সোমবার, ৫ অক্টোবর, ২০২০

মানবতা ও বিচ্ছিন্নতা

১৮৪৪ সালে লেখা মার্ক্সের অর্থনৈতিক এবং দার্শনিক পান্ডুলিপি তাঁর আর সবগুলো লেখার থেকে একদম আলাদা, এমনকি তরুণ বয়সে তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য লেখাগুলোর মধ্যে হেগেলের সমালোচনা করে লেখা লেখাগুলোর থেকেও্। পরিণত বয়সে তাঁর লেখাগুলো ছিল প্রধানত নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে – কখনো সামাজিক বিজ্ঞান (প্রধানত অর্থনীতি) বা কখনো রাজনৈতিক ভাষ্য, আর গুটিকতক সামাজিক বিজ্ঞানের মেথডলজি। কিন্তু, মার্ক্সের অর্থনৈতিক এবং দার্শনিক পান্ডুলিপি এই সবগুলো জ্ঞানকান্ড নিয়ে একসাথে আলোচনা করেছে; এটা মানুষের বৈশিষ্ট্য, এই পৃথিবীতে তার অবস্থান, তার নীতি-নৈতিকতা নিয়েও একটা তত্ত্ব হাজির করেছে। মার্ক্স পরবর্তী দার্শনিকেরা একে পৃথিবীর প্রতি মার্ক্সের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গী বলে মনে করেছেন এবং একে ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ’ নাম দিয়ছেন। উল্লেখ্য, দ্বন্দ্বিক বস্তুবাদ নামটি মার্ক্স নিজে কোনোদিন ব্যবহার করেননি। মার্ক্সের পরিণত লেখাগুলোতেও কখনো কোনো বিশ্ববীক্ষা নজরে পড়েনা। তবে, অর্থনৈতিক এবং দার্শনিক পান্ডুলিপিতে তা দেখা যায়। আর এই কারণেই ১৯৩০-এর দশকে এটি উদ্ধার হওয়ার পর চারিদিকে হৈচৈ পড়ে যায়।

অর্থনৈতিক এবং দার্শনিক পান্ডুলিপিতে দুটি ধারণা হাজির করেছেন মার্ক্স – বিচ্ছিন্ন শ্রম এবং মানবতা। দ্বিতীয়টি তো এখন মানবপ্রকৃতি ও তার নীতি-নৈতিকতার তত্বে এবং সেইসঙ্গে সামাজিক বিজ্ঞানের একটি মেথডলজিতে পরিণত হয়েছে। বিচ্ছিন্ন শ্রমের ধারণাটি দিয়েই আলাপ শুরু করা যাক। মার্ক্স দাবী করেছেন যে –

শ্রমিককে তার পণ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করার অর্থ শুধু এই নয় যে, এক্ষেত্রে শুধুমাত্র শ্রম নিজেই পণ্যে অর্থাৎ কোনো বাহ্যিক বস্তুতে রূপান্তরিত হল। শ্রমিককে তার পণ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করলে সেই পণ্য মুক্ত হয়ে তার নাগালের বাইরে চলে যায় এবং তার কাছেই অচেনা হয়ে যায়। এরপর সে স্বতন্ত্র ক্ষমতা দিয়ে তার সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। যে পণ্যে তিনি জীবন ঢেলেছিলেন সেটিই তখন তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।(Marx et al., 1992) 

এর অর্থ কী? স্বাভাবিকভাবে বোঝা যাচ্ছে যে, পণ্যটিতে আর শ্রমিকের মালিকানা থাকে না, মনিবের মালিকানা হয়ে যায়। কিন্তু এখানে আরও কথা থেকে যায়। পড়ে মনে হচ্ছে যেন পণ্যটির নিজের জীবন আছে এবং সে শ্রমিকের বিরুদ্ধে কাজ করছে। সাধারণভাবে আমাদের মনে হতে পারে যেন, শ্রমিককে দিয়ে এতোই কাজ করানো হয়েছে যে তিনি চাহিদার চেয়েও বেশী পণ্য উৎপাদন করে ফেলেছেন। ফলে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে এবং চাহিদা না থাকার কারণে শ্রমিকও তার কাজ হারিয়েছেন। বা, মনে হতে পারে, পুঁজিপতিরা পণ্য বিক্রি করে টাকা আয় করে সেই টাকা দিয়ে এমন মেশিনপত্র কিনেছেন যাতে আর শ্রমিক পুষতে হচ্ছে না। কিন্তু, এইসব চিন্তার পাশাপাশি আরও একটা চিন্তা এখানে আছে যা মার্ক্স বুঝাতে চেয়েছেন: পণ্য হল পাগলা ঘোড়ার মত। পুঁজিবাদ এমন ক্ষমতাকে উস্কে দেয় যাকে সে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পরে না। আজ আমাদের বৈশ্বিক পরিবেশের সংকট যেভাবে মানব অস্তিত্বকে বিপন্ন করে ফেলেছে সেদিকে নজর দিলে তার প্রমাণ মেলে হাড়ে হাড়ে। মার্ক্সের সময়ে, ‘অতিরিক্ত উৎপাদনের সংকটই’ ছিল প্রধান সংকট। এই সংকট তৈরি করতো মন্বন্তর, অতিরিক্ত উৎপাদনের ফলে খোদ শ্রমিকই সেখানে সবার আগে মরতো।

তবে মার্ক্স এই লেখায় বিচ্ছিন্নতাকে বিশ্ব বাজারের বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখেন নাই, বরং, শ্রমপ্রণালীর বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখেছেন। তাঁর মতে পণ্য শ্রমিকের কাছেই অধরা হয়ে যায় কারণ –

প্রথমত, শ্রম নিজেই শ্রমিকের কাছে তার সত্তার বাইরের কিছু একটা মনে হয় অর্থাৎ, তার নিত্যসত্তার অংশ হয়ে থাকে না। কাজেই সে কাজে মনতো বসাতে পারেই না, উল্টো নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং অসহায় ও অসুখী বোধ করে। তার মধ্যে মানসিক এবং শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্য জাগে না, বরং স্বাস্থ্য আর মন দুটোই ভেঙে যায়। শ্রমিক শুধুমাত্র যখন কাজ করেন না তখনই নিজেকে ফিরে পান; যতক্ষণ কাজ করছেন ততক্ষণ নিজেকে খুঁজে পান না। কাজ না করলেই তার শান্তি, কাজ করলেই অশান্তি। কাজেই তার এই শ্রম স্বেচ্ছায় নয়, অনিচ্ছায়। এটাই হল জবরদস্তি শ্রম। কাজেই এই শ্রম নিজেকে তৃপ্ত করার শ্রম নয়, অন্যের চাহিদা পূরণের শ্রম।(Marx et al., 1992) 

সহজ কথায় বলা যায়, শ্রমিকের সময় যেন তার নিজের সময় নয়, সেই সময়ের মালিক তার মনিব। কিন্তু, গভীরভাবে চিন্তা করলে এটা শ্রমিকেরই সময়, মালিকের নয়। শ্রম যে সম্পত্তি হিসেবে বিক্রি করা যায়, আলাদা করা যায় – এই ধারণার সাথে আমরা এতোই পরিচিত যে আমাদের কাছে এই নিয়ে আর খটকা লাগে না। কিন্তু লাগা উচিত। আমার সময়টা আমার মালিক দখল করেছে কারণ আমিই তাকে এটা বিক্রি করেছি। যেমনটা আমার পূর্বপুরুষেরা করেছে।

কিন্তু সমস্যা এখানেই শেষ নয়, আরও কিছু আছে যা মানবতার সাথে সম্পর্কিত। সেই নিয়ে আলাপ একটু পরেই শুরু করছি। শ্রমিকের শ্রম তার জীবনের চাঞ্চল্যের প্রকাশ, এবং সেটার একটা পূর্ণতা তো অন্তত থাকা চাই; কিন্তু সেটা নাই। তার বদলে মজুরি নামের এক অচেনা জিনিস হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার সাথে পণ্যের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নাই।

এই আলোচনায় বিচ্ছিন্নতার এই ধারণা মার্ক্সের পরবর্তী দুটি ধারণার স্তম্ভ হিসেবে কাজ করছে, যার প্রথমটি হল শোষণের  ধারণা (Exploitation)। শোষণের ক্ষেত্রে একটা বিষয় মার্ক্স পরিষ্কার দেখিয়ে দিয়েছেন যে, শ্রমিকের শ্রম এবং পণ্য পরস্পরের বিপরীতে অবস্থান করে কারণ পণ্যটি তৃতীয় কারো হাতে কুক্ষিগত থাকে – পুঁজিপতি। আর দ্বিতীয়টি হল উৎক্রমণের ধারণা (Inversion)। উৎপাদক ও পণ্যের স্বাভাবিক সম্পর্ক হল উৎপাদক পণ্যের উপর কর্তৃত্ব করবে; কিন্তু বিচ্ছিন্নতার সম্পর্কের মধ্যে পড়ে উল্টো ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। মার্ক্সের উৎক্রমণের ধারণাটি তাঁর পরিণত লেখাগুলোতেও দেখা যায়। যেমন, কমিউনিস্ট ইস্তেহারে তিনি বলছেন:

বুর্জোয়া সমাজে খুচরা শ্রম পুঞ্জীভূত শ্রমকে (যেমন: পুঁজি) বড় করার কাজে লাগে। কমিউনিস্ট সমাজে, পুঞ্জীভূত শ্রম শ্রমিকের অস্তিত্বকে আরও সুসংহত করতে কাজে লাগে।

বুর্জোয়া সমাজে তাই, শ্রমের উপর পুঁজিকে কতৃর্ত্ব করতে দেখা যায়; কমিউনিস্ট সমাজে, পুঁজির উপর কর্তৃত্ব করে শ্রম। বুর্জোয়া সমাজে পুঁজি তাই স্বাধীন এবং তার একটা ব্যক্তিত্ব থাকলেও, জীবন্ত মানুষ সেখানে অধীন এবং তার কোনো ব্যক্তিত্ব নেই।(Marx et al., 1998)

তবে অর্থনৈতিক এবং দার্শনিক পান্ডুলিপিতে যেভাবে উৎক্রমণের ধারণাটি এসেছে সেটি বুঝতে হলে আমাদের মার্ক্সের মানবজাতি এবং প্রকৃতিতে তাদের অবস্থান সম্পর্কিত ধারণার সাথে পরিচিত হতে হবে। মার্ক্সের মতে কোনো পশুর স্বভাব বুঝতে হলে শুধুমাত্র সেই পশুটি কেমন সেটুকু দেখলেই চলবে না বরং সে কি উৎপাদন করে সেটিও দেখতে হবে। যেমন: আমরা পিঁপড়া নিয়ে পড়তে গেলে পিঁপড়ার বাসা নিয়েও জানতে হবে, তেমনি মানুষ নিয়ে পড়তে গেলে তার অন্যান্য দিকগুলোর দিকেও নজর দিতে হবে:

মানুষের বৈষয়িকতাই প্রমাণ করে যে মানুষ একটা প্রজাতিনির্ভর-সত্তা। তার প্রজাতিবদ্ধ জীবনকে ঘিরেই উৎপাদনের সমস্ত আয়োজন। এর মাধ্যমে প্রকৃতি তার শ্রম এবং বাস্তবতার মধ্যে ফুটে ওঠে। কাজেই শ্রমের উদ্দেশ্যই হল মানবজাতির প্রজাতি-সত্তার উদ্দেশ্য পূরণ করা। মানুষ কেবলমাত্র বুদ্ধি ও চৈতন্য খাটিয়েই পুনরুৎপাদন করে না, বরং গায়ে-গতরে পরিশ্রম করেও করে। কাজেই, তার মনে হয় যেন বুঝি সে তার নিজের সৃষ্টি করা জগতে বাস করছে।(Marx et al., 1992)

ব্যাপক বিচ্ছিন্নতার পরেও আজকের হাটে-বাজারে, কলে-কারখানায় আমরা কেমন মানুষ দেখতে পাই? 

মেহনতের ইতিহাস এবং তার উদ্দেশ্যের যে বিকাশ মানুষ করেছে সেখানে থেকেই তার এই অত্যাবশ্যক ক্ষমতা খোলা বইয়ের মত পরিষ্কার বোঝা যায়। বোঝা যায় মানুষের মনের ভিতরে এখনো সেসব তাজা রয়েছে।(Marx et al., 1992)

মেহনতের সম্পর্কই হল প্রকৃতির সত্যিকার সম্পর্ক, আর তাই তা মানুষের কাছে প্রকৃতির বিজ্ঞান। যদি এটুকু বোঝা যায়, তাহলে মানুষের অত্যাবশ্যক ক্ষমতা, মানুষের মানব-প্রকৃতি বা স্বাভাবিক প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা যা কিছু ধারণ করেছি সেসবও বোঝা যাবে।(Marx et al., 1992)

মার্ক্স বলছেন যে, বিদ্যমান শিল্পব্যবস্থায়, মানুষের মর্ম কেবলমাত্র বিচ্ছিন্নভাবে পাওয়া যায়; তবে অন্তত পাওয়া যায়। কারণ  জ্ঞান দিয়ে পরিবর্তন করে ফেলা আমাদের এই দুনিয়া এবং তার উৎপাদনশীল কাজকর্মের মধ্যেই আমাদের প্রজাতির সুনির্দিষ্ট কিছু সক্ষমতা প্রকাশ পেয়ে যায়। তাহলে, এখন প্রশ্ন হল আমাদের এই বৈশিষ্ট্য উন্মোচনের মাধ্যমে কেমন করে আমরা অন্যান্য প্রজাতি থেকে আলাদা হই? মার্ক্সের ভাষ্যে;

বৈষয়িক দুনিয়ার এই যে সমাহার, এর পেছনে যে অজৈব চরিত্র, এটাই হল মানুষের চেতানসম্পন্ন প্রজাতি-সত্তার প্রমাণ, যেমন: এই যে তারা অন্যান্য প্রজাতিগুলোকে নিজের বলে মনে করে অথবা, নিজেকেই আলাদা প্রজাতি-সত্তা বলে ভাবতে পারে। একথা সত্য যে পশুপাখিরাও উৎপাদন করে। তারা বাসা বাঁধে, একসাথে থাকে, যেমন মৌমাছি, বীবর, পিঁপড়া ইত্যাদি। কিন্তু তারা কেবলমাত্র তাদের আশু-প্রয়োজনটুকুই মেটায়, বড়জোড় তাদের বাচ্চাকাচ্চাদের প্রয়োজনটুকু। তারা একমুখী উৎপাদন করে, কিন্তু মানুষ উৎপাদন করে বৈশ্বিক। পশুপাখি কেবলমাত্র বাধ্য হয়ে উৎপাদন করে, কিন্তু মানুষ তার বাহ্যিক প্রয়োজনের বাইরেও উৎপাদন করে, এবং সত্যিকার অর্থেই প্রয়োজন ছাড়াও উৎপাদন করে…পশুপাখিরা তাদের নিজ নিজ প্রজাতির পক্ষে যেমন সম্ভব তেমন উৎপাদন করে, তেমনি মানুষ প্রতিটি প্রজাতির জন্য উৎপাদন করতে জানে এবং প্রতিটা কাজকেই সে নির্দিষ্ট উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। তাই মানুষ সৌন্দর্যের নিয়ম মেনেই উৎপাদন করে।(Marx et al., 1992)

শুধুমাত্র উৎপাদনে দূরদর্শিতাই আমাদের উৎপাদনের সমস্ত কথা নয়, একটি অংশ মাত্র। আমরা হাতিয়ার ব্যবহার করি, আমাদের উৎপাদিত পণ্য ব্যবহার করি, আমরা বিভিন্ন উপায়ে উৎপাদন করি, এবং আমাদের উৎপাদনক্ষমতার বিকাশও করি। পশুপাখিরা একই জিনিসি শত-শত বছর ধরে উৎপাদন করে যায় এবং অন্যান্য প্রজাতিগুলোর উপর নির্ভর করে। উৎপাদক হিসেবে আমাদেরও একটা ইতিহাস আছে, এবং আমরা প্রকৃতির বিভিন্ন তারতম্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েও টিকে থাকতে পারি। তর্ক উঠতে পারে যে, মানবজাতির বিবর্তন মূলত শ্রমজীবির বিবর্তন। আরও বলা যেতে পারে, মানুষের বিবর্তন এক্সোসোমাটিক, অর্থাৎ, আমরা আমাদের দেহের অতিরিক্ত বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করে শক্তিশালী হতে পারি। সুতরাং, আমরা আসলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের বিবর্তনকেও রোধ করে দিতে পারি, কারণ, আমরা যতো দ্রুত জিনিসপত্র তৈরি করে নিজেদের জীবনমানের পরিবর্তন ঘটাতে পারি, প্রাকৃতিক নির্বাচন ততো দ্রুত কাজ করতে পারে না। 

যেহেতু মার্ক্স এই লেখাটি ডারউইনেরও আগে লিখেছেন, কাজেই এখানে একটু এনার্ক্রোনিস্টিক হয়েই বলতে হচ্ছে। তবে আশা করি এগুলো মূল কথাটা ধরতে সাহায্য করবে:

১. মানুষের স্বভাবকে তার উৎপাদনশীল পরিবেশের মধ্যে সহজেই চেনা যায়।

২. আমরা একটু একটু করে জমিয়ে উৎপাদন করি, অন্যান্য প্রজাতির মত বারবার নয়।

৩. যেহেতু আমরা কেমন থাকব সেটা নির্ভর করে আমাদের পরিবেশের উপর, কাজেই, পরিবেশ পরিবর্তন হয়ে গেলে আমরাও পরিবর্তিত হব। 

৪. আমরা শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্যই উৎপাদন করি না, কখনো কখনো নিজেদের স্বার্থে আবার কখনো কখনো সৌন্দর্যের স্বার্থেও করি।

আর এই পয়েন্টগুলো থেকে মার্ক্স মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে দুটি সিদ্ধান্ত টেনেছেন: প্রথমত, মানব প্রকৃতির মোদ্দাকথা হল উৎপাদনশীল শ্রম: ‘কোনো প্রজাতির যাবতীয় বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ, তার প্রজাতি-বৈশিষ্ট্য তার কর্মজীবনের বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে আর মুক্ত চেতনাসম্পন্ন কাজকর্মই মানুষের প্রজাতি-বৈশিষ্ট্য নির্মাণ করে।’(Marx et al., 1992) আর দ্বিতীয়ত, প্রকৃতি এবং সামাজিক পরিবেশ পরিবর্তন হয় বলেই মানুষের মনোজগতেও কালে কালে পার্থক্য হয়।

এবার আবার বিচ্ছিন্নতার প্রসঙ্গে ফেরা যাক। উৎপাদনশীল শ্রমের সাথে আমাদের যে বিচ্ছিন্নতা সেটাকে মার্ক্স সম্ভবত খুবই সূক্ষ্ণভাবে দেখেছেন। আমাদের উৎপাদনশীল কাজকর্মের মধ্যে থাকতেই ভালো লাগে, বিশেষ করে শিল্পীদের। কিন্তু, শ্রমিকরা কাজের সময় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না, তাঁরা সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন বিশ্রাম নিতে।

আমরা আমাদের কর্মজীবনকে শুধুমাত্র টাকা-পয়সা আয়ের উপায় হিসেবে দেখতেই অভ্যস্থ। ভাবি আমাদের অবসর জীবন চালিয়ে নেবার সংস্থান হল এই কর্মজীবন। মার্ক্স কিন্তু বলছেন না যে আমাদের উচিত এই বিচ্ছিন্ন শ্রমকে উপভোগ করার চেষ্টা করা। বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে সবচেয়ে বড় ভুল ধারণাটি হল, এটা বোধহয় ব্যক্তিগত কোনো ব্যাপার এবং যথাযথ পার্সোনেল ম্যানেজমেন্ট করে বোধহয় এটা কাটানো সম্ভব। এর চলতি নাম হল, একঘেয়ে লাগা। কিন্তু তা নয়, যদি একজন শ্রমিকের সময় এবং পণ্য দুটিই অন্যের সম্পত্তি হয়ে থাকে তাহলেই তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। কাজটা তার ভাল লাগলেও তিনি বিচ্ছিন্নই থাকেন। বরং, মার্ক্স বলছেন যে, শ্রমের এখন যে চেহারা তার থেকে একদম ভিন্ন চেহারা হবে মানুষের উপযোগী সমাজে। শ্রমিক জানবেন যে তিনি যা উৎপাদন করেছেন সেটি তার কাজেই লাগবে। আবার একইসাথে বুদ্ধিমান এবং সৃষ্টিশীল মানুষদের জন্য উপযোগী কাজের ব্যবস্থাও করা হবে। 

সৃষ্টিশীল উৎপাদন মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য। সেখান থেকে মানবিকতাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললে সম্পূর্ণ নতুন ধরণের নৈতিকতার উদ্ভব হয়। এটা মানুষকে ইগো-তাড়িত করে ফেলে। সবাই সবার সঙ্গে শুধুমাত্র টিকে থাকার প্রতিযোগিতায় নেমেছে, এটা শুধু সেরকমই একটা বার্তা দেয়; শুধু তাই না, আমাদের মূল্যায়ন করার সহজাত ক্ষমতাও নষ্ট করে দেয় এবং শেষ পর্যন্ত চেনাজানা মানুষদের মধ্যকার সম্পর্কগুলো নষ্ট করে।

ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা আমাদেরকে এতোই বেকুব আর একচোখা করে দিয়েছে যে আমাদের খালি মনে হয় কোনো জিনিস আমাদের করায়ত্তে আসলেই সেটা আমাদের হয়ে যায়। সেটা আমাদের পুঁজি হিসেবে থাকলেই বা আমাদের দখলে থাকলেই কিংবা যা আমরা খেতে, পান করতে, পড়তে, অভ্যাস করতে পারি, এককথায়, ব্যবহার করতে পারি তাই বুঝি আমাদের।(Marx et al., 1992) 

খনির ব্যবসায়ী খালি ব্যবসায়িক স্বার্থ খোঁজে, খনিজের সৌন্দর্য বা বৈশিষ্ট্য নয়; তার চাই কেবল খনির মজুর – যার সেই অনুভূতি নাই।(Marx et al., 1992)

কাজ যেমন আমাদের চরিত্র এবং আমাদের সৃষ্ট দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত, তেমনি আমাদের অনূভুতিকেও সেই বস্তুগত দুনিয়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে। বস্তুকেন্দ্রীক সেইসব অনুভূতিকে গ্রাস না করে ধারণ করাটাই মার্ক্সের মতে, বিচ্ছিন্ন করে ফেলা না হলে, আমাদের জন্য স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হত। কারণ, চরিত্র ‘অজৈব বস্তু’(Marx et al., 1992)। অজৈব বস্তু হওয়ার কারণে, আমাদের জীবনের জন্য এটি দরকার এবং এর যত্ন নেওয়াও দরকার।

মানব চরিত্র এবং মার্ক্স নিয়ে দুটি কথা প্রায়ই শোনা যায়: ১. তিনি নাকি মানব চরিত্রের ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপ করেননি এবং এই কারণেই তার সমস্ত তত্ত্ব নাকি দুর্বল হয়ে গেছে; এবং ২. তিনি মানব চরিত্রে বিশ্বাসই করতেন না। এবার এই বিষয়দুটো দেখা যাক।

যারা বলেন যে মার্ক্স নাকি মানব চরিত্রকে উপেক্ষা করে গেছেন তাদের মতে ‘মানব চরিত্রের’ সংজ্ঞা হল ইগোকেন্দ্রীকতা, স্বার্থপরতা। মার্ক্স অস্বীকার করেননি যে বিদ্যমান পুঁজিবাদী সমাজে বেশীরভাগ মানুষই বড্ড বেশী ইগোতাড়িত। যেহেতু তাদেরকে টিকে থাকতে হলে তার পাশের মানুষটাও পরাজিত করতে হয়, কাজেই তারা এমন হতে বাধ্য। পুঁজিবাদী সমাজের দিকে তাকিয়ে মানব চরিত্র স্বার্থপর বলাটা পুঁতিগন্ধময় কারখানার শ্রমিকদের দিকে আঙ্গুল তুলে বলা যে, কাশিই হল মানব চরিত্রের মত ব্যাপার। মানব চরিত্র নিয়ে মার্ক্সের দৃষ্টিভঙ্গীর মোদ্দাকথা হল, আমরা নিজেদের পরিবেশের পরিবর্তন করার মাধ্যমে নিজেদেরও পরিবর্তন করি। কোনো নির্দিষ্ট পরিবেশে মানুষ কেমন আচরণ করবে সেটা বুঝতে হলে দুইটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে: সাধারণ মানব চরিত্র এবং যেভাবে কোন নির্দিষ্ট পরিবেশ সেই চরিত্রের উপর প্রভাব রাখবে। যেমনটা মার্ক্স উপযোগবাদী দার্শনিক জেরেমি বেনথামের সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন:

কুকুরের জন্য কোনটা দরকারি সেটা জানতে গেলে মানুষকে কুকুরের স্বভাব জানতে হবে। এই স্বভাব শুধুমাত্র উপযোগের তত্ত্ব থেকে জানা যাবে না। একই কথা মানুষের বেলায়ও খাটিয়ে যিনি মানুষের চালচলন, সম্পর্কসহ যাবতীয় কাজকর্মকে বিচার করতে যাবেন উপযোগীতার নীরিখে, তাকে সবার আগে মানুষের সাধারণ চরিত্রের ব্যাপারে তো অন্তত জানতে হবে, এবং তারপর জানতে হবে মানুষের স্বভাব কালের বিবর্তনে কতোটা বদলেছে। বেনথাম এসবকিছু করার চেষ্টাও করেন না। কাঠখোট্টা সরলতার সঙ্গে তিনি অনুমান করেছেন যে আধুনিক পাতি-বুর্জোয়া সমাজ, বিশেষ করে ইংরেজ পাতি-বুর্জোয়া সমাজের লোকেরাই হলেন স্বাভাবিক মানুষ।(Marx et al., 1981)

অবশ্যই কোনোকিছুর স্বভাব বলতে সবসময় সেইসব বিষয়গুলোকে বোঝায় না যেগুলো খালি চোখে দেখা যায়, বরং বিভিন্ন পরিবেশে কোন বিষয়গুলো ধরা পড়বে আর কোনগুলো পড়বে না সেটাকেই বোঝায়। শুন্য থেকে একশ ডিগ্রী সেলিসিয়াস তাপমাত্রায় পানি তরল থাকে, এটা সেরকম বিষয় নয়। এটা মানুষের ইগোকেন্দ্রীকতাও নয়; এটা হল এমন একটা সমাজের সাপেক্ষে তাদের ইগোতাড়িত হওয়ার বিষয়, যেখানে পাশের মানুষটার ক্ষতি করলে নিজে বাঁচা যায়। বাজার অর্থনীতির বাইরে, উৎপাদনশীল শ্রমের মধ্যে আনন্দ বলতে আজও মানুষ অপরকে আনন্দ দেওয়াই বোঝে। কেউ খাবেনা জানলে রাঁধুনী যেমন রান্না করে কোনো আনন্দ পান না।

মানব চরিত্রের এই ধারণার সঙ্গে হব্‌সের ধারণারও সংঘর্ষ হয়। হব্‌সের মতে মানুষের ক্ষমতার প্রতি অসীম লোভ রয়েছে এবং এই লোভ সবসময় তাদেরকে ‘একে অপরের বিরুদ্ধে’ বারবার যুদ্ধে উৎসাহিত করবে যদি সেখানে শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ না থাকে। হব্‌স যদি সঠিক হন মার্ক্স তবে ভুল, তাহলে মার্ক্স প্রায়ই যে আধুনিক কমুনিজমের কথা বলেন, যেখানে প্রয়োজন অনুযায়ী উৎপাদন হবে এবং কোনো রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব থাকবে না, সেটা অসম্ভব হয়ে যাবে। কিন্তু ঘটনা হল পুঁজিবাদী সমাজে যারা হব্‌সের মতোই চিন্তা করেন তাদের ধারণা তারা চিরকাল এইরকম সমাজেই থাকবেন। এটা মার্ক্সকে মোটেও বিচলিত করেনা, বরং, বিদ্যমান পরিবেশে মানুষের স্বভাব কেমন হতে পারে সেটারই মার্ক্সের সপক্ষে প্রমাণ দেয়।

এটা সেইসব মার্ক্সবাদী যারা বলেন যে মার্ক্স মানব চরিত্রে বিশ্বাস করতেন না, তাদের জন্যও একটা উত্তর। তারা সাধারণত বলতে চান যে, তিনি মনে করতেন মানুষ সব সমাজে সমান হয় না। তিনি মানব চরিত্রে বিশ্বাস করতেন, কিন্তু এও মনে করতেন যে, বিভিন্ন ধরণের সমাজে বিভিন্ন ধরণের মানুষ থাকাটাও মানব চরিত্রেরই অংশ।

অর্থনৈতিক এবং দার্শনিক পান্ডুলিপির ৩৬২-৩৬৩ পৃষ্ঠায় মার্ক্স প্রশ্ন তোলেন মানুষের বেচাকেনা আইনসঙ্গত কিনা? মার্ক্স দেখেন যে, পুঁজিবাদী সমাজ যতোটা আবেগতাড়িত, তার অর্থনীতি ঠিক ততোটাই অনৈতিক। তিনি আরও লক্ষ্য করেন যে পুঁজিবাদের সঙ্গে মানানসই এক ধরণের নৈতিকতা রয়েছে:

এটা সত্য যে নৈতিকতা হল সন্ন্যাসব্রতের মত কিন্তু প্রবল কৃচ্ছতাসাধনও, আবার সন্ন্যাসব্রতের মত কিন্তু উৎপাদনশীল দাসের মতোও…আত্মসত্তাকে উপেক্ষা করা, জীবনকে উপেক্ষা করা এবং যাবতীয় মানবিক প্রয়োজনকে উপেক্ষা করাই এর প্রধান মতাদর্শ। যতো কম খাবেন, বইপত্র কিনবেন, থিয়েটারে যাবেন, নাচবেন, পান করবেন, চিন্তা করবেন, ভালোবাসবেস, তত্ত্বে বাঁধবেন, গাইবেন, আঁকবেন, তলোয়ারবাজি করবেন ততোই আপনার সঞ্চয় বাড়বে এবং ততোই আপনার ধনরত্নের বাড়বাড়ন্ত হবে কিন্তু সেই ধন কেউ উপভোগ করতে পারবে না, আর সেই ধনের নামই পুঁজি। যতো কম সঞ্চয় করবেন ততোই জীবনকে উপেক্ষা করা যাবে, যতো বেশী সঞ্চয় করবেন, ততোই বাড়বে আপনার বিচ্ছিন্ন জীবন এবং ততোই বাড়তে থাকবে আপনার বিচ্ছিন্ন জীবনের ভাঁড়ার।(Marx et al., 1992)

এখানে পুঁজিবাদী সমাজগুলোর চালচলনের যেসব ভিত্তি রয়েছে তারই দুটি পরস্পরবিরোধী নৈতিক দর্শন কেমন করে সেই সমাজগুলোতে জেঁকে বসেছে তা দেখা যাচ্ছে এখানে। একদিকে রয়েছে উপযোগবাদ, যা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় ক্রিয়াকর্মকে উপেক্ষা করে বাইরের কোনো বিষয় নিয়ে আনন্দ পাওয়াকেই মানুষের কাজের লক্ষ্য বলে মনে করে। ঠিক যেমনটা বিচ্ছিন্ন শ্রম থেকে আনন্দ পাবার উপায় হল মজুরি পাবার আনন্দ। এর বিরুদ্ধে মার্ক্স জোর দিয়ে বলছেন, সত্যিকার মানবিক পরিবেশে মানুষের কাজকর্মই তার আনন্দ জোগানোর পক্ষে যথেষ্ট, এরজন্য আলাদা কোনো উপায়ের প্রয়োজন হবে না। আর এইসব কাজকর্ম গভীরভাবে সামাজিক প্রকৃতির, কোনো ইগোকেন্দ্রীক বিষয় নয়।

অপরদিকে রয়েছেন কান্ট, প্রাক-পুঁজিবাদী সমাজের প্রায় সকল দার্শনিকের মত তিনি আনন্দ পাওয়াটাই নৈতিক বলে মনে করেননি। বরং, আমাদের নিজের স্বার্থেই আনন্দের আতিশয্য দমন করতে হবে বলে তিনি মনে করতেন। এই নৈতিকতা মার্ক্সের ‘নৈতিকতা সন্ন্যাসব্রতের মত হলেও উৎপাদনশীল দাসের মতোও’ কথাটি মনে করিয়ে দেয়।

‘সত্যিকার মানবিক পরিবেশ’ বলতে আমি অবশ্যই কমিউনিজমের কথা বলছি। কিন্তু কমিউনিজম মানে আদিতে ছিলো ‘সর্বজনীন ব্যক্তিগত সম্পত্তির’ ধারণা(Marx et al., 1992, P.346)। এই কথা বলে মার্ক্স সম্ভবত বোঝাতে চেয়েছেন যে, সামাজিক মালিকানা ব্যক্তিগত মালিকানার বদলে চালু হলেও, তাতে মালিকের (এক্ষেত্রে সমাজ) সঙ্গে সম্পত্তির সম্পর্ক সেই পুরাতন ব্যক্তিগত মালিকানার সম্পর্কই থেকে যায়। এই সম্পর্কও দখলে রাখারই সম্পর্ক। মার্ক্স বলেন, ‘এর ফলে যা কিছু সবার পক্ষে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে দখলে রাখা সম্ভব না সেসব বলপ্রয়োগের হুমকির মুখে পড়ে, এর মধ্যে রয়েছে মেধা থেকে শুরু করে সমস্তকিছু’ (Marx et al., 1992), P.346)। এইরকম ‘অসভ্য এবং অচিন্তনীয়’ কমুনিজম ‘সবকিছুরই অবনতি ঘটায়’ এবং ‘সমস্ত পৃথিবীর সংস্কৃতি এবং সভ্যতাকে’ ধ্বংস করে দেয়। এখানে বিয়ে নারীকে ‘সামাজিক সম্পত্তি’ আর ‘সামাজিক রিরংসার শিকার এবং দাসীতে’(Marx et al., 1992) পরিণত করে। মার্ক্স আরও বলেন, কোনো সমাজে নারী ও পরুষের সম্পর্ক কেমন সেখান থেকেই সেই সমাজে মানবতার অবস্থা সম্পর্কে আঁচ পাওয়া যায়।

কাজেই [এই সম্পর্কই] বলে দেয় মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি কতোটুকু মানবিক হতে পেরেছে বা অন্যভাবে বললে তার মানবীয় নির্যাস কতোটুকু স্বাভাবিক নির্যাসে মিলেমিশে গেছে, কতদূর পর্যন্ত মানবিক প্রবৃত্তি মানুষেরও প্রবৃত্তি হয়ে উঠেছে। এই সম্পর্ক আরও বলে দেয় কতদূর পর্যন্ত মানুষের ব্যক্তিগত চাহিদা মানবিক চাহিদায় পরিণত হয়েছে, সেইসূত্রেই অপর মানুষটিও নিজের কাছে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, কতদূর পর্যন্ত মানুষের ব্যক্তিগত অস্তিত্বও যেমন রয়েছে, ঠিক তেমনি রয়েছে তার সামাজিক অস্তিত্বও।(Marx et al., 1992, P.347)

এই অসভ্য কমিউনিজমের বিপরীতে মার্ক্স একটা আদর্শ কমিউনিজমের ধারণা হাজির করেছিলেন। এটির ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন, ‘এটা হল যাবতীয় বিচ্ছিন্নতার ইতিবাচক অবদমন এবং মানুষের ধর্ম, পরিবার, রাষ্ট্র ইত্যাদির কাছ থেকে মানবিকতায় তথা সামাজিক অস্তিত্বে উত্তরণ’(Marx et al., 1992, P.349)।

যদিও মার্ক্স মানবিক কমিউনিজম নিয়ে বিস্তর লিখেছেন, কিন্তু তবুও তিনি এর কোনো পরিষ্কার ধারণা দাঁড় করাতে পারেননি। তিনি শুধু বলেছেন মানুষের যাবতীয় কাজকর্ম শুধুমাত্র মানবিকতা অর্জনের লক্ষ্যেই হবে এবং সবকিছুই সামাজিক ভিত্তিতে হবে, এমনকি বৈজ্ঞানিক কাজকর্মের বেলায়ও তাই হবে (মানে তত্ত্বীয় বিষয়াশয়ও) যেগুলো এতোদিন একাকী করতে হয়েছে। তাছাড়া, বস্তুর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটাও মালিকানার সম্পর্ক হবে না। বর্তমানে আমাদের যে অবস্থা তাতে আমরা দেখি. ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা আমাদেরকে এতোই বেকুব আর একচোখা করে দিয়েছে যে আমাদের খালি মনে হয় কোনো জিনিস আমাদের করায়ত্তে আসলেই সেটা আমাদের হয়ে যায়। সেটা আমাদের পুঁজি হিসেবে থাকলেই বা আমাদের দখলে থাকলেই কিংবা যা আমরা খেতে, পান করতে, পড়তে, অভ্যাস করতে পারি, এককথায়, ব্যবহার করতে পারি তাই বুঝি আমাদের’(Marx et al., 1992, P.351)। কমিউনিজমের অধীনে, ‘উপভোগের পেছনে ইগোর তাড়না দূরীভূত হবে এবং কেবলমাত্র মানুষের ব্যবহারের জন্যই সবকিছু এমন ধারণারও অবসান হবে।‘(Marx et al., 1992)

যদিও বর্তমান পরিস্থিতির বিপরীতে না হলেও, কমিউনিজমকে ইতিবাচক মানবতাবাদ হিসেবে উপস্থাপনের পরেও আসলে এই বৈপরীত্যের মধ্যেই ধারণাটার স্থায়ীত্ব মূর্ত হয়েছে। তাঁর পরবর্তী লেখাগুলোতে তিনি একে একটা মান হিসেবে দেখেছেন: আমরা বড়জোড় বলতে পারি কোন কোন বিষয়ের অবসান চাই, কিন্তু সেগুলোকে কোন কোন বিষয় প্রতিস্থাপন করবে সেটা অবশ্যই সেই সময়ের মানুষের উপর ছেড়ে দিতে হবে। 

যাহোক, মার্ক্স তাঁর পান্ডুলিপিগুলোতে বারবার একটা সিদ্ধান্তেই এসেছেন এবং সেটাই তিনি সারাজীবন বলে গেছেন। সেটা হল, পুঁজিবাদ শ্রমিকদের শোষণ করে; এটা উৎপাদক এবং পণ্যের মধ্যকার সম্পর্ককে উল্টে দিয়ে পণ্যকেই উৎপাদকের উপর কর্তৃত্বশীল করে তোলে। আর এই সমস্যার সমাধান হল উৎপাদনের উপকরণের উপর যৌথ মালিকানা কায়েম করা। তবে, তিনি এই পান্ডুলিপিগুলোর কোনোটাই প্রকাশযোগ্য হওয়ার মত পর্যায়ে নিয়ে যাননি, এমনকি সমস্ত ধারণাকে তাঁর প্রকাশিত লেখায় নির্বিচারে ব্যবহারও করেননি। ‘বিচ্ছিন্নতা’, ‘মানবিক নির্যাস’ এবং ‘প্রজাতি-সত্তার’ মত ধারণাগুলো হারিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে ‘পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থা’, ‘উব্দৃত্ত মূল্য’ এবং ‘শ্রেণী সংগ্রাম’ এসেছে। এমনকি এক পর্যায়ে তিনি তাঁর নিজের পুরোনো তত্ত্বগুলোর সমালোচনাও করেছেন খোলাখুলিভাবে। যেমন, কমিউনিস্ট ইস্তেহারে তিনি পরিণত ফরাসি লেখাগুলো নিয়ে জার্মান সমাজতন্ত্রীদের দার্শনিক দৈন্যের সমালোচনা করে বলেন:

মূল ফরাসির তলে তারা লিখল তাদের দার্শনিক ছাঁইপাশ। উদাহরণস্বরূপ, মুদ্রার অর্থনৈতিক ক্রিয়ার ফরাসি সমালোচনার তলে তারা লিখল ‘মানবতার বিচ্ছেদ’; বুর্জোয়া রাষ্ট্রের ফরাসি সমালোচনার নিচে লিখে রাখল ‘একে পুরোপুরি বাদ দাও’ এবং এইসব….ফরাসি সমাজতন্ত্রি ও কমিউনিস্ট রচনাগুলিকে এইভাবে পুরোপুরি নির্বীর্য করে তোলা হল। জার্মানদের হাতে যখন এই সাহিত্যগুলো এক শ্রেণীর সঙ্গে অপর শ্রেণীর সংগ্রামের অভিব্যক্তি হয়ে আর রইলো না, তখন তাদের ধারণা হল যে, ‘ফরাসি একদেশদর্শিতা’ বোধহয় অতিক্রম করা গেছে। সত্যকে নয়, বরং প্রকাশ করা গেছে সত্যের প্রয়োজনকে, শুধুমাত্র প্রলেতারিয়েতের নয়, বরাং মানব প্রকৃতির প্রতিনিধিত্ব করা গেছে, যে মানুষের শ্রেণী নাই, বাস্তবতা নাই, যার অস্তিত্ব কেবল জটিল দার্শনিক হেঁয়ালিতে।’ (Marx et al., 1998, P.52)

তাহলে, লুই আলথুসার প্রশ্ন তোলেন, তরুণ মার্ক্স এবং পরিণত মার্ক্সের মধ্যে কি বিরাট পার্থক্য রয়েছে?(Althusser, 2005) আমার মনে হয় একটা বড় পরিবর্তন তো আছেই, কিন্তু তিনি সবকিছু বাতিল করে দেননি। যেমন, মুদ্রা নিয়ে মার্ক্সের যে মন্তব্য, ‘পৃথিবীব্যাপী মানুষ ও জনগণের দালাল’(Marx et al., 1992, P.377) তা কমিউনিস্ট ইস্তেহারেও প্রতিধ্বনিত হয়েছে এভাবে, বুর্জোয়ারা ‘ব্যক্তিগত মূল্যকে বিনিময় মূল্যে রূপান্তর করেছে’(Marx et al., 1998, P.33)। এইরকম আরও অনেক কথা তাঁর অর্থনীতি বিষয়ক আলোচনায় পাওয়া যায়। তেমনি, মালিকানার প্রকৃতি নিয়ে সমালোচনা দেখা যায় পুঁজি’র ৩য় খন্ডে যেখানে তিনি বলছেন যে, এমনকি সমস্ত মানবজাতিও পৃথিবীটার ‘মালিক’ নয়, তবে প্রতিটি প্রজন্মই পৃথিবীটাকে যে অবস্থাতেই পাক না কেন, তাদের সেটাকে বাসযোগ্য করে রেখে যেতে হবে (Marx et al., 1981, P.911)। আর যেমনটা বলছিলাম, শ্রমিকদের সাথে পুঁজিবাদের আচরণ আর উৎপাদক-পণ্যের সম্পর্ক উল্টে যাবার ধারণাটা তাঁর পরবর্তী লেখাগুলোতেও ছিল।

আরও কিছু সমস্যা মার্ক্সের তরুণ বয়সের লেখায় রয়েছে তবে সেগুলোর জন্য তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না, কারণ তিনি সেই লেখাগুলো প্রকাশ করতে চাননি।

প্রথমেই, পদ্ধতির প্রশ্ন আসে: সামাজিক বিজ্ঞানের মনোযোগ কোনদিকে হওয়া উচিত? একটা পুরোনো লেখা থেকে উদ্বৃতি দিলে তরুণ মার্ক্সের দৃষ্টিভঙ্গীটা বোঝা যাবে: ‘র‍্যাডিকাল হওয়া মানে শিকড়কে আরও আঁকড়ে ধরা, কিন্তু মানুষের শিকড় খোদ মানুষই’ (Althusser, 2005, P.226)। মানবজাতিই অর্থনৈতিক এবং দার্শনিক পান্ডুলিপির মূল কেন্দ্রীয় বিষয়। বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এবং অনুকূল অবস্থায় মানবজাতির দশা কেমন হয় সেটাই এর মূল বিষয় হলেও, উৎপাদনের উপায়ের বৈচিত্র – যেমন, পুঁজিবাদের সাথে সামন্তবাদের সম্পর্ক নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। জমিদার আর পুঁজপতিদের পারস্পরিক মন্তব্যগুলোকে মাথায় রেখে মার্ক্স সামন্তবাদ এবং পুঁজিবাদের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার যতো কাছাকাছি যান(Marx et al., 1992, P.338-9) ততোই দেখেন: পুঁজিবাদীরা জমিদারদের অলস, মূর্খ ও বোকা মনে করছে, অপরদিকে, জমিদাররা পুঁজিপতিদের মনে করছে নিষ্ঠুর অর্থলোভী যারা সমস্ত সামাজিক বন্ধন নষ্ট করে দিচ্ছে – আর মার্ক্সের মতে দুই পক্ষের কেউই মিথ্যা বলছেন না।

শুনে মনে হয় যেন মানবজাতি হল ইতিহাসের দাস, এবং সে নিজেই নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে যেন বিচ্ছিন্ন করাই তার কাজ। অথচ এগুলো সবই মানুষের একে অপরের উপর কর্তৃত্ব এবং যেসব কাঠামো এই কর্তৃত্বের সুযোগ তৈরি করে দেয় সেগুলোর বিষয়। মার্ক্সের অনেক পরের একটা লেখায় তিনি এই চিন্তাপদ্ধতির একটা বিকল্প প্রস্তাব করেছিলেন: ‘আমার বিশ্লেষণের পদ্ধতির মূলে মানুষ নয়, বরং, কোনো সুনির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক যুগের মানুষ’ (quoted by Althusser, 2005, P.219)। মার্ক্সের পরিণত বয়সের লেখাগুলোয় এর সত্যতাও মেলে। তিনি আর কখনো নারী ও পুরুষের সাধারণ আচরণ কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে লেখেননি, কিন্তু শ্রমিক হলে বা পুঁজিপতি হলে তাদের আচরণ কেমন হয় সেটা নিয়ে লিখেছেন। এতে তাঁর লেখার সুনির্দিষ্টতা এবং যথার্থতা বেড়েছে।

মানুষের নৈতিকতার দিক দিয়ে চিন্তা করলে এর একটা নৈতিক দিকও রয়েছে। মার্ক্সের তরুণ বয়সের মানবতার ধারণা আমাদের মানুষ হিসেবে যেসব পরিচয় রয়েছে সেসবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক (যেমন, ফরাসি লোক, ছুতার, স্বামী এইসব) এবং তা মানবতাকে সামগ্রীকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করে – এমনকি বলে যে, আমরা আসলে ওইসব পরিচয়ের মধ্যেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। কিন্তু কেউ হয়তো বলবেন (হয়তো হেগেলই বলতেন): আমার ধর্ম, পরিবার, রাষ্ট্র এইসব মিলিয়েই আমার সামাজিক অস্তিত্ব, এর মধ্যেই আমি নিজেকে তৃপ্ত মনে করি। আসলে, মার্ক্স নিজেই জার্মান ভাবাদর্শে এই নিয়ে ঠাট্টা করে লিখেছেন:

নাম নিয়ে যে ঝগড়াটা লেগেছে তা মানবতায় এসে মিটমাট হয়ে যাবে; তখন কেবা কমিউনিস্ট, কেবা সমাজতন্ত্রী? আমরা মানবজাতি – সবাই ভাই, সবাই বন্ধু…কেবা মানবজাতি, কেবা পশু, কেবা গাছপালা আর কেই বা পাথর? আমরা সবাই বস্তু! (Marx et al., 1972)

মানবতাবাদী আদর্শ নিয়ে আরেকটা বিষয় আছে। মার্ক্স হয়তো সঠিক যে মানুষকে তার সৃষ্টিশীল শ্রমই আর সবার থেকে আলাদা করেছে। কিন্তু আমরা অন্যান্য পশুপাখিদের সঙ্গে কি কি ভাগাভাগি করে নেই তার চেয়ে কিসে মানুষ অন্যান্য পশুপাখির চেয়ে আলাদা হয়েছে এই প্রশ্নটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ হল কেন? ধরে নেওয়া যাক যে সৃষ্টিশীল কাজ করা আনন্দদায়ক, এবং একটা অনুকূল সমাজে সেটা নিশ্চয়ই এখনকার চেয়েও ভাল হবে, তাহলে সেখানে কি নিষ্ক্রিয় থাকার আনন্দের কোনো স্থান নেই? পল লাফার্জ একবার দ্য রাইট টু বি লেজি নামের একটা বই লিখেছিলেন। সমাজতন্ত্র কি এই অধিকারটির কথা বিবেচনা করবে না?

সবশেষে, যদিও তরুণ মার্ক্সের মধ্যে এক ধরণের পরিবেশবাদী চিন্তা ছিল, তবে সেসব মানুষকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে: আমাদের উচিত প্রকৃতির যত্ন নেওয়া কারণ এটা আমাদের অজৈব সত্তা; আমাদের প্রকৃতি সম্পর্কে অ-উপযোগবাদী চিন্তাগুলোর ব্যাপারে মনোযোগী হতে হবে কারণ তা না হলে আমাদের অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে যাবে। এই নিয়ে তর্ক আছে যে, মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে অন্যতম পার্থক্য হল, আমাদের নিজেদের শরীরের উপর নিজেদের অনেক অধিকার রয়েছে, অন্যকিছুর উপর এতোটা অধিকার নাই। আমি আমার চুল যখন খুশী কেটে ফেলতে পারি, কিন্তু আমি চাইলেই একটা আস্ত বন উজাড় করে দিতে পারিনা।

গত চল্লিশ বছর ধরে, অর্থনৈতিক এবং দার্শনিক পান্ডুলিপি মার্ক্সের অন্যান্য লেখার তুলনায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় লেখা।  আধুনিক মানুষের কাছে এটা অবশ্যই চিন্তার নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে আজকের আধুনিক দুনিয়াতেও এটা প্রাসঙ্গিক কিনা। আজকের জামানার শিল্পকারখানাগুলোর শ্রমিকদের অবস্থার সঙ্গে পুঁজি’র যে বর্ণনা রয়েছে তা আর যায় না: কোন দেশেই বা এখনো মানুষের শুধুমাত্র একটাই চাহিদা রয়েছে – খাদ্যের চাহিদা, শুধু আলু খেয়ে থাকার দশা আরও নির্দিষ্ট করে বললে, সবচেয়ে খারাপ আলুটা খেয়ে বাঁচার দশা রয়েছে?

তবুও, মার্ক্স বিচ্ছিন্নতার যে সংজ্ঞা দিয়েছেন – একজনের সময় অপরজন চুরি করে নিচ্ছে, একজনের পণ্য আরেকজনের সর্বনাশ করছে, কাজকে শুধুমাত্র মজুরির নীরিখেই মাপা হচ্ছে – এসবই এখনো চলছে। অবিচ্ছিন্ন কাজের দুয়েকটা যা ছিঁটেফোঁটা – যেমন, ছবি আঁকা, পরিবারের জন্য রান্না করা, যেখানে কোনো বড়কর্তা নাই, যার উপকরণগুলো দখলে রাখা যায়, এবং অর্থ নয়, বরং, অপরের আনন্দের জন্যই যা উৎপাদন করা হয়, - সেসবও কমে আসছে। শিল্প এখন ডিজাইন মার্কেটের অংশ, রান্নার জায়গায় তৈরি খাবার জায়গা করে নিয়েছে। শিক্ষা শুধুমাত্র মূল্যায়ন নির্ভর হয়ে পড়েছে, এবং সবচেয়ে অসৃষ্টিশীল ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এমনকি, বিশ্ববিদ্যালয়েও যদি বলা হয়, জানার নিজেরই একটা মূল্য আছে, তাহলে নিজেকে উপহাসের পাত্র মনে হয়। সম্প্রতি ফরাসি সোশালিস্ট পার্টি যে পার্থক্যটা ধরিয়ে দিয়েছে সেটাই এক্ষেত্রে খাটে, আমরা শুধুমাত্র বাজার অর্থনীতিতেই প্রবেশ করিনি, বাজার সমাজেও প্রবেশ করেছি। এমনকি বিয়েকেও একটা চুক্তি হিসেবেই দেখা হয়। এইরকম মতাদর্শগত অবস্থা, যেখানে ব্যবসার উদ্যম সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেখানে মানবতার পতিতাবৃত্তির বিরুদ্ধে তরুণ মার্ক্সের ক্রোধ বরাবরের মতোই যথার্থ।

মূল: ডেভিড কোলিয়ার

ভাবানুবাদ: ইয়ামিন রহমান ইস্ক্রা

রেফারেন্স

Althusser, L., 2005. For Marx, Radical thinkers. Verso, London ; New York.

Marx, K., Engels, F., Arthur, C.J., Marx, K., 1972. The German ideology, New World paperbacks, NW-143. International Publishers, New York.

Marx, K., Engels, F., Engels, F., McLellan, D., 1998. The Communist Manifesto, Reissued. ed, Oxford world’s classics. Oxford University Press, Oxford.

Marx, K., Fowkes, B., Fernbach, D., 1981. Capital: A Critique of Political Economy, v. 1: Penguin classics. Penguin Books in association with New Left Review, London ; New York, N.Y.

Marx, K., Livingstone, R., Benton, G., 1992. Early writings, Repr. ed, Penguin classics. Penguin Books, London.


মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০

পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (শেষ পর্ব ১৫: দ্বিতীয় ভিয়েনিজ স্কুল, আরনল্ড শোয়েনবার্গ, মার্কিন শিল্পীরা)

দ্বিতীয় ভিয়েনিজ স্কুল

বিংশ শতাব্দীর আগে, কয়েক মিলিয়ন সংগীতকার ভিয়েনায় থেকেছেন এবং সেখানে কাজ করেছেন। এঁদের মধ্যে আছেন হেইডেন, মোৎসার্ট, বেটোভেন, শুবার্ট, ব্রামস এবং তাঁদের পরিবারের লোকজন। এই ওস্তাদেরাই শত শত বছর ধরে ধ্রুপদী সংগীতের গঠন কাঠামো নির্ধারণ করেছেন। কিন্তু, নতুন শতাব্দীর সূচনায়, ভিয়েনা নিবাসী একদল নতুন সংগীতকার সংগীতের খোল-নলচে পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। তাঁদেরকে মজা করে ‘সেকেন্ড ভিয়েনিজ স্কুল’ নামে ডাকা হয়। এঁদের দলপতি ছিলেন আরনল্ড শোয়েনবার্গ (১৮৭৪-১৯৫১)।

আরনল্ড শোয়েনবার্গ

শোয়েনবার্গ শুরুতে ভ্যাগনার, স্ট্রস কিংবা মেহলারের মতো সুরেলা সুরই করতেন এবং তাঁর সুরগুলো কোন কি-তে তা চট করেই বলে দেয়া যেতো। কিন্তু কয়েক বছর পর তিনি সুরের টোনালিটি একেবারে ভাঙার উপক্রম করলেন। শোয়েনবার্গ অবশেষে সেটাকে চিরতরে ভেঙেই ফেলেছিলেন। তিনি এক নতুন ধরনের সংগীত রচনা শুরু করলেন যার কোনো কি নাই। এই জাতীয় সংগীতকে নন-টোনাল বা এটোনাল সংগীত বলে। এটোনাল সংগীত বেসুরো। 


শোয়েনবার্গের তত্ত্বের ব্যাখ্যা

যদি পিয়ানোর মধ্য অক্টেভের ‘C’ স্বরটিকে সা মেনে পরবর্তী ‘C’ স্বর পর্যন্ত সবগুলো সাদা স্বর বাজানো যায় তাহলে C-এর কি-তে সারগাম বাজানো হল। পৃথিবীর প্রায় নিরানব্বই শতাংশ সংগীতকারই এইরকম কোনো না কোনো স্বরকে ‘সা’ মেনে সুর তৈরি করেছেন। এই কারণেই কিন্তু ধ্রুপদী সংগীতের বিভিন্ন সুরের নামকরণ করা হয় ‘সিম্ফোনি ইন ডি মেজর’ বা ‘সোনাটা ইন এফ মাইনর’ ইত্যাদি। ডি মেজর বা এফ মাইনর হলো ওই সুরের ‘কি’।

কিন্তু, এবারে ‘C’ এর স্বরগুলোর দিকে তাকানো যাক। দেখা যাচ্ছে, যে আমরা অনেকগুলো কালো রঙের বোতাম ছেড়ে দিয়ে বাজাচ্ছি। আরনল্ড শোয়েনবার্গ বললেন, এই কালো রঙের বোতামগুলোকে আমরা ‘কালো’ বলেই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানিয়ে দিতে পারিনা। আমার কাছে এদের সবার গুরুত্ব সমান। তাঁর নতুন ধরনের সংগীতের নাম হল ১২-টোন সংগীত। কারণ তিনি C থেকে C এর মধ্যকার ১২টা স্বরকেই সমান মর্যাদা দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন।

তিনি শুধুমাত্র ওই স্বরগুলোকে সমান মর্যাদাই দিলেন না, এদের ব্যবহারে জন্য নির্দিষ্ট নিয়মও নির্ধারণ করে দিলেন। তিনি বললেন, যদি কেউ C স্বরটা একবার ব্যবহার করেন, তাহলে পরবর্তী ১১টা স্বর ব্যবহার না করা পর্যন্ত তিনি আর  C স্বরটা ব্যবহার করতে পারবেন না। আবার C ব্যবহার করতে হলে আগে বাকি ১১টা স্বর ব্যবহার করতে হবে!

এই নিয়ম করেই তিনি ক্ষান্ত হলেন না, আরও বহুদূর এগিয়ে গেলেন। তিনি ওই স্বরগুলোকে নতুন করে সাজালেন। যেমন: C, E-flat, G, A-flat, B, C-sharp, B-flat, D, F-sharp, F, A, E এবং নিজেকে বাধ্য করলেন একটা সুরে এই ক্রমেই স্বরগুলোকে বারবার ব্যবহার করবেন। যেকোনো তাল ব্যবহারের ব্যাপারে তাঁর আপত্তি ছিলো না, আপত্তি ছিলো না স্বরগুলোকে দিয়ে কর্ড বানিয়ে বাজাতেও, তবে শর্ত একটাই ওই ক্রম অনুসরণ করতে হবে।

যখন দেখা গেল এইভাবে কিছুই হচ্ছে না, তখন তিনি আরও কিছু নিয়ম তৈরি করলেন। প্রথমত, ১২টা স্বর উল্টো করে বাজানো যাবে (এটাকে বলে রেট্রোগ্রেড)। এমনকি তিনি এই ১২টা স্বরকে পাশাপাশি না বসিয়ে খাড়াভাবে বসাতেও রাজি হলেন। (একে বলে ইনভার্সন)। এবং বছরের পর বছর ধরে এই নিয়মগুলোকে নানাভাবে মিলিয়ে-মিশিয়ে তিনি বিভিন্ন ধরনের সুর তৈরি করতে শুরু করলেন। এই নতুন ধরনের সংগীতকে বলা হয় সিরিয়ালিজম।


সিরিয়াল সংগীত

বেশ কয়েক বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর, শোয়েনবার্গ আরও অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি কোন স্বরটা কাজে লাগাবেন সেটা বের করার জন্য গাণিতিক নিয়মকানুন প্রয়োগ করতে শুরু করেছিলেন। আজ আমরা এই জাতীয় সংগীতকে ১২-টোন সংগীত বা সিরিয়ালিজম বলে থাকি। এলবান বিয়ার্গ (১৮৮৫-১৯৩৫) এবং এন্টন ভেবার্ন (১৮৮৩-১৯৪৫) ছিলেন এই তরিকার লোক।


একগুচ্ছ সিরিয়াল সংগীত

দ্বিতীয় ভিয়েনিজ স্কুলের গবেষণা নিয়ে যদি আপনার আগ্রহ থাকে তাহলে এই সুরগুলো শুনতে পারেন:


শোয়েনবার্গ: Pierrot Lunaire, opus 21: এই সুরে শোয়েনবার্গ একটা কৌশল খাটিয়েছেন, যেটার নাম স্প্রেশটিমে (স্পিক-ভয়েস)। এই পদ্ধতিতে গায়ক সঠিক স্বরে স্থির থাকেন না, বরং গলা কাঁপিয়ে স্বরের ওঠানামা করেন।

বিয়ার্গ: Violin Concerto: এটা একটা ১২-টোন সংগীত। তবে এতে বাখ এবং অস্ট্রিয়ান লোকসংগীতের ছিটেফোঁটা আছে। যদিও এটা পুরোপুরি এটোনাল, তবুও এরমধ্যে একটা নিজস্ব ব্যক্তিগত গভীর রোমান্টিক বোধ আছে।

ভেবার্ন: Six pieces for orchestra, opus 6: এক গুচ্ছ ছোট্ট ছোট্ট সুর, সব মিলিয়ে ১২ মিনিট দীর্ঘ। পুরোপুরি এটোনাল।


মার্কিন শিল্পীরা

দ্বিতীয় ভিয়েনিজ স্কুল যখন ইউরোপে জটিল, ধোঁয়াটে সংগীত তৈরি করছিলো তখন একেবারেই নতুন ধরনের আমেরিকান সংগীতও একটু একটু করে বেড়ে উঠছিলো। এই সংগীত আমেরিকার চেতনা নিয়ে আশাবাদী ও প্রত্যয়ী বার্তা তৈরি করেছিলো।


এরোন কোপল্যান্ড

এরোন কোপল্যান্ড (১৯০০-১৯৯০) হলেন আমেরিকার সবথেকে ভালোবাসা সিক্ত সংগীতকার। নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনের বাসিন্দা এবং রুশ অভিবাসী ঘরের সন্তান কোপল্যান্ড খাস আমেরিকার গ্রামাঞ্চলকে ধারণ করেছিলেন। তাঁর দুয়েকটা সুর শুনলেই মনে হয় যেন গমের ক্ষেতের নয়নাভিরাম দৃশ্য চোখে ভেসে উঠছে।

তাঁর পুরোনো সংগীত শুনলে অবশ্য মনে হয় যেন ইউরোপের ধারা তাঁর মধ্যেও কিছুটা বইছে। কিন্তু তিনি সেসব কাটিয়ে উঠেছিলেন। তিনি এমন একটা ধারা তৈরি করতে চেয়েছিলেন যেটা আমেরিকার মানুষদের কাছে ভালো লাগবে। তিনি তাঁর বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সুরের মধ্যে জ্যাজের তাল এবং হারমোনি প্রয়োগ করেছিলেন। তিনি বিখ্যাত আমেরিকানদের নিয়েও সংগীত রচনা করেছিলেন যেমন বিলি দ্য কিড।

কোপল্যান্ডের সবচেয়ে বিখ্যাত সংগীত হলো এপালাশেন স্প্রিং। এটি একটি ব্যালে যেখানে নব্য বিবাহিত কৃষকের এপালাশেন পর্বতের পাদদেশে নতুন খামারে যাবার গল্প বলা হয়েছে। এই সুরটা শুনে মনে হয় যেন গ্রামদেশে ভোরে শিশির পড়ছে, নব্য বিবাহিত বর-বউয়ের নতুন জীবন শুরু করার আনন্দ যেন ঝরে পড়ছে। 

এপালাশেন স্প্রিং ১৯৪৪ সালে প্রথমবার পরিবেশনের পরে খুব নাম করেছিলো। সেই বছরই এর জন্য পুলিৎজার পুরষ্কার পান কোপল্যান্ড এবং আমেরিকান ধ্রুপদী সংগীতের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে যান।


জর্জ গ্রেশউইন

মার্কিন দ্বিতীয় বিখ্যাত সুরটি জর্জ গ্রেশউইনের (১৮৯৮-১৯৩৭)। তিনিও ব্রুকলিনে জন্ম নিয়েছিলেন। ঊনচল্লিশ বছর বয়সে ব্রেন টিউমারে গ্রেশউইন মারা যান, কিন্তু এই অল্প সময়েই তিনি একা একহাতে টিন প্যান এ্যালি এবং কার্নগী হলের মধ্যকার দ্বন্দ্ব মিটিয়ে যান।

যে সুরটি এই অসাধ্য সাধন করেছিল সেটা হল র‍্যাপসোডি ইন ব্লু, জ্যাজ ব্যান্ডের সঙ্গে বাজানোর উপযোগী পিয়ানো নির্ভর একটি ছোট্ট কনসার্টো। পরবর্তীতে এটি অর্কেস্ট্রার সাথেও বাজানো হয়েছে।

গ্রেশউইন এই সুরটি কনসার্ট শুরু হবার মাত্র এক সপ্তাহ আগে লেখেন। নিউ ইয়র্ক থেকে বোস্টন যাবার পথে ট্রেনের জানালা দিয়ে বিভিন্ন দৃশ্য দেখে আর শব্দ শুনে তিনি এই সুরটি লিখতে আগ্রহী হন। এই সুরটি ধ্রুপদী পিয়ানো কনসার্টোর সঙ্গে আমেরিকান জ্যাজ এবং ব্লুজকে মিলিত করেছে, কিন্তু গ্রেশউইন ধ্রুপদীর চেয়ে জ্যাজেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। 

সংগীতের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকায় গ্রেশউইন খুবই অস্বস্তিতে ভুগতেন। তিনি এজন্য আরনল্ড শোয়েনবার্গের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। কিন্তু শোয়েনবার্গ তাঁকে শেখাতে রাজি হননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তোমাকে হয়তো বাজে শোয়েনবার্গ বানিয়ে ফেলব। কিন্তু তুমি গ্রেশউইন হয়েই দুর্দান্ত কাজ করছো।’


স্যামুয়েল বার্বার

স্যামুয়ের বার্বার (১৯১০-১৯৮১) আমেরিকান ধ্রুপদী সংগীতের তৃতীয় বিখ্যাত সুরটি রচনা করেছিলেন। আদাজিও ফর স্ট্রিংস নামের এই সুরটি আমাদের আবেগকে ছুঁয়ে যায়।

বার্বার ফিলাডেলফিয়ার কার্টিস ইন্সটিটিউট থেকে সংগীত শেখার পর এই সুরটি পঁচিশ বছর বয়সেই তৈরি করেছিলেন। ধীরে ধীরে এটা পুরো আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়েছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযু্দ্ধের সময় এটি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এবং মৃত সৈন্যদের স্মরণে এক অলিখিত সংগীতে পরিণত হয়।

সেই সময় ধ্রুপদী সংগীতের জগতে এটোনালিটি থেকে শুরু করে জ্যাজ, সবকিছু নিয়েই গবেষণা চলছিলো। ইউরোপীয় সংগীতকারদের মতো আমেরিকানরা ভিয়েনাতে যেতেন না। তবে, তাঁদের কেউ কেউ এই ধারায় বেশ সাফল্য পেয়েছিলেন। এই তালিকায় আরও রয়েছে:


চার্লস আইভস (১৮৭৪-১৯৫৪): ইনি ছিলেন একজন বীমা বিক্রয় কর্মী। তিনি এস্টেট প্ল্যানিং ধারণার প্রবক্তা। তাঁর ছিলো শৌখিন সংগীত জীবন। তাঁর বেশীরভাগ কাজই ঘরের মধ্যেই হারিয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু যখন সেগুলো প্রকাশ পেল তখন চারিদিকে জয়জয়কার পড়ে গিয়েছিলো। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত সুর হলো দ্য আনএনসার্ড কোশ্চেন এবং সিম্ফোনি নং ২।


লিওনার্ড বার্নস্টাইন (১৯১৮-১৯৯০): নিউ ইয়র্ক ফিলহারমোনিকের বিখ্যাত পরিচালক বার্নস্টাইন জ্যাজ এবং ধ্রুপদী সংগীতের সন্নিবেশ ঘটিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংগীত রচনা করেছিলেন। তিনি ওয়েস্ট সাইড স্টোরি নামের অন্যতম সেরা ব্রডওয়ে মিউজিক্যালটির স্রষ্টা।

লিওনার্ড বার্নস্টাইন


জন কেজ (১৯১২-১৯৯২): চান্স নামের এক উদ্ভট কৌশল আবিষ্কার করে সংগীতের দুনিয়া বিপ্লব ঘটিয়ে সবাইকে হতবাক করে দিয়েছিলেন এই সংগীতকার। চান্স ধারণায় চারটা রেডিওতে চারটা ভিন্ন ভিন্ন চ্যানেল একসাথে চালু করা হয়। এতে যে সম্মিলিত সুর তৈরি হতো সেটাই হলো সংগীত। তিনি ৪’৩৩” নামের একটা পিয়ানো পিসও তৈরি করেছিলেন যেখানে পিয়ানোবাদক পিয়ানোর ডালাটা খোলেন, তারপর সেখানে চার মিনিট তেত্রিশ সেকেন্ড চুপচাপ বসে থাকেন এবং তারপর ঢাকনা বন্ধ করে দেন। 


জন এডামস (জন্ম ১৯৫১): স্টিভ রাইখ (১৯৩৬) এবং ফিলিপ গ্লাসের (১৯৩৭) সাথে তিনি জন্ম দিয়েছেন মিনিমালিজম ধারার। এই ধারায় একই সুর বারবার ঘুরে ঘুরে আসে, কিন্তু তাল এবং হারমোনি পরিবর্তন হতে থাকে। এটা শুনতে আরামদায়ক এবং বেশীরভাগ সময়ই টোনাল।

বিংশ শতাব্দীর আমেরিকান ধ্রুপদী সংগীতকে বুঝতে হলে এই সুরগুলো শোনা আবশ্যক:


কোপল্যান্ড: Appalachian Spring এবং Fanfare for the Common Man

গ্রেশউইন: Rhapsody in Blue এবং Concerto in F for Piano Solo and Orchestra

বার্বার: Adagio for Strings, Symphony no. 1 in one movement, opus 9; এবং Medea’s Meditation and Dance of Vengeance

আইভস: The Unanswered Question

বার্নস্টাইন: West Side Story

কেজ: Sonatas and Interludes for Prepared Piano

এডামস: Short Ride in a Fast Machine এবং Harmonielehre

কোরিলিয়ানো: Symphony no. 1

পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (পর্ব ১৪: ইগর স্ট্রাভিনস্কি, সের্গেই প্রাকোফিয়েভ, দিমিত্রি সস্তাকোভিচ)

ইগর স্ট্রাভিনস্কি

অনেকের কাছেই, রুশ সংগীতকার ইগর স্ট্রাভিনস্কি (১৮৮২-১৯৭১) হলেন বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগীতকার। স্ট্রাভিনস্কির পরে তাঁকে বাদ দিয়ে সুর করা আর কোনো সংগীতকারের পক্ষে সম্ভব হয়নি। হয় তাঁদেরকে স্ট্রাভিনস্কির ধারণাগুলোকে গ্রহণ করতে হয়েছে অথবা বাদ দিতে হয়েছে।

ইগর স্ট্রাভিনস্কি


স্ট্যাভিনস্কির তরুণ বয়স সাধারণ ক্লাসিকাল সংগীতকারদের জীবনের যে গল্প তার ব্যতিক্রম হয়নি: এক সচ্ছল পরিবারে জন্ম, আইন পড়তে যাওয়া, পড়া ছেড়ে সংগীত শিক্ষার জন্য বেরিয়ে পড়া। স্ট্রাভিনস্কি ছিলেন রিমস্কি-কোরসাকোভের ছাত্র।


ফায়ারবার্ড দিয়ে শুরু

স্ট্রাভিনস্কির শুরুটা হয় ব্যালে সংগীত দিয়ে। সের্গেই ডিয়াগিলেভ নামের এক বিখ্যাত  রাশিয়ান প্রযোজক প্যারিসে ব্যালে রুশে নামে একটা দল তৈরি করেছিলেন। তিনি ফায়ারবার্ডের কাহিনী নিয়ে এই দলটির জন্য একটি ব্যালে তৈরি করার জন্য সংগীতকার খুঁজছিলেন। তিনি প্রথমে আনাতোল লিয়াদভ নামের একজনকে ঠিক করেছিলেন সেটা লেখার জন্য। কিন্তু রিহার্সাল শুরু হবার আগে যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো কাজ কেমন চলছে তিনি বললেন, ‘চমৎকার! আজই লেখার জন্য কাগজ কিনেছি।’ ডিয়াগিলেভ যা বোঝার বুঝে গিয়ে স্ট্রাভিনস্কিকে কাজটা দিয়ে দিলেন।

ফায়ারবার্ডে স্ট্রাভিনস্কির সংগীত ইতিহাসের এক মাইলফলক। প্যারিসে এর প্রথম পরিবেশনায় কেউ এইরকম জটিল তাল আর অদ্ভুত, ভয়াবহ বেসুরো সুর আগে কখনো শোনেনি। তবুও, শ্রোতারা সুরটার ভিতরকার উত্তেজনা আর স্ট্রাভিনস্কির নতুন সুর দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। ব্যালেটা সফল হয়েছিলো। স্ট্রাভিনস্কি ডিয়েগিলেভের প্রিয় সংগীতকার হয়ে গিয়েছিলেন এবং প্যারিসে তাঁর জীবিকাও পাকাপোক্ত হয়ে গিয়েছিল।


পেট্রুসকা কর্ড

এবারের আলোচনার বিষয় পেট্রুসকা। এটা যৌন অবদমিত পুতুলের ভগ্নাবশেষের গল্প নিয়ে ব্যালে। এই ব্যালেটা আগের চেয়েও বেশী বেসুরো। যেমন: স্ট্রাভিনস্কি ইচ্ছা করেই এমন দুটি হারমোনি লিখেছিলেন যারা পরস্পরের সঙ্গে সাংঘাতিকভাবে সংঘর্ষ তৈরি করে। এতে যে কর্ড ব্যবহার করা হয়েছিল সেটাকেই বলে পেট্রুসকা কর্ড:

পেট্রুসকা কর্ড

এই সংঘর্ষটার পেছনে অবশ্য ব্যাখ্যা আছে। এটা পুতুলটার ভিতরের অন্তর্দ্বন্দ্বকে বুঝায়। শ্রোতারা এই বিষয়টা বুঝতে পেরেছিলে এবং এই নাচের সুরটাও সফল হয়েছিলো।


সংগীতের ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত প্রিমিয়ার

এরপর ১৯১৩ সালে ইগর স্ট্রাভিনস্কি এক বোমা তৈরি করলেন: দ্য রাইট অফ স্প্রিং। এই ব্যালেটির উপশিরোনাম হল ‘সিনস অফ পাগান রাশিয়া’। স্ট্রাভিনস্কি লিখেছিলেন, ‘আমার কল্পনায় এক পবিত্র পাগান রীতি ছিল। গোষ্ঠিপতিরা গোল হয়ে বসে আছেন এবং একটা বাচ্চা মেয়েকে নাচতে নাচতে মরে যেতে দেখছেন। তারা মেয়েটিকে আসলে বসন্ত দেবতার উদ্দেশে বলি দিচ্ছেন।’ 

এই দৃশ্যটিকে তিনি এক কর্কশ, ছোট্ট কিন্তু বারবার ঘুরে আসে এইরকম একটা বেসুরো সুরে বেঁধেছিলেন। বাদ্যযন্ত্রগুলো তারস্বরে চিৎকার করে ওঠে এবং পেছনে ভয়ংকর, বুক ধকধক করা নিষ্ঠুর একটা তাল বাজতে থাকে। এককথায় অপূর্ব। প্রথম পরিবেশনার রাতে শ্রোতারা হাতের কাছে যা ছিলো তাই ছুঁড়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলো।

তবে সবাই এটাকে অপছন্দ করেনি; এঁদের মধ্যে ছিলেন ক্লড ডেবুসিসহ প্যারিসের অনেক বিখ্যাত সংগীতকারগণ। এঁরা করতালি দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, এই করতালি ভক্তদের আরও উস্কে দিয়েছিলো, আরও সরব করে তুলেছিলো। এক পর্যায়ে হাতাহাতি শুরু হয়ে গিয়েছিলো, সবাই হুড়োহুড়ি করে বেরিয়ে গিয়েছিলো, এমনকি এক লোক আরেকজনকে ডুয়েল লড়ারও আহবান জানিয়েছিল। স্ট্রাভিনস্কি নিজে জানালা দিয়ে একটা ড্রেসিংরুমে পালিয়েছিলেন এবং পরে নিজেও মারামারি করছেন এমন ভঙ্গী করেছিলেন।

এর ঠিক এক বছর পরেই ব্যালেটি আবার পরিবেশন করা হয় এবং সেবার শ্রোতারা উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানায়।


আরও সংগীত

স্ট্রাভিনস্কি যখন এইসব দুনিয়া কাঁপানো ব্যালেগুলো তৈরি করছিলেন তখনো তিনি নিতান্তই তরুণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছুকাল পরেই রুশ বিপ্লব শুরু হয় এবং স্ট্রাভিনস্কি রাশিয়া থেকে পালান। প্রথমে সুইজারল্যান্ডে যান এবং সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেন। তিনি হলিউডেও একটা বাড়ি কিনেছিলেন।

পরবর্তী সময়ে, স্ট্রাভিনস্কি আরও বেশী নিরীক্ষামূলক কাজকর্ম শুরু করেন। তিনি বেশকিছু ধারা তৈরি করেন যার মধ্যে নিওক্লাসিকাল ধারা উল্লেখযোগ্য। সহজ কথায় নিওক্লাসিকাল হলো সনাতন ক্লাসিকাল সংগীত এবং আরও বেশকিছু ‘ভুল স্বরের’ ব্যবহারের মধ্যে একটা ভারসাম্য তৈরি করার চেষ্টা। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি সংগীত রচনা করেছিলেন বটে, কিন্তু রাইট অফ স্প্রিং এর মত আর কোনো ঐতিহাসিক রচনা তিনি আর করতে পারেননি। তিনি ১৯৭১ সালে নিউ ইয়র্কে মারা যান।

Firebird (also known as L’oiseau de feu)
Petrushka
The Rite of Spring (also known as Le sacre du printemps)
Pulcinella Suite
Symphony of Pslams

সের্গেই প্রাকোফিয়েভ

নিওক্লাসিকাল ধারার রুশ সংগীতকারদের কথা বলতে গেলে যার কথা বলতেই হয় তিনি হলেন সের্গেই প্রাকোফিয়েভ (১৮৯১-১৯৫৩)। তাঁর সংগীতের ব্যাপারে সাধারণ শ্রোতারা তেমন কিছু জানেন না। তবে তাঁর বাচ্চাদের গল্প পিটার এন্ড দ্য উল্ফ সবার কাছে পরিচিত। তাঁর রোমিও এন্ড জুলিয়েটের ব্যালে সংস্করণ একটা মাস্টারপিস। এছাড়া রয়েছে বেশকিছু সিম্ফোনি, বিশেষ করে পঞ্চম সিম্ফোনি।

সের্গেই প্রাকোফিয়েভ


প্রাকোফিয়েভই হলেন একমাত্র সংগীতকার যিনি আইন স্কুল ছেড়ে পালাননি, কারণ তিনি কখনো আইনের স্কুলেই যাননি। তবে তিনি রুশ সংগীতের বেদনাকে ধ্রুপদী সংগীতে মধ্যে অপূর্বভাবে মিশিয়েছিলেন। কারণ চিরায়ত হারমোনির বিপরীতে ওইসব ‘ভুল স্বরের’ যে ব্যবহার শুরু হয়েছিলো সেই তুলনায় তাঁর সুর ছিল সোজাসাপ্টা এবং কখনো কখনো ব্যাঙ্গাত্মক।

প্রাকোফিয়েভের কাজ তাহলে শুনেই ফেলা যাক:

Peter and the Wolf, opus 67
Suites from Romeo and Juliet
Symphony no. 1, opus 25 (also known as the Classical Symphony)
Symphony no. 5, opus 100
Alexander Nevsky Cantata (প্রাকোফিয়েভ এই সুরটি সের্গেই আইজেনস্টাইনের ছবি আলেক্সাজান্ডার নেভস্কি এর জন্য লিখেছিলেন)
Piano Sonatas no.3 and 7


দিমিত্রি সস্তাকোভিচ

১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠিত হয়। দিমিত্রি সস্তাকোভিচ (১৯০৬-১৯৭৫) হলেন সোভিয়েত দেশের অন্যতম সেরা সংগীতকার। স্ট্রাভিনস্কির মত তিনি দেশত্যাগ করেননি, বরং তিনি পুরোটা সময় সোভিয়েত ইউনিয়নেই কাটিয়েছিলেন। সংগীতের আরেক বিস্ময় বালক সস্তাকোভিচ তাঁর প্রথম সিম্ফোনি ‘ফার্স্ট সিম্ফোনি’ লিখেছিলেন আঠারো বছর বয়সে। এটাকে এখনো তাঁর অন্যতম সেরা কাজগুলোর একটি বিবেচনা করা হয়। সিম্ফোনিটা শুনতে প্রাণবন্ত শোনালেও এতে হঠাৎ হঠাৎ বেসুরো সুরও ব্যবহার করা হয়েছে। 

দিমিত্রি সস্তাকোভিচ


দিমিত্রির বিপদ

১৯৩০-এর দশকে ‘প্রাণবন্ত’ এবং ‘বেপরোয়া’ সংগীত সোভিয়েত কর্তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। সরকার বরং তার নিজের মহিমা বর্ণনা করে এইরকম সংগীতের দিকেই বেশী আগ্রহী ছিল।

১৯৩৫ সালে, সস্তাকোভিচ সোভিয়েত ইউনিয়নের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংগীতকার ছিলেন। তাঁর আধুনিক ধাঁচের অপেরা লেডি ম্যাকবেথ অফ এমটসেনস্ক তখন দেশে বিদেশে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে।

এরপরই, একদিন, সোভিয়েত সংবাদপত্র প্রাভদার সম্পাদকীয়তে তাঁর সংগীতের একটা সমালোচনা বেরোলো। সেখানে বলা হলো ‘সংগীতের বদলে বিশৃঙ্খলাই বেশী’, ‘সংগীতের উদ্দেশ্য হল মানুষকে জাগ্রত করা…...এই সুরগুলো বিপদজনক।’

লেডি ম্যাকবেথ অফ এমটসেনস্ক অপেরাটি তড়িঘড়ি করে বন্ধ করা হলো। অপরাপর সংগীতকারেরা তাঁকে একঘরে করে ফেললো, তাঁকে ‘গণশত্রু’ আখ্যা দেওয়া হলো। সস্তাকোভিচ একেবারে ভেঙে পড়লেন।

তবে সস্তাকোভিচ ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। তিনি ঠিক করলেন সোভিয়েতদের কাছে আবার নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন এবং তিনি সেটা করেছিলেন দারুণভাবে। দিমিত্রি ‘একজন সোভিয়েত শিল্পীর যথাযথ সমালোচনার উত্তর’ উপশিরোনামে তাঁর সিম্ফোনি নং ৫ লিখেছিলেন।

সমালোচকদের মুখের কথা বন্ধ হয়ে গেল। এইরকম সুরই তো সোভিয়েতরা এতোদিন খুঁজছিলো। স্টালিনের শাসনামলে সস্তাকোভিচ আবারো হারানো গৌরব ফিরে পেলেন। তিনি আবার তারকায় পরিণত হলেন এবং তাঁর সংগীতও সবখানে বাজতে শুরু করলো।


দিমিত্রির প্রতিশোধ

তবে শেষ হাসিটা সস্তাকোভিচই হেসেছিলেন। ওই উপশিরোনাম থাকা সত্ত্বেও সুরটা আসলে দেশের মধ্যে চলমান উদ্ভট কান্ডকারখানাকে উদ্দেশ্য করেই বানানো হয়েছিল। সুরটা খুব মন দিয়ে শুনলে, সাংগীতিক রূপকগুলো থেকে বোঝা যায় আমলাতন্ত্র কেমন করে সাধারণ মানুষের ইচ্ছাকে দমন করছিল তার একটা প্রকাশ রয়েছে। বেশ কয়েক বছর পর, তিনি স্বীকার করেছিলেন যে আসলে স্টালিনের সমালোচনা করেই সুরটা করেছিলেন। 

বোঝাই যাচ্ছে, সস্তাকোভিচকে পরবর্তীতে সাবধানে সুর করতে হতো। এটা তাঁর সুরগুলো শুনলেও বোঝা যায়। প্রথম মহাকাশচারী ইউরি গ্যাগারিন তাঁর একটা গান মিশন কন্ট্রোলের রেডিও থেকে গেয়ে পাঠিয়েছিলেন।

এই সুরগুলো সস্তাকোভিচের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য ভালো উপায় হতে পারে:

Piano Concerto no. 1, opus 35 

Symphony no. 5 in D minor, opus 47

Symphony no. 1 in F minor, opus 10

Cello Concerto no. 1, opus 107

String Quartet no. 3 and no. 8


পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (পর্ব ১৩: বিংশ শতাব্দীর সংগীত, ক্লড ডেবুসি, মরিস রাভেল)

বিংশ শতাব্দীর সংগীত

বিগত শতাব্দীর সংগীতকার যাঁরা পূর্বতন নিয়মকানুন ভাঙতে চেয়েছিলেন তাঁদের অন্তত এটুকু চিন্তা ছিল যে, আর যাই হোক, সংগীত ‘শুনতে ভালো হওয়া চাই’ কিংবা ‘তাতে সুর এবং তাল থাকা চাই’। কিন্তু, বিংশ শতাব্দীর সংগীতকারেরা এই নিয়মটুকুও ভেঙে দিয়েছিলেন। বিংশ শতাব্দীর সংগীত শুনতে তাই অদ্ভুত, অনেক বেশী বেসুরো। এই শতাব্দীর সংগীতকারদের দুর্দান্ত সব ধারণা মাথায় কিলবিল করেছে। এর ফলে একেবারেই আনকোরা, আগ্রহ জাগানিয়া, অপ্রচলিত অনেক সংগীত সৃষ্টি হয়েছে এই শতাব্দীতে। তবে, সংগীত আধুনিক হলেই যে তাকে বেসুরো হতে হবে এমন কোনো কথা কিন্তু নেই। এই শতাব্দীর অনেক সংগীতকারের সুরই কিন্তু সুরেলা এবং সেগুলোর সঙ্গে পূর্বতন সংগীতকারদের যোগসূত্র অনুভব করা যায়। 


ক্লড ডেবুসি

বিংশ শতাব্দীর যদি একজন সংগীতকারের নাম নিতে হয় তাহলে তিনি ক্লড ডেবুসি (১৮৬২-১৯১৮)। তবে তিনি সময়ের থেকে এগিয়ে ছিলেন। তিনি বিংশ শতাব্দীর সুর তৈরি করতে শুরু করেছিলেন ১৮৯৪ সাল থেকেই।

ক্লড ডেবুসি

ডেবুসি ছিলেন ইম্প্রেশানিস্ট নামের একদল সংগীতকারদের একজন অনুসারী। বিভিন্ন দৃশ্য, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ আমাদের মনের মধ্যে যে ছাপ ফেলে, ইম্প্রেশানিস্টরা সেই ছাপটাকেই শিল্পের মধ্যে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। ক্লড মনেঁ এবং পিয়েরে-অগাস্টিন রেনোঁ’র মত চিত্রশিল্পীরা যেমন চিত্রকলায় এইসব প্রতীতি ধরার চেষ্টা করেছিলেন, তেমনি ক্লড ডেবুসি চেষ্টা করেছিলেন সংগীতের বেলায়।

এইরকম প্রতীতিকে ধরার জন্য ডেবুসির প্রয়োজন ছিলো সংগীতের এক নতুন ভাষার। এতোদিনের প্রতিষ্ঠিত হারমোনি আর কর্ডগুলো দিয়ে তা সম্ভব ছিলো না। তাঁর দরকার ছিলো আলাদা কর্ড, আলাদা কর্ড প্রোগ্রেশন যা আলাদা ধরনের মাত্রা তৈরি করে।

এইরকম ধারণা নিয়ে ডেবুসি প্যারিস কনজার্ভেটরিতে টিকতে পারলেন না, কারণ সেখানে অপ্রচলিত হারমোনি নিয়ে কাজ করার কোনো উপায় ছিলো না। মজার কথা হলো, কয়েক বছর পর এক ছাত্র ডেবুসির স্বরলিপি নিজের কাছে রাখার অপরাধে বহিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো।

বোঝাই যাচ্ছে, প্যারিসের শ্রোতাদের এই নতুন শব্দ হজম করতে বেশ সময় লেগে গিয়েছিলো। আজকের শ্রোতারা ডেবুসির সুরকে আকর্ষণীয় বলে মনে করে, কিন্তু তখনকার শ্রোতাদের কাছে এসব চেঁচামেচি মনে হত।

ডেবুসির সবচেয়ে আগ্রহোদ্দীপক আবিষ্কার হলো হোল-টোন স্কেল। সাধারণত, সাধারণ স্কেলে পরপর একটা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে স্বরগুলো বাজাতে হয়। কিন্তু হোল-টোন স্কেলে সবগুলো স্বর পূর্ণ দূরত্ব রেখে বাজাতে হয়। এর ফল হলো জাদুকরী, স্বপ্নীল, অনেকটা হার্পের মত শব্দ। 

ডেবুসির প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সুরটি হলো স্টেফানি মালর্মের কবিতার উপর ভিত্তি করে তৈরি করা প্রিলুড টু দ্য আফটারনুন অফ আ ফন। কবিতায় দেখা যায় এক মেষ শাবক দুপুরবেলা একা একা বেরিয়ে পড়ে। কবিতার সঙ্গে সুরের মেজাজ একদম মিশে গিয়েছিলো। শুনতে গেলে এক স্বপ্নীল, গভীর ইন্দ্রীয়গত অস্পষ্ট অনুভূতি তৈরি হয়।

ডেবুসির আরেকটি বিখ্যাত সংগীত হলো লা মার (দ্য সি)। এই সুরে, পানির উঠানামার অনুভূতি হয়, একটা ঢেউয়ের সাথে আরেকটা ঢেউ যেন খেলা করছে এবং সমুদ্রের উপর দিয়ে বাতাস যেন উন্মত্তবেগে বয়ে যাচ্ছে। 

ডেবুসি শুনতে হলে অবশ্যই প্রিলুড টু দ্য আফটারনুন অফ আ ফন এবং লা মার শুনতেই হবে। এরপর শুনতে হবে দৃশ্যময়, গভীর বিরাগময় সুর নাকচার্নস এবং ইমেজেস। আর তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত পিয়ানোর সংগীত ক্লেয়ার ডি লুন তো আছেই। 


মরিস রাভেল

মরিস রাভেলের (১৮৭৫-১৯৩৭) চোখে ক্লড ডেবুসি ছিলেন নায়ক। আরেক ফরাসি শিল্পী রাভেলও ছিলেন প্যারিস কনর্জাভেটরি থেকে শেখা একজন ইম্প্রেশানিস্ট সংগীতকার। তবে তাঁর সুর ডেবুসির মত ধোঁয়াশাপূর্ণ ছিলো না। রাভেলের সংগীত আমেরিকার জ্যাজ সংগীত দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিলো। জ্যাজের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ১৯২৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের সময়।

মরিস রাভেল

একটা নির্দিষ্ট সংগীত ছাড়া রাভেলের অন্যান্য সংগীতের সঙ্গে অনেকেই কম পরিচিত। তাঁর বিখ্যাত সুর হল বোলেরো। এই সুরটি স্প্যানিশ তালের উপর তৈরি হয়েছিল। এতে একটা খুব সাধারণ সুর বারবার ঘুরে ঘুরে চলতে থাকে এবং আস্তে আস্তে চড়তে থাকে এবং কিছুক্ষণ পরপর কিছু কিছু বাদ্যযন্ত্র যুক্ত হতে থাকে। প্রায় ১৫ মিনিট ধরে এটা চলতে থাকে। তারপর ক্লাইম্যাক্সে এসে সমস্তকিছু যেন ধুয়ে নিয়ে চলে যায়। এই বার বার একই জিনিস চলতে থাকা সুরটিকে একেবারেই পাগলামী মনে হবে নাকি দুর্দান্ত উত্তেজনাপূর্ণ বলে মনে হবে সেটা নির্ভর করবে আপনার দৃষ্টিভঙ্গীর উপর। এটা এতোই বেশী যৌনতার অনুভূতিপূর্ণ যে, হলিউডের সিনেমায় যৌনদৃশ্য দেখানোর সময় এই সুরটা বহুবার ব্যবহার করতে দেখা গেছে। 

রাভেলের আরেকটা সেরা সংগীত হল ল ভালস (দ্য ওয়াল্টজ) এবং এটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার কিছুদিনের মাঝে লেখা হয়েছিলো। শুরুতেই একটা ধোঁয়াশার মধ্য দিয়ে অর্কেস্ট্রা একটা খুব সাধারণ নাচের সুর বাজিয়ে চলে। এই সুরটা যুদ্ধের আগের শান্তশিষ্ট সমাজের কথা বুঝায়। কিন্তু সুরটা যতোই এগিয়ে চলে ততোই উদ্ভট এবং বেসুরো হতে থাকে। এটা ইউরোপের সমাজের ভাঙনকে বুঝায়। এবারও রাভেল একটা বিরাট ঝাপটা দিয়ে সুরটা শেষ করেন, পুরো অর্কেস্ট্রা একসাথে ভয়ংকরভাবে বেজে ওঠে সবার শেষে।

তবে ড্যাফনিজ এবং ক্লোয়ে ব্যালেটির কথা না বললেই নয়। তিনি এটি ব্যালে রুশে দলের জন্য লিখেছিলেন (সামনের অধ্যায়ে এটা নিয়ে আলাপ করা হয়েছে)। এই সুরটা পরীদের নিয়ে। এই সুরটা অবশ্যই শুনতে হবে। এছাড়া -

Boléro
La Valse
Rhapsodie espagnole

পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (পর্ব ১২: মিখাইল গ্লিংকা এবং মাইটি ফিস্টফুল, পিটার চাইকোভস্কি, সের্গেই রকমানিনফ)

মিখাইল গ্লিংকা এবং মাইটি ফিস্টফুল

একটা পুরাতন কথা আছে, ‘যেখানে কৃষকের লোকসংগীত আছে, সেখানে জাতীয়তাবাদী ধ্রুপদী সংগীতও আছে।’ রাশিয়ার বেলায় কথাটি সত্য। এইরকম লোকসংগীত এবং জাতীয়তাবাদী ধ্রুপদী সংগীতও, দুটোই রাশিয়ার পর্যাপ্ত আছে। 

মাইটি ফিস্টফুল

মিখাইল গ্লিংকা (১৮০৪-১৮৫৭) ছিলেন প্রথম সংগীতকার যিনি রাশিয়ান লোকসংগীতকে রাশিয়ান ধ্রুপদী সংগীতে প্রয়োগ করেছিলেন। হয়তো তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত সুর, রুসলান এন্ড লুদমিলা’র ওভার্চারটা আপনারা শুনেছেন। এটা অর্কেস্ট্রা কনসার্টগুলোর অন্যতম প্রধান একটা বাজনা কারণ এটা একটু হালকা চালের এবং এতে প্রচুর চড়া সুর আছে। এতে ভিয়োলা এবং চেলো’র বাজানোর জন্য চমৎকার সব সুর আছে এবং এটা বাজানো তেমন কঠিন নয়।

গ্লিংকা ছিলেন দীর্ঘ সুর রচনা করার ওস্তাদ এবং এইসব সুরগুলোর নিজস্ব রুশ গন্ধ আছে। রোমান্টিক যুগের রাশিয়ান সংগীতকাররা তাঁকে গুরু মানতেন। তাঁর অনুকরণ করতে গিয়ে মাইটি ফাইভ বা মাইটি ফিস্টফুল নামে সংগীতকারদের একটা দল তৈরি হয়েছিল যাঁরা তাঁদের সংগীতে পশ্চিম ইউরোপীয় প্রভাব দূর করে রুশ প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। মাইটি ফিস্টফুলের পঞ্চপান্ডবের নাম হল মিলি বালাকিরেভ (১৮৩৭-১৯১০), ইনিই সবাইকে একত্র করেছিলেন; সেজার চুই (১৮৩৯-১৯১৮); আলেক্সান্ডার বোরোডিন (১৮৩৩-১৮৮৭); মডেস্ট মাসার্গস্কি (১৮৩৯-১৮৮১) এবং নিকোলাই রিমস্কি-কোরসাকভ (১৮৪৪-১৯০৮)। 

এঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন সৌখিন সংগীতকার, কিন্তু শুধুমাত্র বালাকিরেভ ছিলেন পেশাদার সংগীতকার। চুই ছিলেন মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিঙের একজন অধ্যাপক, বোরোডিন রসায়নবিদ, মাসার্গস্কি প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং রিমস্কি-কোরসাকভ নৌবাহিনীর অফিসার। এঁরা সবাই ছিলেন সত্যিকার অর্থেই গ্রামের মানুষ।


পঞ্চপান্ডব

ছোটোবেলা থেকেই রিমস্কি-কোরসাকভ ছিলেন অসাধারণ পিয়ানোবাদক। কিন্তু তাঁর মন পড়ে রইতো সাগরে। বারো বছর বয়সে তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গের নাভাল একাডেমিতে পড়তে যান। গ্রাজুয়েশন শেষ করে তিনি বাইশ বছর নৌবাহিনীতে কাজ করেন - এগারো বছর নাবিক এবং বাকি এগারো বছর নেভি ব্যান্ডের প্রধান হিসেবে।

নৌবাহিনীর অফিসার থাকাকালীন তাঁর সাথে মিলি বালাকিরেভের দেখা হয়। বালাকিরেভের ভাষ্যে, সেইসময়কার সংগীতকারেরা ফরাসি এবং জার্মান সংগীতকারদের থিমের উপর বেশী নির্ভর করতেন। তাঁদের উচিত রুশ ঐহিত্যের দিকে মন দেওয়া। বালাকিরেভ রিমস্কি এবং অন্যান্য তরুণ প্রতিভাবানদের তাঁর দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করেন। এইভাবেই ‘মাইটি ফাইভ’ এর জন্ম হয়।

নেভির চাকরি শেষ হওয়ার পর, রিমস্কি সেন্ট পিটার্সবার্গ কনজার্ভেটরিতে কম্পোজিশনের অধ্যাপক হিসেবে কাজ পান। রিমস্কি-কোরসাকভ খুবই ভাল শিক্ষক ছিলেন। এমনকি নৌবাহিনীর চাকরির পরে তিনি নিজে নিজেও অনেক হারমোনি, কাঠামো, কাউন্টারপয়েন্ট নিয়ে পড়াশোনা করেন যাতে ছাত্রদেরও কিছু শেখাতে পারেন।

কালক্রমে, নিকোলাইয়ের বেশ কিছু প্রতিভাবান ছাত্র বিখ্যাত সংগীতকারও হন, যেমন সের্গেই প্রোক্রফিয়েভ এবং ইগর স্ট্রাভিনস্কি। রিমস্কি-কোরসাকভ তাঁদের সংগীতের সবধরনের বিষয় শেখালেও বিশেষ করে শিখিয়েছিলেন অর্কেস্ট্রেশন। এই বিষয়ে রিমস্কি একটা অসাধারণ বইও লিখেছিলেন যা আজও সংগীতকারদের কাছে পাঠ্য।

রিমস্কি-কোরসাকভের সেরা সুর হল শেহেরাজাদী। আলিফ লায়লার গল্পের সেই শয়তান সুলতান, যে কিনা প্রতি রাতে একটা করে বিয়ে করে এবং রাত শেষে তাকে মেরে ফেলে। কিন্তু, একবার শেহেরাজাদী নামের এক নারী তাকে বিয়ে করার পর একের পর এক অসাধারণ গল্প বলে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে। প্রতিটা গল্পের শেষেই তিনি একটা করে রহস্য রেখে দিতেন যাতে সুলতান পরের গল্প শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকে। এভাবে ১০০১ রাত্রি পার হয়ে যায়। প্রায় আড়াই বছর এইরকম চলার পর সুলতান তাঁর হত্যা করার পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়।


একমুঠো মাইটি ফাইভ

মাইটি ফাইভের যেসব সুর শোনা যেতে পারে:

Rimsky‐Korsakov: Scheherazade, opus 35
Rimsky‐Korsakov: Russian Easter Overture, opus 36
Mussorgsky: Night on Bald Mountain 
Mussorgsky: Pictures at an Exhibition 
Borodin: Prince Igor: Polovtsian Dances
Borodin: Symphony no. 2 in B minor
Overture to Ruslan and Ludmila

পিটার চাইকোভস্কি

রাশিয়ার সবচেয়ে সেরা সংগীতকার কিন্তু মাইটি ফিস্টফুলের সদস্য ছিলেন না। তবে, তিনি ছিলেন আত্মমগ্ন এবং উন্মাদ, যাঁর পুরো জীবনটা কেটেছে নানান সমস্যায়। তাঁর নাম পিটার ইলিচ চাইকোভস্কি (১৮৪০-১৮৯৩)।

পিটার চাইকোভস্কি

চাইকোভস্কির সচ্ছল বাবা-মা তাঁর সহজাত প্রতিভার কথা বুঝতে পেরেছিলেন। তবে তাঁরা এটাও বুঝেছিলেন যে, কেউই সংগীত করে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামাতে পারে না। তাই তাঁরা ছেলেকে সেন্ট পিটার্সবার্গের আইন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। এবং যথারীতি, পিটার আইন পড়া ছেড়ে সংগীতে মনোনিবেশ করলেন এবং সেন্ট পিটার্সবার্গ কনজার্ভেটরিতে ভর্তি হলেন।

এক পর্যায়ে চাইকোভস্কি মস্কোতে নতুন গড়ে ওঠা একটা কনজার্ভেটরিতে শিক্ষকতার সুযোগ পেলেন। তখন তিনি কপর্দকশূন্য।

তাঁর জীবনে প্রথম যে সুযোগটি এসেছিলো তা হলো, রেললাইনের ব্যবসা করেন এক বিধবা মহিলা, নাম নাদেজদা ভন মেক, গান শুনে তাঁর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। এই বিধবা মহিলাটি তাঁকে খুব করে চাইতেন, কিন্তু সেটা সেইসময় সদ্য বিধবাদের পক্ষে একেবারেই সমর্থনযোগ্য ছিলো না। সুতরাং, মহিলা বারবার চাইকোভস্কিকে টাকা পাঠিয়ে দিতেন, কিন্তু কখনো দেখা করতেন না। বলাই বাহুল্য চাইকোভস্কি এই মহিলার কাছে অশেষ কৃতজ্ঞ ছিলেন এবং তিনি তাঁর চতুর্থ সিম্ফোনি তার এই ‘সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে’ উৎসর্গ করেছিলেন।

নাদেজদার পয়সায় চাইকোভস্কির অর্থকষ্ট ছিলো না, কিন্তু অন্যান্য সমস্যাগুলো সবে দানা বাঁধতে শুরু করেছিলো। এর অন্যতম কারণ তিনি ছিলেন সমকামী। সমকামীতা তখন রাশিয়ায় নিষিদ্ধ এবং এর শাস্তি ছিলো সাইবেরিয়ায় নির্বাসন। চাইকোভস্কি অনেকদিন তাঁর এই সত্য লুকিয়ে রেখেছিলেন। এক সময় হয়তো সেরে উঠবেন ভেবে এক নারী ভক্তকে বিয়েও করেছিলেন। কিন্তু সেই বিয়ে তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। বিবাহ বিচ্ছেদ তাকে একেবারে নিঃস্ব, অসহায় এবং একা করে দিয়েছিলো।


ব্যথার দান

ব্যক্তিগত জীবনে দুঃখ থাকলেও, চাইকোভস্কির সংগীত, বিশেষ করে সিম্ফোনি, ব্যালে, অপেরা এবং ওভারর্চারগুলো অনেক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং তাঁর নামও পৃথিবীর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি তিনি ১৮৯১ সালে নিউ ইয়র্কের কার্নেগী হলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কনসার্টও পরিচালনা করেছিলেন।

চাইকোভস্কির সবচেয়ে বড় অবদান সুরে। গ্লিংকা যে ঐতিহ্য চালু করে দিয়েছিলেন, চাইকোভস্কি সে পথে না গিয়ে তাঁর সুরগুলোকে নিজের মতো করে গড়ে নিয়েছিলেন। আপনি অবশ্যই তাঁর সুর শুনেছেন। রোমিও এন্ড জুলিয়েট সিনেমায় যে উন্মাতাল সুরটা শোনা যায় সেটা চাইকোভস্কির সুর। আর দ্য নাটক্র্যাকারের কথা কে না জানে, এটা পৃথিবীর অন্যতম পরিচিত ব্যালে।

চাইকোভস্কির জীবনের বেশীরভাগ সময় দুঃখ দুর্দশায় কাটলেও, দ্য নাটক্র্যাকারের আনন্দদায়ক সুর লেখার ক্ষমতা আমাদের বিস্মিত করে। কিন্তু তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টিটি মোটেও আনন্দদায়ক নয়। সিম্ফোনি নম্বর ৬-এর আরেক নাম দ্য প্যাথেটিক। এটি তাঁর সবচেয়ে ব্যক্তিগত এবং গভীর বোধসম্পন্ন সুর। চাইকোভস্কির ভিতরের যুদ্ধই তাঁকে দিয়ৈ প্যাথেটিকের মত একটা সিম্ফোনি লিখিয়ে নিয়েছে। অনেক সংগীতকারই মনে করেন যে এর লম্বা এবং উন্মত্ত সুরগুলো তাঁর মনের ভিতরে একটা গোপন জীবনকে পুষে রাখার অন্তর্বেদনারই প্রকাশ। সবচেয়ে মারাত্মক হলো এটার শেষ মুভমেন্টটা, যেটা শুনে মনে হয় যেন চাইকোভস্কির আর বাঁচার কোনো আশাই নাই।

এই আত্মজীবনীমূলক সুরটাই চাইকোভস্কির সবচেয়ে বড় অর্জন। এটা প্রথমবার পরিবেশনের এক সপ্তাহের মধ্যেই চাইকোভস্কি মৃত্যুবরণ করেন।

চাইকোভস্কি শুরু করা যেতে পারে:

Romeo and Juliet Overture‐Fantasy
Suite from the ballet Swan Lake, opus 20
Piano Concerto no. 1 in B‐flat minor, opus 23
Violin Concerto in D major, opus 35
Symphonies no. 4, 5, and (especially) 6

সের্গেই রকমানিনফ

১৯৪৩ সাল অব্দি বেঁচে থাকার পরেও সের্গেই রকমানিনফকে (১৮৭৩-১৯৪৩) বলা যায় একজন সত্যিকার রুশ রোমান্টিক। তাঁর বেড়ে ওঠা সেন্ট পিটার্সবার্গে এবং সেখানকার কনজার্ভেটরিতেই সংগীত নিয়ে লেখাপড়া। রাশিয়ান ওস্তাদ চাইকোভস্কি আর মাইটি ফিস্টফুলেরা যা যা দিয়েছেন তার সবই তিনি শিখেছিলেন। গ্রাজুয়েশনে চাইকোভস্কি তাঁকে সবার থেকে বেশী নম্বর দিয়েছিলেন।

রুশ বিপ্লবের সময় রকমানিনফ যখন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান তখন তিনি তাঁর নিজ দেশের চেতনা সঙ্গে করেই নিয়ে গিয়েছিলেন।

সের্গেই রকমানিনফ

সম্মোহিত সের্গেই

সংগীত জীবনের শুরুর দিকে রকমানিনফ দীর্ঘ সময় ‘কম্পোজার’স ব্লকের’ মধ্যে ছিলেন। তাঁর সিম্ফোনি নং ১ এর ভয়াবহ নেতিবাচক সাড়ার পরে রকমানিনফ একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন, সমস্ত উদ্দীপনা হারিয়ে ফেলেছিলেন। তখন তিনি আর একটা স্বরও লিখতে পারতেন না। তারপর একদিন এক সম্মোহকের কাছ থেকে ফেরার পরেই তাঁর ব্লক কাটে।

সেরে ওঠার পর রাকমানিনফের প্রথম কাজটা ছিল সেকেন্ড পিয়ানো কনসার্টো। এটাই তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত সুর। তিনি এই সুরটাকে ওই সম্মোহকের প্রতি উৎসর্গ করেছিলেন।

সের্গেই ছিলেন একজন সাড়া জাগানো পিয়ানোবাদক এবং তিনি তাঁর বেশীরভাগ সংগীতই কোনো নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানে নিজেই বাজানোর জন্য লিখতেন। আজও তিনি তাঁর পিয়ানোর সুরগুলোর জন্যই বেশী পরিচিত। সংগীতকাররা তাঁকে ডাকে ‘রকি’ বলে। তাঁর সেকেন্ড পিয়ানো কনসার্টোকে বলা হয় ‘রকি ২’ এবং তাঁর সাংঘাতিক জটিল পিয়ানো কনসার্টো ৩-কে বলা হয় ‘রাক ৩’ বা ‘রকি ৩’।


রাকমানিনফের আরও সেসব সংগীত শুনতে হবে:

Piano Concerto no. 2 in C minor, opus 18
Piano Concerto no. 3 in D minor, opus 30
Rhapsody on a Theme of Paganini, opus 43
Symphony no. 2 in E minor, opus 27
Prelude in C‐sharp minor, opus 3, no. 2
Prelude in D major, opus 23, no. 4
Piano Sonata no. 2 in B‐flat minor, opus 36


সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০

পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (পর্ব ১১: এডভার্ড গ্রিগ, ইয়ান সিবেলিয়াস, কার্ল নিলসেন)

এডভার্ড গ্রিগ

স্মেটানা আর ডিভোর্জাক যেমন ছিলেন বোহেমিয়ায় বিখ্যাত,তেমনি নরওয়েতে বিখ্যাত ছিলেন এডভার্ড গ্রিগ (১৮৪৩-১৯০৭)। আত্মপ্রত্যয়ী যেকোনো বড় সংগীতকারের মতো গ্রিগও জার্মানির লিপজিগে বড় বড় ওস্তাদদের কাছে শিখতে গিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, তিনি এতোই কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন যে ফুসফুসে রোগ বাঁধিয়ে বসেছিলেন এবং সেই রোগ তাঁকে পরবর্তী জীবনে অনেক ভুগিয়েছিল।

গ্রিগ

নরওয়ের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান

নরওয়েতে ফেরার পর গ্রিগ মাতৃভূমির স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে গেলেন। ১৮১৪ সাল থেকে নরওয়ে শাসন করছিলো সুইডেন আর তখন থেকেই নরওয়েজীয়রা স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল হয়ে ছিলো। রাজনীতি সচেতন শিল্পীরা বিশেষ করে নাট্যকার হেনরিক ইবসেন গ্রিগকে আন্দোলনে যোগ দিতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। তিনিও মনেপ্রাণে এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। তিনি মন থেকে জার্মান সংগীতের ছিটেফোঁটা দূর করে দিলেন এবং নরওয়েজীয় লোকসংগীতের সুর এবং তাল ব্যবহার করে সংগীত রচনা করতে শুরু করলেন।

নরওয়ের শ্রোতারা তাঁর এইসব সংগীতকে ভালোবেসে ফেললো। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ, মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে নরওয়েজীয় সরকার তাঁর জন্য আজীবন পেনশনের ব্যবস্থা করে। মৃত্যুর দুই বছর আগে, গ্রিগদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফল এলো, নরওয়ে সুইডেনের শাসন থেকে মুক্ত হলো। নরওয়ের বার্জেনে তাঁর শেষকৃত্যে প্রায় ৪০,০০০ মানুষ জড়ো হয়েছিল।

গ্রিগের বেশীরভাগ সংগীতই উজ্জ্বল এবং আনন্দের। তাঁর চমৎকার সুর ছিলো পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন। এডভার্ড গ্রিগের কিছু বিখ্যাত সুর হলো:

Piano Concerto in A minor, opus 16
Peer Gynt Suites no. 1 and no. 2 (incidental music to a play by Henrik Ibsen; they include many familiar melodies)
Holberg Suite for strings, opus 40


ইয়ান সিবেলিয়াস

ইয়ান সিবেলিয়াস বিখ্যাত হয়েছিলেন তার আংশিক কারণ হল তিনি সঠিক সময়ে সঠিক দিকটি বেছে নিয়েছিলেন। ঠিক যেমন সুইডেন নরওয়ে শাসন করতো, তেমনি ১৯ শতকের শেষ পর্যন্ত ফিনল্যান্ড শাসন করতো রাশিয়া।

সিবেলিয়াস

সিবেলিয়াস কথা

আর দশজন সংগীতকারের মতোই, মাকে খুশী করার জন্য ইয়ানও একটা ‘সম্মানজনক’ পেশা বেছে নিতে চেষ্টা করেছিলেন, এক্ষেত্রে সেটা হল আইন পেশা। কিন্তু, যা হবার তাই হলো। ইয়ান এক বছর পড়ার পর আইনের স্কুল বাদ দিয়ে সংগীত শিখতে হেলসিঙ্কি কনজার্ভেটরিতে চলে গেলেন। কালক্রমে, তিনি বার্লিন এবং ভিয়েনাতে সংগীত শেখার জন্য একটা বৃত্তিও পেয়ে গেলেন।

কিন্তু অস্ট্রিয়া থেকে ফেরার পর, তিনি দেখলেন তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি ফিনল্যান্ড রাশিয়ার শাসনে চলে গেছে। তিনি ইয়ং ফিনস নামের এক বিদ্রোহী দলে ভীড়ে গেলেন এবং এডভার্ড গ্রিগের মতো তিনিও তাঁর সংগীত থেকে যাবতীয় জার্মান প্রভাব ঝেড়ে ফেলে দিলেন। যদিও সিবেলিয়াসের সুর শুনতে ঠান্ডা আবহাওয়ার মতো শোনায়, মনে হয় যেন ক্লান্তিকর দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী; বর্ণহীন, তুষার ঢাকা, হিম বাতাসে ক্ষয়ে যাওয়া মাটি; ফিনিস লোকেদের আত্মার ভিতরের দুঃখগাঁথা।

এইসব অনুভূতি চমৎকারভাবে ধরা দিয়েছে তাঁর টোন পোয়েম ফিনল্যান্ডিয়ায়। সেটার সাদাসিধা শুরু থেকে শুরু করে গভীর বাণীসমৃদ্ধ থিম, তার বয়ে চলা এবং বিজয়ীর মত শেষ হওয়া - সবকিছুই ফিনিসদের আত্মা ছুঁয়ে গিয়েছিলো এবং তা ফিনিস স্বাধীনতা আন্দোলনের গানে পরিণত হয়েছিলো। বলাই বাহুল্য, রাশিয়ানরা এই সুর নিয়ে মাতামাতি করেনি, তারা এটাকে নিষিদ্ধ করেছিলো। জার্মানি এবং ফ্রান্সে এটা পরিবেশনের সময় ঝামেলা এড়ানোর জন্য একে শুধু ‘ফাদারল্যান্ড’ নাম দিয়ে পরিবেশন করা হয়েছিলো।

সিবেলিয়াসের সুরগুলো সাধারণত গভীর এবং ঘোলাটে। সিবেলিয়াস শুরু করতে হলে এই সুরগুলো শোনা যেতে পারে:
Finlandia, opus 26
Symphony no. 1 in E minor, opus 39
Symphony no. 2 in D major, opus 43
The Swan of Tuonela (from Legends), opus 22, no. 2


কার্ল নিলসেন

গ্রিগ এবং সিবেলিয়াস দুজনেই তাঁদের নিজেদের দেশ ছাড়িয়ে পুরো পৃথিবীতেই সুনাম কুড়িয়েছিলেন জীবদ্দশাতেই। কিন্তু ড্যানিশ জাতীয়তাবাদী সংগীতকার কার্ল নিলসেনের (১৮৬৫-১৯৩১) বেলায় তা হয়নি। আজকের দিনেও অনেক সংগীতপ্রেমীই নিলসেনের সংগীত সম্পর্কে বিশেষ জানেন না।

নিলসেন

দ্বীপ জীবন

নিলসেনের জন্ম ডেনমার্কের আইল অফ ফিন নামের এক দ্বীপে। এই দ্বীপের বৈরী আবহওয়া, সাদাসিধে জীবন সবই কার্লের সংগীতকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। সতেরো বছর বয়সে তিনি সংগীত রচনা শুরু করেন এবং আঠারো বছর বয়সে তিনি কোপেনহেগেন মিউজিক কনজার্ভেটরিতে যান।

কিন্তু, সেখানে তাঁর সনাতন ধাঁচের শিক্ষকদের পরামর্শে তিনিও জামার্নিতে যান। কার্ল নিলসেনও জার্মান-অস্ট্রিয়ান ধারার সংগীত শেখেন এবং যথারীতি বাড়ি ফেরেন এবং সেসব একেবারে নাকচ করে দেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘যে যতো বেশী করে দেখাতে পারবে সেই ততো বেশী স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বেটোভেন, মিকেলএঞ্জেলো, বাখ, বার্লিওজ, রেমব্রান্ট, শেকসপিয়র, গোথে, হেনরিক ইবসেন এবং এইরকম আরও অনেককেই প্রথমে মানুষ চিনতে পারেনি।’

নিলসেনও করে দেখিয়েছিলেন, বিশেষ করে তাঁর ছয়টি সিম্ফোনি। প্রত্যেকটি সুর সংগীতের একেকটা নতুন এলাকা চিনিয়ে দিয়েছিল। যেমন: পঞ্চম সিম্ফোনিতে নিলসেন স্নেয়ার ড্রামারকে বলেছিলেন ‘সুরটা নষ্ট করে দাও’। এই সুরের মত স্নেয়ার ড্রামকে এতো দারুণভাবে আগে কখনো ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।

নতুন ধরনের শব্দ তৈরি ছাড়াও তাঁর সুরে অনেকসময় বেসুরো শোনায় এমন ভুল স্বর এবং অপ্রচলিত হারমোনির ব্যবহার দেখা যায়। নিলসেন ক্রমে পৃথিবীর কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তবে, আজকের দিনে এসে তাঁর সংগীত পৃথিবীব্যাপী সবচেয়ে বেশী সমাদৃত হচ্ছে। 

নিসলেনের সহজ সুরগুলো দিয়ে শোনা শুরু করাই উচিত হবে। তারপর ধীরে ধীরে জটিল সুরের দিকে যাওয়া যাবে। 

Little Suite, opus 1

Maskarade Overture

Symphony no. 3, opus 27 (Sinfonia Espansiva)

Symphony no. 4, opus 29 (The Inextinguishable)

Concerto for Flute and Orchestra

Concerto for Clarinet and Orchestra, opus 33


পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের অতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (পর্ব ১০: ধ্রুপদী সংগীতে জাতীয়তাবাদ, বেডরিখ স্মেটানা, এন্টোনিন ডিভোর্জাক)

ধ্রুপদী সংগীতে জাতীয়তাবাদ

১৮৫০-এর পুরোটা সময় ধরে জার্মানি এবং অস্ট্রিয়ার সব রুইকাতলারা ধ্রুপদী সংগীতে একচ্ছত্র আধিপত্য ধরে রেখেছিলেন। সারা পৃথিবীর সংগীতকারেরা এইসব ওস্তাদদের কাছ থেকে শিখতে তখন ভিয়েনা, লিপজিগ, ওয়েমার শহরগুলোতে গিয়ে ভীড় করতেন। কোনো সংগীতকার কোন দেশ থেকে এসেছেন সেসব নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা ছিলো না। যতোক্ষণ পর্যন্ত না তিনি জার্মান-অস্ট্রিয়ান ধাঁচটা রপ্ত করতে পারছেন ততোক্ষণ পর্যন্ত কোনো পরিচয়ও অবশ্য জুটতো না।

তবে ঊনিশ শতকের শেষাংশ সংগীতের ইতিহাসের অন্যতম কৌতূহলোদ্দীপক একটা সময়। এই সময়টায় সংগীতকারেরা পারস্পরিক যোগাযোগটাকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নিজ নিজ দেশের সংগীতের দিকে মনোযোগী হয়ে ওঠেন।

প্রতিটি দেশেরই নিজ নিজ লোকসংগীত ছিলো। এতোদিন সেটা ‘উচ্চাঙ্গ’ সংগীত থেকে আলাদাই রাখা হতো। কিন্তু, এবার ধ্রুপদী সংগীতের বেলায় সেইসব লোকসংগীতই যেন অবলম্বন হয়ে উঠলো। যেভাবেই হোক, সংগীত জাতীয় মর্যাদার অংশ হয়ে গেলো। এই বোধটা অচিরেই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিলো।


বেডরিখ স্মেটানা

প্রথমদিককার একজন জাতীয়তাবাদী সংগীতকার ছিলেন বেডরিখ স্মেটানা। ঠিক যে সময়টায় ব্রামস পুরোনো জার্মান কাঠামো নিয়েই কাজ করছিলেন তখন সংগীতকার, পরিচালক ও পিয়ানোবাদক স্মেটানা (১৮২৪-১৮৮৪) সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের সংগীত করছিলেন - এমন সংগীত যেটা বোহেমিয়াকে তুলে ধরে।

স্মেটানা

স্মেটানার সময়ে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয় সাম্রাজ্য বোহেমিয়া শাসন করতো। স্মেটানা, এই বিদেশী শক্তির অধীনে থাকতে অপছন্দ করতেন। তিনি একদল বিদ্রোহীর সঙ্গে ভীড়ে গিয়েছিলেন যাঁরা স্বাধীন বোহেমিয়া কায়েম করতে চেয়েছিল। তাঁদের আঁতাত ব্যর্থ হলে, তিনি কিছুদিনের জন্য সুইডেনে পালিয়ে যান এবং তারপর ঠিক উল্টোপথে প্রাগে ফিরে আসেন। 


নদী বয়ে যায়

স্মেটানার অন্যতম আবেদনময় একটি সুর হলো ছয়টি টোন পোয়েমের একটি সংকলন যার নাম মা ভ্লাস্ট বা মাই ফাদারল্যান্ড। ওই সংকলনের দ্বিতীয় টোন পোয়েমটি ছিল সবচেয়ে বিখ্যাতধ দ্য মোলডৌ। এটি হলো বোহেমিয়ার একটি প্রধান নদীর নাম।

স্মেটানা সুরের মধ্যে নদীকে সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। বাজনাটার শুরুটা হয় দুটো বাঁশির সুর দিয়ে। এখানে বাঁশিদুটি হল পাহাড়ের উৎপত্তিস্থল থেকে দুটি ধারা হয়ে নেমে আসা নদীর রূপক। মোলডৌ যতো বড় হয়, অর্কেস্ট্রার আওয়াজও ততো বাড়তে থাকে, একটার পর একটা বাদ্যযন্ত্র যুক্ত হতে থাকে। নদী বনের মধ্য দিয়ে বয়ে যায় তখন হান্টিং হর্ন বেজে ওঠে, মাঠের মধ্য দিয়ে গেলে শোনা যায় তার ধারে বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে, রাতের বেলায় পানিতে নেমে আসে জলপরীর দল, খরস্রোতা হয়ে তা প্রাগ শহরে ঢুকে পড়ে, এবং শেষ পর্যন্ত, বাণিজ্য স্থাপনার মধ্যে যেতে শুরু করার সাথে সাথে তা সরু হয়ে আসে আর বাজনাও কমে আসতে শুরু করে।

স্মেটানার সাথে পরিচিত হতে গেলে অবশ্যই দ্য মোলডৌ শুনতে হবে, সেইসঙ্গে মাই ফাদারল্যান্ডের বাদবাকি পাঁচটা টোন পোয়েমও। তারপর শুনতে হবে তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত অপেরা - দ্য বার্টারড ব্রাইড।


এন্টোনিন ডিভোর্জাক

এন্টোনিন ডিভোর্জাকও (১৮৪১-১৯০৪) ছিলেন বোহেমিয়ান। তাঁর শৈশব ছিলো লোকসংগীত, লোকনাচ আর আনন্দের কৃষিকাজের সুরে ভরা। বিখ্যাত ডিভোর্জাক কসাই পরিবারের সর্বশেষ কসাই ছিলেন তাঁর বাবা। তবে তিনি বিয়েতে জিথারও বাজাতেন। বাবার সঙ্গে সঙ্গে বেহালা বাজিয়ে বাজিয়েই তরুণ এন্টোনিনের সঙ্গীতে হাতেখড়ি হয়েছিলো।

ডিভোর্জাক

ষোলো বছর বয়সে ডিভোর্জাক প্রাগে যান। সেখানেই তাঁর বেডরিখ স্মেটানার সংগীতের সঙ্গে পরিচয় হয়। এন্টোনিন বোহেমিয়ান লোক ভাষায় গান রচনা করে সবার টনক নড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর বুদ্ধিটা ছিল অতি সহজ কিন্তু ব্যবসা সফল। এই বুদ্ধির কারণেই ডিভোর্জাক একসময় প্রাগ কনজার্ভেটরিতে কম্পোজিশনের অধ্যাপক হয়ে গিয়েছিলেন।


হাসিখুশী ব্যক্তিত্ব

সংগীতের মাপকাঠিতে ডিভোর্জাক ছিলেন খামখেয়ালী। তিনি তাঁর বিখ্যাত ভাইদের মত (মানে বেটোভেন, বার্লিওজ, শুম্যানদের মত) বিষণ্ণ, নির্যাতিত কিংবা পাগল ছিলেন না। তিনি ছিলেন বেশ হাসিখুশী চরিত্রের। তাঁর এই হাসিখুশী চরিত্রের ছাপ সংগীতেও পড়েছিলো। 

ডিভোর্জাক নিজেও ছিলেন খুবই সাদাসিধা ভদ্রলোক। তাঁর ভালোলাগাগুলো ছিল সাধারণ এবং ছিল ছয়টি সন্তান। তিনি পায়রা পুষতে পছন্দ করতেন, সেগুলোর ওড়াওড়ি দেখতে ভালোবাসতেন। তিনি মরার আগেই বিখ্যাত হয়েছিলেন। তাঁর সংগীত দ্রুতই জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। 

তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শ্রোতা ছিলেন স্বয়ং ব্রামস। তিনি ডিভোর্জাকের সংগীতের একজন বড় প্রচারক ছিলেন। তিনিই তরুণ ডিভোর্জাককে তাঁর প্রকাশকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁদের নৈকট্য ছিল বন্ধুত্বের চেয়েও বেশী। ডিভোর্জাকের কিছু সিম্ফোনিতে, বিশেষ করে সিম্ফোনি নং ৭ এ ব্রামসের প্রভাব স্পষ্ট। এমনকি সেখানে একবার জার্মানিক, পরক্ষণেই বোহেমিয়ান, তারপর আবার জার্মানিক, তারপর আবার বোহেমিয়ান এইরকম ধাঁচের পরিবর্তন দেখা যায়।


আমেরিকায় আমন্ত্রণ

একান্ন বছর বয়সে, ১৮৯২ সালে আমেরিকায় ডিভোর্জাককে নবগঠিত নিউ ইয়র্কের ন্যাশনাল কনজার্ভেটরি অফ মিউজিকের দায়িত্ব নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি তাঁর নিজের জাতীয় পরিচয়, উন্নত বোহেমিয়ান ঐতিহ্য, পরিবার এবং ভক্তদের ফেলে যেতে গড়িমসি করছিলেন। তখন তিনি খেয়াল করলেন যে প্রাগ কনজার্ভেটরিতে তাঁর যে বেতন তার প্রায় ২৫ গুণ বেশী বেতন তাকে সাধা হচ্ছে। কাজেই তিনি নিউ ইয়র্কের জাহাজ ধরলেন।

ডিভোর্জাক যুক্তরাষ্ট্রে তিন বছর ছিলেন। কিন্তু তিনি ঘরের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলেন এবং বেশীরভাগ সময় আইওয়ার বোহেমিয়ান কলোনিতেই পড়ে থাকতেন। যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীন আমেরিকান ইন্ডিয়ান এবং আফ্রো-আমেরিকান সংগীতের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটলেও তিনি সেই সময় তাঁর অন্যতম বিখ্যাত সিম্ফোনি নং ৯ (ফ্রম দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড) লেখেন। সংগীতকারের নিজের ভাষ্যে, শুরুর সলো হর্নের সুরটা আফ্রিকান আমেরিকান ঐতিহ্যকে এবং তৃতীয় মুভমেন্টের স্কের্জোটি জঙ্গলে ইন্ডিয়ান নাচের উৎসবকে বুঝিয়েছে। 

নিউ ওয়ার্ল্ড সিম্ফোনি শুনলে মনে হবে যেন এটা আমেরিকান সংগীত। কিন্তু কোনো চেক লোকের সামনেও এটা বাজান, নিশ্চিতভাবে তিনি বলবেন এটা বেহোমিয়ান সংগীত। এটাই সংগীতকারের সার্থকতা। 

ডিভোর্জাকের সংগীত যতো শোনা যায় ততোই আনন্দ পাওয়া যায়। যেমন:

Cello Concerto in B minor, opus 104
Symphonies no. 7, 8, and 9
Romance for Violin and Orchestra in F minor, opus 11
Serenade for Strings in E major, opus 22 
Serenade for Winds in D minor, opus 44
String Quartet no.6 in F major