শুক্রবার, ২৬ মে, ২০১৭

চিন্তা-স্বাধীনতার ইশতেহার: কপি-রাইট, কপি-রঙ

মহাপাজি মহাজন তাদের অশরীরী সম্পত্তি:

ভূতেরা নাকি অশরীরী সত্তা। তাদের উপদ্রবের কি কোনো শেষ আছে? এই মনে করো, চকলেট খাচ্ছো, ভূতে কেড়ে নিয়ে গেল। এরকম তো কতোই হয়! কী বলো! হয় না? ও মা, বলো কি? তুমি তাহলে জেনে গেছ যে এইসব ভূত প্রেত আসলে ঢপ্, সব ভূয়া কথা?! আসলে ভূত-প্রেত বলে কিছুই নাই!! এরা শুধু ভয় দেখানোর জন্য মানুষের কল্পনায় এসেছে। বাহ! তাহলে তোমাকে তো বোকা বানানো গেল না। তাহলে অন্য একটা ফন্দি আঁটা যাক!

শোনো, তুমি যে গান শোনো বা ছবি দেখো সেগুলোও কিন্তু অশরীরী ব্যাপার। কেমন কান দিয়ে ঢুকে ঢুকে যাচ্ছে! আর কানের ভিতরে গেলেই মনে হচ্ছে যেন একটা আনন্দ আনন্দ লাগছে! আবার সুন্দর ছবিটা কেমন চোখের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে? তারপর চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে! ঠিক না? অবশ্যই ঠিক। কিন্তু, ভূতের মত কি এদের আমরা ভয় পাই? না তো! বরং, এরা তো মজার ব্যাপার! কীরকম মিষ্টি মিষ্টি গান, আর বিচিত্র সব রং?

আচ্ছা, দূরে গান বাজলে আমরা কি না শুনে থাকতে পারি? ধরো, ওই গানটা - ‘কেমন বাঁশি বাজায় শোনো মাঠেতে রাখাল[1] সব গানই তো কানের ভিতরে ঢুকে যায়, কিচ্ছু করার থাকে না। কিন্তু, জানো, এইটা ভারী অন্যায়! বিশ্বাস হচ্ছে না? নাকি মন খারাপ হচ্ছে? ভাবছো গান শোনা ভারী অন্যায় হবে কেন?! এ আবার কিরম কথা?! কিন্তু, শোনো, এইখানে আছে এক দুষ্ট বুদ্ধি। এর নাম হল ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টির ধারণা। কঠিন ঠেকছে? সহজ করে বুঝলে, গানবাজনা, ছবি, সিনেমা, লেখাজোখা, গপ্পো আর ভারী ভারী সব কথা - সবই আসলে সম্পত্তি! তাও নাকি মানুষের “অশরীরী সম্পত্তি”, মানে মানুষের পোষা ভূত। তারমানে, যে গান বানিয়েছে, সিনেমা বানিয়েছে বা ছবি এঁকেছে ওইটা তারই সম্পত্তি। তার অনুমতি ছাড়া ওইসব সম্পত্তি শুনে ফেলা, দেখে ফেলা বা বন্ধুকে শোনানোর জন্য বয়ে নিয়ে বেড়ানো সবই নাকি পঁচা কাজ! বোঝো ঠ্যালা! আমরা তো দাদীর কাছে কতোই গপ্পো শুনেছি। তারপরে, ওই যে, বাউলটা কতো যে গান শোনালো! আর, ঘরে বসে গুনগুন করে কতো গান গেয়েছি, সবসময় কি বলেছি এটা কার গান? মহা মুশকিল হলো না? আসলেই মহা মুশকিল। এতো ভারী অন্যায়, গান গাইতে দিবে না?

কিন্তু, কিচ্ছু করার নাই, জানো? ভূতেরা বিদায় নিলেও এই অশরীরী সম্পত্তির ধারণাটা পাকাপোক্তভাবে জায়গা করে নিয়েছে। এইটা এতোই পাকাপোক্ত ধারণা যে, আমাদের স্বাভাবিক যেসব প্রবৃত্তি - ধরো, গান শোনা, বইপড়া এইসবের উপর এক ধরণের নিয়ন্ত্রণ আনতে চাইছে। তোমরাই বলো তো, গায়েবী জিনিসটা বাতাসে মিশে গেলে আমরা কি করে তাকে রুখবো? আর রুখবোই বা কেন? কানে এসে লাগছে, বেশ তো লাগছে। এতে এতো আপত্তির কি হলো?

তাহলেই শোনো ভূতের গপ্পো। এই ভূত সত্যিই ভয় দেখায়। কারণ, এরা হল মানুষ ভূত। বাউল তো আর পয়সা চায় না। কারণ, সে তো আমাদেরই মতো ঘরের লোক। ঘরের বাইরেও তো তার সাথে আমাদের দেখা হয়। তার সাথে আমরা কতো মনের কথা বলেছি, কতো গান শুনেছি। নইলে আর সে আমার মনে কথা কেমন করে বলতে পারতো, বলো তো? কিন্তু, জানো কি, আরেক ধরণের লোক আছে, এরা হলো ব্যবসায়ী। যে-সে ব্যবসায়ী নয়, এক্কেবারে সওদাগর! এদের কাজই হলো, এর জিনিস তাকে, আর তার জিনিস একে গছিয়ে টাকাপয়সা কামানো।অবশ্য, আদতে সওদাগরি বা ব্যবসা খারাপ কিছু না,যদি সেটা একচেটিয়া না হয়ে থাকে যদি সেটা সব সম্পত্তি কুক্ষিগত করার অভিপ্রায় নিয়ে না করা হয় আর সেটাই হয়েছে বর্তমানের পুঁজিবাদী ব্যবসাদারিতে
সওদাগরি কারবার কেমন করে চলে একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছি। ধরা যাক, সুরবিতান হলো একটা গানের ব্যবসাদারী প্রতিষ্ঠান। এরা করে কি, বিভিন্ন শিল্পীর গান রেকর্ড করে বাজারে বিক্রি করে। এর বদলে শিল্পীকে অবশ্য পয়সা দেয়, কিন্তু, গানটার মালিকানা তাদের হয়ে যায়। তো, একজন শিল্পী মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে “বন্যার গান” নামের একটা গান লিখলেন এবং ওই সুরবিতান নামের ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে গানটি বাজারে ছেড়ে দিলেন (কি করবেন বলো? সব শিল্পীর পক্ষে তো আর একা একা গান বানানোর খরচ জোগানো সম্ভব না)। গানটি কিন্তু আমাদেরই দুঃখ দুর্দশার কথা বলছে। ধরা যাক, বন্যায় মানুষের কেমন কষ্ট হয় সেই কথা বলছে। এবারে হলো কি, অনেকবছর পরে তোমার দেশে বন্যা হল। তুমি করলে কি, বন্যার্তদের জন্য সাহায্য তুলতে একটা গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে। ওই অনুষ্ঠানে তুমি “বন্যার গান” গাইতে গেলে। এমন সময় হলো কি, মঞ্চে ওই গান বিক্রেতার লোকজন হাজির! তাদের বায়নাও বড়ো অদ্ভুত! তুমিতো ওদের কিনে নেওয়া গান গেয়ে লোকেদের জড়ো করেছ। তাই, তারা এখন গান শুনতে আসা লোকেদের কাছে তাদের তৈরি করা নতুন সাবানের বিজ্ঞাপণ প্রচার করবে যাতে সাবানটার কাটতি বাড়ে! কী মুশকিল বলো তো! তোমার উদ্দেশ্য তো সাবানের কাটতি বাড়ানো নয়, বন্যার্ত মানুষদের জন্য সাহায্য সংগ্রহ করা। কিন্তু, ওই নাছোড়বান্দা লোকেরা বিজ্ঞাপণ প্রচার করবেই। কারণ, তারা নাকি গানের মালিক! তুমিই বলো তো, গানটা তো আমাদেরই জীবনের কাহিনী নিয়ে বানানো। তাহলে, আমাদেরই দুঃখ-কষ্টের অনুভূতিগুলোর মালিক ওরা কিভাবে হয়? আবার, ওরা যদি গান কিনে নিয়ে গানের মালিক হয়ে যেতে পারে, আমরাও কেন গান কিনলে গানের মালিক হতে পারি না? আমরা যদি শেয়ার করলে ওরা মালিকানা দাবী করে সেখানে বিজ্ঞাপণ বসানোর দাবী করতে পারে, আমরা কেন গানটা কিনে নিলেও শেয়ার করতে পারব না? এ তো ভারী অন্যায়! কিন্তু, তোমার মন সায় না দিলে কি হবে, আইনকানুনও কিন্তু ওদের পক্ষেই কথা বলবে।

এবারে তুমি নিশ্চয়ই অবাক হয়ে যাচ্ছো? ভাবছো, এরকমও হয় নাকি? তাহলে বলি শোনো। তুমি নিশ্চয়ই ইউটিউবে গান শোনো? ওখানে যদি তুমি এরকম মহৎ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে অন্যকোনো শিল্পীর গান করো তাহলে দেখবে সাথে সাথে ওই গানের মালিক এসে বিজ্ঞাপণ বসাতে চাইবেএই ঘটনা আমাদের সাথেই ঘটেছে। আমরা, মানে স্বরব্যাঞ্জো ব্যান্ড একবার এরকম গান করতে গিয়ে ফেঁসে গেছিলাম। বোঝো ঠ্যালা! কেমন পাজি লোক!

কিন্তু, তবুও আইনকানুন ওদের পক্ষেই কথা বলে। আর, আইনকানুন যদি ওদের পক্ষেই কথা বলে, আমাদের কথা বুঝতে না চায়, তাহলে সে আবার কেমন আইন!? ঠিকই ধরেছ। এই আইনটাই খুব সমস্যাযুক্ত, গোলমেলে আর ভেজালে আইন। এই আইনটা আমাদের মানবীয় অনুভূতিগুলোকে বেচাবিক্রি করার অনুমতি দিয়েছে!

তোমাদের মনে কি কৌতুহল হচ্ছে? জানতে ইচ্ছা করছে এরকম আইনের রাজত্বই সবসময় ধরে পৃথিবীতে চলে আসছে কিনা? আসলে এইটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নটা যদি আমরা আইন-প্রণেতাদের করি তাহলে কিন্তু তারা বিপদে পড়ে যাবেন। কারণ, সত্যি কথা হল, ভূতুড়ে সম্পত্তির ধারণাটা প্রাকৃতিক নয়, মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিজাত নয়।[2] বরং, শাসকশ্রেণীর হঠকারী বুদ্ধি দিয়ে বানানো একটা ধারণা। এটা একেবারেই নতুন একটা ধারণা। যখন থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে তখন থেকে এই ধারণাটা তৈরি হয়েছে। কাজেই, বুঝতেই পারছো, এই ধরণের সম্পত্তির ধারণার পেছনে নানান ধরণের দুষ্টু বুদ্ধি আছে। আমরা সেইসব দুষ্টুবুদ্ধিগুলো জেনে ফেলব। কিন্তু, তারও আগে আমরা জানব বোঝাপড়া, স্বাধীনতার ধারণা, আর, তার বিপরীতে উড়ে এসে জুড়ে বসা একটা রাক্ষুসে জিনিসের কথা।


২. বোঝাপড়া সুন্দর, স্বাধীনতা সুন্দর:

আচ্ছা, আমরা তো সমাজে থাকি, তাইনা? আমাদের কতো আপন মানুষ চারিদিকে, খেয়াল করেছ? আমরা কি তাদের সাথে ঝগড়া করি নাকি মিলেমিশে থাকি? ঝগড়া যে একেবারে করিনা তা নয়, কিন্তু, বেশীরভাগ সময়ই তো মিলেমিশেই থাকি, তাইনা? তুমি খেয়াল করলে দেখতে পাবে, একজন মানুষের যতোজন মানুষের সাথে ঝগড়া তারচেয়ে বরং বেশী মানুষের সাথেই বন্ধুত্ব! কী আশ্চর্য! মজা না? এর মানে হল, আমরা সমাজে সবাই মিলেমিশেই বাস করি। আর, মিলেমিশে বাস করতে গেলে তো বোঝাপড়া করতে হয়, তাইনা? আমরা নিশ্চয়ই প্রতিবেশীকে কষ্ট দেই না, সহপাঠীকে কষ্ট দেই না, বন্ধুকে কষ্ট দেই না, ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট দেই না? বন্ধুরা, তারপরে প্রতিবেশীরা, সহপাঠীরাও নিশ্চয়ই আমাদের কষ্ট দিতে চায় না? আর যদি একটু মন কষাকষি হয়েই যায়, আমরা তো আবার মিলঝুল করে নেই। এই যে একে অপরের সুবিধা-অসুবিধা বুঝে বুঝে, স্বাধীনভাবে, মনের মতো করে কাজকর্ম করতে দেওয়ার যে পদ্ধতি আমরা সবসময় মেনে চলি এটাই হল বোঝাপড়া।

তাহলে, বুঝতেই পারছো, বোঝাপড়া করতে হলে আমরা স্বাভাবিকভাবেই নিজেরা নিজেদের নিয়ম-কানুন তৈরি করি এই নিয়মকানুনগুলো আমরা নিজেরাই নিজেদের স্বার্থে মেনে চলি। যেমন: কেউ হয়তো ঝাল খেতে পছন্দ করে, মিষ্টি পছন্দ করে না। আবার, তুমি হয়তো মিষ্টি পছন্দ করো, ঝাল একদম খেতে পারো না। তোমাকে কেউ এসে জোর করে ঝাল খাইয়ে দিলে নিশ্চয়ই তুমি কষ্ট পাবে। তেমনি তুমি তোমার যে বন্ধুটা মিষ্টি পছন্দ করে না তাকে জোর করে মিষ্টি খাইয়ে দিলে সে নিশ্চয়ই কষ্ট পাবে? তখন কি হবে? তোমাদের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট হবে, কথা বলা বন্ধ হবে, মন খারাপ হবে, একা একা থাকতে হবে আরও কতো কি!

অন্যকে কষ্ট দিলে যে নিজেকেও একা হয়ে যেতে হয়, কষ্ট পেতে হয়! অন্যকে স্বাধীনতা না দিলে নিজে স্বাধীনতা কেমন করে পাবো, বলো তো? আর, স্বাধীনতা না থাকলে কি কোনো আনন্দ আছে? তাহলে, আমরা বুঝতে পারলাম, আমরা একসাথে মিলেমিশে থাকতে গিয়ে নিজেরা নিজেরাই বোঝাপড়া করি, আর নিজেদের নিয়মকানুন নিজেরা-নিজেরাই তৈরি করি, মেনেও চলি যাতে অন্যের স্বাধীনতা নষ্ট না হয়।

কিন্তু, এমন একটা প্রতিষ্ঠান আছে, যারা আমাদের এই বোঝাপড়ার মধ্যে মাতব্বরী করতে চায়। এই মাতব্বরী করার জন্য তারা আবার আমাদের অনুমতি আদায় করে নেয়। বেশ তো আমরা ছোট্ট ছোট্ট সমাজে বা গ্রামে থেকে, নিজেরা নিজেরা বোঝাপড়া করে, দরকারি বিভিন্ন জিনিসপত্র বানিয়ে, নেচে-গেয়ে আনন্দ করে, একে অপরকে সহযোগিতা করে আর ভালোবেসে বেঁচে থাকতে পারি।  আমরা কেন কিছু মানুষের উপরে আমাদের শাসন করার ক্ষমতা দেই?

এটা করতে আমরা রাজি হয়ে যাই অনেককিছু ভেবে বা কখনো ভয় পেয়ে বা কখনো নিরুপায় হয়ে। তোমরা ভাবছো এমন কোন প্রতিষ্ঠান আছে, যারা শুধু বসে বসে মাতব্বরী করতে চায়? একটু ভেবে দেখলে বুঝতে পারবে, এই প্রতিষ্ঠানের নাম হল রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থা। যদিও রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থা এখন আমাদের আলোচনার বিষয় নয়, এখানে আমি শুধু তোমাদের অল্প একটু জানিয়ে রাখলাম, যাতে তোমরা আগ্রহী হয়ে নিজেরাই রাষ্ট্রব্যবস্থার হঠকারী দিকগুলো নিয়ে খোঁজখবর নিতে পারো রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থা কেমন করে শাসন করে, ভয় দেখায় আর আমাদের সম্মতি উৎপাদন করে সেজন্য তোমরা কিন্তু চাইলে পড়াশোনা করতে পারো।


৩. শেয়ারিং মানেই আনন্দ:

আমরা কিন্তু বুঝতে পারছি, গানবাজনা, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কায়দাকানুন, খাবারের রেসিপি, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, তারপরে কবিতা, গল্প, উপন্যাস সবকিছুকেই মানুষ “অশরীরী সম্পত্তি” নাম দিয়েছে। এরপর সেগুলোকে কুক্ষিগত করেছে। খেয়াল করে দেখো, এগুলোর অস্তিত্ব শব্দে, লেখায় ইত্যাদি মাধ্যমের মধ্যেই থাকে, যা চোখ-কান দিয়ে আমাদের মাথায় ঢুকে যায় জিনিসগুলোকে কেমন যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে না? ঠিক ধরেছ! এরা হল ‘তথ্য’; যা আমাদের জীবনে অক্সিজেনের মতোই গুরুত্বপূর্ণতাই যদি হবে তাহলে, অক্সিজেন তো কিনে শ্বাস নিতে হচ্ছে না, প্রকৃতিতে আমরা বুকভরে শ্বাস নেই। একটু খেয়াল করে দেখো তো, তথ্যও তো প্রাকৃতিক। সবকিছু থেকেই তথ্য কেমন ঠিকরে ঠিকরে বেরোচ্ছে? কে তাকে রুখবে? কিন্তু, অক্সিজেনের মত তথ্যও উন্মুক্ত থাকে না কেন? আর, তথ্য ছাড়া আমরা চলব-ফিরব কেমন করে? আমাদের চোখ-কান খোলা থাকলে তথ্য তো আপনিই চোখে পড়বে, কানে ঢুকবে, হৃদয় দিয়ে অনুভব করব। তাহলে তো আমরা সবাই চোর হয়ে যাব, কারণ, কার না কার মালিকানার তথ্য আমাদের চোখে-কানে ঢুকে যাবে কে জানে! আর সেই নিয়ে ভাবতে গেলে তো পাগল হওয়ার জোগাড় হবে! একটা মজার উদাহরণ দেওয়া যাক।

আর্কিটেক্টরা তো বাড়িঘরের ডিজাইন করেন আমরা সবাই জানি। তাদের ডিজাইনের কিন্তু কপিরাইট আছে। মানে, যেকেউ ইচ্ছা করলেই তাদের ডিজাইন নকল করে আরেকটা বাড়ি তৈরি করতে পারবেন না, বা তাদের ডিজাইনের ছবি তুলে নিয়ে সেই ছবি অন্যকোথাও ব্যবহারও করতে পারবেন না। তারমানে, আর্কিটেক্টদের সবসময় কারা তাদের ডিজাইন নকল করলো, কারা তাদের ডিজাইন করা বাড়ির ছবি তুলে নিয়ে গেল ইত্যাদি নজরে রাখতে হবে। যদি কেউ নকল করে তাহলে সাথে সাথে গিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিতে হবে। কিন্তু, ধরো তুমি একটা বিল্ডিঙের সামনে দাঁড়িয়ে পয়লা বৈশাখের দিনে একটা ছবি তুলে ফেললেতারমানে অবশ্যই তুমি ওই বিল্ডিঙের ডিজাইনারের কপিরাইট নষ্ট করলে। ব্যস, ঐ স্থপতি করে বসলেন কপিরাইটের দাবী! কিন্তু, এটা কি কোনো কাজের কথা হলো নাকি?

এভাবে চললে তো ছবি থেকে শুরু করে ভিডিও, চলচ্চিত্র, ডকুমেন্টারি তারপরে ধরো, ইউটিউব, ইন্সটাগ্রাম, ফ্লিকার, ফেসবুকসহ যাবতীয় মাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া উচিতআর, স্থপতিদেরও ডিজাইন করা মাথায় তুলে সারাদিন ঐ কপিরাইট ক্লেইম নিয়েই পড়ে থাকা উচিত। এভাবে কোন সময় যে কার কপিরাইট কিভাবে আমরা হয়তো নিজ অজান্তেই নষ্ট করতে পারি তার ইয়ত্তা নেই। কপিরাইটের মত কৃত্রিম আর দুর্বল অধিকারের ধারণা বোধহয় আর কোথাও নেই।

আমাদের বর্ণমালা যদি বিক্রি হয়ে যায়, কিছু মানুষ যদি আমাদের লেখার বর্ণমালার মালিকানা দাবী করে বসে তাহলে সেটা কি অন্যায় হবে না? অবশ্যই হবে! বর্ণমালা, শব্দমালা, ধ্বনি, রং সবই তো মুক্ত। মানুষ কি এদের মালিক হতে পারে? তাহলে, যে বর্ণমালার কোনো মালিকানা নাই সেই বর্ণমালা দিয়ে তৈরি করা গল্প, উপন্যাস, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কায়দাকানুনের মালিকানা কেমন করে থাকে?

আসল কথাটা তাহলে এবার বলেই দেই। আসল কথা হল, তথ্য এক ধরনের ক্ষমতা। এবং, অন্যান্য সব ক্ষমতার মত একেও কিছু মানুষ কুক্ষিগত করে রাখতে চায়। নানান কারণে তথ্যকে কুক্ষিগত করে রেখে নিয়ন্ত্রণ করার দরকার পড়ে। মানুষে মানুষে যোগাযোগ হলে তথ্য আদানপ্রদান হয়। সেই তথ্যই যদি উন্মুক্ত হয়ে যায় তাহলে গোপন বলে আর কিছুই থাকবে না। আর, গোপন না থাকলে চুপচুপ করে শাসকেরা শাসন করবে কিভাবে?

আবার, দেখো, মানুষে মানুষে যোগাযোগ হল সবথেকে স্বাভাবিক ব্যাপার। আমরা একজন আরেকজনের সাথে মিশবো, কথা বলব, নতুন নতুন জিনিস জানবো, জানাবো এটাই তো স্বাভাবিক। যোগাযোগ হলেই মানুষ তথ্য আদান-প্রদান করে। অর্থাৎ, তথ্য অনেক বেশী দরকারী সেটাতো বুঝতেই পারছো আবার, তথ্যকে ধরে রাখাও যায় না, সে তার মতো চলে যায়। কিন্তু, দুষ্ট লোকেরা দেখলো একে নিয়ন্ত্রণ তো করা সম্ভব! সুতরাং, এতে ব্যবসার একটা সুযোগ কিন্তু উঁকি দিচ্ছে। তথ্যকে যদি কোনোভাবে কুক্ষিগত করে বিক্রি করা যায় তাহলে প্রচুর টাকা আয় করা যাবে। কারণ, মানুষ তথ্য আদান-প্রদান না করে থাকতে পারবে না। তাইতো তথ্যকে ‘ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি’ নাম দিয়ে বন্দী করার বুদ্ধি আবিষ্কার করেছে দুষ্ট মানুষেরা।

যুগ যুগ ধরেই বইপত্রের মধ্যে বিশ্বের সমস্ত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, কবিতা, গল্প, মানুষের জীবনের নানান কথা সবকিছুই লেখা হচ্ছে, তাইনা? আবার, আধুনিক যন্ত্রপাতির যুগে সেইসব বইপত্রগুলোর ডিজিটাল সংস্করণও তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু, জানো কি, এইসব তথ্যকে দুষ্প্রাপ্য করে রেখেছে কয়েকটা বড় বড় বোয়াল মাছের মত রাক্ষুসে সওদাগর ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান তুমি যদি পৃথিবীর দারুণ দারুণ আর মজার মজার সব আবিষ্কারের কায়দাকানুন শিখে ফেলতে চাও তাহলে তোমাকে ওইসব দুষ্ট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বহু টাকা খরচ করে সেসব বইপত্র, দলিল-দস্তাবেজ কিনে নিতে হবে।
আর বলো তো, আমাদের সবার কি অতো টাকা আছে? আর অতো টাকা থাকাও কি ভালো কথা? সব টাকা যদি নিজেই নিয়ে নেই তাহলে অন্য মানুষেরা গরীব হয়ে যাবে, তাইনা? এমনিতেই তোমরা জানো, আমাদের দেশটা ছোট্ট একটা দেশ আর আমাদের দেশের টাকাপয়সাও কম। আর ওদিকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমস্ত জিনিস বন্দী করে রেখেছে ধনী দেশের ওইসব দুষ্ট ব্যবসায়ীরা আর রাষ্ট্রগুলোআমাদের টাকাপয়সা না থাকায় আমরা ওইসব দামী দামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের বইপত্র পাই না। এটা কি বৈষম্য নয়? এটা কি কোনো ভালো কাজ হতে পারে?

এগুলো স্রেফ গুণ্ডামী। বড় কর্পোরেশন গুণ্ডামী করে, বড় বড় রাষ্ট্রগুলো গুণ্ডামী করে। রাষ্ট্রীয় গুণ্ডামীর একটা উদাহরণ দেই। সেদিন পত্রিকা খুলেই দেখি ভারত বাংলাদেশের জামদানি, নকশিকাঁথা ও ফজলি আমসহ ৬৬টি পণ্যের প্যাটেন্ট করে নিয়েছে! বোঝো ঠ্যালা![3]

কিন্তু, দুষ্ট ব্যবসায়ীরা এই ভূতুড়ে সম্পত্তির পক্ষে এক ধরণের সাফাই গেয়ে একে জায়েজ করার ধান্ধা করে। তুমি যখনই এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলতে যাবে তখনই তারা তোমাকে উল্টো উদ্ভট যুক্তি দিয়ে দিবে। তারা সবার প্রথমেই বলবে, কপিরাইট না থাকলে সব আবিষ্কার থেমে যাবেকপিরাইট, পেটেন্ট এসব নাকি এই প্রতিযোগীতার দুনিয়ায় আবিষ্কারে উৎসাহ দেয়! এই কথার মধ্যে শুভংকরের ফাঁকি আছে। মানুষ মোটেও প্রতিযোগীতাপ্রবণ প্রাণী নয়। পৃথিবীতে বেশীরভাগ প্রাণীই সহযোগিতাপ্রবণ।  প্রতিযোগীতাকেই এক নম্বর কথা করে তুলেছে এইসব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোই। সুতরাং, প্রতিযোগীতামূলক পৃথিবীটা আসলে তাদেরই তৈরি। তারাই পৃথিবীর বেশীরভাগ সম্পদকে লুটে নিয়ে বৈষম্য তৈরি করেছে। এই বৈষম্য থেকেই তৈরি হয়েছে উদ্ভট প্রতিযোগিতার দুনিয়ার। এর নাম পুঁজিবাদ। তবে, প্রতিযোগিতা সবসময় খারাপ নয়। প্রতিযোগিতাও স্বাভাবিক। যতক্ষণ সেটা আনন্দের, স্বতঃস্ফূর্ত। যতক্ষণ সেটা পেশাদার নয়,হীন উদ্দেশ্যতাড়িত নয়।

কপিরাইট, পেটেন্ট মানেই তো গোপন করা, গোপন রাখা, শেয়ার না করার ব্যাপারস্যাপার। আর মানুষ তো শেয়ার করতেই পছন্দ করে, গোপন করতে অপছন্দ করে। কোনো মজার জিনিস জানার পরেও গোপন করলে মানুষের কষ্ট হয়, বুক ফেটে যায় কথা বলার জন্য। জ্ঞান এবং তথ্যও যে লুকিয়ে রাখার মতো জিনিস হতে পারে এটা মানুষ অনেকদিন পর্যন্ত ভাবতেও পারে নাই। কারণ, স্বাভাবিকভাবেই তা মানুষের বোঝাপড়া আর বিকাশের ক্ষেত্রে অসুবিধাজনক ব্যাপার। শেয়ারিংই যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে সেখানে নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার হবে কিভাবে? এটাই হলো শুভংকরের ফাঁকি। আসলে, শেয়ারিং থাকলে আবিষ্কারও থাকবে তবে ব্যবসায়ীদের ব্যবসাটা থাকবে না। তাই, এই কুযুক্তি মানুষের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে তারা। মজার একটা উদাহরণ দেই।

নিকোলা টেসলা আর টমাস এডিসনকে তো আমরা সবাই কমবেশী চিনি, দুই বিখ্যাত বিজ্ঞানী। টেসলা ছিলেন ক্ষ্যাপাটে এবং খামখেয়ালী। তিনি নাকি তাঁর সব সৃষ্টিশীল কাজকর্ম মনে মনেই করে ফেলতেন। সারাদিন ওইসব ভাবনাচিন্তা নিয়েই পড়ে থাকতেন, নিজমনেই তাঁর চিন্তাগুলোর খুঁতও খুঁজে খুঁজে বের করে ফেলতে পারতেন। আরেকদিকে, এডিসন করতেন কি, অন্যের আইডিয়া থেকে উৎসাহিত হয়ে নতুন কিছু বানিয়ে ফেলতেন। আর, তারপরেই পেটেন্ট অফিসে দিতেন ছুট্! তোমরা আবার ভেবে বসো না অন্যের আইডিয়া থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজে নতুন কিছু বানানো পঁচা কাজ। এটা সম্পুর্ন স্বাভাবিক একটা ঘটনা, যেকোনো আবিষ্কারের এটা একটা স্বাভাবিক উপায়। টেসলা যেমন নিজমনেই কাজটা করতেন এডিসন তা করতেন না। কিন্তু, দুজনের কাজের পদ্ধতি আলাদা কিন্তু দুজনেই কিন্তু নতুন নতুন আবিষ্কারের ওস্তাদ ছিলেন।

তবে, দুজনের মাঝে সবথেকে হাস্যকর এবং উদ্ভট জিনিসটার নাম হল পেটেন্ট অফিস। কেন? টেসলা এমনই খামখেয়ালী ছিলেন যে তিনি অনেক আবিষ্কারের পেটেন্ট করানোর প্রয়োজনই মনে করেন নাই। তাঁর কাছে আবিষ্কারটাই বড় কথা ছিল। তাই, তাঁর কাজের বেশীরভাগই মানুষের জন্য উন্মুক্ত ছিল।[4] অপরদিকে এডিসনের বিভিন্ন আবিষ্কার এখনো ব্যবসায়ীদের দখলে।[5]

সুতরাং, বুঝতেই পারছো, মিছেমিছিই আমাদেরকে এরা ভয় দেখায়। তবে, তাদের যুক্তি যদি তুমি না মানো তখন তারা তোমাকে চোর সাব্যস্ত করার জন্য আইনের আশ্রয় নিবে।


৪. আইনকানুনও যখন পক্ষে নয়:

কিন্তু, নিঃসন্দেহে জ্ঞানকে কুক্ষিগত করে রাখা অত্যন্ত গর্হিত কাজ, এবং কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু, আইনকানুন সবই তাদের পক্ষে। এইসব ব্যবসায়ীদের গালভারী নাম হল কর্পোরেশন। এই কর্পোরেশনগুলো আবার একেকজন আস্ত মানুষের মর্যাদা পেয়ে থাকে![6] আর জ্ঞানের উপরে যে মালিকানা সেগুলোকে এরা নাম দিয়েছে কপিরাইট, পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক এইসব। কর্পোরেশনগুলো যেহেতু “কৃত্রিম মানুষ” আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের তথ্য যেহেতু “অশরীরী সম্পত্তি” তাই এই কর্পোরেশনগুলোই কপিরাইটের ধারক-বাহক বনে গেছে। আর, জ্ঞানের ব্যবসাই তাদের অর্থের বিরাট উৎস তাই, আমরা অনেকে ভেবে বসি এটাই বোধহয় স্বাভাবিক। আবার অনেকে বুঝতে পারেন যে এসব ঘোরতর অন্যায়, এসব হল সব মানুষকে জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে বঞ্চিত করার ফন্দি। কিন্তু, পরক্ষণেই তারা ভাবেন, "আমরা আর কিই বা করতে পারি?"

কিন্তু এমনও মানুষ আছেন যারা এই পরিস্থিতি পরিবর্তনে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। গেরিলা ওপেন অ্যাকসেস মুভমেন্ট (Guerilla Open Access Movement)[7] হল এমনই একটা আন্দোলন। আন্দোলনের প্রস্তাব দুই ধরণের - প্রথমটা হল, পৃথিবীর যতো বিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, কবি, গায়ক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, লেখক আছেন তাঁদের নিজ নিজ সৃষ্টিকে সব মানুষের জন্য উন্মুক্ত করার আহবান। আর, দ্বিতীয়টি হল, এই যে উদ্ভট আইনকানুন দিয়ে কর্পোরেশনগুলো একচেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছে সেই আইনকানুনগুলোকে ভাঙা এবং তথ্যগুলোকে নানান কৌশলে উন্মুক্ত করা
তবে, আইন ভাঙার প্রস্তাবের আগে তোমাদের মনে হয়তো প্রশ্ন আসবে, কেউ কি পেশা হিসেবে সংগীত, গবেষণা, ছবি আঁকা, লেখালেখি করা এইসবকে নিতে পারবে না? কেউ তো গান বানিয়ে টাকা দাবী করতেই পারে, বা বই লিখে টাকা দাবী করতেই পারে।

অবশ্যই তাঁরা এই দাবী করতেই পারেন। যেকোনো পরিশ্রমেরই মূল্য আমাদের দিতে হবে। কিন্তু, আমাদের এখনকার সিস্টেমটা, মানে পুঁজিবাদী সিস্টেমটা কিন্তু শিল্পী, কবি, লেখক, গবেষক সবাইকে প্রথমে বঞ্চিত করার চেষ্টা করে, অথবা তাদের বহু পয়সা দিয়ে কিনে নিয়ে গোলাম বানিয়ে রাখতে চায়। এর ফলাফল কিন্তু শিল্পী-গবেষকদের জন্য বেশীরভাগ সময়েই ভালো হয় না, বিশেষ করে আমাদের মত দরিদ্র দেশে।

আমরা অনেকসময়ই দেখি, কেউ রাতারাতি বিখ্যাত গায়ক, নায়ক বা কবি হয়ে গেলেন। তার অনেক টাকাকড়ি হলো, নাম-যশ-খ্যাতি হল। কিন্তু, একটা সময় পরে তিনি যখন বৃদ্ধ হলেন, তার গানের গলা ভাঙলো, চামড়া গেলো কুঁচকে, শরীরে বাঁধলো নানান রোগের বাসা, সেই দুঃসময়ে আর কেউ তার পাশে নাই! এরকম তো আকছারই হচ্ছে, তাইনা? একসময় যারা তাকে মাথায় তুলে রেখেছে তারাই পরে আর তার খোঁজ নেয় না। শিল্পীরাও অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করেন যে, তারা আসলে বড় বড় কর্পোরেট টিভি চ্যানেল, মিডিয়া-ইণ্ডাস্ট্রিরই কেনা গোলাম হয়ে ছিলেন। যতোদিন তাদের আবেদন ছিল এইসব বড় বড় চ্যানেলগুলো তাদের ব্যবহার করেছেন। এখন তার আবেদন নাই, তাই আর কদরও নাই। তার জায়গা দখল করে নিয়েছেন অন্যকেউ। কিন্তু, মাত্র কিছুদিন আগেও কিন্তু শিল্পীদের অবস্থা এমন ছিলো না। তারা ছিলেন ঘরের মানুষ, তারা আমাদের জন্য গান গাইতেন, আমরাও তাদের জন্য সাধ্যমতো দেখাশোনা করতাম। বাউলেরা গাইতেন, আমরা তাদের খাবারের ব্যবস্থা করে দিতাম। এমনকি বাউলেরা নিজেরাও কাজকর্ম করতেন। তোমাদেরকে কবিয়াল রমেশ শীলের কথাটাই যদি বলি, তোমরা হয়তো বুঝবে, কবি-সাহিত্যিকরা একটা সময়ে জমিদারদের গোলামী করতে করতে এখন এসে কর্পোরেশনের গোলামী করতে কেমন করে বাধ্য হলেন। কবিয়াল রমেশ শীল বলছেন, জমিদারী ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর গ্রামের সব চাষীরা তাদের জমিজমার মালিকানা হারালেন। তার বদলে জমিদার সব জমির মালিক হয়ে গেলেন। ফলে, চাষীরা হয়ে পড়লেন অসহায়, গরীব। তখন তাদের নিজেরই পেটে ভাত জোটানো কষ্ট হয়ে পড়লো। এতে, গ্রামের কবিয়াল-বাউলদেরও দেখাশোনার ভার তারা আর বইতে পারলো না। ফলে, পেটের দায়ে কবিয়ালদের ছুটতে হলো জমিদারের কাছে। জমিদারেরা তো মহা ছ্যাঁচোড়। তারা করলো কি, মোটা অংকের টাকার লোভ দেখিয়ে কবিয়ালদের অশ্লীল গান বাঁধতে, অশ্লীল ভঙ্গিমায় নাচতে আর মেয়েদের নিয়ে বাজে ভাষায় গান করতে বাধ্য করলো। তোমরা যদি হেমাঙ্গ বিশ্বাসের “গানের বাহিরানা” বইটা পড়ো তাহলে সবিস্তারে এসব জানতে পারবে।[8]

তাহলেই বোঝো, কেমন করে আমাদের দেশের মানুষ গরীব হলো, আর, তার সাথে সাথে বাউল-কবিয়ালেরাও বাধ্য হলেন জমিদারের গোলামী করতে। তাইতো বলছি, শিল্পী, আঁকিয়ে, গবেষক যদি তার সৃষ্টিশীলতাকেই পেশা হিসেবে নিতে চান তাহলে এইরকম সময়ে কর্পোরেশনের দাসত্ব করাই তার একমাত্র নিয়তি হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু, এর কোনো বিকল্প নাই? অবশ্যই আছে। আমরা তো আর পুরাতন সমাজে ফিরে যেতে পারবো না, তবে পুরাতন সমাজের ব্যবস্থাটিকে আধুনিক সময়ের আঙ্গিকে নতুন করে তৈরি করতে পারবো। আবার, তুমি যখন নতুন করে বিকল্প রাস্তায় হাঁটতে চাইবে তখন এইসব বদমায়েশ কর্পোরেশনগুলোর পোষা বুদ্ধিজীবিরা এসে বলবেন, তোমার মাথাটা কি পুরোই নষ্ট হয়ে গেছে? তোমার চিন্তাভাবনাকে তারা “উদ্ভট” “অবাস্তব” “ভয়ংকর” এইসব বলে গালি দিবে, ভয় দেখাবে। কিন্তু, তবুও আমাদের বিকল্প ভাবতেই হবে, কারণ, স্বাধীনতাই যদি না থাকে তাহলে আর জীবনে কি মজা থাকলো?

সবার প্রথমেই বুঝতে হবে, সৃষ্টিশীল কোনো কাজ, যেমন: গান তৈরি করা, ছবি আঁকা, কবিতা লেখা বা গবেষণা করা - কখনো পেশা নয়কারণ, তুমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে না যে, তোমার কোন গানটি কখন তৈরি করতে পারবে, কখন তুমি কোনো নতুন জিনিস আবিষ্কার করতে পারবে। এসবের কি কোনো জানাশোনা রাস্তা আছে? জানাশোনা রাস্তা নাই বলেই তো এসব হলো আবিষ্কার, নতুন কিছু করা। আর জানাশোনা পথে জানাশোনা কাজ করাই হল পেশা। যেমন: কারখানায় বস্তা তৈরি করার নির্দিষ্ট নিয়ম আছে, সেটা জেনে গেলেই হাজারে হাজারে বস্তা তৈরি করে ফেলা যায়। সুতরাং, কেউ বস্তা তৈরি করাকে পেশা হিসেবে নিতেই পারেন। কিন্তু, আবিষ্কার করার কি কোনো জানাশোনা রাস্তা আছে? এসব নিয়ে অবশ্যই বিস্তর বিতর্ক আছে, সেসবকেও আমাদের বুঝতে হবে। তবে, আমাদের কাছে পেশা আর নেশার মধ্যকার পার্থক্যটুকু নিশ্চয়ই পরিষ্কার হয়েছে। যদি হয়েই থাকে, তাহলে, আমরা এবারে সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, কর্পোরেট দানবদের দুনিয়ায় সৃষ্টিশীল কাজকে পেশা হিসেবে নিলেই গোলামী করার ধরা খেতে হবে। সুতরাং, আমাদের বিকল্প ভাবতে হবে।

বিকল্প শুধু একটা ভাবলে চলবে না। কারণ সবকিছুতেই একটা মাত্র পথ বের করেই সন্তুষ্ট হলে সেই পথের সমস্যাগুলো কাটিয়ে তোলা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই বৈচিত্র সুন্দর, বৈচিত্র কাম্য। বিচিত্র সব বিকল্প রাস্তার মধ্যে একটি হল, ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্স। এটা হলো এক ধরণের চুক্তি। এই চুক্তি হবে শিল্পী আর শ্রোতার মধ্যে বা লেখক ও পাঠকের মধ্যে। মোটকথা, এই চুক্তির মাঝে কোনো মাতব্বর কর্পোরেশন থাকবে না। এই চুক্তি অনুসারে গায়ক তার গানকে শেয়ার করার অনুমতি দিতে পারেন, সাথে সাথে বলে দিতে পারেন গানটি কিভাবে বিক্রি করা যাবে, কিভাবে বিক্রি করা যাবে না। গায়ক চাইলে ফ্রিতে গানটা দিয়ে দিতে পারেন, অথবা, অর্থের বিনিময়েও গানটি দিয়ে শুনতে দিতে পারেন। সেই অর্থ তাহলে সরাসরি গায়ক পাবেন, কোনো মাতব্বর কর্পোরেশন তা লুটে নিতে পারবে না। ঠিক যেমনটা আমাদের দাওয়ায় বসে বাউল গান করলে আমরা তাকে আপ্যায়নের ব্যবস্থাও করি, তেমন।

আবার, আরও একটি ব্যবস্থা হলো, শিল্পীদের সংঘ তৈরি করা। এই সংঘের কাছ থেকে গান নিয়ে যতোখুশী বাজানো যাবে, যাকে খুশী দেওয়া যাবে, কিন্তু বিনিময়ে সংগঠনকে একটি বাৎসরিক চাঁদা দিতে হবে। এই চাঁদা শিল্পীদের মাঝে বন্টন করা হবে বিভিন্ন হিসাবে। এরকম একটি সংগঠনের নাম হলো আমেরিকান সোসাইটি অফ কম্পোজারস, অথরস এন্ড পাবলিশার্স বা সংক্ষেপে ASCAP.[9]
আর, শুধু গান করাকে বা লেখালেখি করাকে বা গবেষণা করাকে পেশা হিসেবে না নিয়ে কেউ এমন সংঘ তৈরি করতে পারেন যারা মানুষের জন্যই সৃষ্টি বা গবেষণা করবেন এবং তাদের সৃষ্টিকর্ম আর আবিষ্কারকে জনস্বার্থেই উন্মুক্ত করবেন।

আরও একটি রাস্তা হল, রাষ্ট্র নামক দানবটির রাক্ষুসে শাসকদের ক্ষমতাকে খর্ব করার জন্য কাজ করতে হবে। খেয়াল করলে দেখবে ক্ষমতা সবসময় একটা কেন্দ্র থেকে পরিচালিত হয়। ক্ষমতাচর্চার পরিধি যতো বড় হবে শাসকও ততো স্বৈরাচারী হয়ে উঠবেন। কারণ, তার তখন বেশী অস্ত্রশস্ত্র, পাইকপেয়াদা, সৈন্যসামন্ত, মন্ত্রী-উজির, চাটুকার ও গুণ্ডা প্রয়োজন। সুতরাং, ক্ষমতা বলয়কে আস্তে আস্তে ছোটো করে আনতে হবে। শাসকের শাসন করার অঞ্চলকে কমিয়ে আনতে হবে। তাকে বাধ্য করতে হবে আরও বেশী উদার হতে। ছোট্ট ছোট্ট স্বয়ংসম্পূর্ণ অঞ্চলভিত্তিক শাসনব্যবস্থা তৈরি করা যেতে পারে, যেখানে সবাই সবার সাথে সামাজিকভাবেই সংযুক্ত থাকতে পারবে। প্রতিটা উৎপাদন তখন হবে সামাজিক উৎপাদন। ফলে, আমাদের তখন শিল্পী-সাহিত্যিক-গবেষকদের দেখেশুনে রাখা, তাদের কাজে উৎসাহ দেওয়াও সহজ হবে।

এই লক্ষ্য অর্জন করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এজন্য শাসনব্যবস্থার মূলে আমাদের অনবরত আঘাত করতে হবে। আমাদের মধ্যেই অনেকেই আছেন যারা বিদেশে গিয়ে এইসব বড় বড় কর্পোরেশন আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বন্দী করে রাখা দারুণ দারুণ সব বইপত্র পড়ার সুযোগ পেয়ে থাকেন। ওপেন অ্যাকসেস মুভমেন্ট তাদেরকে আহবান জানাচ্ছে তারা যেন তাদের এই সুবিধাটুকু শুধু নিজেরা ভোগ না করে সবার সাথে শেয়ার করেন। কারণ, পৃথিবীর বেশীরভাগ মানুষ সেখানে যেতে পারেন না, কিন্তু, তারা ভাগ্যবান হওয়ায় সেসব বইপত্র পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। তাই, তারা যেন আমাদের জন্য সেইসব বইপত্রের ডিজিটাল সংস্করণ ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেন।

এই কাজকে আবার আইনের চোখে 'পাইরেসি' বা 'চুরি' হিসেবে দেখা হয়। ভাবখানা এমন, জ্ঞানের বিরাট ভাণ্ডার মুক্ত করার 'অপরাধ' যেন মানুষ হত্যার সমান! কিন্তু, খুব সাধারণভাবে চিন্তা করলেই আমরা বুঝতে পারব, এটা অনৈতিক কিছু তো নয়ই, বরং যুগ যুগ ধরে অর্জিত জ্ঞানের সংগ্রহ সকলের সাথে ভাগাভাগি করে নেওয়াটাই সবথেকে স্বাভাবিক ব্যাপার এবং এটাই এই মুহূর্তে এইসব বড় বড় রাঘব বোয়াল চোর-ডাকাতদের বিরুদ্ধে মোক্ষম প্রতিবাদ লোভ আমাদের বোধশক্তি গ্রাস করে না ফেললে এই সত্য সকলেরই বুঝতে পারার কথা। কেন বুঝতে পারার কথা তোমরা নিশ্চয়ই জানো। কারণ, আমরা তো ছোটবেলা থেকেই শেয়ার করতে শিখেছি। বন্ধুদের সাথে মিলেমিশে খেলাধুলা করা, স্কুলে টিফিন সবাই মিলে খাওয়া, একসাথে বেড়াতে যাওয়া, বাসায় ভালো খাবার রান্না হলে প্রতিবেশীকে দিয়ে খাওয়া, বাড়িতে মেহমান এলে তাদের আপ্যায়ন করা এসবই তো স্বাভাবিক ব্যাপার। এগুলো করতে তো আমাদেরই বাবা-মা আমাদেরকে উৎসাহ দিয়েছেন। কাজেই, শেয়ার করার মধ্যে কোনো অন্যায় কিছু থাকতে পারে না। বিশেষ করে, যখন একদল ভদ্রবেশী ডাকাত অলরেডি আমাদের সবকিছুকে লুটে নিয়ে গিয়ে তাদের সিন্দুকে পুরে রেখেছে তখন তো নিজেরা নিজেরা বুদ্ধি করে ওইসব ছিনিয়ে আনা ছাড়া আর গতি কী?

আমরা শিখেছি লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। কিন্তু, তোমরা এখন দেখতে পাচ্ছো বড় বড় কর্পোরেশনগুলোর আসল কাজই হল লোভ করা মজার মজার আবিষ্কারগুলোকে তারা জিম্মি করে রাখবে, আর, সেসব শিখে নিয়ে চড়া দামে যন্ত্রপাতি বানিয়ে আমাদের কাছে বেচবে। আর, আমাদের যে সামান্য পয়সা আছে সেগুলোও ছোঁ মেরে নিয়ে চলে যাবে! আর, আমাদের সব রাজনীতিকেরা তাদেরই রক্ষা করে চলবেন কারণ, তাদের হাতে না রাখলে টাকাপয়সা পাওয়া যাবে না! এই রাজনীতিবিদেরাই তাই আমাদের সম্মতি উৎপাদন করার কাজটি করেন। আগেই বলেছি আমরা কেন রাজনীতিবিদদের কথা মেনে নিতে বাধ্য হই, কেন তাদেরকে আইনকানুন বানানোর অনুমতি দেই। আসলে সবই ডান্ডার ভয়, গুলির ভয়, জীবনের ভয়ে। নয়তো আমরা কি জানিনা এইসব মানুষগুলো আসলে লোভী? আমরা তো জানিই এই মানুষগুলো কর্পোরেশগুলোর সুবিধামতো আইনকানুন বানায়। এই আইনগুলোতে এক চুল পরিবর্তন করার কথা তুমি আমি কেউ তুললেই এইসব কর্পোরেশনের অংশীদারেরা বেজার হবেন। তারা রাজনীতিকদের বলবেন আমাদের উপর ডান্ডা মারতে, আমাদের নামে মামলা ঠুকে দিতে, আমাদেরকে জেলে পুরতে, গুম করতে বা গুলি করে পঙ্গু করে দিতে! এমন ঘটনা কিন্তু ইতিহাসে বহুবার ঘটেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধই কিন্তু সেরকমই একটা ঘটনা। যাহোক, সেই গল্প অন্য একদিন করা যাবে।

কিন্তু, তবুও অন্যায্য আইন মানার কোনো অর্থই হয় নাতাই, আইন ভাঙার সময় এসেছে। সময় এসেছে স্পষ্ট করে বলবার যে, মানুষের অর্জিত কোনো জ্ঞানকেই কোনো দানব কর্পোরেশন তাদের পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেনা। জ্ঞান হবে উন্মুক্ত। তাই, পৃথিবীর সমস্ত তথ্যে আমাদের সকলের অবাধ বিচরণ থাকবে, বন্ধুদের সাথে ভাগাভাগি করে নেওয়ার অধিকার থাকবে সব গোপন জ্ঞানভাণ্ডার উন্মুক্ত করতে হবে।

সারা দুনিয়ায় আমাদের মত চিন্তা বহু মানুষ করছেন। আমরা তাদের সাথে সংযুক্ত হব এবং এই দিনে-দুপুরে ডাকাতির বিরুদ্ধে সবাই একসাথে কাজ করব। নিজেরা নিজেদের সৃষ্টিগুলোকে সবার মধ্যে বিলিয়ে দিব আর যতো জ্ঞানভাণ্ডার ওদের দখলে আছে সবই বিভিন্ন কৌশলে উন্মুক্ত করে দিব। তুমিও নিশ্চয়ই আমাদের সঙ্গে যুক্ত হবে? কি, হবে না?



[1] এটা হলগুপী বাঘা ফিরে এলোসিনেমার গান শুনতে চাইলে শুনে ফেল না এই লিংকে গিয়ে: https://youtu.be/yG63EhWL0F4
[2] বাটলার শ্যাফার (Butler Shaffer) বলছেন, সম্পত্তির ধারণা নিয়ে আমাদের মনের ভিতরে ধোঁয়াশা থাকার কারণেই সমাজে নানান ধরণের গণ্ডগোল লেগে গেছে, মানুষের স্বাধীনতাও খর্ব হয়েছে এবং আধুনিক সমাজ এক ধ্বংসাত্মক চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। তিনি বলছেন, কিছুদিন আগেও ভূতুড়ে সম্পত্তির কোনো ধারণা ছিলো না। উদাহরণ দিতে গিয়ে বলছেন, শেকসপীয়র, দান্তে বা মিল্টনের মতো লেখকেরা, বাখ, বেথোফেন, মোৎজার্ট বা চাইকোভস্কির মতো সংগীতজ্ঞরা বা ভ্যান গগ, ভিঞ্চির মতো আঁকিয়েরা কপিরাইট কি জিনিস চিনতেই না। গুটেনবার্গ প্রেস বা মিশরের পিরামিডেওর কোনো পেটেন্টের বালাই নাই। তাহলে তো বলাই যায়, কিছুদিন আগেও মানুষ কপিরাইট, পেটেন্ট এইসব বিষয় জানতোই না কিন্তু দিব্যি গানবাজনা, আঁকাআঁকি, বড় বড় জিনিসপত্র নির্মাণ করেই গিয়েছিল।
বুক রেফারেন্স: A Libertarian Critique On Intellectual Property : Butler Shaffer
[3] পুরো খবরটা এসেছে বাংলাট্রিবিউন নিউজপোর্টালে। এই লিংক থেকে পুরো খবরটা পড়ে দেখতে পারো: http://tinyurl.com/zyn7qws
[4] এই খামখেয়ালীপনার বিস্তারিত পড়তে হলে মার্গারেট চেনি’র (Margaret Cheney) এর Tesla: Man Out of Time (New York: Touchstone, 1981), পৃষ্ঠা ৩২-৩৫ পড়তে পারো।
[5] কপিরাইট, পেটেন্টের কারণে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি যে কমে যায় সে বিষয়ে বিস্তারিত জানতে তোমরা বাটলার শ্যাফার’র (Butler Shaffer) এর A Libertarian Critique of Intellectual Property বইটা পড়তে পারো।
[6] হ্যাঁ, কর্পোরেশনগুলো আইনের চোখে মানুষের মর্যাদা পেয়ে থাকে, যদিও এগুলো হল মানুষের তৈরি করা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এই কর্পোরেশনগুলো নিজে নিজেই অনেক ধরণের কাজ করতে পারে, যেমন: জমি কিনতে পারে, মামলা ঠুকে দিতে পারে, বিভিন্ন ধরণের চুক্তি করতে পারে ইত্যাদি। আবার, এদের বিরুদ্ধে মামলাও করা যায়। খেয়াল করো, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমাদের উপমহাদেশে ব্যবসা করতে এসে একেবারে স্বৈরাচারী শাসন চালিয়ে গেল। এই কাজটা সম্ভব হয়েছে তার কারণই হল, তাদের কোম্পানিটাকেই একটা মানুষ হিসেবে ধরা হয়েছে। যেন এক ব্যক্তিদানব! অথচ, এই কোম্পানির পেছনে সত্যি সত্যি যে মানুষেরা কলকাঠি নাড়লো,তারা থেকে গেল যাবতীয় প্রশ্নের বাইরে।
[7] গেরিলা ওপেন অ্যাকসেস মুভমেন্ট সম্পর্কে জানতে হলে তোমরা অধরা শ্রেয়সী অথই’র অনুবাদ করা “গেরিলা ওপেন অ্যাকসেস ম্যানিফেস্টো” টা চট করে পড়ে ফেলতে পারো ইন্টারনেটে। গেরিলা ওপেন অ্যাকসেস মুভমেন্টের ধারণা দিয়েছিলেন এ্যারোন সোয়ার্টজ (Aaron Swartz)ভদ্রলোক ছিলেন একজন জিনিয়াস। কিন্তু, এই ভদ্রলোককে পাইরেসি’র দায়ে ৩৫ বছরের জেল দেওয়া হয়েছিল আর তার সব সম্পত্তি ক্রোকও করে নেওয়া হয়েছিল। এই যন্ত্রণা সইতে না পেরে উনি আত্মহত্যা করেন। তোমরা চাইলে এ্যারোন সোয়ার্টজের Guerrilla Open Access Manifesto” লেখাটা পড়ে ফেলতে পারো ইন্টারনেট থেকে। আর, সোয়ার্টজকে নিয়ে বানানো ডকুমেন্টারি মুভি Internet’s Own Boy ও চট করে দেখে ফেলতে পারো
[8] http://www.grontho.com/%e0%a6%97%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%b9%e0%a6%bf%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%be-%e0%a6%b8%e0%a6%82%e0%a6%95%e0%a6%b2%e0%a6%bf%e0%a6%a4-%e0%a6%b8%e0%a6%82/
[9] https://www.ascap.com/

এনার্কি ১০১ (Anarchy 101)

এনার্কি ১০১ - বব ব্ল্যাক
অনুবাদ: ইস্ক্রা রহমান

“নৈরাজ্যবাদ” কি? “নৈরাজ্য” কি? কারা “নৈরাজ্যবাদী”?
নৈরাজ্যবাদ হল সবথেকে ভালোভাবে বাঁচার কৌশল সম্পর্কিত একটা ধারণা। নৈরাজ্য একটা জীবনযাপন পদ্ধতি।

সরকার বা রাষ্ট্র হল অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকর সংগঠন - এই ধারণাই নৈরাজ্যবাদ। নৈরাজ্য হল শাসক বিহীন সমাজব্যবস্থা। নৈরাজ্যবাদীরা হলেন নৈরাজ্যবাদে বিশ্বাসী মানুষ যারা আমাদের পূর্বপুরুষদের মতোই নৈরাজ্যে বাস করতে চান। যারা সরকারব্যবস্থায় আস্থা রাখেন (যেমন: উদারপন্থী, রক্ষণশীল, সমাজতন্ত্রী এবং ফ্যাসিস্ট) তাদের বলা হয় “রাষ্ট্রপন্থী।”

আপনাদের মনে হতে পারে নৈরাজ্য সম্পূর্ণ নেতিবাচক একটা ধারণা - হয়তো সবকিছুরই বিরুদ্ধাচরণ। আসলে, নৈরাজ্যবাদীদের জীবনযাপন ও রাষ্ট্রহীন সমাজ নিয়ে বহু ইতিবাচক চিন্তা আছে। কিন্তু, মার্ক্সবাদী, উদারপন্থী বা রক্ষণশীলদের মতো তাঁদের কোনো ব্লুপ্রিন্ট নাই।

এনার্কিস্টরা কি বোমাবাজ নয়?
না। অন্তত, আমেরিকান সরকারের মত নয়। তারাতো প্রতিদিন ইরাকে যে পরিমাণ বোমা ফেলে, গত ১৫০ বছরের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে এনার্কিস্টরা অতো বোমা মারেনি। তাহলে আমরা “প্রেসিডেন্টরা বোমা মারে” এরকম বলতে শুনিনা কেন? তাহলে কি নৈরাজ্যবাদীদের ছুঁড়ে মারা বোমের থেকে আমেরিকা সরকারের উপর থেকে ফেলা বোমের প্রতি কোনো আলাদা সহর্মিমতা আছে?

বহু দেশে স্বৈরাচারী বা গণতান্ত্রিক সরকারের শাসনের মধ্যেই নৈরাজ্যবাদীরা বহুকাল ধরে সক্রিয় আছেন। কখনো কখনো, বিশেষত চরম নিপীড়িত হয়ে নৈরাজ্যবাদীরা বোমা মেরেছেন। কিন্তু, সেসবই ব্যতিক্রম। অথচ, “নৈরাজ্যবাদীরা বোমামাজ”, পুরো ঊনিশ শতক ধরে এই তকমা দিয়ে গেছেন রাজনীতিক এবং সাংবাদিকরা এবং, আজও তারা এসব বলা ছাড়েননি। কিন্তু, তখন থেকেই সেসব অতিশয়োক্তিই ছিলো।

কোনো কার্যকর নৈরাজ্যবাদী সমাজের অস্তিত্ব কি আদৌ কখনো ছিল?
হ্যাঁ, এরকম অগুণতি উদাহরণ আছে। মানব ইতিহাসের শুরুতে মিলিয়ন বছরেরও বেশী কালব্যাপী তারা ছোট ছোট দলে কোনোরকমের শাসনতান্ত্রিক স্তর বা অধিকর্তা ছাড়াই সমান মর্যাদায় শিকার সংগ্রহ করে জীবনযাপন করতো। এরা আমাদের পূর্বসুরী। নৈরাজ্যবাদী সমাজ নিশ্চয়ই সফল হয়েছিল নয়তো, আমরা আজ এই পর্যায়ে আসতাম না। রাষ্ট্রের উৎপত্তি মাত্র হাজারখানেক বছর আগে, এবং, এই ধারণা স্যান, পিগমি এবং অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীদের মত সমাজব্যবস্থাকেই দমিয়ে দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

কিন্তু আমরা তো আর আগের জীবনব্যবস্থায় ফিরে যেতে পারি না…
প্রায় সকল নৈরাজ্যবাদীই হয়তো এটা স্বীকার করবেন। কিন্তু, এটা আমাদের চোখ খুলে দেয়। অপরাপর নৈরাজ্যবাদীদেরও ইশারা দেয়। আমরা এইসব সমাজকে পর্যবেক্ষণ করতে পারি এবং কিছু কিছু ধারণাকে হয়তো গ্রহণও করতে পারি। তাহলে আমরা বুঝতে পারব কেমন করে একটা স্বাধীন, ব্যক্তিপ্রধান অথচ সহযোগিতাপূর্ণ সমাজব্যবস্থা চলতে পারে। যেমন ধরুন, আদিম নৈরাজ্যবাদী সমাজের লোকজন বেশীরভাগ সময়ই নিজেদের মধ্যকার ঝগড়া-বিবাদ আপোষ-মধ্যস্থতা বা বাধ্যবাধকতা বিহীন সালিসের মাধ্যমে মীমাংসা করতো। তাদের এই পদ্ধতি আমাদের আইনী ব্যবস্থার চেয়েও বেশী কার্যকরী কারণ, এতে বিবাদমান দুই পক্ষের পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীরা মীমাংসার সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে সাহায্য করতে পারতো, সমস্যার যৌক্তিক সমাধান পেতে তারা সমব্যথী ও বিশ্বাসযোগ্য মানুষের মাধ্যমে মধ্যস্থতার সুযোগ পেত। সত্তর ও আশির দশকে বিশেষজ্ঞ একাডেমিশিয়ানরা এই পদ্ধতিকে আমেরিকান আইন ব্যবস্থায় চালু করার চেষ্টা করেন। স্বাভাবিকভাবেই সেই উদ্যোগ টিকলো না, কারণ, এসব তো শুধুমাত্র একটা মুক্ত সমাজেই টেকা সম্ভব।

নৈরাজ্যবাদীরা বোকা; তারা মনে করে মানুষের চরিত্র মূলত  ইতিবাচক…
বিষয়টা সেরকম নয়। একথা সত্য যে, নৈরাজ্যবাদীরা আদিপাপ বা সহজাত ভ্রষ্টাচারের ধারণাকে গ্রহণযোগ্য মনে করেন না। ওসব ধর্মীয় ধারণা, যা বেশীরভাগ মানুষই আর বিশ্বাস করে না। কিন্তু, নৈরাজ্যবাদীরা মনে করেন মানবচরিত্র মূলত ইতিবাচক, বিষয়টা সবসময় সেরকম নয়। একজন মানুষ যেমন, নৈরাজ্যবাদীরা তাকে তেমনভাবেই বিবেচনা করেন। মানুষ “মূলত” কোনো নির্দিষ্ট চরিত্রের নয়। আমরা, যারা পুঁজিবাদ ও এর অনুকূল রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিতরে বাস করছি, আসলে সেইসব মানুষ, যারা কখনোই নিজেরা যা চাই তা হতে পারার সুযোগই পাইনি।

নৈরাজ্যবাদীরা তেমনি করে মানুষের নৈতিকতাবোধকেই অনেক সময় বেশী প্রাধান্য দিয়ে থাকেন, ঠিক যেমনি করে তারা নিজেকে সমৃদ্ধ করার দিকেও প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। নৈরাজ্যবাদ কোনো আত্মোৎসর্গের মতবাদ নয়, যদিও নৈরাজ্যবাদীরা নিজেদের বিশ্বাসের কারণে লড়েছেন এবং মৃত্যুকে বরণ করেছেন। নৈরাজ্যবাদীরা মনে করেন তাঁদের মৌলিক ধারণাগুলো সকলের জন্যই হয়তো হিতকর হবে।

রাষ্ট্রের হাতে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা না থাকলে আমরা কেমন করে বিশ্বাস করব যে মানুষ একে অপরের ক্ষতি করবে না?
আপনি যদি সাধারণ মানুষের উপরেই বিশ্বাস রাখতে না পারেন যে তারা পরস্পরের ক্ষতি করবে না, কেমন করে আপনি রাষ্ট্রের উপরে বিশ্বাস করবেন যে, সে আমাদের সকলের ক্ষতি করবে না? সাধারণ মানুষ কি শাসকের চেয়েও কম নিঃস্বার্থ, নিবেদিতপ্রাণ বা যোগ্যতর নয়? আবার, আপনি সহনাগরিকদের যত বেশী অবিশ্বাস করবেন, আপনার নৈরাজ্যবাদী হওয়ার সম্ভাবনা ততোই বেড়ে যাবে। নৈরাজ্যবাদে ক্ষমতার পরিণত বিকেন্দ্রীকরণ হয়। এতে প্রত্যেকেরই কিছু ক্ষমতা থাকে, কিন্তু কারোর অতিরিক্ত ক্ষমতা থাকে না। কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থায় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে যায় এবং বেশীরভাগ মানুষের কাছেই আসলে কোনো ক্ষমতা থাকে না। তাহলে এবার বলুন, কোন ধরণের ক্ষমতাতন্ত্রের বিপরীতে আপনি দাঁড়াবেন?

কিন্তু - চলুন বাস্তবতায় ফিরি - যদি পুলিশ না থাকে তাহলে কি হবে?
নৈরাজ্যবাদী এলেন থর্নটনের মত হল, “পুলিশের কাজ নিরাপত্তা দেওয়া নয়; তাদের কাজ আসলে প্রতিশোধ নেওয়া।” আমাদের অবশ্যই ব্যাটম্যানের স্টাইলে অপরাধ দমন করে বেড়ানোর ধারণা নিয়ে থাকলে চলবে না। পুলিশের টহলদারী অপরাধ ও অপরাধীদের দমিয়ে রাখে না। কানসাস এবং তার আশেপাশের এলাকায় একবার গোপনে পুলিশী টহলদারী কমিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু, দেখা গেল অপরাধের মাত্রা আগের মতোই থাকলো। অপর একটি গবেষণায় দেখা যায়, গোয়েন্দা নজরদারী, অপরাধ গবেষণাগার এইসবের আসলে অপরাধ কমানোর উপরে কোনো প্রভাব নাই। কিন্তু, যেসব এলাকার মানুষেরা একাট্টা হয়ে একে অপরকে অপরাধীদের সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়, তখন অপরাধীরা সাধারণত সেসব এলাকা থেকে এমন এলাকায় চলে যায় যেখানে শুধুমাত্র পুলিশের প্রহরা থাকে। কারণ, অপরাধীরা জানে যে তারা ঐসমস্ত এলাকাতেই বেশী নিরাপদ।

কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের প্রায় সব কাজের সঙ্গেই তো রাষ্ট্রের কোনো না কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে।
এটা সত্য। কিন্তু, আপনি এভাবেও ভাবতে পারেন, প্রতিদিনের জীবনযাপনের সবটুকুই তো প্রায় নৈরাজ্যকর। পুলিশের মুখোমুখি আমরা কেই পড়তে চাই, ওই ওভারস্পিডের জন্য টিকেট না ধরিয়ে দিলে? স্বাধীন চুক্তি আর বোঝাপড়াই তো প্রায় সবখানে চলে।  নৈরাজ্যবাদী রুডল্ফ রকার বলেছেন, “এমনকি চরম স্বৈরতন্ত্রের মধ্যেও মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো স্বাধীন চুক্তি আর পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমেই চলে। এছাড়া সামাজিক জীবনযাপন করা সম্ভবই নয়।”

পারিবারিক জীবন, বেচাকেনা, বন্ধুত্ব, ধর্মাচরণ, যৌনতা এবং বিশ্রাম সবই নৈরাজ্যবাদী। কর্মক্ষেত্রকেও বেশীরভাগ নৈরাজ্যবাদী রাষ্ট্রের মতোই দমনমূলক জায়গা বলে মনে করেন। কিন্তু, সেখানেও শ্রমিকেরা বসের মাতব্বরী ছাড়াই পরস্পরকে প্রবলভাবেই সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকেন। কারণ, এতে কাজের চাপটা যথাসম্ভব কমিয়ে সেটাকে শেষ করা যায়। কেউ কেউ তারপরেও বলতে পারেন নৈরাজ্য আসলে কার্যকরী কিছু নয়। কিন্তু, নৈরাজ্যই বলা যায় একমাত্র জিনিস যা আসলে কার্যকরী। রাষ্ট্র এবং তার অর্থনীতিই বরং নৈরাজ্যের মধ্যে জবরদস্তি করে আরামে বসে থাকতে চায়।

সংস্কৃতি?
বহু সৃষ্টিশীল মহাত্মাগণ নৈরাজ্যবাদ দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছেন। তাঁরা আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। পার্সি বিসি শেলী, উইলিয়াম ব্লেক, আর্থার রিমবড এবং লরেন্স ফেলিংগেসি'র মত কবিরা নৈরাজ্যবাদী ছিলেন। আমেরিকান প্রবন্ধকারদের মাঝে নৈরাজ্যবাদী ছিলেন হেনরি ডেভিড থোরো। এবং, বিংশ শতাব্দীর ক্যাথলিক অরাজবাদী ডরোথি ডে,পল গুডম্যান এবং এলেক্স কমফোর্ট ('দ্য জয় অফ সেক্স' এর রচয়িতা)। ভাষাতত্ত্ববিদ নোম চমস্কি, ইতিহাসবেত্তা হওয়ার্ড জিন, নৃবিজ্ঞানী এ.আর র‍্যাডক্লিফ ব্রাউন এবং পিয়েরে ক্লাস্টার্সের মতন পণ্ডিত ব্যক্তিরা নৈরাজ্যবাদী। নৈরাজ্যবাদী সাহিত্যিকের সংখ্যা অনেক, কিন্তু তাদের মাঝে লিও টলস্টয়, অস্কার ওয়াইল্ড, মেরী শেলীর ( 'ফ্র‍্যাঙ্কেস্টাইন' এর রচয়িতা) কথা না বললেই নয়। নৈরাজ্যবাদী চিত্রকরদের মধ্যে আছেন গুস্তভ করবেট, জর্জ স্যুরাট, ক্যামিলি পিসারো এবং জ্যাকসন পোলক। এছাড়াও অন্যান্য নৈরাজ্যবাদী শিল্পীদের মধ্যে আছেন জন কেজ, জন লেননের মত সঙ্গীতজ্ঞরা আর, CRASS নামক ব্যান্ডটির কথাও বলা যায় এ তালিকায়।////

ধরে নিলাম আপনার কথাই ঠিক। নৈরাজ্য আমাদের বর্তমান জীবনযাপন পদ্ধতির চেয়ে অধিক শ্রেয়। কিন্তু, আমরা রাষ্ট্রব্যবস্থার পতনই বা কিভাবে ঘটাবো,যদি এটা এতই কঠোর,  ক্ষমতাশালী হয়ে থাকে?
নৈরাজ্যবাদীরাও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন। কিন্তু, তারা কোনো নির্দিষ্ট, সরল সমাধানে পৌঁছতে পারেননি। ১৯৩৬ সালে স্পেনে দশ লক্ষ নৈরাজ্যবাদী ছিলেন। তখন সেখানে এক সামরিক অভ্যুত্থান হল। সে সময় নৈরাজ্যবাদীরা যেমন এই ফ্যাসিস্টদের সাথে মুখোমুখি লড়াই করেছে, তেমনি শ্রমিকদেরও সাহায্য করেছে কারখানার দখল নিতে। কৃষকদের পক্ষ নিয়েছে, তাদের চাষের জমি অধিকার বুঝে নিতে। নৈরাজ্যবাদীরা এই একই কাজ করেছে ১৯১৮-১৯২০ সালে, ইউক্রেনে। সেখানে তাদেরকে জারিস্ট, কম্যুনিস্ট উভয় পক্ষের সাথেই লড়াই করতে হয়েছে। অবশ্য, এসব উপায়ের কোনোটাই আর এই একবিংশ শতাব্দীতে সরকারব্যবস্থার পতন ঘটাতে পারবেনা।

পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতনের ঘটনাটা চিন্তা করে দেখুন। নানান ধরণের সহিংসতা এবং হত্যার ঘটনা সেখানে ঘটেছে। কিছু দেশে তো অন্যদের তুলনায় বেশীই ঘটেছে। কিন্তু, শুধুমাত্র বেশীরভাগ মানুষের এই পচে যাওয়া ব্যবস্থাকে টিকিয়ে না রাখার ইচ্ছাই বড় বড় রাজনীতিবিদ, সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রকে (বলা যায় আগেকার শত্রুরাই) নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। মস্কো বা ওয়ারশ’র রাজনৈতিক নেতাদের কিই বা করার ছিল? জনগণের ওপর বোমাবাজি করে কুল পেতো তারা? শ্রমিকদেরকে মেরে ফেলে রেহাই পেতো ভেবেছেন?
অধিকাংশ নৈরাজ্যবাদী মনে করেন, ওই এক হরতালই সরকারব্যবস্থাকে গুঁড়িয়ে দিতে বিশাল ভূমিকা রেখেছিল। এটা হল আসলি গণ-অসহযোগ আন্দোলন।

আপনি যদি সরকারব্যবস্থার বিরুদ্ধে হন,তাহলে নিশ্চয়ই গণতন্ত্রেরও বিরুদ্ধে?
গণতন্ত্র মানে যদি এটা হয় যে, মানুষ নিজেই তার জীবন স্বাধীনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, তাহলে নৈরাজ্যবাদীরা হত, যেমনটা বেঞ্জামিন টাকার বলে থাকেন, "অকুতোভয় জেফারসনিয়ান ডেমোক্রেট"। তবে, তারাই হত প্রকৃত গণতান্ত্রবাদী। কিন্তু, গণতন্ত্র আদতে মোটেও এরকম নয়। বাস্তবে, কিছু সংখ্যক জনগণ (আমেরিকার ক্ষেত্রে বলা যায়, জনগণের একটি ক্ষুদ্র অংশ) মুষ্টিমেয় কিছু রাজনীতিবিদকে নির্বাচিত করে, যারা কিনা জনগণের মতামতের কোনো তোয়াক্কা না করেই নানা আইন প্রণয়ন করে, আমলা আর পুলিশ দিয়ে মানুষের উপর সেসব আইন প্রয়োগ করে।
যেমনটা ফরাসি দার্শনিক রুশো (ইনি নৈরাজ্যবাদী নন) লিখেছিলেন, গণতন্ত্রে, কেবলমাত্র ভোটের সময়ই জনগণ স্বাধীন, বাকিটা সময় তারা সরকারের দাস। এইসব রাজনীতিবিদ এবং আমলারা সবসময় বড় বড় ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য স্বার্থান্বেষী মহলের শক্তিশালী প্রভাব বলয়ের ভিতরে থাকে। সকলেই এসব জানে। কিন্তু, কিছু মানুষ চুপ করে থাকে কারণ, তারাও এসব ক্ষমতাবানদের থেকে কিছু সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে। আর বাদবাকি বেশীরভাগ মানুষই কোনো প্রতিবাদ করে না কারণ, তারা জানে এতে কোনো লাভ নাই। বরং, তাদেরকে রাষ্ট্র  "প্রতিক্রিয়াশীল" বা "নৈরাজ্যবাদী" আখ্যা দিয়ে ফেলতে পারে! হায় গণতন্ত্র!

আচ্ছা, আপনি যদি প্রতিনিধিই নির্বাচিত না করেন, তাহলে সমাজের হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে কে? আপনি নিশ্চয়ই আমাকে বলবেন না যে, মানুষ অন্যের কথা বিবেচনায় না নিয়ে নিজের খুশীমত কাজ করে যেতে পারবে?
সত্যিকারের সহযোগীতাপূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত সমাজে কোন প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে, তা নিয়ে নৈরাজ্যবাদীদের নানা মত রয়েছে। তবে বেশীরভাগ নৈরাজ্যবাদীই এই মত দেন যে, এই ধরনের সমাজব্যবস্থা স্থানীয় কম্যুনিটি ভিত্তিক হওয়া উচিত। কম্যুনিটিগুলো হবে যথাসম্ভব ছোট, যাতে সকলের সঙ্গে সকলের জানাশোনা থাকে। অথবা তারা যেন অন্তত পরিবারিক বন্ধন, বন্ধুত্ব, মতামত এবং আগ্রহের জায়গাগুলো কম্যুনিটির সকলের সাথে ভাগাভাগি করে নেওয়ার সুযোগ পায়। যেহেতু এসব হল স্থানীয় কম্যুনিটি, তাই তারা নিজেদের কম্যুনিটি ও এর পরিবেশ সম্পর্কে নিজেদের ভাবনা ও মতামত প্রকাশ করতে পারবে। তারা ভালোমতই জানবে যে, নিজেদের গৃহীত সিদ্ধান্তের ফলও নিজেদেরই ভোগ করতে হবে। বিষয়টা রাজনীতিবিদ বা আমলাদের মত নয়, যারা সকলের হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।
নৈরাজ্যবাদীরা বিশ্বাস করেন, সিদ্ধান্ত সবসময় সর্বোচ্চ ছোট পরিসরে গ্রহণ করা উচিত। ‌স্বতন্ত্র ব্যক্তি বা ছোট ছোট দল যে সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে সক্ষম, তা যদি অন্যদের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে সেই সিদ্ধান্ত বোঝাপড়ার মাধ্যমে নিজেদেরই নিয়ে ফেলা উচিত। আবার, অন্যদের সিদ্ধান্তে হিস্তক্ষেপ না করার সাপেক্ষে পরিবার, ধর্মসভা বা শ্রমিকদের ছোট ছোট দলগুলোর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলতে হবে। যদি কোনো সিদ্ধান্তের উল্লেখযোগ্য ব্যাপক কোনো প্রভাব থাকতে পারে বলে কেউ মনে করে, সেক্ষেত্রে কম্যুনিটির সকলে মুখোমুখি বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
কম্যুনিটির এই সভাগুলো, বলাই বাহুল্য, কোনো আইনসভা নয়। এখানে কোনো প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে আসবেনা। যেকেউ এতে যোগ দিতে পারবে। নিজেদের কথা বলতে পারবে। কিন্তু, সেখানে যেহেতু সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে কথা বলাই মুখ্য উদ্দেশ্য, তাই, ফুটবল কোচ ভিন্স লম্বার্ডির সেই কথাটি মনে রাখতে হবে - কথার লড়াইয়ে জিতে যাওয়াই যেন "একমাত্র লক্ষ্য" না হয়ে দাঁড়ায়। চাইতে হবে সকলের জয়। সহনাগরিকের মতামতকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে প্রথমেই চেষ্টা করতে হবে, বিবাদের যথাসম্ভব মীমাংসা করতে। বেশীরভাগ সময়ে মীমাংসায় পৌঁছতে এই চেষ্টাটুকুই যথেষ্ট। যদি তাতেও না হয়, তাহলে আপোষের পথে যাওয়া যেতে পারে। এবং, প্রায় সবসময়েই দেখা গেছে, এতে কাজ হয়। যদি সেটাও না হয় এবং যদি তাৎক্ষণিক সমাধান খুব জরুরী না হয়ে থাকে, তবে সভা সেদিনের মত মুলতুবি রাখা যেতে পারে। এতে করে কম্যুনিটির সদস্যরা পরবর্তী সভার আগে নিজেদের মাঝে বিষয়টি নিয়ে আলাপ আলোচনা করার সুযোগ পাবে। যদি এই পদ্ধতিও সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে, কম্যুনিটি দেখবে নিজেদের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সাময়িকভাবে তারা আলাদা হতে পারে কিনা।
দুটি দলের সিদ্ধান্তের মাঝে যদি তখনও পার্থক্য থাকে, তাহলে সংখ্যালঘু দলটির সামনে দুটো পথ খোলা থাকবে। তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলটির সাথে সম্মতি প্রকাশ করতে পারে, যেহেতু, কম্যুনিটির ভেতর সমন্বয় রক্ষা করা উক্ত বিষয়টির চেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলটি এক্ষেত্রে অন্যকোনো উপায়ে সংখ্যালঘু দলকে সন্তুষ্ট করতে পারে।

কিন্তু, এই সকল প্রচেষ্টাই যদি ব্যর্থ হয়, নিজেদের সিদ্ধান্ত সংখ্যালঘু দলের কাছে যদি এতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে, তাহলে তারা বিদ্যমান কম্যুনিটি থেকে আলাদা হয়ে নিজেদের কম্যুনিটি গঠন করতে পারে। আমেরিকার কানেটিকাট, রোড আইল্যান্ড, ভারমন্ট, কেন্টাকি, মেইন, উটা, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ইত্যাদি রাজ্যগুলোর মতন। যে যুক্তি তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে খাটাতে পারে না. সেসব যুক্তি নৈরাজ্যবাদের বিরুদ্ধে খাটালেই হবে না। এসব ব্যর্থতা নৈরাজ্যবাদের নয়, কারণ প্রতিটা কম্যুনিটিতে নৈরাজ্যবাদের পুনঃবিকাশ ঘটা সম্ভব। নৈরাজ্যবাদ নিখুঁত কোনো সিস্টেম নয়, এটা কেবল অন্যগুলোর চেয়ে শ্রেয়তর।

স্থানীয়ভাবে আমাদের সকল চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়।
সকল চাহিদা পূরণ হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু, প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় প্রাগৈতিহাসিক ইউরোপের নৈরাজ্যবাদী সমাজে শতশত, এমনকি হাজার মাইল দূরত্বের বাণিজ্যেরও নজির মিলেছে। বিংশ শতাব্দীর নৃবিজ্ঞানীরা আদিম নৈরাজ্যবাদী সমাজের হদিস পেয়েছিলেন। এদের ভেতর স্যান (বুশম্যান) শিকারি সম্প্রদায় এবং ট্রোব্রিয়ান্ড দ্বীপের আদিবাসীরা তাদের নিজ নিজ অংশীদারদের ভেতর এই ধরনের বাণিজ্য পরিচালনা করতো। কার্যত, নৈরাজ্যবাদ কখনোই স্থানীয় স্বয়ংসম্পূর্ণতার ওপর নির্ভর করে থাকেনি। তবে, আধুনিক অনেক নৈরাজ্যবাদী মনে করেন, কম্যুনিটিগুলোর যতটা সম্ভব স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা উচিত। দূরের বা অচেনা কারো উপর নির্ভর না করেই। এমনকি, বর্তমানের আধুনিক প্রযুক্তি, যেসবের তৈরিই করা হয়েছে মূলত স্বয়ংসম্পূর্ণতাকে ভেঙে বাজার সম্প্রসারণ করতে, সেগুলো ব্যবহার করেও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব। কিন্তু সেই তরিকা সরকার বা বড় বড় কর্পোরেশনগুলো আমাদেরকে জানতে দিতে চায় না।

নৈরাজ্যবাদের অন্যতম সংজ্ঞা হল 'বিশৃঙ্খলা'। নৈরাজ্যবাদ কি শেষমেশ বিশৃঙ্খলাতেই পরিণত হবেনা?
পিয়েরে জোসেফ প্রুঁধো - নিজেকে নৈরাজ্যবাদী ঘোষণা দেওয়া প্রথম ব্যক্তি, লিখেছিলেন, স্বাধীনতা হল সব নিয়মশৃঙ্খলার মাতা, কন্যা নয়। নৈরাজ্যবাদী শৃঙ্খলা রাষ্ট্রের চাপানো আইনকানুনের চেয়ে অধিকতর শ্রেয়, কারণ, এগুলো কোনো দমনমূলক আইন নয়। এগুলো কম্যুনিটির মানুষগুলোর একসাথে বেঁচে থাকার জন্য সহজাত বোঝাপড়া। নৈরাজ্যবাদে গৃহীত নীতিগুলো সকলের সম্মতিতে সাধারণ বোধ থেকে উদ্ভুত।

নৈরাজ্যবাদের দর্শন প্রথম কবে প্রণীত হয়েছিল?
কেউ কেউ মনে করেন, নৈরাজ্যবাদী ধারণার প্রথম প্রকাশ হয়েছিল প্রাচীন গ্রীসে ডায়োজিনিস দ্য সিনিকের মাধ্যমে, প্রাচীন চীনে লাও সে, মধ্যযুগীয় কয়েকজন আধ্যাত্মবাদীদের দ্বারা এবং সতের শতকের ইংলিশ সিভিল ওয়ারের সময়টায়। কিন্তু, আধুনিক নৈরাজ্যবাদের সূচনা ঘটেছে ১৭৯৩ সালে উইলিয়াম গডউইনের ‘পলিটিক্যাল জাস্টিস বইটি’ প্রকাশের সাথে। পরবর্তীতে, ১৮৪০ সালে ফ্রান্সে আধুনিক নৈরাজ্যবাদের পূনর্জাগরণ ঘটে পিয়েরে জোসেফ প্রুঁধোর "হোয়াট ইজ প্রপার্টি?" বইয়ের মাধ্যমে। ফ্রান্সের শ্রমিকদের নিয়ে তিনি একটি নৈরাজ্যবাদী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ম্যাক্স স্টার্নার তার "দি ইগো এন্ড হিস ওন“ (১৮৪৪) বইতে "এনলাইটেন্ড ইগোইজম" এর সংজ্ঞায়ন করেছেন, যেটাকে নৈরাজ্যবাদের একটি মৌলিক মানদণ্ড হিসেবে ধরা হয়। জোসিয়া ওয়ারেন নামের একজন আমেরিকান ওই একই সময়ে, একই ধারণা নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে এগিয়েও একই সিদ্ধান্তে আসেন এবং ইউটোপিয়ান কম্যুনিটির ভিত্তিস্থাপনের উদ্দেশ্যে একটি বিরাট আন্দোলন গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখেন। পরবর্তীতে রাশান বিপ্লবী মিখাইল বাকুনিন এবং রাশান পণ্ডিত পিটার ক্রপোৎকিন নৈরাজ্যবাদের ধারণাকে আরো বিকশিত করেন। নৈরাজ্যবাদীরা আশা করে যে, পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে তাদের ধারণা উত্তরোত্তর বিকাশ লাভ করবে।

এই বিপ্লবী ব্যাপারস্যাপারগুলো অনেকটাই কমুনিজমের মত শোনাচ্ছে, যা কেউ চায়না।
এনার্কিস্ট আর মার্ক্সিস্টদের বিরোধ লেগে আছে সেই ১৮৬০ থেকে। যদিও, রাশান বিপ্লবের সময় দুই পক্ষেরই সাধারণ শত্রু জারিস্টদের বিরুদ্ধে, কিংবা স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময় স্পেনীয় ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে তারা একসাথেই কাজ করেছে। কমুনিস্টরা বরাবরই নৈরাজ্যবাদীদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে এসেছে। এছাড়া, কার্ল মার্ক্স থেকে শুরু করে জোসেফ স্টালিন সকলেই নৈরাজ্যবাদের নিন্দাই করেছেন সবসময়।
ক্রপোৎকিনের কিছু নৈরাজ্যবাদী অনুসারীরা নিজেদেরকে 'communists' দাবি করেন, 'Communists' নয়। কিন্তু তারা কমুনিজম বলতে মিলেমিশে সম্পত্তি ভোগদখল করা, স্থাণীয় কমুনিটিতে চেনাজানা লোকজনদের সঙ্গে কাজকর্ম করা - এসবকেই বুঝতেন। রাষ্ট্র অধিকৃত ভূমিব্যবস্থা আর উৎপাদন ব্যবস্থা, রাষ্ট্রের স্থানীয় স্বায়ত্বশাসন, আর শ্রমিকদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষণের প্রতি ছিল তাদের অনাস্থা। দুটি ধারণার মধ্যে তাহলে তো বিরাট পার্থক্য দেখা যাচ্ছে, তাই না?

ইউরোপিয়ান কম্যুনিজমের পতনকে নৈরাজ্যবাদীরা কেবল স্বাগতই জানায়নি, এতে অংশগ্রহণও করেছিল। কিছু কিছু বিদেশী নৈরাজ্যবাদী ইস্টার্ন ব্লকের ভিন্নমতাবলম্বীদেরকেও সহায়তা করেছে যা কিনা বহুবছর পর্যন্ত আমেরিকান সরকারও করেনি। অনেক সাবেক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বর্তমানে নৈরাজ্যবাদীরা সক্রিয় আছে।
কম্যুনিস্টদের পতন আমেরিকার বামপন্থীদের জন্য অনিবার্য দুর্নাম বয়ে আনলেও, এর সাথে নৈরাজ্যবাদীদের আসলে কোনো সম্পর্ক নেই। এদের অনেকেই নিজেকে বামপন্থী হিসাবে দাবীও করেন না। মার্ক্সিজমের আগেও নৈরাজ্যবাদীরা ছিল, এখনো আছে।

নৈরাজ্যবাদীরা কি সহিংসতাকেই উস্কে দেয়না?
ডেমোক্রেট, রিপাবলিকান, উদারপন্থী বা রক্ষণশীলদের সহিংসতার কাছে নৈরাজ্যবাদীরা কিছুই নয়। ওইসব মানুষকে দূর থেকে দেখে অহিংস মনে হয়, কারণ, তারা তাদের সব নোংরা কাজকর্ম রাষ্ট্রকে দিয়ে করায়; রাষ্ট্র তাদের হয়ে সহিংস কাজকর্ম চালায়। কিন্তু, সহিংসতা সহিংসতাই। ইউনিফর্ম বা পতাকা সহিংসতার চরিত্র ঢাকতে পারেনা। রাষ্ট্র গোড়া থেকেই সহিংস। আমাদের নৈরাজ্যবাদী, শিকারি বা কৃষক পূর্বপুরুষদের উপর চড়াও না হলে রাষ্ট্রের জন্মই হতোনা। কিছু কিছু নৈরাজ্যবাদী সহিংসতার পক্ষে কথা বলে ঠিকই, কিন্তু, সব রাষ্ট্রই প্রতিনিয়ত সহিংসতার আগুনে ঘি ঢালছে।
কিছু নৈরাজ্যবাদী টলস্টয়ের ধারায় শান্তিবাদী, অহিংস নীতি গ্রহণ করেছে। আপেক্ষিকভাবে, কম সংখ্যক নৈরাজ্যবাদীই রাষ্ট্রকে সরাসরি আক্রমণের পথ বেছে নেয়। বেশীরভাগ নৈরাজ্যবাদীই আত্মরক্ষায় বিশ্বাস করে, এবং, বিপ্লবী পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় সহিংসতাকে সমর্থন দেয়।
কিন্তু, বিষয়টি আদৌ সহিংসতা বনাম অহিংসতার নয়। বিষয়টি হল সরাসরি প্রতিবাদের। নৈরাজ্যবাদীরা বিশ্বাস করে, সকল মানুষের উচিত নিজের ভাগ্যের হাল নিজহাতে ধরা। আর এজন্য তাকে একা একা বা ঐক্যবদ্ধভাবে, আইনী বা বেআইনী, সহিংস বা অহিংস যেকোন পথেই যেতে হতে পারে।

নৈরাজ্যবাদী সামাজিক কাঠামোটা আসলে কেমন হবে?
নৈরাজ্যবাদীরা এইব্যপারে 'পুরোপুরি' নিশ্চিত নন। কারণ, সরকারব্যবস্থা লুপ্ত হওয়ার পরের পৃথিবীর সাথে বর্তমান পৃথিবীর কোনো মিলই থাকবেনা।

নৈরাজ্যবাদীরা এক্ষেত্রে কোনো ব্লুপ্রিন্ট পেশ করেনা, তবে, তারা কিছু নীতি-নির্দেশনা দেয়। তারা বলে, প্রতিযোগিতার চেয়ে বরং পারস্পারিক বোঝাপড়াই হল সামাজিক জীবনের অন্যতম সুস্থ ভিত্তি। তারা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী এই অর্থে যে, তারা মনে করে, সকল স্বতন্ত্র সত্তার সুবিধার জন্যেই সমাজের উৎপত্তি- এর উল্টোটা নয়। তারা বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষে। অর্থাৎ, তারা মনে করে সমাজের ভিত্তি হবে স্থানীয় পরিসরে ও প্রত্যক্ষ। তারপর এই কম্যুনিটিগুলো পারস্পারিক সমঝোতার ভিত্তিতে পরস্পর যুক্ত হবে। এই ফেডারেশন কেবলমাত্র সেসব বিষয়েই হস্তক্ষেপ করতে পারবে, যেগুলো স্থানীয় কম্যুনিটিতে চালনা করা সম্ভব নয়। এই ধরণের বিকেন্দ্রীকরণ বর্তমানের শাসনতান্ত্রিক স্তরবিন্যাসকেই উল্টে দিবে। বর্তমানে, সরকারব্যবস্থায় যত উঁচুতে যাওয়া যায়, ক্ষমতা তত বাড়তে থাকে। কিন্তু, নৈরাজ্যের অধীনে ফেডারেশনের সবথেকে উঁচু পদটি সর্বক্ষমতার অধিকারী হতে পারবে না। দমনমূলক কোনো ক্ষমতা তাদের হাতে থাকবে না। আর, যতোই উঁচুতে যাওয়া যাবে, তাদের দায়িত্ব ততোই কমতে থাকবে। তারপরেও ফেডারেশনের আমলাতান্ত্রিক বা রাষ্ট্রচরিত্র ধারণের ঝুঁকি নৈরাজ্যবাদীরা অস্বীকার করেন না। আমাদেরকে কল্পনাবিলাসী মনে হলেও, আমরা বাস্তববাদী। এইসব ফেডারেশনগুলোকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। টমাস জেফারসন যেমনটা বলেছেন, "স্বাধীনতা রক্ষা করার মধ্যেই এর সার্থকতা নিহিত।"

কোনো শেষকথা বলতে চান?
সদ্যপ্রয়াত মদাসক্ত ইংরেজ রাজনীতিবিদ ও যুদ্ধাপরাধী, উইন্সটন চার্চিল লিখেছিলেন, "গণতন্ত্র, শাসন করার জন্য অন্যান্য সব সিস্টেমের চেয়ে নিকৃষ্ট।" তেমনি বলা যায়, নৈরাজ্যবাদ সমাজ পরিচালনার জন্য অন্যান্য সব ব্যবস্থার চোখে নিকৃষ্ট। এখন পর্যন্ত মানবসভ্যতায় সকল শাসনতান্ত্রিক সমাজের পতন ঘটেছে, সফল হয়েছে কেবল নৈরাজ্য। সহজাতভাবেই, রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা খুবই অস্থিতিশীল। আগে হোক বা পরে, বর্তমান সমাজব্যবস্থাও ভেঙে পড়বে। এই জায়গাটা কে নেবে, তা নিয়ে চিন্তা করার এখনই সময়। নৈরাজ্যবাদীরা গত দুইশো বছর ধরে এর উত্তর খুঁজে আসছেন। তাই, এই চিন্তার জায়গাটা আমাদের জন্য অনেকটাই সহজ হয়েছে। আমাদের এই চিন্তাজগতে আপনাদেরকে আহবান জানাচ্ছি। আহবান জানাচ্ছি, পৃথিবীকে আরো বাসযোগ্য করে তুলতে আমাদের এই যাত্রার সঙ্গী হতে।