রোমান্টিক যুগ: প্রেমে পড়ার যুগ
মেন্ডেলসনের মৃত্যুর সময়েই সংগীতের এক নতুন যুগের সূচনা ঘটছিলো। ক্লাসিকাল যুগের সময়কালের যে বুদ্ধিবৃত্তিক, যৌক্তিক সংগীত, সেটা রোমান্টিক যুগে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেলো। এই যুগে অনুভূতি, আবেগ এবং ভিতরের কৌতুহলী শিশুসত্তাটি প্রাধান্য পেতে থাকলো। রোমান্টিক সংগীতকারগণ বেশীরভাগ সময়ই প্রকৃতি থেকে অনুপ্রাণিত হতেন, যেমন: সূর্যোদয়, বিদ্যুৎ চমক বা চাষের সময় ইত্যাদি।
কার্ল মারিয়া ভন ভেবার
আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন আর দশজন রোমান্টিক সংগীতকারের মত কার্ল মারিয়া ভন ভেবারও (১৭৮৬-১৮২৬) অসংখ্য রোমান্টিক ধারার সুর রচনা করেছেন। কিন্তু, সেই সময়ে সংগীতকে যাপন করে দেখাবার ব্যাপারে তাঁর যে অবদান সেই কারণেও তিনি স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।
ভেবারই হলেন প্রথম অর্কেস্ট্রা পরিচালক যিনি বাদকদের বসার জায়গা নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন, যে পদ্ধতিটি আজও ব্যবহৃত হচ্ছে। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি অর্কেস্ট্রার প্রতিটা অংশের জন্য আলাদা আলাদা রিহার্সাল করতেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে ব্যাটন হাতে নিয়ে অর্কেস্ট্রা পরিচালনা করতেন। এবং তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি তাঁর পরিচালিত সকল অংশের উপরেই অসাধারণ শৈল্পিক দক্ষতা দেখাতে পেরেছিলেন। এতোটুকু বলাও আসলে যথেষ্ট নয়। তিনি আসলে পৃথিবীর অন্যতম সেরা পিয়ানো বাদকদের একজন।
ভেবার জার্মান রোমান্টিক অপেরার জনক হিসেবেও পরিচিত। রোমান্টিক যুগের একজন পথপ্রদর্শক কার্লের মৃত্যুও হয়েছিল রোমান্টিক যুগের মধ্যভাগেই, টিউবারক্লোসিস রোগে। রোমান্টিক যুগের বহু শিল্পীই এই রোগে মারা গিয়েছিলেন।
ভেবারের বেশীরভাগ বিখ্যাত কাজই অপেরা নিয়ে, তবে তিনি পুরোপুরি বাজনা নির্ভর কাজও করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে পিয়ানো, ক্লারিনেট, হর্ন এবং বেসুনের জন্য কনসার্টো। তিনি দুটি বিরল সিম্ফোনিও লিখেছিলেন যেগুলো খুব বেশী শোনা যায়না।
ভেবার ছিলেন মেজাজকে ধরতে পারার ওস্তাদ। তিনি বিভিন্ন আবহ তৈরি করতেন। যেমনটা তিনি করে দেখিয়েছিলেন ডার ফ্রেসুৎজের এক ক্লাইম্যাক্সে ভরা একটা দৃশ্যে ভয়ে কাঁপা, খল এবং দৈব আবহ তৈরি করে। এটা ছিল একটা গথিক ভয়ের গল্প। আসলে সেই যুগটাই ছিল গথিক ভয়ের গল্পের যুগ। এই সময়ই মেরি শেলী ফ্রাঙ্কেনস্টাইন লিখেছিলেন।
ভেবার রোমান্টিক যুগের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করেছিলেন যা পরবর্তী সংগীতকারদের প্রভাবিত করেছিল। ভেবারের উল্লেখ যোগ্য কাজগুলো হল:
● Overture to Euryanthe
● Clarinet Concerto no. 2 in E‐flat major, opus 74
হেক্টর বার্লিওজ
সংগীতের ইতিহাসে বেশীরভাগ বিখ্যাত নামই বিখ্যাত এই কারণে যে তাঁরা সংগীতের নিয়মকানুন ভেঙেছিলেন। আর হেক্টর বার্লিওজ (১৮০৩-১৮৬৯) বিখ্যাত এই কারণে যে তিনি নিয়মকানুনের কোনো তোয়াক্কাই করতেন না ।
বার্লিওজ একদিক থেকে বেটোভেনের চেয়েও বড় আবিষ্কর্তা। বুঝতে হলে তাহলে বেটোভেনের সিম্ফোনি শোনার পরেই বার্লিওজের সিম্ফোনি ফ্যান্টাস্টিকটা শুনে দেখেন, বেটোভেনের মৃত্যুর মাত্র তিন বছর পরে তৈরি করা। অথচ, তার সুর শুনেই মনে হবে বার্লিওজ যেন অন্য গ্রহ থেকে এসেছেন।
বার্লিওজের জন্ম ফ্রান্সে, গ্রেনোবেলের কাছাকাছি এক স্থানে। তাঁর ডাক্তার বাবা চেয়েছিলেন তাঁর পুত্রও ডাক্তারই হোক। তবে প্যারিসে ডাক্তারি পড়ার সময়ই বার্লিওজ আরও অনেক বিখ্যাত সংগীতকারের মতোই ডাক্তারি পড়া ছেড়ে দিয়ে গানের জগতে ঢুকে পড়েন। কেন তাঁর এই পরিবর্তন? হয়তো সংগীতের প্রতি টান। কিংবা হয়তো শবদেহ ব্যবচ্ছেদ করার ভয়। তিনি লিখেছিলেন:
আমি যখন সেই মানুষের অঙ্গ-প্রতঙ্গে ভরা ওই ভয়ংকর ঘরটাতে ঢুকতাম এবং দেখতাম দেহ থেকে মাথা কেটে পড়ে আছে, যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে রক্তে ভেসে যাচ্ছে, কাকেরা অবশিষ্টাংশ কামড়াকামড়ি করে খাচ্ছে আর ইঁদুরেরা এককোণে মানুষের ভার্টিব্রার উপর কামড় বসাচ্ছে, তখন এক ভয়ংকর অনুভূতি আমাকে গ্রাস করে ফেলতো আর মনে হতো আমি এক্ষুনি জানলা দিয়ে লাফ দিয়ে বেরিয়ে বাড়ি চলে যাই। মনে হত যেন মৃত্যু আমাকে পেছন থেকে ধাওয়া করছে।
নতুন ধরনের সংগীত
বার্লিওজ প্যারিস কনজার্ভেটরিতে এক ভয়াবহ নিয়মানুবর্তি সংগীতকার লুইজি কেরুবিনির কাছে সংগীতের তালিম নিতে যান। দুর্ভাগ্যবশত, বার্লিওজ কেরুবিনির প্রত্যেকটা মতকেই অপছন্দ করতেন। বিশেষ করে নানান কৌতূহলী চিন্তাগুলোকে নাকচ করে দিয়ে সংগীতের নিয়মকানুনের অন্ধ অনুকরণ করতে বলার বিষয়টি। বিদ্রোহী বার্লিওজ নতুন ধরনের সুর করতে চেয়েছিলেন এবং এই অন্ধ নিয়মানুবর্তি লোক যে কিনা তাঁকে বুঝতেই পারে না তাঁর সঙ্গে আর থাকতে পারছিলেন না।
তাঁর সংগীত জীবনে তিনি সংগীতের প্রত্যেকটা ধারাকে নিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। এরমধ্যে হারমোনির নিয়মকানুন, সিম্ফোনির গঠন, সুর তৈরির নিয়ম, অর্কেস্ট্রায় বাদকদের সংখ্যা কোনোকিছুই বাদ যায়নি। যে প্রথাটিকে মনে হতো তিনি যা বলতে চান সেটি প্রকাশ করতে পারছে সেটিকে তিনি রেখে দিতেন। আর যদি মনে হতো পারছে না, তাহলে সেটা ভেঙে ফেলতেন।
সাতাশ বছর বয়সে বার্লিওজ সম্মানজনক প্রিঁ দ্য রোম জেতেন। এটি রোমে থেকে সংগীত শেখার যাবতীয় খরচ সমেত সংগীতকারদের জন্য চার বছর মেয়াদী একটি বৃত্তি। তবে, তিনি সেখানে খুব বেশী সংগীত চর্চার অবকাশ পাননি, তিনি শহরটা ঘুরে দেখাতেই বেশী ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এটা তাঁকে তাঁর পরবর্তী কাজের ক্ষেত্রে অনেক অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল, যার মধ্যে রয়েছে তাঁর অন্যতম সেরা একটি কাজ রোমান কার্নিভাল ওভার্চার।
হেক্টরের খুব বেশী এগোতে না পারার আরেকটা কারণ হল প্যারিসে ফেলে আসা ক্যামিলা নামের এক নারীর প্রতি তাঁর প্রেম। চার মাস রোমে থাকার পর তাঁর কানে খবর আসে যে ক্যামিলার নতুন প্রেমিক জুটেছে। এই খবরে তিনি ভেঙে পড়েন। নতুন প্রেমিকটিকে খুন করার জন্য তিনি একটা পিস্তল কেনেন এবং নারীর বেশ ধরে প্যারিসের উদ্দেশ্যে ট্রেনে রওনা দেন। ট্রেন ইতালির জেনোয়াতে পৌঁছানোর পর হেক্টরের মনে হলো যে ওই প্রেমিককে খুন করাটা অতি নাটকীয় কাণ্ড হয়ে যাবে। তার বদলে বরং মেডিটেরানিয়ান সাগরে ডুবে মরা যাক।
তাঁর আত্মহত্যা সফল হয়নি - জেলেরা তাঁকে জাল দিয়ে টেনে তোলে যাতে তিনি তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত সিম্ফোনিটা লিখতে পারেন। সিম্ফোনি ফ্যান্টাস্টিক ছিল সংগীত দিয়ে নারী পটানোর সবচেয়ে মোক্ষম পদক্ষেপ।
ফ্যান্টাস্টিকের গপ্পো
এক রাতে, বার্লিওজ রোমিও জুলিয়েটের একটা ইংরেজি পরিবেশনা দেখতে গিয়েছিলেন। যে অভিনেত্রী জুলিয়েটের চরিত্রে অভিনয় করছিলেন প্রথম দেখা থেকেই বার্লিওজ পাগলের মত তাঁর প্রেমে পড়ে গেলেন।
এই আইরিশ অভিনেত্রী হ্যারিয়েট স্মিথসন ফরাসি ভাষায় একটা শব্দও বলতে পারতেন না। আর এই ভাষাগত দূরত্বই বরং তাঁর আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলো। হেক্টর তাঁকে চিঠি, উপহার, প্রেমপত্র এইসব পাঠাতেন। যেখানে ওই অভিনেত্রী যেতেন তিনিও সেখানেই চলে যেতেন, যাতে কোনোদিন সুযোগ মেলে। এবং, এক পর্যায়ে তিনি তাঁকে চমকে দিতে সফলও হলেন।
হ্যারিয়েট স্মিথসনের প্রতি বার্লিওজের এই আকর্ষণই তাঁকে পাঁচ মুভমেন্টের এক অদ্ভুত সিম্ফোনি লিখিয়ে নিয়েছিল - সিম্ফোনি ফ্যান্টাস্টিক। সিম্ফোনিটার গল্প হল এক তরুণ শিল্পী এক সাড়া না দেওয়া নারীর প্রেমে পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এই আকর্ষণ ফুটিয়ে তুলতে বার্লিওজ ‘আইডি ফিক্সে’ বা ‘ফিক্সড আইডিয়া’ নামের একটা থিম রচনা করেছিলেন। এই ছোট্ট সুরের টুকরাটি পুরো সিম্ফোনির মধ্যে বারবার ঘুরে ঘুরে আসতো।
বার্লিওজের কালের সংগীতের থেকে সিম্ফোনি ফ্যান্টাস্টিক এতোটাই অন্যরকম ছিলো যে বার্লিওজকে পরিচালকের উদ্দেশ্যে নোট লিখে দিতে হতো: ‘দয়া করে এই স্বরলিপিটাকে লেখার ভুল ধরে নেবেন না। সুরটা যেমন লেখা হয়েছে তেমনই ঠিক আছে। দয়া করে সংশোধন করবেন না।’
আর, বার্লিওজের কাছে সিম্ফোনি ফ্যান্টাস্টিক সফল ছিল অন্য কারণে। এতে কাজ হয়েছিলো। হ্যারিয়েট স্মিথসন এটার প্রিমিয়ারে এসেছিলেন এবং দেখে খুবই খুশী হয়েছিলেন। কনসার্ট শেষ হলে তিনি হেক্টরের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, প্রেম করেছিলেন এবং পরবর্তীতে বিয়েও করেছিলেন।
এখানেই গল্পটা শেষ করতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ নয়। বিয়ের অনেক বছর চলে যাবার পরেও হ্যারিয়েট ফরাসি শেখেননি। এবং হেক্টরও কখনো ইংরেজি শেখেননি। এক পর্যায়ে এই নীরবতা চরমে উঠলে হেক্টর এবং হ্যারিয়েটের বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
বার্লিওজের বিশেষ কিছু সংগীত হলো:
● Symphonie fantastique
● Roman Carnival Overture
● The Corsair Overture
● Requiem
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন