১.
"ঝলমল করিও না গো
তোমার ঐ অতো আলো
বেশী রূপ হলে পরে
সাবধানে থাকাই ভালো
মুখের ওই উর্নিটাকে একটু রাখো
খুলো নাকো দোহাই একেবারেই
ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে।"
পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, প্রভাষ দে'র সুরে মান্না দে গাইছেন, তুমুল রোমান্টিক গান। বাঙালি মননে এই গান গভীরভাবে রেখাপাত করে, একেবারে যাকে বলে রোমান্স। কিন্তু কী ভাবায়? খুব স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়, চাঁদ হলো নারী। হ্যাঁ, এই গানের নারীর নির্মাণ চলছে, রোমান্সের নির্মাণ চলছে। কারা করছেন? ইন্টেলেকচুয়ালেরা।
এবারে বহুল প্রচলিত ওয়াজের নসিহত শুনুন, দেখুনতো, মিল খুঁজে পাচ্ছেন কিনা?
"কলাকে খোসা ছাড়িয়ে রাখলে তাতে মাছি বসবেই। তেমনি নারীও পর্দায় না থাকলে তাতে দুষ্ট লোক চোখ দিবেই।"
এতো মিল হলো কেমন করে? এ তো মৌলবাদ আর 'কালচারে' মাখামাখি! কিন্তু, কালচার 'মালটা" কী? আর, 'মৌলবাদ' মালটাই বা কী? আর, ইন্টেলেকচুয়াল কেনই বা মৌলবাদীর মতো করে কথা বলছে? আমার কাছে ইন্টেলেকচুয়াল আর মৌলবাদীতে বিশেষ পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না। সুতরাং, আগে মৌলবাদ কী সেটাই নাহয় জেনে নেই। আমি যে ধারণাকে মৌলবাদের সংজ্ঞা হিসেবে যুক্তিযুক্ত বলে গ্রহণ করেছি সেটা হলো, মৌলবাদ খোদ আনুগত্যের, দণ্ডের, শাসনের প্রতি আনুগত্য আনার চেষ্টা। মূল পাল্টায় তো ভোলও পাল্টায়।
অবশ্য পাল্টানোই জগতের সব থেকে স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু, যা পাল্টে গেলো তাকেই ব্যবহার করে আনুগত্য আনার যে আপ্রাণ চেষ্টা তাই মৌলবাদ, এককথায় কর্তৃত্ববাদ। আর ইন্টেলেকচুয়াল হলেন তারাই যারা এই চেষ্টাটা করে যান এবং তার বিনিময়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।
এবারে প্রশ্ন হলো ‘কালচার’ মালটা কী? কালচার ল্যাটিন থেকে ফ্রেঞ্চ হয়ে ইংরেজি ভাষায় যুক্ত হওয়া শব্দ সেকথা সকলেই জানি। এর বাংলাটা হয়েছে সংস্কৃতি। আমাদের মগজে ‘সংস্কৃতি’ শব্দটা এলেই ভেসে ওঠে গান-বাজনা-শিল্পকর্ম-নাচ-অভিনয়-নাটক-চলচ্চিত্র ইত্যাদি। আবার কখনও কখনও মানুষের চিন্তা করার ধরণধারণ, বাচনকেও আমরা কালচার বলতে চাই। আর এইসব মিলিয়ে সংস্কৃতি বা কালচার এক ধোঁয়াটে মাল, অ্যাবস্ট্রাক্ট বা নির্বস্তুক। একটা মজার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, এই যে কালচারকে ‘মাল’ সম্বোধন করলাম, এটা কিন্তু আবার নিম্নরুচির পরিচয় হতে পারে। অথচ, ইংরেজি ‘শিট’ বা ‘ফাক’ শব্দটি এখন শহুরে শিক্ষিত মানুষের কালচারের অংশ। সুতরাং, সংস্কৃতিকে সংজ্ঞায়িত করা যেমন কঠিন, ঠিক তেমনি অপসংস্কৃতি ঠিক কী মাল তাও বলা কঠিন।
সংস্কৃতি যদি হয় মানুষের ‘সম্যক কৃতি’, তবে বলা যায়, বস্তুগত ও ভাবগত সকল কৃতিই মানুষের সংস্কৃতি।[১] লক্ষণীয় শব্দটি হলো ‘সকল কৃতি’। সুতরাং, এর কোনটি সুকুমার এবং কোনটি ‘কুকুমার’ সেইটা আপাতদৃষ্টিতে বোঝার উপায় নাই। সেই হিসেবে কথায় কথায় ‘বাল’ অথবা ‘ফাক’ বলাটা সুকুমার সংস্কৃতি নাকি কুকুমার সংস্কৃতি তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তবে, হ্যাঁ, যেখানে রয়েছে ইন্টেলেকচুয়ালের (আগেই বলেছি কারা) বিজ্ঞাপণ সেখান থেকে সংস্কৃতিটির গতিপ্রকৃতির ভালোমন্দ বুঝা যেতে পারে বৈকি। অর্থ্যাৎ, আমাদের ইন্টেলেকচুয়াল কোন কর্পোরেট প্ল্যানের হয়ে কথা বলছেন সেটাই এর মতিগতি বুঝতে সাহায্য করে।
কালচার মালটা জানার সাথে জানতে হবে ধর্ম সংক্রান্ত কিছু ধারণা। প্রথমতই আমরা ফ্রয়েডের দ্বারস্থ হই। ফ্রয়েডের এই মতবাদটি কমবেশী আমাদের জানা। ডারউইনের বিবর্তনবাদের উপর ভিত্তি করে তিনি এই ‘টোটেমবাদের’ অবতারণা করেছিলেন। সংক্ষেপে এইরকম-
সুপ্রাচীনকালে মানুষ ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বাস করত, প্রত্যেকটি দলের অধিপতি ছিল একজন শক্তিশালী পুরুষ।....শক্তিশালী পুরুষটি সমস্ত দলটির প্রভু এবং পিতা ছিল। তার ক্ষমতা ছিল অপরিসীম, যে ক্ষমতা সে নির্দয়ভাবে ব্যবহার করত। তার দলের পত্নীরা ও কন্যারা এবং তার সঙ্গে হয়ত অন্য দলের থেকে চুরি করে আনা স্ত্রীগণ - সমস্ত স্ত্রীজাতি ছিল তার সম্পত্তি। পুত্রদের ভাগ্য ছিল কঠোর; যদি ওরা পিতার ঈর্ষা বা ক্রোধ উদ্রেক করত তাহলে হয় তাদের মেরে ফেলা হত, অথবা জননেন্দ্রিয় নষ্ট করে দিয়ে পুরুষত্বহীন করে দেওয়া হত, অথবা দল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হত।...কালক্রমে পুত্রদের মধ্যে সবলজন হয়ে উঠতো দলটির প্রভু্। বেশীরভাগ সময় হয়তো কনিষ্ঠ পুত্রটিই প্রভু হয়ে উঠতো, কারণ, সে মা’র স্নেহ এবং নজরদারিতে সুরক্ষিত থাকতো। আর, যেসব পুত্র বহিষ্কৃত হয়ে যেত তারা একসঙ্গে হয়ে পিতাকে পরাজিত করতো এবং পরাজিত পিতার মাংস খেয়ে ফেলত। এটা ভাবার কারণ নাই যে, এই যুগে এসে এই মনোবৃত্তির আর অস্তিত্ব নাই। বরং, এখনকার প্রাপ্ত গবেষণার ফল থেকেই এই সিদ্ধান্তে আসা হচ্ছে। যাহোক, সেই আদি মানবেরা যে শুধুমাত্র ঘৃণা থেকে এই কাজটা করতো এমন ভাবার কারণ নাই। এরা পিতাকে আদর্শ হিসেবে সম্মানও করত। আসল কথা হলো এরা প্রত্যেকেই পিতার আসনে বসতে চাইত। কাজেই এই মাংস খেয়ে ফেলার ব্যাপারটা পিতার শরীরের একটা অংশ নিজের শরীরের মধ্যে নিয়ে নিজেকে পিতার সঙ্গে একাত্ম করার একটা প্রচেষ্টা হিসেবে বোধগম্য হয়।
পিতাকে মেরে ফেলার পর ভাইয়েরা লড়াই করতো উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজের শাসনাধিকার কায়েম করতে। এরপর একসময় তারা আবিষ্কার করলো যে, এভাবে লড়াই করাটার কোনো মানেই হয় না। ফলে তারা সংঘবদ্ধ সামাজিক চুক্তির মধ্যে যাওয়ার চেষ্টা করলো। সৃষ্টি হল প্রথম সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানকে পবিত্র ঘোষনা করা হলো, মা ও ভগ্নীদের দখল করার বাসনা পরিত্যাগ করা হলো, সূত্রপাত হলো নৈতিকতা ও আইনের।....কিন্তু এইসব ব্যাপারে ধর্ম আসছে কোথা থেকে? টোটেম-বাদ, পিতার প্রতিকল্পকে পুজো করা, পিতার প্রতি বিপরীতধর্মী মানসিকতার যুগপৎ বিদ্যমানতা, যেটা টোটেম-ভোজের মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত, স্মারক-উৎসবের প্রবর্তন এবং এমন সব আইনের প্রবর্তন, যা ভঙ্গ করলে শাস্তি ছিল মৃত্যু – এই টোটেম-বাদ ফ্রয়েডের মতে মানুষের ইতিহাসে ধর্মের আবির্ভাবের প্রাচীনতম নিদর্শন।’[২]
এই পর্যায়ে এসে আমরা শুনব ধর্ম ও আফিম সংক্রান্ত মার্ক্সের সেই বাণী। কারণ, মার্ক্সও ডারউইন ও তার বিবর্তনবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তো, মার্ক্স বলছেন –
“Religion is the sigh of the creature overwhelmed by misfortune, the sentiment of a heartless world, and the soul of soulless conditions. It is the opium of the people.”[৩]
একে কাউন্টার করেছেন সাইমন ওয়েল (Simone Weil)। তিনি বলেছেন –
“Marxism is undoubtedly a religion, in the lowest sense of the word. Like every inferior form of the religious life it has been continually used, to borrow the apt phrase of Marx himself, as an opiate for the people.”[৪]
কথা বলছিলাম কালচার নিয়ে। এর মধ্যে ধর্ম আর মার্ক্স এলো কোত্থেকে? ল্যাবরেটরি স্পেসিমেন হিসেবে উনি প্রাসঙ্গিক কারণেই এসেছেন, আবার চলেও যাবেন প্রাসঙ্গিক কারণেই। ধর্ম যদি আফিমের মতো ব্যথা ভুলিয়ে রাখার মন্ত্রই হয়, তাহলে সাইমন ওয়েল খোদ মার্ক্সবাদকেই ধর্ম বলেছেন। কিন্তু কেন? আর এরপরের কথা হলো, ধর্ম(শাস্ত্র) এবং কালচার দুটোর স্বভাবই কি প্রায় একইরকম নাকি? কখনোই যে এমন নয়, তা না। কালচার অবশ্যই রাজনৈতিক কালচার। তবে, ধর্ম ও কালচার বলতে এখন যা বুঝি তা স্রেফ কর্তৃত্ববাদ হয়ে উঠেছে। কারণ, রাজনীতি তো রাজার নীতি, পলিটিক্স বা জননীতি নয়। ধর্ম যেইমুহূর্তে শাস্ত্রে আর কালচার যেই মূহুর্তে ইন্টেলেকচুয়ালের হাতে পড়েছে সেদিন থেকে এদের চরিত্র একাকার হতে শুরু করেছে। ঠিক যেমন করে সমাজতন্ত্র মার্ক্সের নামে একটি বাদ হয়ে উঠেছে, সেরকম করে।
একটা অস্বস্তিকর উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। উদ্বৃতি করছি রুশ ‘দেন’ পত্রিকার একটা প্রবন্ধের অংশবিশেষ এবং তাকে কোট করে ১৮ জানুয়ারি, ১৯১৪ সালের ‘প্রলেতার্স্কায়া প্রাভ্দা’ পত্রিকাতে প্রকাশিত লেনিনের বক্তব্য।[৫]
‘রাষ্ট্রসত্তা হল সাংস্কৃতিক একত্বের দৃঢ়প্রতিষ্ঠা...রাষ্ট্রভাষা রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির একটা অত্যাবশ্যক অঙ্গ-উপাদান...রাষ্ট্রসত্তার ভিত্তি হল কর্তৃত্বে একত্ব, আর রাষ্ট্রভাষা সেই একত্বের একটা হাতিয়ার। রাষ্ট্রসত্তার অন্যান্য সমস্ত রূপের মতো রাষ্ট্রভাষার আছে একই বাধ্যতামূলক এবং সর্বব্যাপী-নিগ্রহকর ক্ষমতা...রাশিয়াকে সম্মিলিত এবং অবিভাজ্য থাকতে হলে রুশ সাহিত্যিক ভাষার রাষ্ট্রীয় উপযোগিতার বিষয়ে আমাদের দৃঢ়ভাবে নাছোড়বান্দা হওয়া চাই।’[৬]
উত্তরে লেনিন বলেন, ‘উদাপন্থীদের জবাবে আমরা বলি, ভদ্রমহোদয়গণ, এই সবই ঠিক। তুর্গেনেভ, তলস্তয়, দব্রলিউবভ এবং চের্নিশেভ্স্কির ভাষা মহান এবং শক্তিমান, সেটা আমরা তোমাদের চেয়ে ভালভাবেই জানি। তোমাদের চেয়ে বেশী করেই আমরা চাই রাশিয়ায় অধিবাসী সমস্ত জাতির নিপীড়িত শ্রেণীগুলির মধ্যে যতখানি সম্ভব ঘনিষ্ঠ আদান-প্রদান এবং ভ্রাত্রোচিত ঐক্য স্থাপিত হোক – কোন রকমের বৈষম্য ছাড়াই। আর, রাশিয়ার প্রত্যেকটি অধিবাসী মহান রুশ ভাষা শেখার সুযোগ পাক, আমরা নিশ্চয়ই তার পক্ষে।
যে-জিনিসটা আমরা চাই নে সেটা হল নিগ্রহ। মানুষকে মুগুরপেটা করে তাড়িয়ে নিয়ে স্বর্গে তোলা হয়, সেটা আমরা চাই নে, কেননা ‘সংস্কৃতি’ সম্বন্ধে যতই সুন্দর-সুন্দর বুলি তোমরা আওড়াও না কেন, আবশ্যিক রাষ্ট্রভাষার সঙ্গে নিগ্রহ সংশ্লিষ্ট, মুগুরের ব্যবহার সংশ্লিষ্ট আছে। মহান এবং শক্তিমান রুশ ভাষা কাউকে পড়াবার জন্যে ডাহা বাধ্যতার দরকার আছে বলে আমরা মনে করি নে।’
লেনিনের কথাগুলো কিন্তু মোক্ষম জবাব। উনি মুগুরের ব্যবহারের বিপক্ষে। এটা খুবই ভালো কথা। অন্তত মেনশেভিকদের তুলনায় ভালো কথা তো বটেই। কিন্তু, এখানে আশঙ্কার কথাও আছে। সেটা হলো, লেনিন তাঁর মহান রুশ ভাষা তাহলে কিভাবে ছড়াতে আগ্রহী? এই বিষয়ে শেষমেষ লেনিন বলছেন, “এই কারণেই মার্কসবাদীরা বলছে, কোন আবশ্যিক রাষ্ট্রভাষা চলবে না, জনসাধারণের জন্যে এমন বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা করতে হবে যেখানে শিক্ষণ চলবে সমস্ত স্থানীয় ভাষায়, যেকোন এক-জাতির সমস্ত বিশেষ অধিকার এবং সংখ্যালঘু জাতিগুলির সমস্ত রকমের অধিকার লঙ্ঘনকে বাতিল ঘোষণা করে সংবিধানে একটা বুনিয়াদী আইন ঢুকাতে হবে।”
এরচেয়ে উত্তম ব্যবস্থা হতেই পারে না। সত্য সত্যই এই চিন্তাটা অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য চিন্তা, এই পরিকল্পনা সত্যিই বাস্তবায়িত হলে সত্যিই সেটা খুব ভালো হতো। কিন্তু, যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। এই পরিকল্পনার পরে আসলে সোভিয়েত ইউনিয়নে কী হয়েছে সেটা জানা যায় সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি প্রবন্ধে।
‘১৯১৯ সালে রুশও এই কথাই বলেছিল। অতীতের ‘জঞ্জাল’কে বিসর্জন দিতে গিয়ে তখন সে যে শুধু ধর্মকে নিষ্পেষিত করেছিল তা নয়, টলস্টয়, পুশকিন, টুর্গেনিভের মত লেখকের ঐতিহ্যও বাদ দিয়ে সে ‘নূতন সংসার’ পেতেছিল। কিন্তু যেদিন জার্মানী তার সে-সংসারে আগুন ধরালো তখন দেখা গেল, সে-সংসার বাঁচাবার জন্য আগ্রহের বড়ই অভাব। তখন আবার খোলা হল গির্জাঘর, আবার ডাকা হল অনাদৃত ঐতিহ্য-পন্থীদের, আবার চিৎকার করা হল ‘পবিত্র রাশিয়া (Holy Russia)’ নামে, আবার আহবান প্রচারিত হল টলস্টয়, পুশকিনের দেশকে বাঁচাবার জন্য।
রুশ সেদিন হুঙ্কার দিয়ে বলেছিল, “জয়তু ইভান দি টেরিব্ল্।” “জয়তু ঐতিহ্যঘন মার্কস” বলেনি।’[৭]
কিন্তু, হঠাৎ করে তলস্তয়, তুর্গেনিভদের বাদ দিতে হয়েছিল কেন? যে লেনিন তলস্তয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতেন[৮] তিনিই তলস্তয়কে বর্জন করলেন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মাপকাঠিতে জীর্ণ হয়ে গেলেন! মার্ক্স ধর্মকে আফিম বলে তাকে বাদ দিতে চাইলেন। পরবর্তীতে তিনিই ধর্মশাস্ত্র হয়ে উঠলেন। ধর্মশাস্ত্রের নীতি হলো অতীত ধর্মশাস্ত্রকে বয়কট করা অথবা সন্ধি করা। তাই বোধহয় লেনিনের জন্য ধর্ম, ধর্মশাস্ত্র এবং ঐতিহ্যকে ফেলে দেওয়ার দরকার পড়েছিল। কেউ আবার ভেবে বসবেন না মেনশেভিকের হয়ে এই সময়ে এসে কথা বলছি। মেনশেভিকের ইন্টেলেকচুয়ালরা তো তাও খুল্লম খুল্লা বলেছিলেন, ডান্ডা মেরে হলেও রাষ্ট্রভাষা রুশ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কিন্তু, কমুনিজমের ইন্টেলেকচুয়ালেরা বললেন এক, করলেন আরেক!
এতোক্ষণে এই প্রবন্ধে মার্ক্সের আফিমতত্ত্বের প্রয়োজন ফুরিয়ে এসেছে। এবার তার বিদায় নেবার পালা। একে টেনে আনার উদ্দেশ্যটা হলো এইটুকু বুঝানো যে, ইন্টেলেকচুয়ালের কলমের খোঁচায় সংস্কৃতি কখনো মূল্যবান হয়ে উঠতে পারে আবার কখনো মূল্যহীন হয়ে পড়তেও পারে। এরা যাকে গোড়া মানবেন সেটাই আসল সংস্কৃতি, বাকিসব অপসংস্কৃতি অথবা জীর্ণ সংস্কৃতি। এই আমলাতন্ত্রটি যদি বুঝা গিয়ে থাকে তাহলে আমরা এবার মূল আলাপে ঢুকতে পারি।
২.
দেখতে পাচ্ছি এ শহরের বুকে, দেখতে পাচ্ছেনা যারা
সংস্কৃতির গ্রাফ উঠছে না নামছে ফিতে দিয়ে মাপছেন তারা
কোনটা ভালো আর কোনটা যে মন্দ – নির্দেশ করে দেন তারা
লেনিন বন্দী হয়! থুরি থুরি! স্বরাজ বন্দী হয় মানুষ বোঝে না বলে
মানুষই আবার জ্ঞানী জিতে ভোট ফলাফলে, মানুষ তো মুরগী, ছাগলও বলা চলে!
এ ভেবেই টিকে আছে যারা, তারা কারা? তারা কারা? তারা কারা?
শিল্প-সংস্কৃতির ধারক-বাহক সেজে, বুদ্ধিজীবির সাজে নিজেদের ত্বক মেজে
জ্ঞানের বাটখারা তারা, তারা কারা? তারা কারা? তারা কারা?
এরা ইন্টালেকচুয়াল! এরা ইন্টালেকচুয়াল!! [৯]
ধর্মই বলুন বা কালচার, যখনই তা মতাদর্শ তখন তার হেফাজতকারী লাগে, যেমন: হেফাজতে ইসলাম এবং রবীন্দ্রবাদী। রবীন্দ্রনাথরে ধারণ করতে গিয়া আমরা হইছি "রবীন্দ্রবাদী।" একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কেউ খেয়াল করেছেন কিনা দেখুন তো। বিএনপির আমলে টিভি চ্যানেলে ভোর হইতে না হইতেই দেখতাম আরবি পড়ার মক্তব বসেছে। একদল হুজুর হাপুর-হুপুর আরবি পড়াচ্ছে। আর এখন সেই চ্যানেল খুললেই শুনি গান - গানে গানে সকাল শুরু। একদল গানের হুজুর রবীন্দ্র-নজরুল- আর পঞ্চকবি শোনাচ্ছেন। চ্যানেলের মালিকানা পরিবর্তন হয়নি, তারা যে মুখে ধর্ম শিখিয়েছেন সেই মুখেই আজ প্রগতি শেখাচ্ছেন।
বিএনপির আমলে দেখতাম "বিনোদন জুম্মাবার"। সেইখানে অভিনয় করতেন শামস সুমন, মাথায় টুপি পড়ে ব্যাপক ভাব গাম্ভীর্যের সঙ্গে হিজাব নিয়া উপদেশ দিতাছেন। আর এহন শুনি সেই শামস সুমন এফএম রেডিওর প্রোগ্রামের হর্তাকর্তার কাজ করেন, ওসব আবার প্রগতি মেরে খাওয়া অনুষ্ঠান।
এটিএন বাংলায় হইতো বিনোদন জুম্মাবার। আর এখন এটিএনের মালিকের বউ ইভা রহমানের 'রবীন্দ্রসংগীতের এলবাম" এর "পরিচিতি অনুষ্ঠানের" উপস্থাপনা করে শ্রীকান্ত আচার্য!
এগুলো কালচারাল পলিটিক্স। পলিটিক্স শব্দটা না বলে বরং বলি, এগুলো কালচারাল রাজনীতি। কিন্তু, রাজনীতি আগে নাকি কালচার সেই প্রশ্ন থেকে যায়। বাংলাদেশ সহ সারা পৃথিবীতেই যে চিত্র দেখা যাচ্ছে তা হলো, রাজনীতি (মোটেও জননীতি নয়) নিয়ন্ত্রণ করছে কালচার। ফলে, গণমানুষের শিল্পীরা কথা বলা তো দূরে থাক, তৈরি হওয়াই বন্ধ হয়ে গেছে। অবশ্য গণমানুষের শিল্পীরা স্ক্যাটার্ড থাকবেন, মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় কম আসবেন এটা সবখানেই হয়েছে। কিন্তু, এখানে যেটা হয়েছে তা হলো, পরস্পরবিচ্ছিন্নতা। এর কারণটা সম্ভবত রাজধানীকেন্দ্রীকতা, ক্ষমতার সাথে সাথে যাবতীয় চর্চার কেন্দ্রও হয়েছে রাজধানী। ফলে, সবাইকেই এখন ওখানেই যেতে হবে, পেটের দায়ে অথবা নিজেকে প্রকাশের তাগিদে। এই সুযোগটা কাজে লাগায় পপুলার মিডিয়া, তারা গড়ে তোলে পপুলার কালচার। এতে লগ্নিও প্রচুর, উসুলও নিশ্চিত। আর এসব নিয়ন্ত্রিত হয় পলিটিক্যালি। যেমন, বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকলে আরবি পড়ার ধুম বেড়ে যায় আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে প্রগতি বেড়ে যায়। আসলে, কোনোটাই বাড়ে না, কারণ, কোনোটাই জনমানুষের ভিতর তেকে উৎসারিত নয়, জনমানুষের মনের কথাও নয়, পপুলার কালচারের ল্যাবরেটরিতে উৎপাদিত এবং প্রচারিত।
তো, কালচারাল পলিটিক্সটা নিয়ে আলাপে আমরা যতীন সরকার দিয়েই ঢুকি। যতীন সরকার বলছেন, রাজনীতি ও রাজনীতিকদের কৃতিও সংস্কৃতিরই অন্তর্গত। কারণ, পৃথিবীতে মানুষ বেঁচে থাকা ও প্রতিনিয়ত বিকশত হয়ে ওঠার জন্য যেসব কৃতির আশ্রয় নিয়ে থাকে সেসবই সংস্কৃতি। তবে, শুধু রাজনীতির কৃতি সংস্কৃতির ‘অন্তর্গত’ বললেই পুরো সত্য কথাটি বলা হবে না। এক অর্থে রাজনীতি যদিও সংস্কৃতির ভেতরেই অবস্থান করে, তবুও রাজনীতি একটি পৃথক প্রপঞ্চও বটে। আসলে যে-সংস্কৃতি মানুষকে মানুষ করে তোলে সেই সংস্কৃতি-অর্জনের ও সংস্কৃতি-সাধনার পথ ও উপায়ই হলো রাজনীতি।[১০]
যতীন সরকারের পর্যবেক্ষণটি মনোযোগের দাবী রাখে। শেষের বাক্যে তিনি বলছেন, মানুষকে মানুষ করে তোলার রাজনীতি। কিন্তু, রাজার নীতি কেমন করে মানুষকে মানুষ করে তুলবে? সেতো মানুষকে রাজা করে তুলবে, শাসক করে তুলবে। এবং, সারাজীবন এটাই হয়েছে। তাহলে যতীন সরকার আসলে কী বুঝাতে চাইছেন? আমার মতে, তিনি আসলে জননীতির কথাই বুঝাতে চেয়েছেন। সেটা আরও নিশ্চিত হওয়া যায় তার পরবর্তী বিশ্লেষণে।
উদাহরণস্বরূপ তিনি বলছেন, নিজস্ব ভাবগত ও বস্তুগত সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের বোধ জাগ্রত হয়েছিল বলেই পাকিস্তানি রাজনীতিকে আমরা প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছিলাম। ঘুরেফিরে তিনি মানুষেই ফিরছেন, কোনো রাজার কাছে নয়। কারণ, ৭১ এ যিনি রাজা তিনি তো পাকিস্তান সরকার। সেই সরকারকে তার বুদ্ধিজীবিরা বাতলে দিতো কী করতে হবে। সেই মৌলবাদের জনক যে তৎকালীন বুদ্ধিজীবিরাই এভাবে বললেও অত্যুক্তি হয় না। রাষ্ট্র বুদ্ধিজীবিদের পালন করে এমনটা ভাবলে ভুল হবে। বরং, বুদ্ধিজীবিরাই রাষ্ট্রকে ধারণ করে। কিন্তু, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হওয়ার পর আমরা আবারও প্রমাণ পেয়েছি, যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ। ক্ষমতার বাতাবরণে আবারও সেই পাকিস্তানীকরণের দিকেই আমাদের বুদ্ধিজীবিদের যাত্রা ছিলো, এখনও আছে।
ইতিমধ্যেই যার যার জমিদারী ভাগ হয়ে গেছে। কেউ হয়েছে চেতনাধারী, আবার, কেউ হয়েছে জাতীয়তাবাদী। তারা ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে ধর্ম, জাতীয়তাবাদ, প্রগতি সবই ছড়াচ্ছেন এবং করে খাচ্ছেন। রাজনীতির কবল থেকে জননৈতিক কালচারের মুক্তি ঘটেনি কখনও।
তবে, এতে আমাদের দায় কতোটুকু? বা আদৌ আমাদের বোঝাপড়া কতোটুকু ছিলো? যতীন সরকার এও বলছেন, সংস্কৃতিকে কোনোমতেই রাজনীতির অধীন হতে দেয়া চলবে না, রাজনীতির উপর সংস্কৃতির আধিপত্যকেই নিরঙ্কুশ করে রাখতে হবে। কিন্তু, এটার জন্য আসলে কী দরকার? আসলে, দরকার জনগণের বোধন, আর বোধনের জন্য চাই জ্ঞান। কিন্তু, সেই বোধনের উদ্বোধন হয়নি কোনোদিনই। এতে সবচেয়ে বড় বাধা দিয়েছেন বুদ্ধিজীবিরাই। তারা নির্মাণ করেছেন আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী, কুক্ষিগত করে রেখেছেন জ্ঞানকে। তাই, মৌলবাদী এবং বুদ্ধিজীবির গলায় একই সুরের কথা শোনা যায়।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে আমরা বুদ্ধিজীবি মারফতে জানতে পেরেছি অবকাঠামোগত উন্নয়ন। আর অবকাঠামোগত উন্নয়ন মানেই কর্পোরেশনের আগ্রাসন। আর কর্পোরেশনের টাকায় খেয়ে বুদ্ধিজীবিরা নির্মাণ করেছেন কর্পোরেট সংস্কৃতি, যেখানে সবাই পণ্য।
উদাহরণস্বরূপ, পর্নোগ্রাফি আমাদেরকে তথাকথিত "বেশ্যা" এর নয়া ডেফিনিশন এবং ডাইমেনশন দেখিয়েছে। নতুন করে চিনিয়েছে "বাস্টি" এবং "ফেটিশ"। পর্নোগ্রাফির জনরা, সাব-জনরায় মা-বাপ থেকে স্কুল গার্ল, সেলস গার্ল, আর্মি থেকে আমলা কোনো নারী-ফেটিশই বাদ যায় নাই। আমরা প্রতিদিন স্রেফ এই জ্ঞানার্জন করছি যে, রাস্তায় যেতে যেতে, অফিসে বসে বসে, বাড়িতে শুয়ে শুয়ে হঠাৎ করে অজানা অচেনা মানুষের সাথে যৌনতা শুরু করে দেওয়া যায়। এরচেয়েও ভয়াবহ হলো, নারী সে কর্পোরেট চাকুরে হোক, জজ হোক, ডাক্তার হোক বা আর যাই হোক না কেন, তার কতিপয় বিশেষ ভঙ্গিমাই তাকে বেশ্যায় রূপান্তর করতে যথেষ্ট। নো ম্যাটার হোয়াট শি উইয়ারস, ইট ইজ দ্য ইনটেনশন হুইচ ইজ ফোকাসড ইন ইচ পর্ন ফিল্ম। ওখানে বিকিনি আর আর্মির ইউনিফর্ম একাকার হয়ে যায়, একাকার হয়ে যায় মিনি স্কার্ট থেকে বোরকা। চরম কাল্পনিক রাজ্যের ওইসব নারীরা তাই জামা গায়েও যেমন, জামা ছাড়াও তেমন, বিশেষ পার্থক্য নাই।
সমস্যাটা হয়ে যায় বাস্তবতায় ফেরার পর। কোনো মেয়ে স্কুলগার্ল, কি কর্পোরেট চাকুরে, কি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী - ব্যাপার না, আমাদের ক্ষুরধার কল্পনাশক্তি তাকে ন্যাংটো করবেই। তার পোশাকের স্ফিত অংশ হয়ে উঠবে মোহনীয় স্তন। এর হাত থেকে বোরকাও বাদ যায় না।
কারণ, আমরা চুলের জেল থেকে গায়ের সেন্ট সব মেখেছি হট হওয়ার জন্য এবং হট করার জন্য। এরপর গাছের আম (স্লাইস জুস - আমসূত্র, ক্যাটরিনা) থেকে কুঁচকির চুল (ভিট-ক্যাটরিনা) পরিষ্কারকারী ক্রিম - সবখানেই লাগিয়েছি যৌনতা। ক্রমাগত "হটায়ন" প্রক্রিয়া আমাদের ঘরের মেয়ের চালচলনকে "হট দৃষ্টিতে দেখো" বলতে চেয়েছে। এখন আমাদের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সামান্য ক্রিয়াপদ ও তাদের ধাতুও আমাদের যৌনাকাঙ্খা থেকে রেহাই পায় না। যদি বলি "চুষি" তাহলেও মুচকি হাসি, যদি বলি "লাগাই" তাহলে তো সিনেমা চলে কল্পরাজ্যে।
তথাকথিত উন্নত বিশ্ব নিজেরা পর্নোগ্রাফি ও পর্নোগ্রাফিক প্রোডাক্ট ছড়িয়ে দিচ্ছে সারাবিশ্বে। চাইল্ড পর্নোগ্রাফি নামক ভয়াবহ ব্যাপারটি ব্যাপকভাবে ছড়ানোর জন্য আপনি ধর্মকে দোষ দিবেন নাকি পশ্চিমাবিশ্বের পর্নোগ্রাফি মিডিয়াকে? অথচ, আজ এই বিশাল ইন্ডাস্ট্রির কথা আমরা যেন ভাবিই না। আমরা ভাবি কেবল ধর্ম আমাদের কি ক্ষতি করলো। ভেবে ভেবে ক্লান্ত হই এবং ক্লান্তি আনি। অথচ, চোখের সামনে সমস্যার গোড়া, দেখতে পাই না। অবশ্য, দেখতে না পাওয়াটা বিচিত্র নয়, নিজেরা কতোটা অবসেসড তাও তো ঠিকঠাক জানিনা।
আমাদের 'ঐতিহ্য প্রীতি' আছে। তবে ঐতিহ্যকে ধরতে গিয়ে আমরা যেটাকে ধরে বসেছি সেগুলো সবই ক্ষতিকর জিনিস। আসলে আমরা ধরে বসিনি, আমাদের ধরানো হয়েছে – গানে, নাটকে, বিজ্ঞাপণে (উদাহরণ: মিন্টোস চুইংগামের বিজ্ঞাপণ, এখানেই ডটকমের বিজ্ঞাপণ)। এই কারণে ৯০ দশকের বাংলা ছবিরস্টিরিওটাইপগুলো আজ আমাদের ঐতিহ্য। আসলেই ৯০ এর শেষের দিক থেকে অদ্যাবধি যেসমস্ত বাংলা ছবি হয়েছে সেগুলো কি আমাদের ঐতিহ্য? মানে তিনটা ফাইট, পাঁচটা গান, দুইটা ধর্ষণ - এই কি আমাদের ঐতিহ্য?
ওই সময়ের অন্যতম ভিলেন ডিপজল। তার মুখেই ডায়লগ শুনছিলাম, 'তোর সামনে তোর মায়ের ইজ্জত নিমু, তোর বোনরে ন্যাংটা করমু।' - এটাই আমাদের ঐতিহ্যবাহী ডায়লগ?
আবার, এই সময়টাতেই বাংলাদেশ, ভারতীয় বাংলা ও হিন্দী চলচ্চিত্রে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল কেউ কেউ। "গুরুদক্ষিণা" বা "তাল" এর মতো কাহিনী নিয়ে আরও ছবি হয়েছে। বিষয়বস্তু সংগীত ও তার বাজার। ছবির মূলকথাই হচ্ছে, অডিও বাজার ক্রমশ আগ্রাসী হয়ে উঠছে। ফলে, হারিয়ে যাচ্ছে চর্চা, হারিয়ে যাচ্ছে গুরুদের সম্মান তথা তাঁদের প্রতি সামাজিক দায়বদ্ধতা। এককথায় বলা যায়, বাজার গ্রাস করে নিচ্ছে আমাদের সামাজিক দায়িত্ববোধ ও সাধনা।
সেই সময়ে দুনিয়া থেকে কমিউনিস্ট আন্দোলন একে একে স্তিমিত হয়ে পড়ছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাচ্ছে, পুঁজিবাদ সারা দুনিয়ায় স্বরূপে আবির্ভূত। সেই জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে সামাজিক চর্চাগুলো, রূপান্তরিত হচ্ছে পণ্যে-ইন্ডাস্ট্রিতে। তাই, চলচ্চিত্রেও এসে গেছে তার বিরুদ্ধে চিৎকার। কিন্তু, আমরা খুব কমই ব্যাপারটা নোটিশ করেছি। আমরা, ঐতিহ্য হিসেবে স্টিরিওটাইপটাকে আঁকড়ে ধরেছি এবং পিছিয়ে পড়েছি।
ক্ষতিকর বিষয়কে আঁকড়ে ধরার ফলাফল আমরা পেয়েছি। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখন "দেব" ও "শাহরুখ" হতে চাচ্ছে, "ক্যাটরিনা" "দিপিকা" হতে চাচ্ছে (বাংলাদেশের নায়ক নায়িকারা ইন্ডাস্ট্রির যুগে পিছিয়ে পড়েছেন)। তারও আগে দেখতাম, বাচ্চারা মুখ দিয়ে চলচ্চিত্রের মতো গুলির আওয়াজ করছে - ওয়া ঢিসা ঢিসা। তাদের সাথে কেউ দুষ্টামী করতে এলে তারা সিনেমা স্টান্টের মতো করে হাত ছোঁড়াছুঁড়ি করছে। এখনো করে। এরচেয়েও ভয়াবহ প্রভাব দেখেছি, ভিলেনের মতো আচরণ করা। তারা ভিলেনের মতো বিকট হাসি হাসছে, চশমা পড়ছে, তার অশ্লীল ডায়লগ দিচ্ছে। মোটকথা, খুব অল্প বয়স থেকেই এগুলো মনে গেঁথে গেছে। জীবনটা বাস্তবতা ও পরাবাস্তবতার মিশেলে অদ্ভুতভাবে গড়ে উঠছে, যা কোনোভাবেই কল্পনার স্বাধীন শক্তি নয়, বরং, কল্পনার দাসত্ব।
বাংলা চলচ্চিত্রের যৌনতা সম্পর্কিত উপস্থাপনা আমাদের যতোটা ক্ষতি করেছে তা অপূরণীয়। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী নির্মাণে এর ভূমিকা খুবই গভীর। অথচ, এইসবই নাকি এখন ঐতিহ্য। অবশ্য, এগুলোকে যে আমরা ঐতিহ্য হিসেবে গ্রহণ করেছি তা আমাদের 'রিকশা পেইন্টিং' দেখলেও কিন্তু বুঝা যাবে। রিকশা পেইন্টিং এসবের গতিপ্রকৃতিও বুঝতে সাহায্য করবে।
৩.
হিটলার হলোকাস্ট চালিয়েছিল জাতীয়তাবাদের মোড়কে। আর, এখন চলছে কর্পোরেট হলোকাস্ট। এতে রক্তক্ষরণ শরীরে হয় না, হয় হৃদয়ে। কেন্দ্রীভূত হওয়া এর প্রাণ, গোলকায়ন এর পোশাকী নাম। গোলকায়ন বলতে আমরা কী বুঝব? ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্রের একটা বক্তৃতা থেকে উদ্বৃতি করছি। “লড়াইয়ের উদ্দেশ্যটা মাইক্রো ফেডারালিজম। ফেডারাল করতে হবে। গ্লোবালকে যদি স্বীকারও করতে হয়, আমি সেটা করি। আমি ১৯৮০ এ থাকি, আমার মোবাইল নেই, আমি টিভি দেখিনা, আমি কম্পিউটার ইউজ করি না, পারতপক্ষে ইমেল খুলি না। কিন্তু সেটা সলুশন না। সলুশন হচ্ছে আমরা কি কোনো ফেডারালিজম অফ কালচার ভাবতে পারি? যেখানে কেন্দ্রও আছে, আবার আমাদের নিজস্ব কালচারের প্রদেশ আছে এবং কেন্দ্রকে কী আমরা “এক্স” কোনো ফ্যাক্টর দিয়ে ডি-সেন্টার করতে পারি কিনা? মাঝে মাঝে এমন ধাক্কা দিতে পারি যে ওটা আর কেন্দ্র থাকবে না? প্রদেশটাই কেন্দ্র হবে? যদি পলিটিক্সে ফেডারাল স্ট্রাকচার হয়, তাহলে কালচারের কেন ফেডারাল স্ট্রাকচার হতে পারে না?”[১১]
কিন্তু, মাইক্রো ফেডারালিজম কই? যে গ্লোবালাইজেশনের কথা এখন শুনি সেসব তো গুন্ডামী। সবল কালচারের অনুপ্রবেশ। একে ঠেকানোর জন্য শিল্পীর সংগ্রাম কই? মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার দিকে দেখি। একদিকে চলচ্চিত্র শিল্প মৃতপ্রায়, চলচ্চিত্র মানুষের চিত্র দেখাচ্ছে না, সে নির্মাণ করছে কর্পোরেট ওয়ান্ডারল্যান্ড, লাক্স সুন্দরী আর অনন্ত জলিল। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হল চলচ্চিত্রের উন্নয়ন - দামী ক্যামেরা, স্বল্পবসনা নায়িকা, অতিমানব নায়ক, ধুমধাম গান, এই প্রচারণাই চলছে। এসব কী গুন্ডামী নয়? অপরদিকে টিভি নাটকের জয়জয়কার। কারণ, প্রচুর কর্পোরেট ইনভেস্টমেন্ট। আরও আছে ট্যালেন্ট হান্ট ও বিবিধ প্রতিযোগীতা। পয়সা দিয়ে শিল্পী তৈরির কারখানা। শিল্পী রিপ্রেজেন্ট করবে টিভি চ্যানেল, গুঁড়া মশলা ও সৌন্দর্যবর্ধক সাবানকে। তারা পয়সা দিবে, শিল্পী গাইবে, নাচবে, প্রয়োজনে টুপি পড়বে, হিজাব পড়বে আবার প্রয়োজনে বেশ্যাবৃত্তিও করবে। মঞ্চে থাকবেন সমঝদার বিচারক। তাঁরা বলবেন কে শিল্পী এবং কে শিল্পী নয়। একেবারে আদালতি বিচার, তোঘলকি কাণ্ড! সেই রুটির ভাগ নিয়ে কত দালালি, কত রাজনীতি, কত কোচিং, কত সুপারিশ, কত ভোট ভিক্ষা। কালচারাল পলিটিক্যাল দুর্বৃত্তায়নের কর্পো-রাষ্ট্রীয় প্রজেক্ট। কেন একে “কর্পো-রাষ্ট্রীয়” প্রজেক্ট বললাম?
ডিজিটাল বাংলাদেশ, বাংলাদেশের নির্বাচনী ইশতেহারের ইতিহাসে সম্ভবত অন্যতম চমকপ্রদ ম্যান্ডেট। কিন্তু, এর সারমর্ম কি আমাদের কারোর কাছেই বোধহয় পরিষ্কার নয়। বিশেষত, দেশের সার্বিক ডিজিটাইটেশনের গতিপ্রকৃতি অত্যন্ত বিদঘুটে, রহস্যময়। এই ডিজিটাইটেশনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত দেশের শিল্প-সংস্কৃতি।
দেশের চলচ্চিত্র এবং অডিও বাজার চরম সংকটে। পাইরেসি এর অন্যতম কারণ বলা হয়ে থাকে। এছাড়াও আছে অশ্লীলতা ও নানাবিধ রাজনৈতিক চালবাজি। তাই, এ খাতে সেরকম উল্লেখযোগ্য কোনো বিনিয়োগ সরকারি বা বেসরকারি কোনো পর্যায়েই নাই। ফলে, এই দুটি শিল্প ক্রমশ অবলুপ্তির পথে। অথচ, দেশের বিজ্ঞাপণের খাতে আর টেলিভিশন নাটক খাতে বিপুল বেসরকারি বিনিয়োগ লক্ষ্যণীয়। সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় হলো, এই বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় অংশগ্রহণকারী কর্পোরেশনগুলো হলো কমুনিকেশন মিডিয়া অথবা গণমাধ্যম, যেমন: গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, চ্যানেল আই, প্রথম আলো ইত্যাদি।
এইসব কমুনিকেশন মিডিয়ার অন্যতম বক্তব্য হলো দেশপ্রেম। এরা এই দেশপ্রেম প্রচারের জন্য গুচ্ছের টাকা ঢালছে। দেদার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করছে বিজ্ঞাপণ, টেলিফিল্ম, গান, রিয়েলিটি শো।
কিন্তু এতে শিল্পী কারা? ইয়েস, উচ্চমধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা। এদের পরিবারগুলো সম্ভবত কিছু ব্যবসা অথবা চাকুরী করে। এরা বেশীরভাগই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। যেহেতু, এরা সেই অর্থে অঢেল সম্পদের অধিকারী অথবা ধনী ঘরের ছেলেমেয়ে নয়, সুতরাং, এদের জন্য এইসব নাটক-বিজ্ঞাপণে অভিনয় একটা শখ হতেই পারতো। কিন্তু তা নয়, এরা রীতিমতো ক্যারিয়ার হিসেবে নিয়ে নিচ্ছে মিডিয়া প্রফেশনকে! ফলে এরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাকে আর সেভাবে নিচ্ছে না। এরা ড্রপআউট হচ্ছে কিন্তু তবুও মিডিয়া ছাড়ছে না। দেশের চলচ্চিত্রের এই দুর্দশার আমলেও এরা শিল্পী হওয়ার মতো রিস্কি প্রফেশনে যেতে উন্মুখ। কিন্তু কেন? কারণ নিশ্চয়ই এখানে নিশ্চিত আয়ের উৎস ও পাশাপাশি জনপ্রিয়তার হাতছানি আছে।
কিন্তু, ওদিকে নাকি দেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি আর অডিও বাজার বিনিয়োগের অভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে। অথচ, কোনো উল্লেখযোগ্য কর্পোরেট বিনিয়োগ সেখানে নাই! ফলে, এইসব উচ্চমধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা সেখানে অংশগ্রহণও করে না। শুধু তাই নয়, এরা চলচ্চিত্রমাধ্যমকে রীতিমতো তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, এইসব উঠতি স্টারদের তৈরি চলচ্চিত্র বিষয়ক নানারকম ট্রল, ভিডিও পডকাস্ট দেখলেই বা চলচ্চিত্র সম্পর্কে এদের বক্তব্য শুনলেই তা অনুমেয়। আবার, যারা চলচ্চিত্রকে তথাকথিত "আধুনিকায়নের" জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন তারাও নিতান্তই অপগণ্ড, অদক্ষ, অসচেতন, মূর্খ। মোদ্দাকথা, একরকম পরিকল্পনা করেই চলচ্চিত্র শিল্পকে নিম্নশ্রেণীর বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে প্রমানের চেষ্টা সর্বত্র লক্ষ্যণীয়। এবং সেই হিসেবে এই শিল্পকে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলার চেষ্টাও লক্ষ্যণীয়।
আবার, এইসব বিজ্ঞাপণ বা টিভি নাটকে দেশপ্রেম তথা উগ্র জাতীয়তাবাদ ষোলআনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বহুদূরে, গণমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সবচেয়ে স্থুল প্রকাশ আমরা এইসব বিজ্ঞাপণেই দেখতে পাই। এতে বক্তব্য স্রেফ বিকিকিনি, আবেগের হাটে দুটো মোবাইল সিমের দোকান বসাতে পারলেই কাঁচা পয়সা।
দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলের প্রচারণায় কিছু পরিবর্তন এসেছে, তা হলো, রাজনৈতিক দলেরও "নির্বাচনী থিম সং" আমরা এই আমলেই শুনতে পেয়েছি। কিন্তু, এই থিম সংটির শিল্পী কারা? অবধারিতভাবে, উক্ত উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিল্পীরাই।
এভাবেই ক্রমশ সাংস্কৃতিক মাধ্যম কর্পোরেট বিনিয়োগের ছোঁয়ায় ক্রমশ হয়ে উঠছে এলিট মধ্যবিত্তের মাধ্যম। মধ্যবিত্তের মাধ্যম হওয়া সমস্যা নয়। কিন্তু, মধ্যবিত্তের সামগ্রীক অবস্থাটা বিবেচনা করা জরুরী। রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় গ্রাহক এরাই। এই শিক্ষাব্যবস্থা কেমন শিক্ষাব্যবস্থা তা আমরা সকলেই জানি। এটা যে মনকে প্রসারিত করে না, বরং, সংকীর্ণ করে তা পূর্বের বেশকিছু লেখায় বলেছি।[১২] ফলে, শাস্ত্রই হল বর্তমান মধ্যবিত্তের ধর্ম আর নগদ পাওনাই সবচেয়ে বড় অর্জন। মধ্যবিত্তের বোধশক্তি দাসত্বের ঘেরাটোপে বন্দী, তাই তার ধর্মও লাগে, ঘুষও লাগে, আখেরাতও লাগে, দুনিয়াবি সুযোগও লাগে।
কর্পোরেট-রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তায়নের ফলে শিল্পী তৈরি হচ্ছে না এমনটা নয়, আসলে রাষ্ট্র বা কর্পোরেশন কখনোই শিল্পী উৎপাদন করেনি, ওদের কোনো দরকার নাই। শিল্পী তৈরি হয় সমাজের ভিতর থেকে। কিন্তু, সেই প্রক্রিয়াটি যখন কর্পোরেশন নকল করে এবং রাষ্ট্র তাতে ইনভেস্ট করে শিল্পী হওয়া তখন আর কোনো স্ট্রাগল ও রিপ্রেজেন্টেশনের বিষয় থাকে না। অভিনয় বা সংগীত আর সাধনার বিষয় থাকে না। এতে দক্ষতা অর্জনে প্রয়োজনীয় পড়াশোনা, রাজনৈতিক পরিপক্কতা, গণমানুষের কাছাকাছি থাকা, গণমানুষের কথা বোঝা ও তাদের হয়ে বলার মতো বোধশক্তি আর প্রয়োজন থাকে না। আর সাথে যদি দাসত্বের জন্য সদাপ্রস্তুত মধ্যবিত্ত শ্রেণী থাকে তাহলে তো সোনায় সোহাগা। এদের দিয়ে একইসাথে ধর্ম ও অধর্ম সবই করিয়ে নেওয়া যায়। কারণ, রেডিমেড প্লাটফরমে কেতাদুরস্ত স্টাইল সহযোগে দাঁড়াতে পারলেই হয়, বিজ্ঞাপণ বা টেলিফিল্মের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।
তাই দেখা যাচ্ছে দেশে কোনো গণমানুষের শিল্পী নাই বা, বলা যায়, শিল্পীদের কোনো সংগ্রামী চেতনা নাই অথবা আরও একভাবে বলা যায়, কোনো সাধনা নাই। হিতচিন্তা নাই। এরা স্রেফ শিল্পী, সাধক নয়। কিন্তু, এইরকম হওয়ার কারণ কি? একদিকে চলচ্চিত্রের মতো একটি দুনিয়াবি স্বীকৃত শিল্পমাধ্যমের অকাল মৃত্যু, অপরদিকে দেশপ্রেমকে পুঁজি করে কর্পোরেট মিডিয়ার বিজ্ঞাপণ আর টেলিফিল্মের বাজারের ক্রম ফুলে ফেঁপে ওঠার কারণ কি? কারণ, ডিজিটাল বাংলাদেশ। এইটা আর কিছুই না, সর্বস্তরে কর্পোরেট ব্র্যান্ডিং, বাউল থেকে ব্যান্ড, সবখানে কর্পোরেট বাওয়ালি। যে কারণে, কুষ্টিয়ায় বাংলালিংক লালন মেলা এবং ঢাকায় মোজো মাদক বিরোধী কনসার্ট হচ্ছে!
৪.
অতি সম্প্রতি আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছি। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াও মধ্যম আয়ের দেশ। জাতীয় স্থুল আয়ের ভিত্তিতে এই র্যাংকিং আমাদের কপালে পড়েছে। কিন্তু, বাস্তব চিত্র ভিন্ন। এই তত্ত্বীয় উন্নয়ন দুর্দশাপীড়িত মধ্যবিত্তের দাসত্বকেই আরও বাড়িয়ে দিবে। এই র্যাংকিঙের অসারতা বুঝার জন্য খোদ পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদের বক্তব্যই যথেষ্ট।
"স্থূল জাতীয় আয় নির্ভুল গাণিতিক সংখ্যা নয় - অনুমান-নির্ভর আসন্ন-মান মাত্র। এর ভিত্তিতে এক দেশের জনগণের জীবনকুশলতা অন্য রাষ্ট্রের সাথে তুলনা করা মোটেও সঙ্গত নয়। কয়েকটি উদাহরণ দিলে এ বক্তব্য আরও স্পষ্ট হবে। যদি মজুরির বিনিময়ে মহিলারা গৃহস্থালির কাজ করে তবে তা জাতীয় উৎপাদে অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু পরিবারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কন্যা জায়া জননীরা হাসিমুখে বিনা বেতনে উদয়াস্ত যে পরিশ্রম করে তা জাতীয় আয়ের হিসাবে আসে না। একজন অর্থনীতিবিদ্ তাই বলেছেন, যদি বাড়ির কর্তা চাকরানীকে বিয়ে করে তবে তাতে শুধু সামাজিক কেলেঙ্কারিই হবে না, তা হবে বড় ধরনের অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি। বিয়ের আগে চাকরানীর পারিশ্রমিক জাতীয় আয়ে অন্তর্ভুক্ত হত। বিয়ের পরে গিন্নি অর্থ্যাৎ প্রাক্তন চাকরানী যদি নিজের সংসারে একই কাজ (অথবা ভালবেসে আরও বেশি কাজ) করে তো তা জাতীয় উৎপাদে গণনা করা হবে না। চাকরানীর বিয়ের আগে ও পরে বাস্তব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অপরিবর্তিত থাকলেও, চাকরানীর বিয়ের পর অর্থনীতির খামখেয়ালি নিয়মের ফলে জাতীয় আয় কমে যাবে। সরকারী পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৪০ শতাংশ নারী আনুষ্ঠানিক শ্রমশক্তির অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মেয়েরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেয়েদের চেয়ে অনেক বেশি পরিশ্রম করে, কিন্তু বাংলাদেশে মহিলাদের অবদান জাতীয় আয়ে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় বাংলাদেশে তাই জাতীয় আয়ের অবপ্রাক্কলন (underestimate) করা হয়। যদি অনুমান করা হয় যে, বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত ৩০ শতাংশ নারী কাজ করে এবং তাদের উৎপাদনশীলতা বাংলাদেশের পুরুষদের ৫০ শতাংশ মাত্র, তবু বাংলাদেশে মাথাপিছু আয়ের হিসাব কমপক্ষে ৩০ শতাংশ বাড়াতে হবে।.....
সমস্যা শুধু হিসাবের নয়। হিসাব সঠিক হলেও মাথাপিছু আয় দেখে সমাজের ধন বণ্টন সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়। যে সমাজে ধন সম্পদ বণ্টনে চরম অসাম্য রয়েছে সেখানে মাথাপিছু আয় বেশি হলেও দরিদ্রের অনুপাত বেশি হতে পারে।"[১৩]
তবে, এইরকম তত্ত্বীয় উন্নয়নের মজার কিছু অর্জন আছে। যেমন, এতে নারীবাদের সর্বোচ্চ অর্জন হতে পারে প্রকাশ্যে রাস্তায় চুমু খেতে পারা। অথবা, যৌনতা নিয়ে কিছু নির্দিষ্ট পরিসরে কথা বলতে পারা। কিন্তু, এই সুযোগ শুধু কতিপয় মধ্যবিত্তের জন্যই। আসল সমস্যাগুলো এইসব ফ্যান্সি অর্জনের কাছে চাপা পড়ে যায়। আরও কিছু মজার উন্নয়ন হল, ফ্যান্সি সামাজিক আন্দোলন ও খেলাধূলায় উন্নয়ন। বাংলাদেশের ক্রিকেট দল আর আগের অবস্থায় সহজে ফিরে যাবে না। কারণ, দেশের জিডিপি বাড়ছে। মানে, পুঁজির বিকাশ হচ্ছে। পুঁজির বিকাশের ফলে খেলাধুলা এবং কালচারাল বিকাশ হয়। কারণ, পুঁজি এগুলোর পেছনে বিনিয়োগ করে। এদের পেছনে যারা ব্যয় করছে তাদের দেশপ্রেমমার্কা বিজ্ঞাপণগুলো দেখে ভাবার কারণ নাই যে, সে দেশকে খুব ভালোটালো বেসে এই টাকা খরচ করে। এটা তার প্রয়োজনেই করে।
পুঁজিবাদের মটো হলো, "খাওয়ামু শক্ত, হাগামু রক্ত।" অতএব, সে শুধু ভালোবেসে ক্রিকেট দলের পিছনে ব্যয় করবে না, সে উসুল করার জন্যই ব্যয় করবে। এই কারণে ক্রিকেট দল, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার বিপর্যয় না হলে আর আগের মতো খারাপ অবস্থায় ফিরে যাবে না।
আপাতদৃষ্টিতে একে খুবই ভাল মনে হবে। দেশের খেলাধুলা তরতর করে এগিয়ে যাবে, গানবাজনার জন্য দামি দামি যন্ত্রপাতি আসবে। কিন্তু, এর খারাপ দিক খুব দ্রুতই টের পাওয়া যাবে। আর, হারিয়ে যাবে সত্যিকার সাধনা। 'মেড ইজি' সলুশন বের হবে। খেলাগুলো রুক্ষ হয়ে যাবে, তার উদ্দেশ্য হারাবে, ব্যবসার মতো চরিত্র ধারণ করবে। হচ্ছেও তাই। খেয়াল করুন - দিবসগুলোর মূলকথা হারিয়ে যাচ্ছে, আনুষ্ঠানিকতায় ভরে যাচ্ছে।
স্বাধীনতা দিবসের পতাকাওয়ালা টিশার্ট কিংবা পয়লা বৈশাখের পান্তা ইলিশের ভীড়ে আমরা আমাদের মননশীলতা দিয়ে গত ৪৪ বছরে স্রেফ ইভ টিজিংটা কমাতে পারিনি। সেই ৯০ এর দশকে মাকসুদ বলেছিল, "বখাটে ছেলের ভীড়ে ললনাদের রেহাই নাই" সেই রেহাই ২০১৫ সালেও মেলেনি। অথচ, আমরা পয়লা বৈশাখ গত ৪৪ বছর ধরে পালন করে আসছি আমাদের মননশীলতা, অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক হিসেবে। অথচ, আজও মন্দির ভেঙে দেওয়া, সংখ্যালঘুর উপর নির্যাতনের চিত্র একটুও পাল্টায়নি।
কিন্তু, খেয়াল করে দেখুন, ৪৪ বছরে আমাদের পয়লা বৈশাখ উদযাপনের খরচ ও রুচি পাল্টে গেছে। পান্তা আর ইলিশসর্বস্ব হয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু, সেই সাম্প্রদায়িক চেতনার কোনো উপশম হয়নি, বরং, আরও বেড়েছে। কারণ, পুঁজিবাদের ইনভেস্টমেন্ট আসলে সাম্প্রদায়িকতায়, আর মুনাফা নিহিত অসাম্প্রদায়িক "অনুষ্ঠানমালায়"। আজও সাম্প্রদায়িকতা টিকে আছে বলেই অসম্প্রদায়িকতার জন্য আমাদের অনুষ্ঠান করতে হয়। একে না পুষলে অভাব থাকবে কেমন করে? আর অভাব না থাকলে মুনাফাই বা আসবে কোত্থেকে?
চকচক করিলেই যেমন সোনা হয় না। তেমনি, ক্রিকেট এগোলেই দেশপ্রেম বাড়ে না, পান্তা এবং ইলিশ খেলেই অসাম্প্রদায়িক হওয়া যায় না। প্রতিদিন ট্রেনে বাসে হিজড়া দেখে নাক কুঁচকে এলজিবিটি রাইট নিয়ে ইন্টারনেটে রংধনু বুনলেই বৃহন্নলাদের অধিকার আসে না। তাঁদের কথা রিপ্রেজেন্ট করবেন এমন মানুষ কই? ঘুরে ফিরে আবার মান্না দে’র গানেই ফিরে আসি,
"ঝলমল করিও না গো
তোমার ঐ অতো আলো
বেশী রূপ হলে পরে
সাবধানে থাকাই ভালো
মুখের ওই উর্নিটাকে একটু রাখো
খুলো নাকো দোহাই একেবারেই
ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে।"
যে কালচারে শিল্পী একটা নির্দিষ্ট শ্রেণীর “রূপ” কে ঝলমল করতে নিষেধ করেন সেখানকার অসাম্প্রদায়িকতার স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়, আর চলে “হিন্দু-মুসলমান, জোলা, পীর, হুজুর-গোলাম, নারী-পুরুষ, ব্রাহ্মণ-শুদ্র, বৃহৎ-ক্ষুদ্রের নির্মাণ।
ফুটনোট
১. সরকার যতীন. ২০১১. বিনষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা প্রবন্ধ হতে, পৃষ্ঠা: ১২, বিনষ্ট রাজনীতি ও সংস্কৃতি. ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা।
২. ফ্রয়েড সিগ্মুণ্ড. অনুবাদ: সৌরীন নাগ. ২০১১. মোজেস ও একেশ্বরবাদ, পৃষ্ঠা: ৭৮-৮১, সন্দেশ, ঢাকা।
৩. Marx Karl. 1844. A Contribution to the Critique of Hegel's Philosophy of Right, Deutsch-Französische Jahrbücher.
৪. Raymond Aron. 1962. Opium of the Intellectuals, W.W. Norton & Company, Inc., New York.
৫. লেনিন ভ্লাদিমির ইলিচ. ১৯৭৬. সাহিত্য প্রসঙ্গে. প্রগতি প্রকাশন, মস্কো।
৬. স. পাত্রাশ্কিন. দেন (৪৭)(নং ৭)
৭. আলী সৈয়দ মুজতবা. ২০০৪. ঐতিহ্য প্রবন্ধ থেকে, পৃষ্ঠা: ৬২, সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলী, ৭ম খণ্ড (২য় পর্ব).স্টুডেন্ট ওয়েজ, ঢাকা।
৮. লেনিন ভ্লাদিমির ইলিচ. ১৯৭৬. লেভ তলস্তয়- রুশ বিপ্লবের দর্পণ প্রবন্ধ (১৯০৮). সাহিত্য প্রসঙ্গে, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো।
৯. নচিকেতা চক্রবর্তী
১০. সরকার যতীন. ২০১১. বিনষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা প্রবন্ধ হতে, পৃষ্ঠা: ১২, বিনষ্ট রাজনীতি ও সংস্কৃতি. ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা।
১১. ভদ্র গৌতম. মমতাজুর রহমান স্মারক বক্তৃতা - আত্মসত্তার রাজনীতি. ( ১.০৩.১৫ সেকেণ্ড) ২৭ জুন, ২০১৪. বাংলাদেশ অধ্যয়ন কেন্দ্র
১২. রহমান ইস্ক্রা. ২০১৩. ক্লাশরুম ও অরাজ
১৩. খান আকবর আলি, খোলা ম্যানহলের রাজনৈতিক অর্থনীতি, পৃষ্ঠা: ৯৩-৯৪, পরার্থপরতার অর্থনীতি।
"ঝলমল করিও না গো
তোমার ঐ অতো আলো
বেশী রূপ হলে পরে
সাবধানে থাকাই ভালো
মুখের ওই উর্নিটাকে একটু রাখো
খুলো নাকো দোহাই একেবারেই
ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে।"
পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, প্রভাষ দে'র সুরে মান্না দে গাইছেন, তুমুল রোমান্টিক গান। বাঙালি মননে এই গান গভীরভাবে রেখাপাত করে, একেবারে যাকে বলে রোমান্স। কিন্তু কী ভাবায়? খুব স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়, চাঁদ হলো নারী। হ্যাঁ, এই গানের নারীর নির্মাণ চলছে, রোমান্সের নির্মাণ চলছে। কারা করছেন? ইন্টেলেকচুয়ালেরা।
এবারে বহুল প্রচলিত ওয়াজের নসিহত শুনুন, দেখুনতো, মিল খুঁজে পাচ্ছেন কিনা?
"কলাকে খোসা ছাড়িয়ে রাখলে তাতে মাছি বসবেই। তেমনি নারীও পর্দায় না থাকলে তাতে দুষ্ট লোক চোখ দিবেই।"
এতো মিল হলো কেমন করে? এ তো মৌলবাদ আর 'কালচারে' মাখামাখি! কিন্তু, কালচার 'মালটা" কী? আর, 'মৌলবাদ' মালটাই বা কী? আর, ইন্টেলেকচুয়াল কেনই বা মৌলবাদীর মতো করে কথা বলছে? আমার কাছে ইন্টেলেকচুয়াল আর মৌলবাদীতে বিশেষ পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না। সুতরাং, আগে মৌলবাদ কী সেটাই নাহয় জেনে নেই। আমি যে ধারণাকে মৌলবাদের সংজ্ঞা হিসেবে যুক্তিযুক্ত বলে গ্রহণ করেছি সেটা হলো, মৌলবাদ খোদ আনুগত্যের, দণ্ডের, শাসনের প্রতি আনুগত্য আনার চেষ্টা। মূল পাল্টায় তো ভোলও পাল্টায়।
অবশ্য পাল্টানোই জগতের সব থেকে স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু, যা পাল্টে গেলো তাকেই ব্যবহার করে আনুগত্য আনার যে আপ্রাণ চেষ্টা তাই মৌলবাদ, এককথায় কর্তৃত্ববাদ। আর ইন্টেলেকচুয়াল হলেন তারাই যারা এই চেষ্টাটা করে যান এবং তার বিনিময়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।
এবারে প্রশ্ন হলো ‘কালচার’ মালটা কী? কালচার ল্যাটিন থেকে ফ্রেঞ্চ হয়ে ইংরেজি ভাষায় যুক্ত হওয়া শব্দ সেকথা সকলেই জানি। এর বাংলাটা হয়েছে সংস্কৃতি। আমাদের মগজে ‘সংস্কৃতি’ শব্দটা এলেই ভেসে ওঠে গান-বাজনা-শিল্পকর্ম-নাচ-অভিনয়-নাটক-চলচ্চিত্র ইত্যাদি। আবার কখনও কখনও মানুষের চিন্তা করার ধরণধারণ, বাচনকেও আমরা কালচার বলতে চাই। আর এইসব মিলিয়ে সংস্কৃতি বা কালচার এক ধোঁয়াটে মাল, অ্যাবস্ট্রাক্ট বা নির্বস্তুক। একটা মজার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, এই যে কালচারকে ‘মাল’ সম্বোধন করলাম, এটা কিন্তু আবার নিম্নরুচির পরিচয় হতে পারে। অথচ, ইংরেজি ‘শিট’ বা ‘ফাক’ শব্দটি এখন শহুরে শিক্ষিত মানুষের কালচারের অংশ। সুতরাং, সংস্কৃতিকে সংজ্ঞায়িত করা যেমন কঠিন, ঠিক তেমনি অপসংস্কৃতি ঠিক কী মাল তাও বলা কঠিন।
সংস্কৃতি যদি হয় মানুষের ‘সম্যক কৃতি’, তবে বলা যায়, বস্তুগত ও ভাবগত সকল কৃতিই মানুষের সংস্কৃতি।[১] লক্ষণীয় শব্দটি হলো ‘সকল কৃতি’। সুতরাং, এর কোনটি সুকুমার এবং কোনটি ‘কুকুমার’ সেইটা আপাতদৃষ্টিতে বোঝার উপায় নাই। সেই হিসেবে কথায় কথায় ‘বাল’ অথবা ‘ফাক’ বলাটা সুকুমার সংস্কৃতি নাকি কুকুমার সংস্কৃতি তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তবে, হ্যাঁ, যেখানে রয়েছে ইন্টেলেকচুয়ালের (আগেই বলেছি কারা) বিজ্ঞাপণ সেখান থেকে সংস্কৃতিটির গতিপ্রকৃতির ভালোমন্দ বুঝা যেতে পারে বৈকি। অর্থ্যাৎ, আমাদের ইন্টেলেকচুয়াল কোন কর্পোরেট প্ল্যানের হয়ে কথা বলছেন সেটাই এর মতিগতি বুঝতে সাহায্য করে।
কালচার মালটা জানার সাথে জানতে হবে ধর্ম সংক্রান্ত কিছু ধারণা। প্রথমতই আমরা ফ্রয়েডের দ্বারস্থ হই। ফ্রয়েডের এই মতবাদটি কমবেশী আমাদের জানা। ডারউইনের বিবর্তনবাদের উপর ভিত্তি করে তিনি এই ‘টোটেমবাদের’ অবতারণা করেছিলেন। সংক্ষেপে এইরকম-
সুপ্রাচীনকালে মানুষ ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বাস করত, প্রত্যেকটি দলের অধিপতি ছিল একজন শক্তিশালী পুরুষ।....শক্তিশালী পুরুষটি সমস্ত দলটির প্রভু এবং পিতা ছিল। তার ক্ষমতা ছিল অপরিসীম, যে ক্ষমতা সে নির্দয়ভাবে ব্যবহার করত। তার দলের পত্নীরা ও কন্যারা এবং তার সঙ্গে হয়ত অন্য দলের থেকে চুরি করে আনা স্ত্রীগণ - সমস্ত স্ত্রীজাতি ছিল তার সম্পত্তি। পুত্রদের ভাগ্য ছিল কঠোর; যদি ওরা পিতার ঈর্ষা বা ক্রোধ উদ্রেক করত তাহলে হয় তাদের মেরে ফেলা হত, অথবা জননেন্দ্রিয় নষ্ট করে দিয়ে পুরুষত্বহীন করে দেওয়া হত, অথবা দল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হত।...কালক্রমে পুত্রদের মধ্যে সবলজন হয়ে উঠতো দলটির প্রভু্। বেশীরভাগ সময় হয়তো কনিষ্ঠ পুত্রটিই প্রভু হয়ে উঠতো, কারণ, সে মা’র স্নেহ এবং নজরদারিতে সুরক্ষিত থাকতো। আর, যেসব পুত্র বহিষ্কৃত হয়ে যেত তারা একসঙ্গে হয়ে পিতাকে পরাজিত করতো এবং পরাজিত পিতার মাংস খেয়ে ফেলত। এটা ভাবার কারণ নাই যে, এই যুগে এসে এই মনোবৃত্তির আর অস্তিত্ব নাই। বরং, এখনকার প্রাপ্ত গবেষণার ফল থেকেই এই সিদ্ধান্তে আসা হচ্ছে। যাহোক, সেই আদি মানবেরা যে শুধুমাত্র ঘৃণা থেকে এই কাজটা করতো এমন ভাবার কারণ নাই। এরা পিতাকে আদর্শ হিসেবে সম্মানও করত। আসল কথা হলো এরা প্রত্যেকেই পিতার আসনে বসতে চাইত। কাজেই এই মাংস খেয়ে ফেলার ব্যাপারটা পিতার শরীরের একটা অংশ নিজের শরীরের মধ্যে নিয়ে নিজেকে পিতার সঙ্গে একাত্ম করার একটা প্রচেষ্টা হিসেবে বোধগম্য হয়।
পিতাকে মেরে ফেলার পর ভাইয়েরা লড়াই করতো উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজের শাসনাধিকার কায়েম করতে। এরপর একসময় তারা আবিষ্কার করলো যে, এভাবে লড়াই করাটার কোনো মানেই হয় না। ফলে তারা সংঘবদ্ধ সামাজিক চুক্তির মধ্যে যাওয়ার চেষ্টা করলো। সৃষ্টি হল প্রথম সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানকে পবিত্র ঘোষনা করা হলো, মা ও ভগ্নীদের দখল করার বাসনা পরিত্যাগ করা হলো, সূত্রপাত হলো নৈতিকতা ও আইনের।....কিন্তু এইসব ব্যাপারে ধর্ম আসছে কোথা থেকে? টোটেম-বাদ, পিতার প্রতিকল্পকে পুজো করা, পিতার প্রতি বিপরীতধর্মী মানসিকতার যুগপৎ বিদ্যমানতা, যেটা টোটেম-ভোজের মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত, স্মারক-উৎসবের প্রবর্তন এবং এমন সব আইনের প্রবর্তন, যা ভঙ্গ করলে শাস্তি ছিল মৃত্যু – এই টোটেম-বাদ ফ্রয়েডের মতে মানুষের ইতিহাসে ধর্মের আবির্ভাবের প্রাচীনতম নিদর্শন।’[২]
এই পর্যায়ে এসে আমরা শুনব ধর্ম ও আফিম সংক্রান্ত মার্ক্সের সেই বাণী। কারণ, মার্ক্সও ডারউইন ও তার বিবর্তনবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তো, মার্ক্স বলছেন –
“Religion is the sigh of the creature overwhelmed by misfortune, the sentiment of a heartless world, and the soul of soulless conditions. It is the opium of the people.”[৩]
একে কাউন্টার করেছেন সাইমন ওয়েল (Simone Weil)। তিনি বলেছেন –
“Marxism is undoubtedly a religion, in the lowest sense of the word. Like every inferior form of the religious life it has been continually used, to borrow the apt phrase of Marx himself, as an opiate for the people.”[৪]
কথা বলছিলাম কালচার নিয়ে। এর মধ্যে ধর্ম আর মার্ক্স এলো কোত্থেকে? ল্যাবরেটরি স্পেসিমেন হিসেবে উনি প্রাসঙ্গিক কারণেই এসেছেন, আবার চলেও যাবেন প্রাসঙ্গিক কারণেই। ধর্ম যদি আফিমের মতো ব্যথা ভুলিয়ে রাখার মন্ত্রই হয়, তাহলে সাইমন ওয়েল খোদ মার্ক্সবাদকেই ধর্ম বলেছেন। কিন্তু কেন? আর এরপরের কথা হলো, ধর্ম(শাস্ত্র) এবং কালচার দুটোর স্বভাবই কি প্রায় একইরকম নাকি? কখনোই যে এমন নয়, তা না। কালচার অবশ্যই রাজনৈতিক কালচার। তবে, ধর্ম ও কালচার বলতে এখন যা বুঝি তা স্রেফ কর্তৃত্ববাদ হয়ে উঠেছে। কারণ, রাজনীতি তো রাজার নীতি, পলিটিক্স বা জননীতি নয়। ধর্ম যেইমুহূর্তে শাস্ত্রে আর কালচার যেই মূহুর্তে ইন্টেলেকচুয়ালের হাতে পড়েছে সেদিন থেকে এদের চরিত্র একাকার হতে শুরু করেছে। ঠিক যেমন করে সমাজতন্ত্র মার্ক্সের নামে একটি বাদ হয়ে উঠেছে, সেরকম করে।
একটা অস্বস্তিকর উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। উদ্বৃতি করছি রুশ ‘দেন’ পত্রিকার একটা প্রবন্ধের অংশবিশেষ এবং তাকে কোট করে ১৮ জানুয়ারি, ১৯১৪ সালের ‘প্রলেতার্স্কায়া প্রাভ্দা’ পত্রিকাতে প্রকাশিত লেনিনের বক্তব্য।[৫]
‘রাষ্ট্রসত্তা হল সাংস্কৃতিক একত্বের দৃঢ়প্রতিষ্ঠা...রাষ্ট্রভাষা রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির একটা অত্যাবশ্যক অঙ্গ-উপাদান...রাষ্ট্রসত্তার ভিত্তি হল কর্তৃত্বে একত্ব, আর রাষ্ট্রভাষা সেই একত্বের একটা হাতিয়ার। রাষ্ট্রসত্তার অন্যান্য সমস্ত রূপের মতো রাষ্ট্রভাষার আছে একই বাধ্যতামূলক এবং সর্বব্যাপী-নিগ্রহকর ক্ষমতা...রাশিয়াকে সম্মিলিত এবং অবিভাজ্য থাকতে হলে রুশ সাহিত্যিক ভাষার রাষ্ট্রীয় উপযোগিতার বিষয়ে আমাদের দৃঢ়ভাবে নাছোড়বান্দা হওয়া চাই।’[৬]
উত্তরে লেনিন বলেন, ‘উদাপন্থীদের জবাবে আমরা বলি, ভদ্রমহোদয়গণ, এই সবই ঠিক। তুর্গেনেভ, তলস্তয়, দব্রলিউবভ এবং চের্নিশেভ্স্কির ভাষা মহান এবং শক্তিমান, সেটা আমরা তোমাদের চেয়ে ভালভাবেই জানি। তোমাদের চেয়ে বেশী করেই আমরা চাই রাশিয়ায় অধিবাসী সমস্ত জাতির নিপীড়িত শ্রেণীগুলির মধ্যে যতখানি সম্ভব ঘনিষ্ঠ আদান-প্রদান এবং ভ্রাত্রোচিত ঐক্য স্থাপিত হোক – কোন রকমের বৈষম্য ছাড়াই। আর, রাশিয়ার প্রত্যেকটি অধিবাসী মহান রুশ ভাষা শেখার সুযোগ পাক, আমরা নিশ্চয়ই তার পক্ষে।
যে-জিনিসটা আমরা চাই নে সেটা হল নিগ্রহ। মানুষকে মুগুরপেটা করে তাড়িয়ে নিয়ে স্বর্গে তোলা হয়, সেটা আমরা চাই নে, কেননা ‘সংস্কৃতি’ সম্বন্ধে যতই সুন্দর-সুন্দর বুলি তোমরা আওড়াও না কেন, আবশ্যিক রাষ্ট্রভাষার সঙ্গে নিগ্রহ সংশ্লিষ্ট, মুগুরের ব্যবহার সংশ্লিষ্ট আছে। মহান এবং শক্তিমান রুশ ভাষা কাউকে পড়াবার জন্যে ডাহা বাধ্যতার দরকার আছে বলে আমরা মনে করি নে।’
লেনিনের কথাগুলো কিন্তু মোক্ষম জবাব। উনি মুগুরের ব্যবহারের বিপক্ষে। এটা খুবই ভালো কথা। অন্তত মেনশেভিকদের তুলনায় ভালো কথা তো বটেই। কিন্তু, এখানে আশঙ্কার কথাও আছে। সেটা হলো, লেনিন তাঁর মহান রুশ ভাষা তাহলে কিভাবে ছড়াতে আগ্রহী? এই বিষয়ে শেষমেষ লেনিন বলছেন, “এই কারণেই মার্কসবাদীরা বলছে, কোন আবশ্যিক রাষ্ট্রভাষা চলবে না, জনসাধারণের জন্যে এমন বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা করতে হবে যেখানে শিক্ষণ চলবে সমস্ত স্থানীয় ভাষায়, যেকোন এক-জাতির সমস্ত বিশেষ অধিকার এবং সংখ্যালঘু জাতিগুলির সমস্ত রকমের অধিকার লঙ্ঘনকে বাতিল ঘোষণা করে সংবিধানে একটা বুনিয়াদী আইন ঢুকাতে হবে।”
এরচেয়ে উত্তম ব্যবস্থা হতেই পারে না। সত্য সত্যই এই চিন্তাটা অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য চিন্তা, এই পরিকল্পনা সত্যিই বাস্তবায়িত হলে সত্যিই সেটা খুব ভালো হতো। কিন্তু, যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। এই পরিকল্পনার পরে আসলে সোভিয়েত ইউনিয়নে কী হয়েছে সেটা জানা যায় সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি প্রবন্ধে।
‘১৯১৯ সালে রুশও এই কথাই বলেছিল। অতীতের ‘জঞ্জাল’কে বিসর্জন দিতে গিয়ে তখন সে যে শুধু ধর্মকে নিষ্পেষিত করেছিল তা নয়, টলস্টয়, পুশকিন, টুর্গেনিভের মত লেখকের ঐতিহ্যও বাদ দিয়ে সে ‘নূতন সংসার’ পেতেছিল। কিন্তু যেদিন জার্মানী তার সে-সংসারে আগুন ধরালো তখন দেখা গেল, সে-সংসার বাঁচাবার জন্য আগ্রহের বড়ই অভাব। তখন আবার খোলা হল গির্জাঘর, আবার ডাকা হল অনাদৃত ঐতিহ্য-পন্থীদের, আবার চিৎকার করা হল ‘পবিত্র রাশিয়া (Holy Russia)’ নামে, আবার আহবান প্রচারিত হল টলস্টয়, পুশকিনের দেশকে বাঁচাবার জন্য।
রুশ সেদিন হুঙ্কার দিয়ে বলেছিল, “জয়তু ইভান দি টেরিব্ল্।” “জয়তু ঐতিহ্যঘন মার্কস” বলেনি।’[৭]
কিন্তু, হঠাৎ করে তলস্তয়, তুর্গেনিভদের বাদ দিতে হয়েছিল কেন? যে লেনিন তলস্তয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতেন[৮] তিনিই তলস্তয়কে বর্জন করলেন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মাপকাঠিতে জীর্ণ হয়ে গেলেন! মার্ক্স ধর্মকে আফিম বলে তাকে বাদ দিতে চাইলেন। পরবর্তীতে তিনিই ধর্মশাস্ত্র হয়ে উঠলেন। ধর্মশাস্ত্রের নীতি হলো অতীত ধর্মশাস্ত্রকে বয়কট করা অথবা সন্ধি করা। তাই বোধহয় লেনিনের জন্য ধর্ম, ধর্মশাস্ত্র এবং ঐতিহ্যকে ফেলে দেওয়ার দরকার পড়েছিল। কেউ আবার ভেবে বসবেন না মেনশেভিকের হয়ে এই সময়ে এসে কথা বলছি। মেনশেভিকের ইন্টেলেকচুয়ালরা তো তাও খুল্লম খুল্লা বলেছিলেন, ডান্ডা মেরে হলেও রাষ্ট্রভাষা রুশ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কিন্তু, কমুনিজমের ইন্টেলেকচুয়ালেরা বললেন এক, করলেন আরেক!
এতোক্ষণে এই প্রবন্ধে মার্ক্সের আফিমতত্ত্বের প্রয়োজন ফুরিয়ে এসেছে। এবার তার বিদায় নেবার পালা। একে টেনে আনার উদ্দেশ্যটা হলো এইটুকু বুঝানো যে, ইন্টেলেকচুয়ালের কলমের খোঁচায় সংস্কৃতি কখনো মূল্যবান হয়ে উঠতে পারে আবার কখনো মূল্যহীন হয়ে পড়তেও পারে। এরা যাকে গোড়া মানবেন সেটাই আসল সংস্কৃতি, বাকিসব অপসংস্কৃতি অথবা জীর্ণ সংস্কৃতি। এই আমলাতন্ত্রটি যদি বুঝা গিয়ে থাকে তাহলে আমরা এবার মূল আলাপে ঢুকতে পারি।
২.
দেখতে পাচ্ছি এ শহরের বুকে, দেখতে পাচ্ছেনা যারা
সংস্কৃতির গ্রাফ উঠছে না নামছে ফিতে দিয়ে মাপছেন তারা
কোনটা ভালো আর কোনটা যে মন্দ – নির্দেশ করে দেন তারা
লেনিন বন্দী হয়! থুরি থুরি! স্বরাজ বন্দী হয় মানুষ বোঝে না বলে
মানুষই আবার জ্ঞানী জিতে ভোট ফলাফলে, মানুষ তো মুরগী, ছাগলও বলা চলে!
এ ভেবেই টিকে আছে যারা, তারা কারা? তারা কারা? তারা কারা?
শিল্প-সংস্কৃতির ধারক-বাহক সেজে, বুদ্ধিজীবির সাজে নিজেদের ত্বক মেজে
জ্ঞানের বাটখারা তারা, তারা কারা? তারা কারা? তারা কারা?
এরা ইন্টালেকচুয়াল! এরা ইন্টালেকচুয়াল!! [৯]
ধর্মই বলুন বা কালচার, যখনই তা মতাদর্শ তখন তার হেফাজতকারী লাগে, যেমন: হেফাজতে ইসলাম এবং রবীন্দ্রবাদী। রবীন্দ্রনাথরে ধারণ করতে গিয়া আমরা হইছি "রবীন্দ্রবাদী।" একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কেউ খেয়াল করেছেন কিনা দেখুন তো। বিএনপির আমলে টিভি চ্যানেলে ভোর হইতে না হইতেই দেখতাম আরবি পড়ার মক্তব বসেছে। একদল হুজুর হাপুর-হুপুর আরবি পড়াচ্ছে। আর এখন সেই চ্যানেল খুললেই শুনি গান - গানে গানে সকাল শুরু। একদল গানের হুজুর রবীন্দ্র-নজরুল- আর পঞ্চকবি শোনাচ্ছেন। চ্যানেলের মালিকানা পরিবর্তন হয়নি, তারা যে মুখে ধর্ম শিখিয়েছেন সেই মুখেই আজ প্রগতি শেখাচ্ছেন।
বিএনপির আমলে দেখতাম "বিনোদন জুম্মাবার"। সেইখানে অভিনয় করতেন শামস সুমন, মাথায় টুপি পড়ে ব্যাপক ভাব গাম্ভীর্যের সঙ্গে হিজাব নিয়া উপদেশ দিতাছেন। আর এহন শুনি সেই শামস সুমন এফএম রেডিওর প্রোগ্রামের হর্তাকর্তার কাজ করেন, ওসব আবার প্রগতি মেরে খাওয়া অনুষ্ঠান।
এটিএন বাংলায় হইতো বিনোদন জুম্মাবার। আর এখন এটিএনের মালিকের বউ ইভা রহমানের 'রবীন্দ্রসংগীতের এলবাম" এর "পরিচিতি অনুষ্ঠানের" উপস্থাপনা করে শ্রীকান্ত আচার্য!
এগুলো কালচারাল পলিটিক্স। পলিটিক্স শব্দটা না বলে বরং বলি, এগুলো কালচারাল রাজনীতি। কিন্তু, রাজনীতি আগে নাকি কালচার সেই প্রশ্ন থেকে যায়। বাংলাদেশ সহ সারা পৃথিবীতেই যে চিত্র দেখা যাচ্ছে তা হলো, রাজনীতি (মোটেও জননীতি নয়) নিয়ন্ত্রণ করছে কালচার। ফলে, গণমানুষের শিল্পীরা কথা বলা তো দূরে থাক, তৈরি হওয়াই বন্ধ হয়ে গেছে। অবশ্য গণমানুষের শিল্পীরা স্ক্যাটার্ড থাকবেন, মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় কম আসবেন এটা সবখানেই হয়েছে। কিন্তু, এখানে যেটা হয়েছে তা হলো, পরস্পরবিচ্ছিন্নতা। এর কারণটা সম্ভবত রাজধানীকেন্দ্রীকতা, ক্ষমতার সাথে সাথে যাবতীয় চর্চার কেন্দ্রও হয়েছে রাজধানী। ফলে, সবাইকেই এখন ওখানেই যেতে হবে, পেটের দায়ে অথবা নিজেকে প্রকাশের তাগিদে। এই সুযোগটা কাজে লাগায় পপুলার মিডিয়া, তারা গড়ে তোলে পপুলার কালচার। এতে লগ্নিও প্রচুর, উসুলও নিশ্চিত। আর এসব নিয়ন্ত্রিত হয় পলিটিক্যালি। যেমন, বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকলে আরবি পড়ার ধুম বেড়ে যায় আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে প্রগতি বেড়ে যায়। আসলে, কোনোটাই বাড়ে না, কারণ, কোনোটাই জনমানুষের ভিতর তেকে উৎসারিত নয়, জনমানুষের মনের কথাও নয়, পপুলার কালচারের ল্যাবরেটরিতে উৎপাদিত এবং প্রচারিত।
তো, কালচারাল পলিটিক্সটা নিয়ে আলাপে আমরা যতীন সরকার দিয়েই ঢুকি। যতীন সরকার বলছেন, রাজনীতি ও রাজনীতিকদের কৃতিও সংস্কৃতিরই অন্তর্গত। কারণ, পৃথিবীতে মানুষ বেঁচে থাকা ও প্রতিনিয়ত বিকশত হয়ে ওঠার জন্য যেসব কৃতির আশ্রয় নিয়ে থাকে সেসবই সংস্কৃতি। তবে, শুধু রাজনীতির কৃতি সংস্কৃতির ‘অন্তর্গত’ বললেই পুরো সত্য কথাটি বলা হবে না। এক অর্থে রাজনীতি যদিও সংস্কৃতির ভেতরেই অবস্থান করে, তবুও রাজনীতি একটি পৃথক প্রপঞ্চও বটে। আসলে যে-সংস্কৃতি মানুষকে মানুষ করে তোলে সেই সংস্কৃতি-অর্জনের ও সংস্কৃতি-সাধনার পথ ও উপায়ই হলো রাজনীতি।[১০]
যতীন সরকারের পর্যবেক্ষণটি মনোযোগের দাবী রাখে। শেষের বাক্যে তিনি বলছেন, মানুষকে মানুষ করে তোলার রাজনীতি। কিন্তু, রাজার নীতি কেমন করে মানুষকে মানুষ করে তুলবে? সেতো মানুষকে রাজা করে তুলবে, শাসক করে তুলবে। এবং, সারাজীবন এটাই হয়েছে। তাহলে যতীন সরকার আসলে কী বুঝাতে চাইছেন? আমার মতে, তিনি আসলে জননীতির কথাই বুঝাতে চেয়েছেন। সেটা আরও নিশ্চিত হওয়া যায় তার পরবর্তী বিশ্লেষণে।
উদাহরণস্বরূপ তিনি বলছেন, নিজস্ব ভাবগত ও বস্তুগত সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের বোধ জাগ্রত হয়েছিল বলেই পাকিস্তানি রাজনীতিকে আমরা প্রত্যাখ্যান করতে পেরেছিলাম। ঘুরেফিরে তিনি মানুষেই ফিরছেন, কোনো রাজার কাছে নয়। কারণ, ৭১ এ যিনি রাজা তিনি তো পাকিস্তান সরকার। সেই সরকারকে তার বুদ্ধিজীবিরা বাতলে দিতো কী করতে হবে। সেই মৌলবাদের জনক যে তৎকালীন বুদ্ধিজীবিরাই এভাবে বললেও অত্যুক্তি হয় না। রাষ্ট্র বুদ্ধিজীবিদের পালন করে এমনটা ভাবলে ভুল হবে। বরং, বুদ্ধিজীবিরাই রাষ্ট্রকে ধারণ করে। কিন্তু, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হওয়ার পর আমরা আবারও প্রমাণ পেয়েছি, যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ। ক্ষমতার বাতাবরণে আবারও সেই পাকিস্তানীকরণের দিকেই আমাদের বুদ্ধিজীবিদের যাত্রা ছিলো, এখনও আছে।
ইতিমধ্যেই যার যার জমিদারী ভাগ হয়ে গেছে। কেউ হয়েছে চেতনাধারী, আবার, কেউ হয়েছে জাতীয়তাবাদী। তারা ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে ধর্ম, জাতীয়তাবাদ, প্রগতি সবই ছড়াচ্ছেন এবং করে খাচ্ছেন। রাজনীতির কবল থেকে জননৈতিক কালচারের মুক্তি ঘটেনি কখনও।
তবে, এতে আমাদের দায় কতোটুকু? বা আদৌ আমাদের বোঝাপড়া কতোটুকু ছিলো? যতীন সরকার এও বলছেন, সংস্কৃতিকে কোনোমতেই রাজনীতির অধীন হতে দেয়া চলবে না, রাজনীতির উপর সংস্কৃতির আধিপত্যকেই নিরঙ্কুশ করে রাখতে হবে। কিন্তু, এটার জন্য আসলে কী দরকার? আসলে, দরকার জনগণের বোধন, আর বোধনের জন্য চাই জ্ঞান। কিন্তু, সেই বোধনের উদ্বোধন হয়নি কোনোদিনই। এতে সবচেয়ে বড় বাধা দিয়েছেন বুদ্ধিজীবিরাই। তারা নির্মাণ করেছেন আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী, কুক্ষিগত করে রেখেছেন জ্ঞানকে। তাই, মৌলবাদী এবং বুদ্ধিজীবির গলায় একই সুরের কথা শোনা যায়।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে আমরা বুদ্ধিজীবি মারফতে জানতে পেরেছি অবকাঠামোগত উন্নয়ন। আর অবকাঠামোগত উন্নয়ন মানেই কর্পোরেশনের আগ্রাসন। আর কর্পোরেশনের টাকায় খেয়ে বুদ্ধিজীবিরা নির্মাণ করেছেন কর্পোরেট সংস্কৃতি, যেখানে সবাই পণ্য।
উদাহরণস্বরূপ, পর্নোগ্রাফি আমাদেরকে তথাকথিত "বেশ্যা" এর নয়া ডেফিনিশন এবং ডাইমেনশন দেখিয়েছে। নতুন করে চিনিয়েছে "বাস্টি" এবং "ফেটিশ"। পর্নোগ্রাফির জনরা, সাব-জনরায় মা-বাপ থেকে স্কুল গার্ল, সেলস গার্ল, আর্মি থেকে আমলা কোনো নারী-ফেটিশই বাদ যায় নাই। আমরা প্রতিদিন স্রেফ এই জ্ঞানার্জন করছি যে, রাস্তায় যেতে যেতে, অফিসে বসে বসে, বাড়িতে শুয়ে শুয়ে হঠাৎ করে অজানা অচেনা মানুষের সাথে যৌনতা শুরু করে দেওয়া যায়। এরচেয়েও ভয়াবহ হলো, নারী সে কর্পোরেট চাকুরে হোক, জজ হোক, ডাক্তার হোক বা আর যাই হোক না কেন, তার কতিপয় বিশেষ ভঙ্গিমাই তাকে বেশ্যায় রূপান্তর করতে যথেষ্ট। নো ম্যাটার হোয়াট শি উইয়ারস, ইট ইজ দ্য ইনটেনশন হুইচ ইজ ফোকাসড ইন ইচ পর্ন ফিল্ম। ওখানে বিকিনি আর আর্মির ইউনিফর্ম একাকার হয়ে যায়, একাকার হয়ে যায় মিনি স্কার্ট থেকে বোরকা। চরম কাল্পনিক রাজ্যের ওইসব নারীরা তাই জামা গায়েও যেমন, জামা ছাড়াও তেমন, বিশেষ পার্থক্য নাই।
সমস্যাটা হয়ে যায় বাস্তবতায় ফেরার পর। কোনো মেয়ে স্কুলগার্ল, কি কর্পোরেট চাকুরে, কি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী - ব্যাপার না, আমাদের ক্ষুরধার কল্পনাশক্তি তাকে ন্যাংটো করবেই। তার পোশাকের স্ফিত অংশ হয়ে উঠবে মোহনীয় স্তন। এর হাত থেকে বোরকাও বাদ যায় না।
কারণ, আমরা চুলের জেল থেকে গায়ের সেন্ট সব মেখেছি হট হওয়ার জন্য এবং হট করার জন্য। এরপর গাছের আম (স্লাইস জুস - আমসূত্র, ক্যাটরিনা) থেকে কুঁচকির চুল (ভিট-ক্যাটরিনা) পরিষ্কারকারী ক্রিম - সবখানেই লাগিয়েছি যৌনতা। ক্রমাগত "হটায়ন" প্রক্রিয়া আমাদের ঘরের মেয়ের চালচলনকে "হট দৃষ্টিতে দেখো" বলতে চেয়েছে। এখন আমাদের অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সামান্য ক্রিয়াপদ ও তাদের ধাতুও আমাদের যৌনাকাঙ্খা থেকে রেহাই পায় না। যদি বলি "চুষি" তাহলেও মুচকি হাসি, যদি বলি "লাগাই" তাহলে তো সিনেমা চলে কল্পরাজ্যে।
তথাকথিত উন্নত বিশ্ব নিজেরা পর্নোগ্রাফি ও পর্নোগ্রাফিক প্রোডাক্ট ছড়িয়ে দিচ্ছে সারাবিশ্বে। চাইল্ড পর্নোগ্রাফি নামক ভয়াবহ ব্যাপারটি ব্যাপকভাবে ছড়ানোর জন্য আপনি ধর্মকে দোষ দিবেন নাকি পশ্চিমাবিশ্বের পর্নোগ্রাফি মিডিয়াকে? অথচ, আজ এই বিশাল ইন্ডাস্ট্রির কথা আমরা যেন ভাবিই না। আমরা ভাবি কেবল ধর্ম আমাদের কি ক্ষতি করলো। ভেবে ভেবে ক্লান্ত হই এবং ক্লান্তি আনি। অথচ, চোখের সামনে সমস্যার গোড়া, দেখতে পাই না। অবশ্য, দেখতে না পাওয়াটা বিচিত্র নয়, নিজেরা কতোটা অবসেসড তাও তো ঠিকঠাক জানিনা।
আমাদের 'ঐতিহ্য প্রীতি' আছে। তবে ঐতিহ্যকে ধরতে গিয়ে আমরা যেটাকে ধরে বসেছি সেগুলো সবই ক্ষতিকর জিনিস। আসলে আমরা ধরে বসিনি, আমাদের ধরানো হয়েছে – গানে, নাটকে, বিজ্ঞাপণে (উদাহরণ: মিন্টোস চুইংগামের বিজ্ঞাপণ, এখানেই ডটকমের বিজ্ঞাপণ)। এই কারণে ৯০ দশকের বাংলা ছবিরস্টিরিওটাইপগুলো আজ আমাদের ঐতিহ্য। আসলেই ৯০ এর শেষের দিক থেকে অদ্যাবধি যেসমস্ত বাংলা ছবি হয়েছে সেগুলো কি আমাদের ঐতিহ্য? মানে তিনটা ফাইট, পাঁচটা গান, দুইটা ধর্ষণ - এই কি আমাদের ঐতিহ্য?
ওই সময়ের অন্যতম ভিলেন ডিপজল। তার মুখেই ডায়লগ শুনছিলাম, 'তোর সামনে তোর মায়ের ইজ্জত নিমু, তোর বোনরে ন্যাংটা করমু।' - এটাই আমাদের ঐতিহ্যবাহী ডায়লগ?
আবার, এই সময়টাতেই বাংলাদেশ, ভারতীয় বাংলা ও হিন্দী চলচ্চিত্রে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল কেউ কেউ। "গুরুদক্ষিণা" বা "তাল" এর মতো কাহিনী নিয়ে আরও ছবি হয়েছে। বিষয়বস্তু সংগীত ও তার বাজার। ছবির মূলকথাই হচ্ছে, অডিও বাজার ক্রমশ আগ্রাসী হয়ে উঠছে। ফলে, হারিয়ে যাচ্ছে চর্চা, হারিয়ে যাচ্ছে গুরুদের সম্মান তথা তাঁদের প্রতি সামাজিক দায়বদ্ধতা। এককথায় বলা যায়, বাজার গ্রাস করে নিচ্ছে আমাদের সামাজিক দায়িত্ববোধ ও সাধনা।
সেই সময়ে দুনিয়া থেকে কমিউনিস্ট আন্দোলন একে একে স্তিমিত হয়ে পড়ছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাচ্ছে, পুঁজিবাদ সারা দুনিয়ায় স্বরূপে আবির্ভূত। সেই জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে সামাজিক চর্চাগুলো, রূপান্তরিত হচ্ছে পণ্যে-ইন্ডাস্ট্রিতে। তাই, চলচ্চিত্রেও এসে গেছে তার বিরুদ্ধে চিৎকার। কিন্তু, আমরা খুব কমই ব্যাপারটা নোটিশ করেছি। আমরা, ঐতিহ্য হিসেবে স্টিরিওটাইপটাকে আঁকড়ে ধরেছি এবং পিছিয়ে পড়েছি।
ক্ষতিকর বিষয়কে আঁকড়ে ধরার ফলাফল আমরা পেয়েছি। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এখন "দেব" ও "শাহরুখ" হতে চাচ্ছে, "ক্যাটরিনা" "দিপিকা" হতে চাচ্ছে (বাংলাদেশের নায়ক নায়িকারা ইন্ডাস্ট্রির যুগে পিছিয়ে পড়েছেন)। তারও আগে দেখতাম, বাচ্চারা মুখ দিয়ে চলচ্চিত্রের মতো গুলির আওয়াজ করছে - ওয়া ঢিসা ঢিসা। তাদের সাথে কেউ দুষ্টামী করতে এলে তারা সিনেমা স্টান্টের মতো করে হাত ছোঁড়াছুঁড়ি করছে। এখনো করে। এরচেয়েও ভয়াবহ প্রভাব দেখেছি, ভিলেনের মতো আচরণ করা। তারা ভিলেনের মতো বিকট হাসি হাসছে, চশমা পড়ছে, তার অশ্লীল ডায়লগ দিচ্ছে। মোটকথা, খুব অল্প বয়স থেকেই এগুলো মনে গেঁথে গেছে। জীবনটা বাস্তবতা ও পরাবাস্তবতার মিশেলে অদ্ভুতভাবে গড়ে উঠছে, যা কোনোভাবেই কল্পনার স্বাধীন শক্তি নয়, বরং, কল্পনার দাসত্ব।
বাংলা চলচ্চিত্রের যৌনতা সম্পর্কিত উপস্থাপনা আমাদের যতোটা ক্ষতি করেছে তা অপূরণীয়। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী নির্মাণে এর ভূমিকা খুবই গভীর। অথচ, এইসবই নাকি এখন ঐতিহ্য। অবশ্য, এগুলোকে যে আমরা ঐতিহ্য হিসেবে গ্রহণ করেছি তা আমাদের 'রিকশা পেইন্টিং' দেখলেও কিন্তু বুঝা যাবে। রিকশা পেইন্টিং এসবের গতিপ্রকৃতিও বুঝতে সাহায্য করবে।
৩.
হিটলার হলোকাস্ট চালিয়েছিল জাতীয়তাবাদের মোড়কে। আর, এখন চলছে কর্পোরেট হলোকাস্ট। এতে রক্তক্ষরণ শরীরে হয় না, হয় হৃদয়ে। কেন্দ্রীভূত হওয়া এর প্রাণ, গোলকায়ন এর পোশাকী নাম। গোলকায়ন বলতে আমরা কী বুঝব? ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্রের একটা বক্তৃতা থেকে উদ্বৃতি করছি। “লড়াইয়ের উদ্দেশ্যটা মাইক্রো ফেডারালিজম। ফেডারাল করতে হবে। গ্লোবালকে যদি স্বীকারও করতে হয়, আমি সেটা করি। আমি ১৯৮০ এ থাকি, আমার মোবাইল নেই, আমি টিভি দেখিনা, আমি কম্পিউটার ইউজ করি না, পারতপক্ষে ইমেল খুলি না। কিন্তু সেটা সলুশন না। সলুশন হচ্ছে আমরা কি কোনো ফেডারালিজম অফ কালচার ভাবতে পারি? যেখানে কেন্দ্রও আছে, আবার আমাদের নিজস্ব কালচারের প্রদেশ আছে এবং কেন্দ্রকে কী আমরা “এক্স” কোনো ফ্যাক্টর দিয়ে ডি-সেন্টার করতে পারি কিনা? মাঝে মাঝে এমন ধাক্কা দিতে পারি যে ওটা আর কেন্দ্র থাকবে না? প্রদেশটাই কেন্দ্র হবে? যদি পলিটিক্সে ফেডারাল স্ট্রাকচার হয়, তাহলে কালচারের কেন ফেডারাল স্ট্রাকচার হতে পারে না?”[১১]
কিন্তু, মাইক্রো ফেডারালিজম কই? যে গ্লোবালাইজেশনের কথা এখন শুনি সেসব তো গুন্ডামী। সবল কালচারের অনুপ্রবেশ। একে ঠেকানোর জন্য শিল্পীর সংগ্রাম কই? মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার দিকে দেখি। একদিকে চলচ্চিত্র শিল্প মৃতপ্রায়, চলচ্চিত্র মানুষের চিত্র দেখাচ্ছে না, সে নির্মাণ করছে কর্পোরেট ওয়ান্ডারল্যান্ড, লাক্স সুন্দরী আর অনন্ত জলিল। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হল চলচ্চিত্রের উন্নয়ন - দামী ক্যামেরা, স্বল্পবসনা নায়িকা, অতিমানব নায়ক, ধুমধাম গান, এই প্রচারণাই চলছে। এসব কী গুন্ডামী নয়? অপরদিকে টিভি নাটকের জয়জয়কার। কারণ, প্রচুর কর্পোরেট ইনভেস্টমেন্ট। আরও আছে ট্যালেন্ট হান্ট ও বিবিধ প্রতিযোগীতা। পয়সা দিয়ে শিল্পী তৈরির কারখানা। শিল্পী রিপ্রেজেন্ট করবে টিভি চ্যানেল, গুঁড়া মশলা ও সৌন্দর্যবর্ধক সাবানকে। তারা পয়সা দিবে, শিল্পী গাইবে, নাচবে, প্রয়োজনে টুপি পড়বে, হিজাব পড়বে আবার প্রয়োজনে বেশ্যাবৃত্তিও করবে। মঞ্চে থাকবেন সমঝদার বিচারক। তাঁরা বলবেন কে শিল্পী এবং কে শিল্পী নয়। একেবারে আদালতি বিচার, তোঘলকি কাণ্ড! সেই রুটির ভাগ নিয়ে কত দালালি, কত রাজনীতি, কত কোচিং, কত সুপারিশ, কত ভোট ভিক্ষা। কালচারাল পলিটিক্যাল দুর্বৃত্তায়নের কর্পো-রাষ্ট্রীয় প্রজেক্ট। কেন একে “কর্পো-রাষ্ট্রীয়” প্রজেক্ট বললাম?
ডিজিটাল বাংলাদেশ, বাংলাদেশের নির্বাচনী ইশতেহারের ইতিহাসে সম্ভবত অন্যতম চমকপ্রদ ম্যান্ডেট। কিন্তু, এর সারমর্ম কি আমাদের কারোর কাছেই বোধহয় পরিষ্কার নয়। বিশেষত, দেশের সার্বিক ডিজিটাইটেশনের গতিপ্রকৃতি অত্যন্ত বিদঘুটে, রহস্যময়। এই ডিজিটাইটেশনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত দেশের শিল্প-সংস্কৃতি।
দেশের চলচ্চিত্র এবং অডিও বাজার চরম সংকটে। পাইরেসি এর অন্যতম কারণ বলা হয়ে থাকে। এছাড়াও আছে অশ্লীলতা ও নানাবিধ রাজনৈতিক চালবাজি। তাই, এ খাতে সেরকম উল্লেখযোগ্য কোনো বিনিয়োগ সরকারি বা বেসরকারি কোনো পর্যায়েই নাই। ফলে, এই দুটি শিল্প ক্রমশ অবলুপ্তির পথে। অথচ, দেশের বিজ্ঞাপণের খাতে আর টেলিভিশন নাটক খাতে বিপুল বেসরকারি বিনিয়োগ লক্ষ্যণীয়। সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় হলো, এই বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় অংশগ্রহণকারী কর্পোরেশনগুলো হলো কমুনিকেশন মিডিয়া অথবা গণমাধ্যম, যেমন: গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, চ্যানেল আই, প্রথম আলো ইত্যাদি।
এইসব কমুনিকেশন মিডিয়ার অন্যতম বক্তব্য হলো দেশপ্রেম। এরা এই দেশপ্রেম প্রচারের জন্য গুচ্ছের টাকা ঢালছে। দেদার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করছে বিজ্ঞাপণ, টেলিফিল্ম, গান, রিয়েলিটি শো।
কিন্তু এতে শিল্পী কারা? ইয়েস, উচ্চমধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা। এদের পরিবারগুলো সম্ভবত কিছু ব্যবসা অথবা চাকুরী করে। এরা বেশীরভাগই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। যেহেতু, এরা সেই অর্থে অঢেল সম্পদের অধিকারী অথবা ধনী ঘরের ছেলেমেয়ে নয়, সুতরাং, এদের জন্য এইসব নাটক-বিজ্ঞাপণে অভিনয় একটা শখ হতেই পারতো। কিন্তু তা নয়, এরা রীতিমতো ক্যারিয়ার হিসেবে নিয়ে নিচ্ছে মিডিয়া প্রফেশনকে! ফলে এরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাকে আর সেভাবে নিচ্ছে না। এরা ড্রপআউট হচ্ছে কিন্তু তবুও মিডিয়া ছাড়ছে না। দেশের চলচ্চিত্রের এই দুর্দশার আমলেও এরা শিল্পী হওয়ার মতো রিস্কি প্রফেশনে যেতে উন্মুখ। কিন্তু কেন? কারণ নিশ্চয়ই এখানে নিশ্চিত আয়ের উৎস ও পাশাপাশি জনপ্রিয়তার হাতছানি আছে।
কিন্তু, ওদিকে নাকি দেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি আর অডিও বাজার বিনিয়োগের অভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে। অথচ, কোনো উল্লেখযোগ্য কর্পোরেট বিনিয়োগ সেখানে নাই! ফলে, এইসব উচ্চমধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা সেখানে অংশগ্রহণও করে না। শুধু তাই নয়, এরা চলচ্চিত্রমাধ্যমকে রীতিমতো তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, এইসব উঠতি স্টারদের তৈরি চলচ্চিত্র বিষয়ক নানারকম ট্রল, ভিডিও পডকাস্ট দেখলেই বা চলচ্চিত্র সম্পর্কে এদের বক্তব্য শুনলেই তা অনুমেয়। আবার, যারা চলচ্চিত্রকে তথাকথিত "আধুনিকায়নের" জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন তারাও নিতান্তই অপগণ্ড, অদক্ষ, অসচেতন, মূর্খ। মোদ্দাকথা, একরকম পরিকল্পনা করেই চলচ্চিত্র শিল্পকে নিম্নশ্রেণীর বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে প্রমানের চেষ্টা সর্বত্র লক্ষ্যণীয়। এবং সেই হিসেবে এই শিল্পকে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলার চেষ্টাও লক্ষ্যণীয়।
আবার, এইসব বিজ্ঞাপণ বা টিভি নাটকে দেশপ্রেম তথা উগ্র জাতীয়তাবাদ ষোলআনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বহুদূরে, গণমানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সবচেয়ে স্থুল প্রকাশ আমরা এইসব বিজ্ঞাপণেই দেখতে পাই। এতে বক্তব্য স্রেফ বিকিকিনি, আবেগের হাটে দুটো মোবাইল সিমের দোকান বসাতে পারলেই কাঁচা পয়সা।
দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলের প্রচারণায় কিছু পরিবর্তন এসেছে, তা হলো, রাজনৈতিক দলেরও "নির্বাচনী থিম সং" আমরা এই আমলেই শুনতে পেয়েছি। কিন্তু, এই থিম সংটির শিল্পী কারা? অবধারিতভাবে, উক্ত উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণীর শিল্পীরাই।
এভাবেই ক্রমশ সাংস্কৃতিক মাধ্যম কর্পোরেট বিনিয়োগের ছোঁয়ায় ক্রমশ হয়ে উঠছে এলিট মধ্যবিত্তের মাধ্যম। মধ্যবিত্তের মাধ্যম হওয়া সমস্যা নয়। কিন্তু, মধ্যবিত্তের সামগ্রীক অবস্থাটা বিবেচনা করা জরুরী। রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় গ্রাহক এরাই। এই শিক্ষাব্যবস্থা কেমন শিক্ষাব্যবস্থা তা আমরা সকলেই জানি। এটা যে মনকে প্রসারিত করে না, বরং, সংকীর্ণ করে তা পূর্বের বেশকিছু লেখায় বলেছি।[১২] ফলে, শাস্ত্রই হল বর্তমান মধ্যবিত্তের ধর্ম আর নগদ পাওনাই সবচেয়ে বড় অর্জন। মধ্যবিত্তের বোধশক্তি দাসত্বের ঘেরাটোপে বন্দী, তাই তার ধর্মও লাগে, ঘুষও লাগে, আখেরাতও লাগে, দুনিয়াবি সুযোগও লাগে।
কর্পোরেট-রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তায়নের ফলে শিল্পী তৈরি হচ্ছে না এমনটা নয়, আসলে রাষ্ট্র বা কর্পোরেশন কখনোই শিল্পী উৎপাদন করেনি, ওদের কোনো দরকার নাই। শিল্পী তৈরি হয় সমাজের ভিতর থেকে। কিন্তু, সেই প্রক্রিয়াটি যখন কর্পোরেশন নকল করে এবং রাষ্ট্র তাতে ইনভেস্ট করে শিল্পী হওয়া তখন আর কোনো স্ট্রাগল ও রিপ্রেজেন্টেশনের বিষয় থাকে না। অভিনয় বা সংগীত আর সাধনার বিষয় থাকে না। এতে দক্ষতা অর্জনে প্রয়োজনীয় পড়াশোনা, রাজনৈতিক পরিপক্কতা, গণমানুষের কাছাকাছি থাকা, গণমানুষের কথা বোঝা ও তাদের হয়ে বলার মতো বোধশক্তি আর প্রয়োজন থাকে না। আর সাথে যদি দাসত্বের জন্য সদাপ্রস্তুত মধ্যবিত্ত শ্রেণী থাকে তাহলে তো সোনায় সোহাগা। এদের দিয়ে একইসাথে ধর্ম ও অধর্ম সবই করিয়ে নেওয়া যায়। কারণ, রেডিমেড প্লাটফরমে কেতাদুরস্ত স্টাইল সহযোগে দাঁড়াতে পারলেই হয়, বিজ্ঞাপণ বা টেলিফিল্মের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।
তাই দেখা যাচ্ছে দেশে কোনো গণমানুষের শিল্পী নাই বা, বলা যায়, শিল্পীদের কোনো সংগ্রামী চেতনা নাই অথবা আরও একভাবে বলা যায়, কোনো সাধনা নাই। হিতচিন্তা নাই। এরা স্রেফ শিল্পী, সাধক নয়। কিন্তু, এইরকম হওয়ার কারণ কি? একদিকে চলচ্চিত্রের মতো একটি দুনিয়াবি স্বীকৃত শিল্পমাধ্যমের অকাল মৃত্যু, অপরদিকে দেশপ্রেমকে পুঁজি করে কর্পোরেট মিডিয়ার বিজ্ঞাপণ আর টেলিফিল্মের বাজারের ক্রম ফুলে ফেঁপে ওঠার কারণ কি? কারণ, ডিজিটাল বাংলাদেশ। এইটা আর কিছুই না, সর্বস্তরে কর্পোরেট ব্র্যান্ডিং, বাউল থেকে ব্যান্ড, সবখানে কর্পোরেট বাওয়ালি। যে কারণে, কুষ্টিয়ায় বাংলালিংক লালন মেলা এবং ঢাকায় মোজো মাদক বিরোধী কনসার্ট হচ্ছে!
৪.
অতি সম্প্রতি আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছি। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াও মধ্যম আয়ের দেশ। জাতীয় স্থুল আয়ের ভিত্তিতে এই র্যাংকিং আমাদের কপালে পড়েছে। কিন্তু, বাস্তব চিত্র ভিন্ন। এই তত্ত্বীয় উন্নয়ন দুর্দশাপীড়িত মধ্যবিত্তের দাসত্বকেই আরও বাড়িয়ে দিবে। এই র্যাংকিঙের অসারতা বুঝার জন্য খোদ পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদের বক্তব্যই যথেষ্ট।
"স্থূল জাতীয় আয় নির্ভুল গাণিতিক সংখ্যা নয় - অনুমান-নির্ভর আসন্ন-মান মাত্র। এর ভিত্তিতে এক দেশের জনগণের জীবনকুশলতা অন্য রাষ্ট্রের সাথে তুলনা করা মোটেও সঙ্গত নয়। কয়েকটি উদাহরণ দিলে এ বক্তব্য আরও স্পষ্ট হবে। যদি মজুরির বিনিময়ে মহিলারা গৃহস্থালির কাজ করে তবে তা জাতীয় উৎপাদে অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু পরিবারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কন্যা জায়া জননীরা হাসিমুখে বিনা বেতনে উদয়াস্ত যে পরিশ্রম করে তা জাতীয় আয়ের হিসাবে আসে না। একজন অর্থনীতিবিদ্ তাই বলেছেন, যদি বাড়ির কর্তা চাকরানীকে বিয়ে করে তবে তাতে শুধু সামাজিক কেলেঙ্কারিই হবে না, তা হবে বড় ধরনের অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি। বিয়ের আগে চাকরানীর পারিশ্রমিক জাতীয় আয়ে অন্তর্ভুক্ত হত। বিয়ের পরে গিন্নি অর্থ্যাৎ প্রাক্তন চাকরানী যদি নিজের সংসারে একই কাজ (অথবা ভালবেসে আরও বেশি কাজ) করে তো তা জাতীয় উৎপাদে গণনা করা হবে না। চাকরানীর বিয়ের আগে ও পরে বাস্তব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অপরিবর্তিত থাকলেও, চাকরানীর বিয়ের পর অর্থনীতির খামখেয়ালি নিয়মের ফলে জাতীয় আয় কমে যাবে। সরকারী পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৪০ শতাংশ নারী আনুষ্ঠানিক শ্রমশক্তির অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মেয়েরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেয়েদের চেয়ে অনেক বেশি পরিশ্রম করে, কিন্তু বাংলাদেশে মহিলাদের অবদান জাতীয় আয়ে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় বাংলাদেশে তাই জাতীয় আয়ের অবপ্রাক্কলন (underestimate) করা হয়। যদি অনুমান করা হয় যে, বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত ৩০ শতাংশ নারী কাজ করে এবং তাদের উৎপাদনশীলতা বাংলাদেশের পুরুষদের ৫০ শতাংশ মাত্র, তবু বাংলাদেশে মাথাপিছু আয়ের হিসাব কমপক্ষে ৩০ শতাংশ বাড়াতে হবে।.....
সমস্যা শুধু হিসাবের নয়। হিসাব সঠিক হলেও মাথাপিছু আয় দেখে সমাজের ধন বণ্টন সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়। যে সমাজে ধন সম্পদ বণ্টনে চরম অসাম্য রয়েছে সেখানে মাথাপিছু আয় বেশি হলেও দরিদ্রের অনুপাত বেশি হতে পারে।"[১৩]
তবে, এইরকম তত্ত্বীয় উন্নয়নের মজার কিছু অর্জন আছে। যেমন, এতে নারীবাদের সর্বোচ্চ অর্জন হতে পারে প্রকাশ্যে রাস্তায় চুমু খেতে পারা। অথবা, যৌনতা নিয়ে কিছু নির্দিষ্ট পরিসরে কথা বলতে পারা। কিন্তু, এই সুযোগ শুধু কতিপয় মধ্যবিত্তের জন্যই। আসল সমস্যাগুলো এইসব ফ্যান্সি অর্জনের কাছে চাপা পড়ে যায়। আরও কিছু মজার উন্নয়ন হল, ফ্যান্সি সামাজিক আন্দোলন ও খেলাধূলায় উন্নয়ন। বাংলাদেশের ক্রিকেট দল আর আগের অবস্থায় সহজে ফিরে যাবে না। কারণ, দেশের জিডিপি বাড়ছে। মানে, পুঁজির বিকাশ হচ্ছে। পুঁজির বিকাশের ফলে খেলাধুলা এবং কালচারাল বিকাশ হয়। কারণ, পুঁজি এগুলোর পেছনে বিনিয়োগ করে। এদের পেছনে যারা ব্যয় করছে তাদের দেশপ্রেমমার্কা বিজ্ঞাপণগুলো দেখে ভাবার কারণ নাই যে, সে দেশকে খুব ভালোটালো বেসে এই টাকা খরচ করে। এটা তার প্রয়োজনেই করে।
পুঁজিবাদের মটো হলো, "খাওয়ামু শক্ত, হাগামু রক্ত।" অতএব, সে শুধু ভালোবেসে ক্রিকেট দলের পিছনে ব্যয় করবে না, সে উসুল করার জন্যই ব্যয় করবে। এই কারণে ক্রিকেট দল, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার বিপর্যয় না হলে আর আগের মতো খারাপ অবস্থায় ফিরে যাবে না।
আপাতদৃষ্টিতে একে খুবই ভাল মনে হবে। দেশের খেলাধুলা তরতর করে এগিয়ে যাবে, গানবাজনার জন্য দামি দামি যন্ত্রপাতি আসবে। কিন্তু, এর খারাপ দিক খুব দ্রুতই টের পাওয়া যাবে। আর, হারিয়ে যাবে সত্যিকার সাধনা। 'মেড ইজি' সলুশন বের হবে। খেলাগুলো রুক্ষ হয়ে যাবে, তার উদ্দেশ্য হারাবে, ব্যবসার মতো চরিত্র ধারণ করবে। হচ্ছেও তাই। খেয়াল করুন - দিবসগুলোর মূলকথা হারিয়ে যাচ্ছে, আনুষ্ঠানিকতায় ভরে যাচ্ছে।
স্বাধীনতা দিবসের পতাকাওয়ালা টিশার্ট কিংবা পয়লা বৈশাখের পান্তা ইলিশের ভীড়ে আমরা আমাদের মননশীলতা দিয়ে গত ৪৪ বছরে স্রেফ ইভ টিজিংটা কমাতে পারিনি। সেই ৯০ এর দশকে মাকসুদ বলেছিল, "বখাটে ছেলের ভীড়ে ললনাদের রেহাই নাই" সেই রেহাই ২০১৫ সালেও মেলেনি। অথচ, আমরা পয়লা বৈশাখ গত ৪৪ বছর ধরে পালন করে আসছি আমাদের মননশীলতা, অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক হিসেবে। অথচ, আজও মন্দির ভেঙে দেওয়া, সংখ্যালঘুর উপর নির্যাতনের চিত্র একটুও পাল্টায়নি।
কিন্তু, খেয়াল করে দেখুন, ৪৪ বছরে আমাদের পয়লা বৈশাখ উদযাপনের খরচ ও রুচি পাল্টে গেছে। পান্তা আর ইলিশসর্বস্ব হয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু, সেই সাম্প্রদায়িক চেতনার কোনো উপশম হয়নি, বরং, আরও বেড়েছে। কারণ, পুঁজিবাদের ইনভেস্টমেন্ট আসলে সাম্প্রদায়িকতায়, আর মুনাফা নিহিত অসাম্প্রদায়িক "অনুষ্ঠানমালায়"। আজও সাম্প্রদায়িকতা টিকে আছে বলেই অসম্প্রদায়িকতার জন্য আমাদের অনুষ্ঠান করতে হয়। একে না পুষলে অভাব থাকবে কেমন করে? আর অভাব না থাকলে মুনাফাই বা আসবে কোত্থেকে?
চকচক করিলেই যেমন সোনা হয় না। তেমনি, ক্রিকেট এগোলেই দেশপ্রেম বাড়ে না, পান্তা এবং ইলিশ খেলেই অসাম্প্রদায়িক হওয়া যায় না। প্রতিদিন ট্রেনে বাসে হিজড়া দেখে নাক কুঁচকে এলজিবিটি রাইট নিয়ে ইন্টারনেটে রংধনু বুনলেই বৃহন্নলাদের অধিকার আসে না। তাঁদের কথা রিপ্রেজেন্ট করবেন এমন মানুষ কই? ঘুরে ফিরে আবার মান্না দে’র গানেই ফিরে আসি,
"ঝলমল করিও না গো
তোমার ঐ অতো আলো
বেশী রূপ হলে পরে
সাবধানে থাকাই ভালো
মুখের ওই উর্নিটাকে একটু রাখো
খুলো নাকো দোহাই একেবারেই
ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে।"
যে কালচারে শিল্পী একটা নির্দিষ্ট শ্রেণীর “রূপ” কে ঝলমল করতে নিষেধ করেন সেখানকার অসাম্প্রদায়িকতার স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়, আর চলে “হিন্দু-মুসলমান, জোলা, পীর, হুজুর-গোলাম, নারী-পুরুষ, ব্রাহ্মণ-শুদ্র, বৃহৎ-ক্ষুদ্রের নির্মাণ।
ফুটনোট
১. সরকার যতীন. ২০১১. বিনষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা প্রবন্ধ হতে, পৃষ্ঠা: ১২, বিনষ্ট রাজনীতি ও সংস্কৃতি. ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা।
২. ফ্রয়েড সিগ্মুণ্ড. অনুবাদ: সৌরীন নাগ. ২০১১. মোজেস ও একেশ্বরবাদ, পৃষ্ঠা: ৭৮-৮১, সন্দেশ, ঢাকা।
৩. Marx Karl. 1844. A Contribution to the Critique of Hegel's Philosophy of Right, Deutsch-Französische Jahrbücher.
৪. Raymond Aron. 1962. Opium of the Intellectuals, W.W. Norton & Company, Inc., New York.
৫. লেনিন ভ্লাদিমির ইলিচ. ১৯৭৬. সাহিত্য প্রসঙ্গে. প্রগতি প্রকাশন, মস্কো।
৬. স. পাত্রাশ্কিন. দেন (৪৭)(নং ৭)
৭. আলী সৈয়দ মুজতবা. ২০০৪. ঐতিহ্য প্রবন্ধ থেকে, পৃষ্ঠা: ৬২, সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলী, ৭ম খণ্ড (২য় পর্ব).স্টুডেন্ট ওয়েজ, ঢাকা।
৮. লেনিন ভ্লাদিমির ইলিচ. ১৯৭৬. লেভ তলস্তয়- রুশ বিপ্লবের দর্পণ প্রবন্ধ (১৯০৮). সাহিত্য প্রসঙ্গে, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো।
৯. নচিকেতা চক্রবর্তী
১০. সরকার যতীন. ২০১১. বিনষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে ভাবনাচিন্তা প্রবন্ধ হতে, পৃষ্ঠা: ১২, বিনষ্ট রাজনীতি ও সংস্কৃতি. ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা।
১১. ভদ্র গৌতম. মমতাজুর রহমান স্মারক বক্তৃতা - আত্মসত্তার রাজনীতি. ( ১.০৩.১৫ সেকেণ্ড) ২৭ জুন, ২০১৪. বাংলাদেশ অধ্যয়ন কেন্দ্র
১২. রহমান ইস্ক্রা. ২০১৩. ক্লাশরুম ও অরাজ
১৩. খান আকবর আলি, খোলা ম্যানহলের রাজনৈতিক অর্থনীতি, পৃষ্ঠা: ৯৩-৯৪, পরার্থপরতার অর্থনীতি।