শুক্রবার, ১৩ মার্চ, ২০২০



ঔপনিবেশিক ভারতের ইতিহাসচর্চার কতিপয় দিক প্রসঙ্গে[1]
রণজিৎ গুহ
১. ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসচর্চা দীর্ঘকাল অভিজাততন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে – ঔপনিবেশিক অভিজাততন্ত্র এবং বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী অভিজাততন্ত্র। দুটোই ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভাবাদর্শজাত পণ্য হিসেবে উৎপত্তি লাভ করলেও ক্ষমতার পালাবদলের মাঝে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছে এবং ব্রিটেনে নয়া-ঔপনিবেশিক এবং ভারতে নয়া-জাতীয়তাবাদী ডিসকোর্সের মধ্যে মিশে গিয়েছে। উপনিবেশবাদী অথবা নয়া-উপনিবেশবাদী অভিজাত ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন বিভিন্ন ব্রিটিশ লেখক এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ, তাছাড়া ভারত এবং অন্যান্য দেশগুলোতেও তাদের অসংখ্য অনুসারী রয়েছে। জাতীয়তাবাদী অথবা নয়া-জাতীয়তাবাদী অভিজাত ইতিহাসচর্চা মূলত ভারতীয় চর্চা হলেও ব্রিটেন এবং অন্যান্য অঞ্চলের উদারপন্থী ইতিহাসবিদদের বাদ দিয়ে তা কখনো চর্চিত হয়নি।
২. অভিজাততন্ত্রের বিভিন্ন ধারাগুলো এই ধ্যান-ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত যে, ভারত রাষ্ট্র গঠনে এবং তার সার্বিক চেতনা বিকাশে জাতীয়তাবাদের যে ভূমিকা, তা একচেটিয়াভাবে বা প্রধানত অভিজাতদের অর্জন। উপনিবেশবাদী এবং নয়া-উপনিবেশবাদী ইতিহাসচর্চায় এই অর্জনগুলোর কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছে ব্রিটিশ শাসক, প্রশাসক, শাসনপ্রণালী, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সংস্কৃতিকে; আর জাতীয়তাবাদী এবং নয়া-জাতীয়তাবাদী লেখায় – ভারতীয় অভিজাত ব্যক্তিত্বদের, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, কর্মকান্ড এবং মতাদর্শকে।
৩. এই দুই ধরণের ইতিহাসচর্চার প্রথমটি ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে প্রাথমিকভাবে উদ্দীপনাদায়ী এবং প্রতিক্রিয়াশীল প্রণালী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। একেবারেই সংকীর্ণ আচরণগত ধারণার উপর ভিত্তি করে এটি জাতীয়বাদকে কিছু কর্মকান্ড এবং ধারণার সারবস্তু হিসেবে উপস্থাপিত করে যেগুলোর প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় অভিজাতগণ উপনিবেশবাদের তৈরি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সুযোগ-সুবিধা, সংস্থান ইত্যাদির প্রতি সাড়া দিয়েছিল। এই ধরণের ইতিহাসচর্চার একাধিক সংস্করণ রয়েছে, তবে যে মূলসূত্রটি তাদের মধ্যে বিদ্যমান তা হল, ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে এক ধরণের ‌‌‘শিখন প্রক্রিয়া’ হিসেবে চিহ্নিত করা যার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং শাসনের স্বার্থে ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রবর্তিত সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের সঙ্গে আপোষ করে দেশীয় অভিজাতগণ রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। অভিজাতদের এই প্রক্রিয়ায় যেতে যেটি বাধ্য করেছিল, ইতিহাসচর্চার এই ধারামতে তা, রাষ্ট্রের ভালোর জন্য কোনো মহৎ আদর্শ ছিল না বরং তা ছিল নিতান্তই সম্পত্তি, ক্ষমতা এবং ঔপনিবেশিক শাসকদের তৈরি ও তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মান-সম্মানের ভাগ বাটোয়ারার আকাঙ্ক্ষা; এবং এটি ছিল ওইসব পুরষ্কারের জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস এবং ক্ষমতাসীন এবং দেশীয় অভিজাত এবং সেইসাথে তাদের আরও বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যকার প্রতিযোগিতা, আর এগুলোই নাকি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচনা করেছিল।
৪. আরেক ধরণের অভিজাত ইতিহাসচর্চার সাধারণ প্রবণতা হল ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে প্রাথমিকভাবে এক ধরণের আদর্শবাদী প্রয়াস হিসেবে উপস্থাপন করা যার মূলকথা হল পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতার পথে জনগণের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্বদেশী অভিজাত ব্যক্তিগণ। এই ধরণের ইতিহাসচর্চার একাধিক সংস্করণ রয়েছে যেগুলো এই সমস্ত প্রয়াসের প্রেরণাশক্তি হিসেবে বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ অথবা অভিজাত সংঘ বা প্রতিষ্ঠানের উপর গুরুত্বারোপের ভিত্তি করে পৃথক পৃথক ধারায় আলাদা হয়েছে। তবে, যে মূলসূত্রটি তাদের প্রত্যেকের মধ্যেই বিদ্যমান তা হল, সহযোগিতার যতোই প্রমাণ থাকুক, ঔপনিবেশিক শাসনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে গৌণ করে দেখিয়ে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে দেশীয় অভিজাতদের ইতিবাচক চাওয়ার অন্যতম প্রকাশ হিসেবে উপস্থাপন করা, তাদের সহযোগিতার বিষয়টির তুলনায় একে বড় করে দেখানো, তাদের ভূমিকাকে শোষক এবং নিপীড়ক হিসেবে না দেখিয়ে জনগণের ইচ্ছার প্রবর্তক হিসেবে তুলে ধরা, নগন্য ক্ষমতা হলেও সেদিকে তাদের আকাঙ্ক্ষা এবং ব্রিটিশ রাজের সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য তাদেরকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদানের বিষয়গুলোকে ছাপিয়ে তাদের পরার্থপরতা এবং আত্মত্যাগকে তুলে ধরা।
৫. অভিজাত ইতিহাসচর্চা অবশ্যই অপ্রয়োজনীয় নয়। এটি আমাদের ঔপনিবেশিক দশার কাঠামো, নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে তার বিভিন্ন সংগঠনের কার্যকলাপ বুঝতে সাহায্য করে, যেসব শ্রেণী একে টিকিয়ে রাখে তাদের সম্পৃক্ততার প্রকৃতি, তৎকালীন সময়ের মুখ্য মতাদর্শ হিসেবে অভিজাততন্ত্রের বিভিন্ন আঙ্গিক; দুই শ্রেণীর অভিজাতদের মধ্যকার বৈপরীত্য এবং উভয় শ্রেণীর সাধারণ বিরোধী শ্রেণী এবং জোটেদের সম্পর্কে, বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্রিটিশ এবং ভারতীয় ব্যক্তিত্ব ও অভিজাত প্রতিষ্ঠানসমূহের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে। সবচেয়ে বড় কথা এটি আমাদেরকে খোদ ওই ইতিহাসচর্চাটিকেই বুঝতে সাহায্য করে।
৬. তবে, এই ধরণের ইতিহাসচর্চা যেটি করতে পারে না তা হল ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারা। কারণ এটা ব্যাখ্যা করা তো দূরের কথা, জাতীয়তাবাদের উৎকর্ষের ক্ষেত্রে অভিজাতদের ব্যতিরেকে সাধারণ জনগণ স্বতপ্রণোদিতভাবে যে ভূমিকা রেখেছে সেটিকে স্বীকারই করে না। এই ইতিহাসচর্চার দৈন্যতার কথা বলতে গিয়ে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে জনসম্পৃক্ততার বিষয়টি বুঝতে এবং মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে ‘নেতিবাচকভাবে, একে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ভেবে এবং ইতিবাচকভাবে, বড়জোড়, কয়েকজন অভিজাত নেতার চমকপ্রদ গুণ অথবা হাল ফ্যাশনের ভাষায় বিবিধ গোষ্ঠীকে প্রভাবিত করে সমাজ কাঠামোর উত্তরণ ঘটানো হিসেবে দেখে’ যে অপরাগতার পরিচয় দেয় নিঃসন্দেহে সেই বিষয়টি তুলে ধরা যায়। সুতরাং, শত শত, হাজার হাজার আবার কখনো বা লক্ষ লক্ষ মানুষের জাতীয়তাবাদী কর্মকান্ড ও মতাদর্শে এই যে অংশগ্রহণ সেটিকে তথাকথিত ‘সত্যিকার’ রাজনৈতিক কর্মকান্ডের বাইরের কিছু একটা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, অর্থাৎ, রাষ্ট্রযন্ত্র এবং অভিজাত প্রতিষ্ঠানগুলোকে চালিয়ে নেওয়া বা মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছে অভিজাতদের প্রভাব এবং বিভিন্ন উদ্যোগকে। এই ইতিহাসচর্চার দেউলিয়াত্ব প্রকাশ্যে ফুটে ওঠে তখনই যখন একে অভিজাতদের অনুপস্থিতিতে অথবা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে তৈরি হওয়া অসংখ্য জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন যেমন ১৯১৯ সালের রাওলাট বিদ্রোহ এবং ১৯৪২ সালের ভারত ছাড় আন্দোলনের মত আন্দোলনগুলোকে ব্যাখ্যা করতে বলা হয়। এই ধরণের একপেশে এবং অন্ধ ইতিহাসচর্চা কেমন করেই বা অভিজাত রাজনীতির বাইরের আন্দোলন যেগুলো চৌরী-চৌরা বা আরআইএন বিদ্রোহীদের সঙ্গে সংহতি জানাতে সশস্ত্র সংগ্রামের মত কর্মকান্ডগুলোকে বুঝতে সাহায্য করবে?
৭. অভিজাত ইতিহাসচর্চা শ্রেণী সম্পর্কিত অপর্যাপ্ত চিন্তা-চেতনার কারণেই রাজনীতির সংকীর্ণ এবং আংশিক দিকগুলোকে প্রত্যক্ষভাবে অনুসরণ করে। এই ধরণের সমস্ত লেখাতেই ভারতীয় রাজনীতির অধিক্ষেত্রগুলোকে অবধারিতভাবে শাসনের প্রয়োজনে ব্রিটিশদের তৈরি এবং তাদের প্রণীত প্রতিষ্ঠানাদির উপর ভিত্তি করে উদ্ভুত বিভিন্ন আইনকানুন, নীতিমালা, অভিব্যক্তি এবং অন্যান্য সুপারস্ট্রাকচারের উপর অবস্থিত বলে ধরেই নেওয়া হয়েছে অথবা একচেটিয়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। অবধারিতভাবে, এই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাসচর্চাটি দেশীয় সমাজে যারা প্রভাবশালী গোষ্ঠী অর্থাৎ, ঔপনিবেশিক শাসক এবং তাদের দাসেরা যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে পারস্পরিক লেনদেনের মাধ্যমে যতটুকু নিয়ন্ত্রণ করেছে শুধুমাত্র ততোটুকুই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সারবস্তু, বাকিটা ওই রাজনীতিরই কাকতালীয় ঘটনা, এইরকম কিছু কর্মকান্ড এবং ধারণার সমষ্টির বাইরে রাজনীতিকে চিন্তা করতে পারে না।
৮. এই অ-ঐতিহাসিক ইতিহাসচর্চা পরিষ্কারভাবে যে বিষয়টিকে প্রত্যাখ্যান করেছে তা হল জনগণের রাজনীতি। অভিজাত রাজনীতির সমান্তরালে ভারতীয় রাজনীততে পুরো ঔপনিবেশিক আমল জুড়ে আরও একটি ধারা ছিল যার মুখ্য চরিত্রে দেশীয় সমাজের কোনো প্রভাবশালী গোষ্ঠী বা ঔপনিবেশিক প্রভুরা ছিল না বরং তাতে ছিল শহর ও গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে থাকা নিম্নবর্গের এবং খেটে খাওয়া মানুষের বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী, অর্থাৎ, জনগন। এই ধারাটি ছিল স্বায়ত্তশাসিত, কারণ এটি কোনো অভিজাত রাজনীতি থেকে উদ্ভুত ধারাও ছিল না বা সেই ধারার উপরে কোনোভাবে নির্ভরশীলও ছিল না। প্রাক-ঔপনিবেশিক আমল থেকে যতদূর খোঁজ পাওয়া যায়, এটি চিরাচরিত উপায়ে চলে আসছিল, তাই বলে কোনোমতেই একে সেকেলে বলে ধরে নেওয়া যাবে না। ঔপনিবেশিক শাসনের আঘাতে চিরায়ত অভিজাত রাজনীতি যেরকম ধ্বংস হয়ে অচল হয়ে গিয়েছিল সেই তুলনায় এটি ব্রিটিশ রাজের সময়কার বিভিন্ন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে প্রবল প্রতাপে টিকে ছিল এবং কাঠামো এবং বক্তব্যের অনেক দিক বিবেচনায় নতুন ধারায় বিকশিত হয়েছিল। দেশীয় অভিজাত রাজনীতির মতোই আধুনিক হলেও সময় এবং কাঠামোর গভীরতার সাপেক্ষে একে আলাদা করে চেনা যেত।
৯. এই রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল তার সক্রিয়তার বিভিন্ন দিক যেগুলো সম্পর্কে অভিজাত ইতিহাসপাঠ সামান্য আলাপ করেছে। অভিজাত রাজনীতিতে সক্রিয়তা দানা বেঁধেছিল খাড়াভাবে অপরদিকে নিম্নবর্গের রাজনীতিতে তা ছড়িয়ে পড়েছিল সবদিকে। প্রথমটির একাংশের গোড়াপত্তন হয়েছিল মূলত ব্রিটিশ সংসদীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ঔপনিবেশিক অভিযোজনের মাধ্যমে এবং বাকিটুকু উপনিবেশ-পূর্ব আধা-সামন্ত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর নির্ভর করে; মানুষের চেতনার তারতম্যের উপর নির্ভর করে দ্বিতীয়টি বরং চিরায়ত জ্ঞাতি ও অঞ্চলভিত্তিক প্রতিষ্ঠান বা শ্রেণীভিত্তিক সঙ্ঘের সঙ্গে সম্বন্ধ রাখতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত। অভিজাত সক্রিয়তাকে অপেক্ষাকৃত বেশী আইনানুগ এবং ঝোঁকের দিক থেকে গঠনমূলক আর নিম্নবর্গের সক্রিয়তাকে সেই তুলনায় সহিংস বলে মনে হত। আগেরটি ছিল মোটের উপর, বেশী সতর্ক এবং নিয়ন্ত্রিত এবং পরেরটি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। কৃষক বিদ্রোহের ব্যাপকতা থেকে ঔপনিবেশিক আমলের জনপ্রিয় সক্রিয়তাকে আন্দাজ করা যায়। তবে, অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার নজির আছে যেখানে কৃষক বিদ্রোহের আদলে বিরাট সংখ্যক খেটে খাওয়া লোকজন এবং শহুরে পাতি বুর্জোয়ার জনসম্পৃক্ততাও হয়েছিল।
১০. এই অধিক্ষেত্রে ক্রিয়াশীল মতবাদটি, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই, তার সামাজিক গঠনের বৈচিত্রকে তুলে ধরার সাথে সাথে যেকোন সময়ে এবং যেকোন পরিস্থিতিতে অন্যান্য মতবাদগুলোর তুলনায় তা যেসব মুখ্য উপাদান নিয়ে কর্তৃত্বশীল ছিল তা তুলে ধরেছে। তবে, এতো বৈচিত্র থাকা সত্ত্বেও যে বৈশিষ্ট্যটি কখনো পরিবর্তন হয়নি তা হল অভিজাতদের কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রবণতা। এই অধিক্ষেত্রের যাবতীয় সামাজিক অঞ্চলগুলোতে এই সাধারণ নিম্নবর্গীয় প্রবণতা বিদ্যমান ছিল এবং এটাই অভিজাত রাজনীতি থেকে একে স্পষ্টভাবে পৃথক করেছিল। এই মতাদর্শিক উপাদানগুলো অবশ্যই গুণগতভাবে সমান ছিল না বা সকল ক্ষেত্রে সমানভাবে ছড়ায়নি। বড়জোড় এটা নিম্নবর্গীয় রাজনৈতিক সক্রিয়তার জমাটবদ্ধতা, মনোযোগ এবং দৃঢ়তাকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। তবে, এমন ঘটনাও আছে যেখানে শ্রেণীগত স্বার্থের দিকে জোর দেওয়ার প্রবণতাটি জনপ্রিয় আন্দোলনগুলোর ভারসাম্য এমনভাবে নষ্ট করেছে যাতে অর্থনীতির বাঁকবদল এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনের পথ সৃষ্টি হয় এবং সাধারণভাবে সমান্তরালে বেড়ে ওঠা জোটগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
১১. এছাড়া, শোষণের যেসব ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে নিম্নবর্গীয় শ্রেণীগুলো অবস্থান করত সেই পর্যায়, একইসাথে এর প্রধান চরিত্রের অধিকাংশ অর্থাৎ, শ্রমিক এবং কৃষকদের সঙ্গে উৎপাদনশীল শ্রমের সম্পর্ক এবং অ-মেহনতি শহুরে দরিদ্র শ্রেণী এবং পাতি বুর্জোয়াদের নিম্নতর অংশের যথাক্রমে কায়িক এবং মানসিক শ্রম থেকেও এই রাজনীতির আরও একটি সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য মূর্ত হয়ে ওঠে। শোষণ এবং শ্রমের অভিজ্ঞতা এই রাজনীতিকে বহু নামে, ধাঁচে এবং মূল্যে ভূষিত করেছে যেগুলো একে অভিজাত রাজনীতি থেকে ভিন্ন ধারায় নিয়ে গেছে।
১২. উপরোক্ত তিনটি প্যারাগ্রাফে বর্ণিত গণরাজনীতির এইসব এবং অন্যান্য সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্যসমূহ (কোনো তালিকাতেই তা সম্পূর্ণ করা সম্ভব নয়) অবশ্যই সবসময় পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় উদ্ভুত হয়নি। জীবনযাপনের বৈচিত্র সেগুলোকে গড়ে নিয়ে বাস্তবায়নের ইতিহাসে প্রভাব রেখেছে। তবে, যাবতীয় পরিমার্জনের পরেও সেসব নিম্নবর্গের রাজনীতিকে অভিজাত রাজনীতির থেকে পৃথক করে চিনতে সাহায্য করেছে। এই দুই ধরণের অধিক্ষেত্র বা ধারার সহাবস্থান, যা ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় দিয়েও অনুমান করা যায় এবং বাহ্যিকভাবেও প্রমাণ করা যায়, এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সত্য উন্মোচন করে, সেটা হল, ভারতীয় বুর্জোয়াদের জাতির পক্ষাবলম্বনের ব্যর্থতা। জনগণের জীবনযাত্রা এবং চেতনার বিশাল একটা জায়গা ছিল যেগুলো কোনোদিন তাদের হেজিমনির অন্তর্ভূক্ত হয়নি। এর থেকে উদ্ভুত কাঠামোগত দ্বিবিভাজন হল ঔপনিবেশিক আমলের ভারতের ইতিহাসের উপাত্ত, যিনিই এর ব্যাখ্যা করতে যাবেন নিতান্তই না করলে ভুল এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই।
১৩. তবে, এই দ্বিবিভাজন আবার এটা বোঝায় না যে, এই দুটি ধারা একেবারে অভেদ্যভাবে পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগও ছিল না। উল্টো, দুটোকে একীভূত করার লক্ষ্যে স্থানীয় অভিজাত বিশেষত বুর্জোয়াদের বিভিন্ন সময়ে আরও উন্নত ধরণের উপাদান নিয়ে প্রচেষ্টা চালানোর ফলস্বরূপ একে মিলেমিশে যেতেও দেখা যায়। এই ধরণের প্রচেষ্টা যখন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী উদ্দেশ্যের সঙ্গে কম-বেশী জড়িয়েছিল এবং ধারাবাহিকভাবে চলেছিল তখন দারুণ ফলাফল দেখা গিয়েছিল। অপরদিকে, যখন এমন আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়েছিল যেগুলোর কোনো শক্ত সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী উদ্দেশ্য ছিল না বা দানা বাঁধার সময়ই তা সেই উদ্দেশ্য হারিয়েছিল এবং পরবর্তীতে ঔপনিবেশিক সরকারের সঙ্গে আইনগত, প্রাতিষ্ঠানিক বা অন্যকোনো ধরণের সমঝোতায় গিয়েছিল, তখন লক্ষ্যণীয় পশ্চাদপসরণ এবং নোংরা শ্রেণী-বিভাজন দেখা গিয়েছিল। দুই ক্ষেত্রেই অভিজাত এবং নিম্নবর্গীয় রাজনীতির একীভবন এই ইঙ্গিত দিয়েছিল যে, অভিজাতরা তাদের নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য যেসব লোক জড়ো করেছিল তারা তাদের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে এবং সেগুলোকে উপরতলার মানুষদের তৈরি কার্যক্রম হিসেবে চরিত্রগত ছাপ বসিয়ে দিয়ে অবধারিতভাবে বিস্ফোরক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল।
১৪. তবে, নিম্নবর্গের রাজনীতির তরফ থেকে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল সেগুলো জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে পূর্ণাঙ্গ জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে রূপান্তরের জন্য যথেষ্ট ছিল না। মেহনতি শ্রেণী তখনো তার সামাজিক সত্তার অভীষ্ট কর্তব্য প্রসঙ্গে যথেষ্ট পরিণত ছিল না এবং তাদের চেতনায় নিজস্ব-শ্রেণীর প্রতি মোহ থাকায়, তারা কৃষক শ্রেণীর সঙ্গেও শক্তভাবে একাত্ম হতে পারেনি। পরিণামে এটি বুর্জোয়ারা যেসব লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিল শুধুমাত্র সেগুলোকেই করায়ত্ত করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি। এই সবকিছুর ফলাফল হিসেবে তৎকালীন কিছু কৃষক বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল, উপনিবেশ-বিরোধী চেতনার বিচারে যেগুলোর কয়েকটির পরিসর ছিল বিরাট এবং সমৃদ্ধ, কিন্তু সেগুলোর নেতৃত্ব আঞ্চলিকতার উর্ধ্বে উঠতে না পারায় এবং দেশব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী কার্যক্রমের সঙ্গে মিশে যেতে না পারায় বর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। কালক্রমে, কৃষক, শ্রমিক এবং শহুরে পাতি-বুর্জোয়াদের সাম্প্রদায়িক সংগ্রাম অর্থনীতির ঘেরাটোপে বা, যেসব ক্ষেত্রে তাকে রাজনীতিকরণ করা হয়েছিল সেসব ক্ষেত্রে, বৈপ্লবিক নেতৃত্বের অভাবে, অতিরিক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়ায় কোনো জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের মত কোনো কার্যকর কিছুতে পরিণত হতে পারেনি।
১৫. এটা হল কোনো রাষ্ট্রের নিজ পায়ে দাঁড়াতে না পারার ঐতিহাসিক ব্যর্থতার পাঠ, নেতৃত্বের অভাবে বুর্জোয়া এবং মেহনতি উভয় শ্রেণীর অপারগতার কারণে এবং ঊনিশ-শতকের ধ্রুপদি ধাঁচের বুর্জোয়া হেজিমনির অধীনস্ত অথবা অপেক্ষাকৃত আধুনিক ধরণের কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর হেজিমনির অধীনস্ত বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লব, অর্থাৎ, “নয়া গণতন্ত্রের” ‌ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে জিততে না পারার ব্যর্থতা – এটা হল এই ব্যর্থতার পাঠ যেখানে ঔপনিবেশিক ভারতের ইতিহাসপাঠের কেন্দ্রীয় সমস্যাটি মূর্ত হয়েছে। কেউ এই সমস্যা খতিয়ে দেখতে প্রবৃত্ত হয়নি। কাজেই শত ফুল ফুটুক, এমনকি আগাছাতেও আমাদের আপত্তি নেই। এমনকি আমরা মনে করি যে ইতিহাসপাঠের চর্চায় অভিজাতদেরও একটি ভূমিকা আছে যদি নেতিবাচক উদাহরণ হিসাবে উপস্থাপন করতে হয়। কিন্তু আমরা এটাও নিশ্চিত যে বিকল্প ডিসকোর্স নির্মাণ করে অভিজাত ইতিহাসপাঠের ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নিয়ে তার কৃত্রিম এবং অনৈতিহাসিক একরৈখিক চরিত্রায়নকে নাকচ করে শক্তভাবে মোকাবেলা করতে হবে এবং অভিজাত ও নিম্নবর্গীয় রাজনীতির সহাবস্থান এবং পারস্পরিক যোগাযোগের স্বীকৃতি আদায়ে কাজ করতে হবে।
১৬. আমরা নিশ্চিত যে ঔপনিবেশিক ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক ইতিহাসপাঠের অবস্থা এবং এর থেকে বের হবার রাস্তা সন্ধানের ব্যাপারে আমরা একা নই। আধুনিক ভারতীয় ইতিহাসপাঠের যে আভিজাত্য তা চাপানো সত্য বলে তিক্ত মন্তব্য করেছেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং আমাদের মত লেখকসহ আরও অনেকেই। তাদের প্রত্যেকেই যে উপরে যেসব কথা যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে সেসবের সঙ্গে একমত এমনও নয়। তবে, আমাদের কোনো সন্দেহ নাই যে আরও বিভিন্ন ইতাহাসপাঠের দৃষ্টিভঙ্গি এবং চর্চাও আমাদের মতের আশাপাশেই বিচরণ করে। আমাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণের উদ্দেশ্য হল একই বিন্দুতে মিলিত হওয়া। আমরা একটা ঝোঁক তৈরি করা এবং বাস্তবেও যে এটা চর্চা করা সম্ভব সেই আশা সঞ্চার করা ছাড়া আর কোনো দাবী রাখি না। অন্য যেকোন আলাপই উঠুক না কেন, আমাদের মত যারা চিন্তা করেন তাদের একাত্মতা এবং যারা করেন না, তাদের সমালোচনা, সবকিছু থেকেই আমরা বিপুল পরিমাণে শেখার আশা রাখি।
উপরে ব্যবহৃত ‘অভিজাত’,’জনগণ’,’নিম্নবর্গ’, ইত্যাদি পরিভাষা সংক্রান্ত টীকা:
‘অভিজাত’ শব্দটি এই লেখায় দেশী এবং বিদেশী, কর্তৃত্বশীল সকল সম্প্রদায়কে বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। কর্তৃত্বশীল বিদেশী সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছেন অ-ভারতীয়, অর্থাৎ, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রধানত ব্রিটিশ কর্মচারীগণ এবং বিদেশী শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, নির্মাণকারী, ভূস্বামী এবং মিশনারিগণ।
কর্তৃত্বশীল দেশীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছেন দুই স্তরের শ্রেণী এবং স্বার্থ হাসিলকারী দল। সর্ব-ভারতীয় পর্যায়ে রয়েছেন শিল্পপতি এবং বণিক বুর্জোয়াদের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি সামন্তপ্রভুরা, এবং আমলাতন্ত্রের উপরের দিককার দেশীয় কর্মকর্তারা।
আঞ্চলিক এবং স্থানীয় পর্যায়ে তারা এমন শ্রেণী এবং উপাদানের প্রতিনিধিত্ব করতেন যারা হয় পূর্বোক্ত শ্রেণীর সর্ব-ভারতীয় দলগুলোর প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন অথবা প্রভাবশালী সর্ব ভারতীয় দলগুলোর থেকে নিম্নতর সামাজিক স্তরের সদস্য হলেও তাদের নিজস্ব সামাজিক সত্তার স্বার্থে সত্যিকারার্থে কোনো ভূমিকা না রেখে পূর্বোক্তদের স্বার্থ হাসিলে ভূমিকা রাখতেন।
মোটের উপর এবং বিমূর্তভাবে ধরতে গেলে অভিজাতদের এই সর্বশেষ শ্রেণীটি বিভিন্ন উপাদানে গঠিত ছিল এবং আঞ্চলিক অর্থনীতি এবং সামাজিক বিকাশের চরিত্র স্থানভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয় বলে রক্ষা। উপরোক্ত সংজ্ঞানুযায়ী একই শ্রেণী বা উপাদান যা এক এলাকায় প্রভাবশালী সেটিই আবার অন্য এলাকায় শোষিতের দলেও পড়ে যেতে পারত। এই বিষয়টি আচরণ এবং মৈত্রীবন্ধনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অস্পষ্টতা এবং বৈপরীত্য তৈরি করতে সক্ষম ছিল এবং তা করেওছিল, বিশেষত গ্রামীণ সর্বনিম্ন স্তরের মধ্যবিত্ত, নিঃস্ব হয়ে যাওয়া জমিদার, ধনী কৃষক এবং উচ্চ-মধ্যবিত্ত কৃষকদের মাঝে, যারা নিচের সংজ্ঞানুযায়ী, আক্ষরিক অর্থেই, ‘জনগণ’ বা ‘নিম্নবর্গ’ শ্রেণীতে পড়েন। গবেষণার ভার হল আদর্শ অবস্থা থেকে এই উপাদানগুলোর সঠিক চরিত্র এবং বিচ্যুতির পরিমাণ খুঁজে বের করে চিহ্নিত করা এবং তা ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা।
‘জনগণ’ এবং ‘নিম্নবর্গ’ শব্দদুটিকে এই রচনায় সবসময় সমার্থক শব্দ হিসবে ব্যবহার করা হয়েছে। এই শ্রেণীর সামাজিক সম্প্রদায় এবং উপাদানসমূহ ভারতীয় জনগণ এবং যাদের আমরা ‘অভিজাত’ বলে পরিচয় দিয়েছি তাদের মধ্যকার জনতাত্ত্বিক পার্থক্যকে তুলে ধরে। এই শ্রেণীর কয়েকটি অংশ এবং দল যেমন গ্রামীণ সর্বনিম্নস্তরের মধ্যবিত্ত, নিঃস্ব হয়ে যাওয়া জমিদার, ধনী কৃষক এবং উচ্চ-মধ্যবিদত্ত কৃষক যারা, উপরের সংজ্ঞানুযায়ী, ‘স্বাভাবিকভাবেই’ ‘জনগণের’ এবং ‘নিম্নবর্গের’ কাতারে পড়ে, কিছুক্ষেত্রে তারা ‘অভিজাতদের’ পক্ষেও কাজ করতে পারে, এবং সেই কারণে কিছু কিছু স্থানীয় এবং আঞ্চলিক ক্ষেত্রে তাদের এভাবে শ্রেণীকরণ করা যায় – প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণকে নিবিড় এবং বিচক্ষণ পর্যালোচনা করে এই অস্পষ্টতা সমাধানের ভার ঐতিহাসিকদের কাঁধে দেওয়া হল।
[1] লেখক এই সংখ্যার অন্যান্য লেখকদের কাছে কৃতজ্ঞ এবং একইসাথে এই লেখার পুরাতন সংস্করণে গৌতম ভদ্র, দীপেশ চক্রবর্তী এবং রাঘবেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতামতের জন্য তাঁদের প্রতিও কৃতজ্ঞ।