওনার্ড বার্নস্টাইন (১৯১৮-১৯৯০): নিউ ইয়র্ক ফিলহারমোনিকের বিখ্যাত পরিচালক বার্নস্টাইন জ্যাজ এবং ধ্রুপদী সংগীতের সন্নিবেশ ঘটিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংগীত রচনা করেছিলেন। তিনি ওয়েস্ট সাইড স্টোরি নামের অন্যতম সেরা ব্রডওয়ে মিউজিক্যালটির স্রষ্টা।
● জন কেজ (১৯১২-১৯৯২): চান্স নামের এক উদ্ভট কৌশল আবিষ্কার করে সংগীতের দুনিয়া বিপ্লব ঘটিয়ে সবাইকে হতবাক করে দিয়েছিলেন এই সংগীতকার। চান্স ধারণায় চারটা রেডিওতে চারটা ভিন্ন ভিন্ন চ্যানেল একসাথে চালু করা হয়। এতে যে সম্মিলিত সুর তৈরি হতো সেটাই হলো সংগীত। তিনি ৪’৩৩” নামের একটা পিয়ানো পিসও তৈরি করেছিলেন যেখানে পিয়ানোবাদক পিয়ানোর ডালাটা খোলেন, তারপর সেখানে চার মিনিট তেত্রিশ সেকেন্ড চুপচাপ বসে থাকেন এবং তারপর ঢাকনা বন্ধ করে দেন।
● জন এডামস (জন্ম ১৯৫১): স্টিভ রাইখ (১৯৩৬) এবং ফিলিপ গ্লাসের (১৯৩৭) সাথে তিনি জন্ম দিয়েছেন মিনিমালিজম ধারার। এই ধারায় একই সুর বারবার ঘুরে ঘুরে আসে, কিন্তু তাল এবং হারমোনি পরিবর্তন হতে থাকে। এটা শুনতে আরামদায়ক এবং বেশীরভাগ সময়ই টোনাল।
বিংশ শতাব্দীর আমেরিকান ধ্রুপদী সংগীতকে বুঝতে হলে এই সুরগুলো শোনা আবশ্যক:
● কোপল্যান্ড: Appalachian Spring এবং Fanfare for the Common Man
● গ্রেশউইন: Rhapsody in Blue এবং Concerto in F for Piano Solo and Orchestra
● বার্বার: Adagio for Strings, Symphony no. 1 in one movement, opus 9; এবং Medea’s Meditation and Dance of Vengeance
● আইভস: The Unanswered Question
● বার্নস্টাইন: West Side Story
● কেজ: Sonatas and Interludes for Prepared Piano
● এডামস: Short Ride in a Fast Machine এবং Harmonielehre
● কোরিলিয়ানো: Symphony no. 1
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন