অধ্যায় ১
ভূমিকা
এই গবেষণাকর্মে যাদের কথা বলা হবে তারা এককথায়
অরাজপন্থী। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী, কমুনিস্ট, সমাজ সংস্কারক,
বিপ্লবী বা সন্ত্রাসী – এগুলোর কোনোটাই তাদের পরিচয় নয়। তারা নিতান্তই দার্শনিক, যারা ভেবেছিলেন মুসলিম সমাজ
তথাকথিত রাষ্ট্রব্যবস্থা ছাড়াই চলতে পারবে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গী প্রাচীন ইসলামিক
রাজনৈতিক চিন্তাধারা এবং অরাজপন্থার সঙ্গে খাপ খায়। যেহেতু তারা সারা বিশ্বেই,
এমনকি ইসলামিক পন্ডিতদের কাছেও একেবারেই অজানা এবং যেহেতু অরাজপন্থী ঐতিহাসিকগণের
পক্ষেও এখনো তাদের উন্মোচন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি, তাই তাদেরকে এভাবে জনসম্মুখে
পরিচিত করতে পারার সুযোগ পেয়ে আমি কৃতজ্ঞ বোধ করছি।[1]
এই অরাজপন্থীরা ইরাকের দক্ষিণে বসরা শহর থেকে
এসেছেন এবং তাদের দর্শনের উৎপত্তিও এই শহর থেকেই। কিন্তু, এরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত
ছিলেন। এদের বেশীরভাগই ছিলেন মুতাজিলা ধারার। বসরা ভিত্তিক একটি ধর্মীয় ধী-গোষ্ঠী (theological school) হলো মুতাজিলা ধারা। এই মতবাদের অনুসারীরা যুক্তিবাদী
হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত। মুতাজিলামাত্রেই অরাজপন্থী এমনটা কিন্তু নয়। ৯শতকে একজন
প্রথাবিরোধী দার্শনিকের (heresiographer) সন্ধান পাওয়া যায় যার নাম জাফর-বিন-হার্ব বলে অনুমান
করা হয়। তার মারফতেই জানা যায়, সরকার
ব্যবস্থার অনুপযোগীতার বিশ্বাসটি তার আমলেও প্রচলিত ছিলো।[2] আল-আসাম (d.৮১৬-৮১৭)[3], আল-নাজ্জাম (d.৮৩৫
এবং ৮৪৫ এর মধ্যবর্তী সময়ে)[4], হিশাম আল-ফুয়াতি (d.৮৪০?)
এবং তার শিষ্য আব্বাদ ইবনে সুলায়মান (d.৮৭০?)[5] – এরা সকলেই এই বিশ্বাসের
অনুসারী ছিলেন। এরা সকলে বসরাতেই বসবাস করতেন অথবা সেখানেই তাদের কর্মজীবন শুরু
করেছিলেন। এছাড়াও এই দলে ছিলেন বাগদাদের মুতাজিলা সুফীগণ (Sufiyyar al-mu’tazila)[6]। আরও একপ্রকার অরাজপন্থীরা
হলেন খারেজীয়গণ (Kharijites)।
এরা ছিলেন বসরা অঞ্চলের অধিবাসী এবং যুদ্ধবাজ চিন্তাধারায় বিশ্বাসী। খারেজীয়রাও আপাতদৃষ্টে
অরাজপন্থী ছিলেন না। কেবলমাত্র তাদের একটি উপ-গোত্র, অর্থ্যাৎ, নাজদিয়া বা
নাজাদাতেরা (Najdiyya or
Najadat) ছিলেন অরাজপন্থী। নাজদীয়দের
আবির্ভাব ঘটে ৭ম শতকে এবং ধারণা করা হয় এরা ১০ম শতক পর্যন্ত বসরা এবং তার আশেপাশের
এলাকায় টিকে ছিলেন।[7]
মুতাজিলীয়দের কথাই বলি অথবা খারেজীয়দের, উভয়েরই
অরাজপন্থী চিন্তাভাবনাগুলোকে খুবই অযত্ন-অবহেলায় সংরক্ষণ করা হয়েছে। কিছু কিছু সূত্র
থেকে জানা যায়, কতিপয় মুতাজিলীয় এবং খারেজীয় অনুসারীগণ ইমামতির প্রয়োজনীয়তাকে
অস্বীকার করেছিলেন (ইমাম ধারণাটিকে সাধারণ ব্যবহারের জন্য বৈধ সরকার ব্যবস্থা
হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে)। ফন এস (van Ess), জাফর ইবনে হার্ব এর প্রথাবিরোধীতার সামান্য যে হদীস
পেয়েছিলেন তার সাথে অরাজপন্থাকে মেলানোর আগপর্যন্তও এসবের প্রমাণ কিন্তু পাওয়া
যায়নি। আল-জাহিজ (d.৮৬৯) ছিলেন তৎকালীন অ-অরাজপন্থী মুতাজিলীয়দের
একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক।[8] ফন এসের নয়া এই সূত্রটি
আল-জাহিজের টুকরো টুকরো লেখালেখি থেকে অজানা এইসব অরাজপন্থীদের চিহ্নিত করতেও ইশারা
দিয়েছিল। তাদেরকে বর্তমানে আল-আসাম প্রভাবিত মুতাজিলা বলে চিহ্নিত করা হয়।[9] উপরন্তু, ফন এস অরাজপন্থীদের
নিয়ে এক বিশাল অনুসন্ধান চালিয়েছেন তার Theologie und
Gesellschaft বইতে। এই স্মারক গ্রন্থে প্রাচীন ইসলামিক বিশ্বের তত্ত্বীয় ক্রমবিকাশ
(prosopography) এবং বিশ্লেষণ (analysis) প্রথম চার খণ্ডে সন্নিবেশিত হয়েছে। এবং, বাকি দুটি খণ্ড কেবলমাত্র
অনুবাদকর্মে পূর্ণ। Pseudo-Nashi এবং Theologie und Gesellschaft বইদুটি ছাড়া এই প্রবন্ধটি হয়তো লেখাই সম্ভব
হতো না।[10] তথাপি, কিছু কথার ব্যাখ্যা
সংক্রান্ত সমস্যা এখনো রয়েই গেছে। তাই, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরবরাহকৃত তথ্যাবলীকে পাঠকদের
চোখে হয়তো ঘিঞ্জি পাদটীকা মনে হতে পারে।
অরাজ, সবচেয়ে সহজ কথায় বলা যায় সরকারব্যবস্থার
পরিহার্যতা। পশ্চিমে এর একটি সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক পরম্পরা পাওয়া যায় ১৪২০ পরবর্তী
বোহেমিয়ান ট্যাবোরাইটস (Bohemian Taborites) ধারাতে।[11] পশ্চিমের বাইরে এর অস্তিত্ব
খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অনেকে বলেন চুয়াং জু (Chuang Tzu, ৪র্থ শতক) এবং অন্যান্য
প্রাচীন তাওবাদীদের (Taoists) অরাজপন্থীদের তালিকায় রাখা যেতে পারে।[12] কিন্তু, আপাতদৃষ্টিতে তাদের
অরাজপন্থী মনে নাও হতে পারে[13] এবং, তাওবাদীরা বাদে,
পশ্চিমের বাইরে অরাজপন্থী বলতে এখানে কেবলমাত্র মুসলিম চিন্তাবিদদেরই বুঝানো হয়েছে। উপরোক্ত তিন ধরণের
অরাজপন্থীগণ হয়তো বিভিন্ন ঘাটের জল খেয়ে, বিভিন্ন চিন্তাধারার থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ
নিজ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন - এমনটা আশা করা যেতেই পারে। এখানে তাওবাদীদের নিয়ে
আলোচনাটি তোলা থাকলো। তবে,
চলুন আমরা পশ্চিমা এবং ইসলামিক চিন্তাধারার মধ্যকার তুলনামূলক পাঠ দিয়েই শুরু করি।
অধ্যায় ২
পশ্চিমা উঠোনে
মধ্যযুগীয় অথবা আধুনিক - পশ্চিমা অরাজের গোড়ার
কথা হলো মানব সমাজই রাষ্ট্রের জনক। পশ্চিমা ধারাটি জোর দিয়ে বলে থাকে - একটা সময়ে
মানুষ কর্তৃত্বকারী সরকার ব্যবস্থা ছাড়াই মিলেমিশে থেকেছে। স্বর্গের স্বর্ণালী
দিনগুলোতে বা প্রাচীন প্রাকৃতিক সমাজে অথবা কৃষিযুগের সূচনারও আগে মানুষ এভাবে থেকেছে।
যাহোক, তত্ত্বটির মোদ্দাকথা হলো: রাষ্ট্র এবং সমাজ অবিচ্ছেদ্য বা সমভাবাপন্ন নয়। এই তত্ত্ব আধুনিককালের যেকোনো
মানুষের কাছে বাহুল্য মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে তা নয়। এর ইতিহাস জানতে আমাদের
স্টোয়িকদের (Stoics) স্মরণাপন্ন
হতে হবে।
প্লেটো এবং এরিস্টটল সহ প্রাচীন গ্রীক
দার্শনিকদের মতে সমাজ এবং রাষ্ট্র মুদ্রার দুটি পিঠের মতো, যা একইসাথে উৎপত্তি
লাভ করে। একটি ছাড়া আরেকটি চিন্তাই করা যায় না।[14] কিন্তু, প্রাকৃতিক আইনের (Natural law) উপর ভিত্তি করে সমাজ
কেমন হতে পারে তা ভেবেই স্টোয়িকরা এদের মাঝে একটি পার্থক্য দাঁড় করিয়েছিলেন।
প্রাকৃতিক আইন হলো বিশ্বসংসারের অলংঘনীয় আইন যার আলোকে জ্ঞানী লোকেরা জীবনযাপন করে
থাকেন। এইরকম আইনের উপর ভিত্তি করে যে সমাজ গড়ে উঠবে সেখানে কোর্ট-কাচারী,
ব্যক্তিগত সম্পত্তি, দাসত্ব, বিবাহ বা যুদ্ধ থাকবে না। এককথায়, এর কোনো
কর্তৃত্বমূলক চরিত্র বা বলপ্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠান থাকবে না। উপরোক্ত সবকিছু মানুষে
মানুষে বোঝাপড়ার মাধ্যমে চলবে, এমনকি প্রাকৃতিক আইনের নামেও নয়। (প্রচলিত অন্যান্য
প্রতিষ্ঠানসমূহও যেমন, মন্দির, বিদ্যালয় এবং মুদ্রাব্যবস্থাও থাকবে না।)[15] স্টোয়িকরা অরাজপন্থী ছিলেন
না। তাদের বক্তব্যের অর্থ এই নয় যে, উপরোক্ত সকল প্রতিষ্ঠানসমূহ বিলুপ্ত হবে বা করতে
হবে।[16] তারা মানুষের সামাজিক দক্ষতা
এবং কর্তৃত্বশীল মনোভাবকে দুটি স্বতন্ত্র্য ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। এরপর প্রথমটিকে যুক্তিসংগত,
প্রাকৃতিক এবং হিতকর এবং পরেরটিকে অযৌক্তিক, অপ্রাকৃতিক এবং ক্ষতিকর হিসেবে
চিহ্নিত করেছিলেন। আর এভাবেই তারা অরাজের ভিত্তি তৈরি করেছিলেন মাত্র। এরও পরে স্টোয়িকগণ
বললেন, স্বর্ণযুগে মানুষ আসলে প্রাকৃতিক আইনের সমাজেই বসবাস করত এবং তাদের নেতৃত্ব
দিতেন জ্ঞানী লোকেরা। কিন্তু, এমন সময়েই অর্থলিপ্সার সূচনা হয় যার থেকে ব্যক্তিগত
মালিকানা, স্বৈরাচার, দাসত্ব, যুদ্ধ ইত্যাদির উদ্ভব ঘটে। অল্পকথায়, সামাজিক ও
রাজনৈতিক বৈষম্য, বলপ্রয়োগ এবং অন্যান্য বিসম্বাদের উদ্ভব ঘটে।[17] মানবসভ্যতার এই ঐতিহাসিক
দৃষ্টিভঙ্গী সিসেরো (Cicero) এবং অন্যান্য ল্যাটিন মাধ্যমে মধ্যযুগীয় পশ্চিমাবিশ্বের
হাতে আসে।[18] এবং,
এগুলো ল্যাটিন চার্চের হাতে পরে। ফলে, এগুলো ল্যাটিন খ্রিস্টবাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে
যায়।[19] এগুলোর খ্রিস্ট-সংস্করণে বলা
হয়, একসময় স্বর্গে অথবা কোনো সুদূর অতীতে পৃথিবীতে মানুষেরা কোনোরকম ব্যক্তিগত
মালিকানা এবং দাসত্ব (কিন্তু বিবাহ ছাড়া নয়) ছাড়াই বসবাস করতো।[20] কিন্তু, স্বর্গচ্যূতির ফলে এভাবে
বসবাস আর সম্ভব হলো না। ফলে, পাপের শাস্তি দিতে স্বয়ং ঈশ্বর রাজাদের নিয়োগ করলেন।
তাই কঠোর নির্যাতন সত্ত্বেও সকলকেই তাদের মানতে হত। কিন্তু, তবুও রাজারা পূর্বের নিষ্পাপ অবস্থায় ফেরাতে পারেনি।[21] ক্ষমতার ঈশ্বরপ্রদত্ত অথচ পাতকী
তকমার কল্যাণেই মধ্যযুগীয় পাদ্রীগণ কখনো নারকীয় আবার কখনো স্বর্গীয়, যখন যেমনটা
দরকার তেমন বিধি-বিধানের সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন। এমনকি এও বলা হয় যে,
রাজনৈতিক আজ্ঞানুবর্তিতা স্বর্গেও ছিলো।[22] থমাস একুইনাস (Thomas Aquinas, d.১২৭৪) এরিস্টটলের প্রাকৃতিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান তত্ত্বের দোহাই
দিয়ে স্বর্গের নাগরিক আজ্ঞানুবর্তিতার কথা জোরেশোরেই বলেছিলেন।[23] কিন্তু, ঈশ্বরের পরিকল্পনায়
এবং প্রকৃতিতেও সরকারব্যবস্থার অনুপস্থিতির তত্ত্বটি পশ্চিমা জ্ঞানতত্ত্বের সঙ্গে
জড়িত ছিলো।
এই ধারণারও বিলুপ্তি ঘটেছিল, যদিও একে প্রায়শই আক্রমণ করা হতো।
ফলাফলস্বরূপ, পশ্চিমারা রাষ্ট্রকে এড়িয়ে চিন্তা
করার অবকাশ বরাবরই পেয়েছেন। কেউ কেউ আবার সমাজকে এড়িয়ে চলার চিন্তাও করতেন। তারা
বুঝাতে চাইতেন এভাবে রাষ্ট্রবদ্ধ জীবন কতোটা নোংরা, পাশবিক এবং আয়ুনাশী হতে পারে। কিন্তু, বেশীরভাগই এমন সমাজের
স্বপ্ন দেখতেন যেখানে কোনো দমনমূলক প্রতিষ্ঠান থাকবে না। সুদূর অতীত ও ভবিষ্যতের
উপর নির্ভর করে অথবা সত্যিকার অথবা কাল্পনিক প্রাচীন সমাজ অথবা প্রাকৃতিক আইন
নির্ভর ইউটোপিয়া রচনা করে এবং এর আর্থ-সামাজিক উত্তারিধাকারী হিসেবে তারা এমনটা
চিন্তা করতেন। অল্পকথায়, পশ্চিমা অরাজ আসলে স্বর্গচ্যূত সেই নিষ্পাপ দশাতে ফিরে
যাবার অথবা এরচেয়ে কিছুটা ধর্মনিরপেক্ষ বিশ্বাস। অরাজীয় অনুভূতিগুলো তাই পশ্চিমের
একান্ত স্থানীয় অনুভূতি যদিও সেগুলো কদাচ বাইরে ছড়িয়ে পড়তে পেরেছিল।[24] অন্যভাবে যদি কেউ চিন্তা করে
যে, বুদ্ধিবৃত্তিক দর্শনগুলো হলো প্রজন্ম পরম্পরায় পৃথিবীকে বোঝাপড়ার একেকটি চিন্তার
বাক্স, তাহলে অরাজের পশ্চিমা ধারাটির গায়ে সহজেই “ঈশ্বর বা প্রকৃতি আদৌ শাসক চান
কিনা?” সেই প্রশ্নেরই লেবেল সেঁটে দেওয়া যায়।
অধ্যায় ৩
মুসলিম উঠোনে
কিন্তু মুসলমানরা পাশ্চাত্যের তুলনায় ভিন্নধর্মী
এক চিন্তাধারার অবতারণা করেছিলেন। তারা দেখলেন যে, দমনমূলক
প্রতিষ্ঠান সবসময়ই ছিলো এবং সবসময়ই থাকবে। কারণ, দুনিয়াটাই একটা সাম্রাজ্য।
এই দুনিয়ার রাজা হলেন খোদাতালা, যিনি তাঁর আইনে
দুনিয়া চালান। প্রথম দর্শনে মনে হতে পারে মুসলমানদের ঐশ্বরিক আইন বোধহয় স্টোয়িকদের
প্রাকৃতিক আইনের মতোই (স্টোয়িকরাও কিন্তু কখনো কখনো তাদের আইনকে ঐশ্বরিক আইন
বলতেন)। কিন্তু, দুটি দর্শনের মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। স্টোয়িকদের প্রাকৃতিক আইন
বলতে বুঝায় সেইসব আইন যেগুলো প্রকৃতির মাঝেই সৃষ্ট, প্রকৃতিই যার নিয়ন্তা এবং
মানুষ নির্বিশেষে সকলের ক্ষেত্রে যথোপযুক্তভাবে প্রযোজ্য। সেন্ট পলের মতে, এগুলো
যেন মানুষের হৃদয়েই প্রথীত।[25] এগুলো তাই স্বতন্ত্রভাবে
মানুষকে শাসন করতে পারে। কিন্তু মুসলিম ঐশ্বরিক আইন মূলত পজেটিভ ল (positive law)
- এর ধারণা থেকে উদ্ভুত যেগুলো কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের জন্যই বিধৃত,
জারিকৃত এবং প্রযোজ্য। মানুষকে নতুন আইন জানাতে রাজা যেমন দূত নিয়োগ করতেন, তেমনি
ঈশ্বরেরও তাঁর আইনকে কার্যকর করতে দূত নিয়োগ করতে হয়েছিলো। তাই, মানুষকে
স্বাধীনভাবে চলতে না দেওয়ার জন্যই ঐশ্বরিক আইনের আবির্ভাব হয়েছে। এই আইনমতে,
আপনাকে সর্বপ্রথম ঈশ্বরের শাসনব্যবস্থার শরিক হয়ে তাঁকেই সর্বশক্তিমান রাজা হিসেবে
স্বীকার করে নিতে হবে এবং দূত মারফত যেসব আইন তিনি জারি করেছেন সেইমতো চলতে হবে।
ঈশ্বরের শাসন বাধ্যতামূলক। তার মানে এই নয় যে
তিনি নিজেকে মানতে বাধ্য করার জন্য বলপ্রয়োগ করেন। কিন্তু, কখনো কখনো এই শাসনের
বিরুদ্ধেও মানুষ বিদ্রোহ করতে চায়। এইরকম বিদ্রোহ শুধু মানুষই করে থাকে এমন নয়। মানুষের
সৃষ্টির আগেও ঈশ্বর তার অবাধ্য সৃষ্টিদের দমন করতে সৈন্য প্রেরণ করেছিলেন এবং, এই
কারণেই ঈশ্বরের শাসন কেন বাধ্যতামূলক সেই বিশ্লেষণের মুসলিম দৃষ্টিভঙ্গীতে মানুষের
বিদ্রোহের ভূমিকাটিই তাই একমাত্র বিবেচ্য বিষয় নয়।[26] সরকারব্যবস্থা সবসময়ই ছিলো
এবং থাকবে। এটা জগতসংসারের একটা অনিবার্য উপাদান।
অতএব, মুসলিম স্বর্ণযুগের মিথটি সরকারহীনতার কথা
বলে না, বরং, সরকারের আদর্শ রূপের কথা বর্ণনা করে। মিথটি ইসলামের নবী ও তাঁর
খলিফাদের আমলে মদীনা নগরীকে কেন্দ্র করে ৬২২ থেকে ৬৫৬ (অথবা তারও আগে) খ্রিস্টাব্দে
গড়ে ওঠে।[27] অর্থ্যাৎ,
কোনো ধোঁয়াটে অতীতে নয় বরং স্মরণীয়কালেই এটা গড়ে উঠেছিল। এই মিথ নিছক গল্প নয় বরং, সেই
সময়ের একটি আদর্শ চিত্র তুলে ধরে। স্টোয়িকদের মতোই, এটা জ্ঞানীদের দ্বারা শাসিত
একটা সহজ সমাজের ধারণা দেয়। এবং,
৬৫৬ সালে প্রথম গৃহযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্তও এইরকম সমাজ চালু ছিলো। কিন্তু
স্টোয়িকদের সাথে এর বৈসাদৃশ্য হলো, এটা ঐশ্বরিক আইন ও মানুষের শাসনের মাঝে
পার্থক্য না করে উভয়ের শাসনের একীভবন করে রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরি করেছিল। ইসলামের
নবী এবং প্রথম খলিফাগণ, যারা ঈশ্বরের আদেশকে প্রতিপালন করতেন তাঁরা স্রেফ জ্ঞানীই
ছিলেন না, দ্ব্যর্থহীনভাবে শাসকও ছিলেন। তাঁরা দণ্ডবিধান করতেন, প্রচারণা চালাতেন,
বিদ্রোহ দমন করতেন এবং রাজ্যদখলের জন্য যুদ্ধও করতেন। এককথায়, তাঁরাও সংঘবদ্ধ সহিংসতা
চালাতেন। কিন্তু, তাঁরা সবসময়ই এগুলো ঈশ্বরের আইন অনুযায়ীই করতেন। দমনমূলক
প্রতিষ্ঠান হলেও যতক্ষণ সেগুলোকে যথাযথভাবে পরিচালনা করা সম্ভব ততক্ষণ কোনো সমস্যা
নাই – এটাই ছিলো তাঁদের মূলনীতি।[28]
ইমামশাসিত সরকারই ছিলো তখন আদর্শ সরকার ব্যবস্থা।
ইমাম হলেন একজন সাম্প্রদায়িক নেতা যিনি ঈশ্বরের আইনের আলোকে নিজেকে পরিচালিত করেন।
যিনিই এমন নজির সৃষ্টি করতে পারতেন তাঁকেই সকলের অনুসরণ করতে হত। মানব ইতিহাসের
প্রথম ইমাম হলেন আদম। ইসলামিক ইতিহাসের প্রথম ইমাম হলেন মোহাম্মদ। তাঁর পরবর্তীতে
যারা ইমাম হয়েছিলেন তাঁদের ডাকা হতো “খলিফা” এবং অতীতে তাঁদের কাজের পদবী ছিলো
“ইমামতি” (এর মাধ্যমে আইনগত চরিত্রটি বোঝানো হতো) এবং বর্তমানে “খেলাফত” (এর
মাধ্যমে বোঝানো হত রাজনৈতিক চরিত্র)। কিন্তু, তাঁরা সকলেই আসলে একই ধরণের শাসক। এই ব্যবস্থার পূর্বে
দুনিয়ায় যে ভিন্ন দুটি ব্যবস্থার কথা জানা যায় সেগুলো ছিলো দুর্নীতিপরায়ণ।
এর পূর্বে, একদিকে কিছু মানুষ ঈশ্বরের ক্ষমতাকে
অতিক্রম করে নিজের ক্ষমতা নিয়ে গর্বিত হয়ে স্বৈরশাসনের সূচনা করেছিলেন। মুসলিমরা
অধিগ্রহণের আগে অ-আরবীয়রা এইরকম দুনিয়ায় থাকতেন। আরও সংক্ষেপে বলতে গেলে, তারা
রাজার অধীনে চলতেন। কিন্তু ঈশ্বর ব্যতীত দুনিয়াবি সকল রাজাই ছিলেন স্বৈরশাসক। কারণ, রাজারা সবসময়ই ঈশ্বরের
নাম ভাঙিয়ে ক্ষমতার চর্চা করতে চাইতেন। মিশরীয় ফারাওরা এর অন্যতম প্রাচীন উদাহরণ।[29] অপরদিকে, কিছু মানুষ ঈশ্বর ও
তাঁর আইনকানুনকে ভুলে গিয়েছিল। তাই তাদের কোনো
শাসনব্যবস্থাই ছিলো না। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবীয়রা ছিলেন এইরকম রাষ্ট্রহীন
দুনিয়ার বাসিন্দা। গ্রীকরা নিজেদের তো বটেই, পাশাপাশি আরবদের শাসকবিহীন বসবাসকে
প্রশংসাই করতেন।[30] গ্রীকরা তাদের কাব্যে নিজেদের
রাজা বা অন্যকারও শাসন প্রত্যাখ্যানের উচ্চকিত প্রশংসা করেছেন।[31] কিন্তু ইসলামের আবির্ভাবের
পর আরবরা উপলব্ধি করলেন যে, তারা আসলে এতোদিন প্যাগান অজ্ঞতা ও বর্বরতা বা
জাহেলিয়াতের[32] যুগে
বসবাস করেছেন। জাহেলিয়াত হলো
নীতিহীনতা ও দুঃশাসনের কাল। তারা উপলব্ধি করলেন জাহেলিয়াত কোনো নিষ্কলুষতার কাল নয়, দমনপীড়নের বিরুদ্ধে
স্বাধীনতার সহজাত অধিকারের কোনো কাল নয়। ধর্মের প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে মানুষের
যেসমস্ত আইনি ও নৈতিক দায়িত্বগুলো রয়েছে সেগুলো স্থির করা – তাদের এই প্রতিবোধনের
সাথে সাথে ধীরে ধীরে দায়িত্ব, আনুগত্য এবং শৃঙ্খলা সবই পুনঃস্থাপিত হল। মদীনার খলিফাগণ ঈশ্বরের
আইনকে গ্রহণের মাধ্যমে স্বৈরতন্ত্র ও অরাজপন্থার মধ্যবর্তী একটা পথ বেছে নিলেন। মুসলামানদের
বড় অংশের কাছে তারা রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে তখনও বিবেচিত হতেন এবং এখনও হয়ে থাকেন।
সংক্ষেপে, রাজারাজড়ারা দমনমূলক শাসনপ্রণালীকে
মানুষের উপর চাপিয়ে না দিলে এগুলোর কোনোটাই মানুষের স্বাভাবিক রীতিনীতি ছিলো না। একেবারে খাঁটি অবস্থায়
এগুলো হলো খোদায়ি রীতিনীতির প্রতিষ্ঠান। প্রকাশ্য কোনো আইন ছাড়া নৈতিক শৃঙ্খলা
পাওয়া যায় না, আবার, কোনো ইমাম ছাড়া প্রকাশ্য কোনো আইনও পাওয়া যায় না। এইরকম একটা সময়ে মুসলিমরা
তাদের যাত্রা শুরু করে। এইরকম অবস্থা থেকে অরাজের চিন্তা করা খুব সহজ ছিলো না।
অধ্যায় ৪
ইমামতি থেকে রাজাগিরি
অন্যান্যদের মতো মুসলমানেরাও আবিষ্কার করলেন যে,
ঐশ্বরিক আইন এবং মানব সৃষ্ট সরকারব্যবস্থাও একই দ্বন্দ্ব-বিবাদের দিকেই ঝুঁকেছে।
৮০০ সালের দিকে, মদীনা ততোদিনে বহুদিন হলো রাজধানীর মর্যাদা হারিয়েছে; মুসলিম
রাষ্ট্রও তাদের সারল্য খুইয়েছে এবং ইমামেরাও আর জ্ঞানী লোকদের মধ্য থেকে আসছেন না
এবং তাঁরাও এতোদিনের বন্ধুসুলভ সহায়তা পরিত্যাগ করেছেন। আব্বাসীয় খলিফাগণ বাগদাদে
বসে ঠিক ফারাওদের ভঙ্গীতেই বিশাল এক সাম্রাজ্য শাসন করতে শুরু করেছেন। আর, ইমামতি ততোদিনে
রাজাগিরিতে রূপ নিয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, সাধারণ মানুষের চোখে সবই স্বৈরশাসনে
পরিণত হয়েছিল।
এমতাবস্থায় বিকল্প হিসেবে কী করা যায় সেটাই ছিলো বড় প্রশ্ন।
ইসলাম জন্মলগ্ন থেকেই একটি সক্রিয় ধর্ম হিসেবেই
গড়ে উঠেছিল। এই পরিস্থিতির পরেও
এমন মানুষ ছিলেন যারা বলতেন যেখানেই মানুষকে অনৈতিক কাজ করতে দেখা যাবে, তখনই তার
বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে এবং প্রয়োজনে তরবারিও ব্যবহার করতে হবে। যদি শাসক
অনৈতিক কাজ করেন আর যদি সাফল্যের সম্ভাবনা থাকে, তবে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে
হবে এবং তাকে অপসারণ করে নতুন কাউকে বসাতে হবে। ৯ শতকের বেশীরভাগ মুতাজিলীয়[33] এবং অ-অরাজপন্থী খারেজীয়গণও[34] এইরকম মত পোষণ করতেন। কিন্তু সুন্নি
ইসলামের অনুসারী পণ্ডিতেরা ছিলেন মধ্যযুগীয় পশ্চিমা যাজকদের মতো তান্ত্রিক (quietists) প্রকৃতির। তাদের মতে, গৃহযুদ্ধ যেকোনো
সম্প্রদায়ের জন্য বিধ্বংসী হতে পারে, কারণ, এতে স্বৈরশাসকের সক্রিয়তাও থাকতে পারে। আর, নেতৃত্বের সঠিকতা
নির্ণয়ের চেয়ে সম্প্রদায়কে টিকিয়ে রাখাটাই বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তাই, শাসক যত
পাপিষ্ঠই হোন না কেন, তিনি ঈশ্বরের আদেশ পরিপন্থী কোনো কাজ করতে নির্দেশ না দিলে তাকে
মেনে চলাটাই উচিত। আর
এইরকম পরিস্থিতিতে পরোক্ষ প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার।[35]
কেউ কেউ তো খ্রিস্টবাদের অনুকরণে বলতেন, পাপের
শাস্তিস্বরূপ মানুষের ভাগ্যে স্বৈরশাসকেরা জুটেছে।[36] কিন্তু অরাজপন্থীরা সম্পুর্ন
ভিন্ন একটি সমাধানের কথা বলেছিলেন। আমরা মুতাজিলীয়দের দর্শন দিয়ে শুরু করতে পারি
এবং বলে রাখি, এটাই আমাদের মনোযোগের অধিকাংশ অংশ জুড়ে থাকবে।
অধ্যায় ৫
মুতাজিলীয় যুক্তি
মুতাজিলীয়গণ অরাজপন্থার পক্ষে বিভিন্ন যুক্তিই
দেখিয়েছেন। কিন্তু, একমাত্র মুতাজিলীয় সাধকগণের (ascetics) প্রদেয় যুক্তিটিরই পূর্ণাঙ্গ পাঠ পাওয়া গেছে। এটা অনেকটা
এরকম - ইসলাম অন্যান্য ধর্মগুলো থেকে আলাদা কারণ অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোতে
রাজারাজড়ারা আছেন। এইসব রাজারাজড়ারা তার অধীনস্থদের দাসত্বে বাধ্য করতেন। কিন্তু, ইসলামের নবী কোনো
রাজা ছিলেন না, তাঁর উত্তরাধিকারদের কেউও রাজা ছিলেন না। আর, যদি কোনো ইমাম আইন
ভঙ্গ করে রাজা হবার চেষ্টা করতেন তাহলে মুসলমানেরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাকে
অপসারণের আইনগত অধিকার রাখতেন (এইধারার অনুসারীরা বলে থাকেন)। কিন্তু, তবুও যেহেতু, ইমামগণ
অবশ্যম্ভাবীভাবে রাজায় পরিণত হতেই থাকলেন, তাই সবচেয়ে ভালো সমাধান হলো ইমাম হিসেবে
কাউকে নিয়োগ না দেওয়া।[37] অবশ্য, মুতাজিলীয় সাধকগণ
কখনোই ভবিষ্যতে কোনো বৈধ শাসক নিয়োগের ক্ষেত্রে অমত করেন নাই। তারা বোধহয় ভেবেছিলেন
শাসককে একজন অলিদ (Alid) বা নবীর বংশধর হতে হবে।[38] আর, এমন কাউকে শাসক হিসেবে না
পাওয়া গেলে বরং কোনো শাসক না থাকাই ভালো।
আল-আসামের যুক্তির সারবস্তু তাঁর বিপুল সংখ্যক
লেখনী থেকে সংগ্রহ করে পাওয়া গেছে। এটির মূলকথা হলো, ইমাম হলেন সেই
শাসক যিনি তাঁর সম্প্রদায়ের সকলের সম্মতিতে নির্বাচিত হয়েছেন। এই সম্মতি ব্যতীত তাঁর
ইমাম হবার কোনো সুযোগই নাই।[39] এই যুক্তিটি
ব্যাপকভাবে গৃহীত হয় (সেইসাথে নাজদিয়াদের যুক্তিটিও). আসলে, খলিফাগণ সাম্প্রদায়িক
চুক্তির ভিত্তিতে শাসন করতেন বলেই তাঁরা ছিলেন সত্যিকার ইমাম (আল-আসামের ভাষ্যমতে,
কিন্তু, নাজদিয়দের মত অনুযায়ী নয়)। কিন্তু, বর্তমানে এমনটা হয় না, কারণ, এখন
সম্প্রদায়ের সীমানা অনেক বড় হয়ে গেছে।[40] সাধকদের মতো, আল-আসামও বোধহয়
মনে করতেন যে ভবিষ্যতে কোনো একদিন সত্যিকার ইমাম আবার আসবেন। অবশ্য, তিনি যদি
সম্প্রদায়ের আকারকে বিবেচনায় নিতেন তাহলে হয়তো এভাবে চিন্তা করতেন না।[41] এবং, তিনি নিশ্চিতভাবেই এমনটাও
ভাবতেন না যে, ইমাম হতে হলে অবশ্যই নবীর বংশধর, নিদেনপক্ষে আরব হতে হবে।[42]
হিশাম আল-ফুয়াতি, আল-আসামের থেকে একটু ভিন্ন
যুক্তি দেখিয়েছিলেন। তাঁর মতে, কোনো সম্প্রদায়ের তখনই একজন ইমাম থাকা উচিত যখন
তাকে সর্বসম্মতিক্রমে এবং ন্যায়নিষ্ঠার মাপকাঠিতে নির্বাচন করা সম্ভব হবে। এর
মাধ্যমে বোধহয় বোঝানো হয়েছে, কেবলমাত্র যখন পরিস্থিতি অনুকূলে থাকবে অথবা
পরিস্থিতি বাধ্য করবে তখনই একজন ইমাম নির্বাচন করা উচিত।[43] অতীতকালে এটা সম্ভব ছিলো,
কিন্তু বর্তমানে এটা আর সম্ভব নয়, কারণ, সম্প্রদায় তখন অনেক জটিল গেছে। তার শিষ্য, আব্বাদ ইবনে
সুলায়মান মনে করতেন যে, আর কখনো ইমাম নির্বাচন করাই সম্ভব নয়।[44] এই কথাটিও বিকল্প কোনো
ব্যবস্থা খোঁজার পক্ষে মত দেয়।
মুতাজিলীয় অরাজপন্থীগণ পরিষ্কারভাবেই হতাশাবাদী
ছিলেন। তারা হয়তো এমা গোল্ডম্যানের (d. 1940) “সকল ধরণের শাসনব্যবস্থাই সহিংসতার উপর ভিত্তি করে টিকে থাকে। তাই এগুলো
ক্ষতিকর এবং অপ্রয়োজনীয়” – এই কথাটির সাথে একমত হবেন না।[45] তাদের মত থেকে বুঝা যায়, নেতিবাচক
দৃষ্টি শুধুমাত্র রাজা শাসিত শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য এবং ইমামতি এর একটি
ব্যতিক্রম। কিন্তু, এই ব্যবস্থাও আসলে কোনো ব্যতিক্রম কিছু ছিলো না। এই ব্যবস্থাও
আসলে সহিংসতার উপর ভিত্তি করেই টিকে ছিলো, আর তাই, একেও ভুল, ক্ষতিকর এবং
অপ্রয়োজনীয় বলা যায়। আর, একই ধরণের সমস্যার সাথে তাদেরও লড়তে হচ্ছিলো।
মুতাজিলীয়গণ (এবং নাজদীয়গণও) ইমামতি ধর্মীয় আইন
দ্বারাই বিধৃত এই ধারণাকে অস্বীকার করে একে অপ্রয়োজনীয় আখ্যা দিয়েছিলেন। তারা
বলতেন, একজন মুসলিমকে নামাজ পড়তে হয়, রোজা রাখতে হয় এবং অন্যান্য নির্দেশিত
কর্তব্য পালন করতে হয়, কিন্তু, ইমাম নিয়োগ করাটা সেরকম নির্দেশিত বাধ্যতামূলক
কর্তব্য নয়। এটাকে তারা নানাভাবে ব্যাখ্যা করতেন। আল-আসাম, আল-নাজ্জামের পথ অনুসরণ
করে বললেন, মানুষ যদি তার নিজ তাগিদে নির্দেশিত বিধিবিধান মেনে চলে তাহলে কোনো
ইমামেরই প্রয়োজন নাই।[46] এই কথার মাধ্যমে তিনি এটা
বুঝাতে চান নি যে, এইরকম সাম্যাবস্থা এমনিই আসবে। বরং, যেইমাত্র কেউ ইমামতিকে
অনাবশ্যক হিসেবে বিবেচনা করতে পারবেন, কেবলমাত্র তখনই তিনি চাইলে যুক্তির আলোকে এই
ব্যবস্থাকে আর বাধ্যতামূলক মনে না করার দিশা পেতে পারেন। এটা কোরআনেও বাধ্যতামূলক নয় (যেহেতু
প্রায় সকল অ-শিয়াগণ এইমর্মে একমত হয়েছেন)। আল-আসামের অনুমিত অনুসারি আল-জাহিজ
বলেছেন, নবীজীর মৃত্যুর পরে তাঁর সাহাবীগণের হাবভাব দেখে মনে হয়েছিল যে, নবীজীও
একে বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।[47] সংক্ষেপে, এ ধরণের কোনো প্রতিষ্ঠানের
অস্তিত্ব আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক ছিলো না। আব্বাদ ইবনে সুলায়মান তো হিশাম আল-ফুয়াতি’র
বক্তব্যকেই তুলে ধরে বৈধ ইমাম না আসার সম্ভাব্যতার দিকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।[48] তিনি সম্ভবত অনুমান করেছিলেন
যে, ইমামতি থাকার পেছনে কোনো বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে না; কারণ, সাধারণভাবে মেনে
নেওয়া হয়েছে যে, ঈশ্বর কখনো তার বান্দার উপরে অসম্ভব কাজের দায়িত্ব চাপান না। সাধকেরা
কেমন করে তর্ক করতেন আমাদের জানা নাই, তবে, তারা কমবেশী সকলেই ইমামতিকে ঈশ্বরপ্রদত্ত
বলে অস্বীকার করতেন। অন্যভাবে বলা যায়, এটা সর্বশক্তিমানকে প্রতিফলিত করে না বলে তাঁরা
এর ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যকে বিলোপ করার পক্ষপাতী ছিলেন। তারা বলেছিলেন এটা অন্যান্য মানবসৃষ্ট প্রতিষ্ঠানের মতোই ভ্রমপ্রবণ।[49] তারা অবশ্য বলেন নাই যে, এটা
ক্ষতিকর প্রতিষ্ঠান অথবা, ঈশ্বর আসলে একে ছাড়াই জীবনযাপন করতে বলেছেন। তারা শুধু
অস্বীকার করতেন যে ঈশ্বরের এই নিয়ে আদৌ কোনো কামনা বা অন্যকিছু ছিলো। উল্লেখ্য যে,
ইমামতি নিছক মানবসৃষ্ট রীতি, প্রয়োজন মতো একে গ্রহণ বা বর্জন করা যেতে পারে। অতীতে
মানুষ একে গ্রহণ করেছিল এবং তখন তা খুবই কার্যকরীও ছিলো। কিন্তু, এই সময়ে মানুষের স্বাভাবিক
আকাঙ্খা বা কখনো কখনো অবশ্যম্ভাবী লক্ষ্য হলো এই ব্যবস্থা ছাড়াই চলা। সংক্ষেপে,
মূলত যে সংযোগের উপর ভিত্তি করে ইসলামিক সমাজ গড়ে উঠেছিল, অরাজপন্থীগণ আইন এবং
ইমামতির মাঝের সেই সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন। এভাবেই তারা অরাজপন্থাকে সফল করেছিলেন।
অধ্যায় ৬
ইমাম বিহীন সমাজযাত্রা
কিন্তু ইমামবিহীন জীবনযাত্রাই বা কেমন হবে? সর্বোপরি,
আইনকানুন কে প্রয়োগ করবে আর দণ্ডবিধিই (hudud) বা প্রয়োগ করবে কে? কারণ, দণ্ডবিধি সাধারণভাবে সর্বসম্মতিক্রমে মনোনীত
ইমাম বা প্রতিনিধিরই প্রয়োগ করার কথা। স্বাভাবিক পরিস্থিতে কোনো মানুষ
ব্যক্তিগতভাবে অপরকে হত্যা বা ক্ষতি করার অধিকার রাখে না। আইনের মাধ্যমেই কিছু
কিছু অপরাধের শাস্তি অঙ্গচ্ছেদ বা প্রহারের মাধ্যমে মৃত্যু ইত্যাদি নির্ধারিত
হয়েছে। এই শাস্তিগুলোকে বলা হয় “ঈশ্বরের
অধিকার” অর্থ্যাৎ, এগুলো বৃহত্তর কল্যাণ ও স্বার্থের জন্যই প্রয়োজন। কিন্তু, এই
কাজগুলো সম্পাদনের জন্য তো নেতৃস্থানীয় কাউকে চাই।[50] এগুলো থেকে দ্ব্যর্থহীনভাবেই বোঝা
যায় যে ইমাম নিয়োগ করাও একটি আইনী দায়িত্ব।[51] কারণ, দণ্ডবিধান (hudud) তখন সম্ভবত
বেঁচে থাকার প্রশ্নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছিল। ইমাম ছাড়া সামরিক বিষয়গুলোকেই
বা কে দেখবে সেই প্রশ্ন মুতাজিলীয়দের খুব বেশী ভাবায়নি। যদিও নয় শতকের মুতাজিলীয়দের
কাছে একজন ইমাম একইসাথে একজন ধর্মীয় নেতা হিসেবেও বিবেচিত হতেন, তবুও ইমামবিহীন
সমাজে ধর্মীয় নির্দেশনাই বা কে দিবে তা নিয়ে তারা একেবারেই আলোচনা করেন নাই।[52] অবশ্য সন্দেহ হয়, ভাঙা ভাঙা
ভাবে প্রাপ্ত তথ্যের কারণেই এই সম্পর্কে তাদের দর্শন পুরোপুরি জানা সম্ভব হয়নি।
মুতাজিলীয়গণ বরং নৈতিক ভিত্তি এবং চর্চার দিকে
সায় দিয়েছেন। চর্চার কথা বলতে গিয়ে তারা পারস্পরিক সহযোগিতার পক্ষে কথা বলেছেন।
তারা দায়িত্ববান আচরণের কথা বলতেন। কেউ কেউ বলেছেন, ‘মানুষের ভালো থাকা বা মন্দ
থাকার পুরোটাই তাদের পারস্পরিক সহযোগিতার উপরে নির্ভর করে।’ তাই, প্রথমত, চর্চায়
সবাইকেই অংশগ্রহণ করতে হবে, কোনো ফাঁকিবাজি চলবে না। এমনকি যারা বিভিন্ন অপরাধে
অপরাধী প্রমাণিত হয়েছেন তাদেরও স্বেচ্ছাসেবকের মতো অংশগ্রহণ করতে হবে।[53]
দ্বিতীয়ত, নৈতিক ভিত্তি গঠনের ক্ষেত্রে তাদের
প্রস্তাব হলো সবধরণের সরকারি কর্তৃত্বের বিলোপের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিকেন্দ্রীকরণ।
সবধরণের সরকারি কর্তৃত্বতন্ত্রের বিলোপের ধারণাটি বোধহয় হিশাম আল-ফুয়াতি এবং
আব্বাদ ইবনে সুলায়মানের চিন্তা ছিলো। যেহেতু, কোনো আইনসঙ্গত কর্তৃপক্ষ থাকা সম্ভব
নয়, তাই মানুষের উচিত প্রয়োজন অনুসারে আইনকে নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া। আত্মনির্ভরশীলতাকেই
সর্বক্ষেত্রে উৎসাহিত করা উচিত। এমনকি যখন হত্যা বা গুপ্তহত্যা করাও আবশ্যক হয়ে
দাঁড়ায় তখনও।[54] মানুষের বিদ্রোহীসত্তাকে
জাগ্রত রাখা এবং প্রকাশ্যে আইনের ক্ষমতাকে প্রয়োগ করতে পারাটাই অধিকতর মঙ্গলজনক।
চুরির জন্য হাত কেটে নেওয়ার বিধান বা মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিধান, মোটকথা একজন
ইমামের যাবতীয় ক্ষমতার বিপরীতেই এই কথা প্রযোজ্য।[55] আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এ যেন সহিংস
নৈরাজ্যের ধারণা। অপর একটি ধারার মুতাজিলীয়গণ বলেছিলেন যে, স্থানী বিশ্বাসযোগ্য
এবং জ্ঞানী নেতাগণ তাদের অধিক্ষেত্রের মধ্যে আইন প্রয়োগ করবেন। তারা হুদুদ (Hudud) বা দণ্ডবিধিও নির্ধারণ করবেন।[56] অন্যকথায়, ক্ষমতা কেবলমাত্র
দেশপ্রেমিক এবং স্থানীয় নেতাদের অথবা আধুনিককালের ভাষায় দেশীয় শাসক এবং স্থানীয়
খুনেদের হাতে থাকবে। এছাড়া, অপর আরও একটি পক্ষ সরকারি কর্তৃত্বের প্রতি নমনীয়
মনোভাব পোষণ করতেন। তাদের
মতে অস্থায়ী ইমাম নিয়োগ দেওয়া যেতেই পারে। আইনি জটিলতা দেখা দিলে অথবা কোনো অপরাধ
সংঘটিত হলে, বা বহিঃশত্রু আক্রমণ করলে অস্থায়ী ভিত্তিতে ইমাম নিয়োগ দেয়া যেতে
পারে। এবং, প্রয়োজন ফুরানোর সাথে সাথেই ইমামও তার পদ হারাবে, ঠিক যেমন করে একজন
ইমামের নামাজ শেষ হওয়ামাত্র তার দায়িত্বের অবসান হয়।[57] মনে হতে পারে যে স্থানীয় নেতাগণই
হয়তো এইসব দায়িত্ব পালন করবেন, কিন্তু, যেকোনো ক্ষেত্রেই এই ধারার মুতাজিলীয়গণ
নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকারব্যস্থা পরিবর্তন করার পক্ষপাতী ছিলেন। আল-আসামও এই ধারণাটির
কথা বলেছিলেন। তিনি
বলেছিলেন, যদি যথাযোগ্য মানুষকে নিয়োজিত করে পক্ষপাতিত্ব এবং ষড়যন্ত্র রোধ করা
যায়, তাহলে আইন এবং দণ্ডবিধানের জন্য তা ইমাম ব্যবস্থার বিকল্প হতে পারে।[58] এককথায়, কার্যনিবাহী কমিটি
তৈরি করে শাসন করা যেতেই পারে।
আল-আসাম কঠোর বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষে আরও একটি
প্রস্তাব রেখেছিলেন। প্রস্তাবটি হলো একাধিক আধা-স্বাধীন ইমাম নিয়োগ করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, খেলাফতের যুগে একজন ইমামই যথেষ্ট ছিলেন। কিন্তু, এখন কেবলমাত্র একজন
মানুষের পক্ষে সর্বসম্মতি অর্জন সম্ভব নয়। তাছাড়া, তার একার পক্ষে দূরের
প্রদেশগুলোর যোগ্য ও মেধাবী লোকজনকে চেনা সম্ভব নাও হতে পারে। আল-আসাম দেখলেন যে,
এতে সেই ব্যক্তি প্রদেশে যারা শাসন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণে আগ্রহী তাদের সাথে সমন্বয়হীনতায়
ভুগতে পারেন, যা শাসনকার্যে আগ্রহীদের হতাশ করতে পারে। সুতরাং, একাধিক ইমাম থাকাই
ভালো এবং এটা আইনসম্মতও বটে। তিনি আরও বলেন, যেহেতু, ইমামতি হলো মানবীয় রীতিনীতি, তাই
আমরা যেমন সুবিধা তেমন করেই এটা পরিচালনা করতে পারি। কিন্তু, এইপর্যায়ে এসে তিনি
তাল হারিয়ে ফেলেন। তিনি তার প্রস্তাবকে বৈধ প্রমাণ করতে গিয়ে নবীজীর কর্মকান্ডকে নজির
হিসেবে দেখান। তিনি দাবী করেন যে, আরবে নবীজীর নিযুক্ত শাসকেরা বস্তুত ছিলেন
স্বাধীন ইমাম। তাদের প্রত্যেকেই খাজনা আদায় করতেন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করতেন, বহিঃশত্রুর
আক্রমণকে প্রতিহত করতেন এবং মানুষকে আইনকানুন শেখাতেন।[59] এবং, নবীজী যখন মারা গেলেন,
তখন প্রতিটি প্রদেশের অধিবাসীগণ তাদের নিজেদের শাসক নিয়োগের অধিকার অর্জন করলেন। সংক্ষেপে,
প্রতিটি প্রদেশই তাদের নিজেদের আধা-স্বাধীন শাসক নির্বাচনের অধিকার অর্জন করেছিলো এবং
তাদেরকে নিজ নিজ প্রয়োজনেই একে অপরকে সহযোগিতা করে চলতে হতো।[60] কিন্তু, আল-জাহিজ এই
প্রস্তাবের বিরোধীতা করেছিলেন। তিনি বললেন, প্রতিবেশী শাসকেরা পরস্পরের সাথে
মারামারি না করে থেকেছে এমন কথা কি কেউ কখনো শুনেছে?[61] কিন্তু, আল-আসাম যা প্রবর্তন
করতে চাইছিলেন তা স্পষ্টতই ফেডারেশন গঠনের চিন্তা। এমন কোনো ধারণা আগে কখনো ছিলো
না। এবং, নবীজীর মৃত্যুর পর কেই বা শাসকগণকে ঐক্যবন্ধ করে রাখবে সে ব্যাপারে
আল-জাহিজ নিজেও আর কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। তবুও, এটা একটা
বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রাজনৈতিক চিন্তা এবং তার তাল হারানোটা মোটেও বিস্ময়কর ঘটনা নয়।
কারণ, একেবারেই ইমামবিহীনতার কথা বলার চেয়েও একাধিক ইমামের অধীন মুসলিম সমাজের
বিভক্তির কথা বলাটা প্রচণ্ডরকম প্রথাবিরোধী পদক্ষেপ ছিলো সেই সময়ের প্রেক্ষিতে। আল-আসাম কখনো তার
মতামত প্রকাশে ভয় করতেন না, তিনি প্রায়ই তার বন্ধুবান্ধব ও শিষ্যদের এসব কথা বলতেন।
অধ্যায় ৭
গ্রীক নাকি আঞ্চলিক উৎস?
প্রায় আশি বছর আগে গোল্ডজিহার (Goldziher) বলেছিলেন,
আল-আসাম এবং হিশাম আল-ফুয়াতি অরাজের ধারণা আলেক্সান্ডারের ইরান বিজয়ের পর তাকে
লেখা এরিস্টটলের একখানা চিঠি থেকেই পান।[62] কিন্তু এটা প্রায় অসম্ভব এবং
তাই ফন এস (van Ess) এই প্রস্তাবকে বাতিল করে দেন।[63] চিঠিটা দুটি অংশে বিভক্ত;
রাজতন্ত্রের পক্ষে এবং বিপক্ষে হেলেনীয় বিতর্ক (Helenistic debate) নিয়ে লেখা এই চিঠি। সেই বিতর্কে একপক্ষের মতে প্রথমত, ‘অনেকেই মনে করতেন যে
কেবলমাত্র যুদ্ধের সময়েই একজন শাসক নিয়োগ করা উচিত। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে, শান্তি ও
নিরাপত্তা ফিরে এলে শাসক ছাড়াও চলা সম্ভব।’ দ্বিতীয়ত, ‘কেউ কেউ মনে করেন যে,
শাসক-শাসিত নির্বিশেষে সকলকেই সমান চোখে দেখা উচিত।’ আবার বিরোধীপক্ষ একেবারে অনড়
অবস্থান থেকে শাসকের প্রয়োজনীয়তাকে আইনের শাসনের জন্য বাধ্যতামূলক হিসেবেই দেখেছিলেন।[64] এই চিঠিটা সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব
৭৩০-৭৪০ অব্দে সিরিয়ায় আরবীতে অনূদিত হয়[65] এবং এই যুক্তিরই পুনঃপ্রকাশ
ঘটে ইরানি সেক্রেটারি ইবনে আল-মুকাফ্ফার (d.c.7757) লেখনীতে। তার মতে, আল-আসাম এবং
হিশামের বহু আগেই এই চিঠিটা সম্পর্কে ইরাকে জানাশোনা ছিলো।[66] কিন্তু এই চিঠি তাদের জীবনে
কেমন প্রভাব ফেলে ছিলো তা বোঝা সম্ভব হয়নি। কারণ, কেবলমাত্র জরুরী অবস্থায় শাসক
নিয়োগের ধারণাটা গ্রীক এবং ইরাক উভয়ের কাছেই অপরিচিত ছিলো। আবার, ইরাকিরা ইমামকেও
একেবারে অপরিহার্য হিসেবে দেখেন নাই, কারণ, তারা সকল মানুষকে সমান চোখেই দেখতে
চাইতেন। গ্রীকদের
প্রকল্পের প্রভাব তাই একপ্রকার বাতিল করা যায়। বরং, আল-আসাম
এবং হিশামের চিন্তাধারায় তাদের প্রতিবেশী খারেজীয়দের সঙ্গে মেশামেশার প্রভাবই
মুখ্য ছিলো (খারেজীয়রা গ্রীকদের ওই চিঠি সম্পর্কে জানতো না)। মুতাজিলীয় এবং নাজদীয়
অরাজপন্থীরা তাই, নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, প্রাচীন ইসলামের বিভিন্ন গোত্রের
অপেক্ষাকৃত মুক্তিপরায়ণ রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার উপর ভিত্তি করেই তাদের রীতিনীতি গড়ে
তুলেছিলেন।
আরও বলা যায়, স্থানীয় ভাবনাচিন্তাগুলো কেবলমাত্র
প্রাচীন মুসলিমদের নীতি-নৈতিকতার ভিত্তি তৈরিতে কাজ করেছে, নিজেদের অধিকার অর্জনের
ভিত্তি হিসেবে নয়। সেসময় রাজনৈতিক ধীশক্তির জন্য আলাদা করে বাহবা দেওয়া হতো না, যা
আজকের সভ্য সমাজে হারিয়ে গেছে। এরও বহুকাল পরে, ১৪ শতকে ইরানের কোনো এক স্কুলপাঠ্য
থেকে জানা যায়, কেউ একজন যুক্তি দিচ্ছেন যে, মানুষের আসলে ইমামের প্রয়োজন নাই,
কারণ, বেদুঈনরা শাসক ছাড়াই সবকিছু সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে পারতেন।[67] কিন্তু, এই যুক্তিটা কবে,
কোত্থেকে এসেছে তা আর জানা সম্ভব হয়নি। হতে পারে এটা নাজদীয়দের থেকে আগত। কিন্তু,
মুতাজিলীদেয় কোনো পাঠ্যে বেদুঈনদের সম্বন্ধে কিছু পাওয়া যায়নি। এই সম্ভাবনা থেকেই
যায় যে, তারা হয়তো বেদুঈনদের রাষ্ট্রহীনতাকে ঈশ্বরের আইনের পরিপন্থী ভেবে
স্বৈরশাসনের মতোই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতেন। তারা আদতে কখনোই রাষ্ট্রহীনতার পক্ষে কোনো দৃঢ় উদাহরণ দেখান
নাই। আর, এটাই তাদের সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক। তারা আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়ার
কথা ভাবতেন না। তারা সকলেই নতুন নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সংগঠনের উপায় নিয়ে
ভাবতেন। এই কারণেই তাদের চিন্তাভাবনার কোনো কাল্পনিক অতীতের উদাহরণও পাওয়া যায় না।
তাই বলা যায়, তারা কেবল যুক্তির সাহায্যে দেখার চেষ্টা করতেন যে, যে কেউ আইনকানুন
এবং কিছু স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমেই স্বনির্ভর জীবনযাপন করতে পারে।
অধ্যায় ৮
ইসলামিক অরাজ বনাম পশ্চিমা
অরাজ
তর্কের খাতিরে বলা যায়, মুতাজিলীয় দর্শনগুলো আসলে
অরাজপন্থী কোনো দর্শন নয়। কারণ, সেগুলোর বেশীরভাগই শাসনব্যবস্থাকে একেবারে নির্মূলের
বদলে এক ধরণের শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে আরেক ধরণের শাসনব্যবস্থা প্রণয়নের কথা বলে। বেশীরভাগ
অরাজপন্থী দর্শনের বৈশিষ্ট্য হলো রাষ্ট্রের বিকল্প হিসেবে যা ভাবা হয় সেগুলো
অধিকাংশ সময়ই রাষ্ট্রের চেয়ে কম কর্তৃত্বপরায়ণ চরিত্রের হয় এবং বেশীরভাগই পুঙ্খানুপুঙ্গ
বিশ্লেষণধর্মী হয়। মুতাজিলীয় এবং পশ্চিমা অরাজের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো,
মুতাজিলীয়গণ কেবলমাত্র ইমামতির রাজনৈতিক বিকল্পের কথা বলেছেন, অপরদিকে পশ্চিমা
অরাজপন্থীগণ রাষ্ট্রবিহীন জীবনযাপনের জন্য সাধারণ সামাজিক সংহতি এবং জীবনকে একদম
সহজ করে যাপন করার কথা বলেছেন। পশ্চিমা অরাজপন্থীগণ প্রায় সমসময়ই সাম্যের ভিত্তিতে,
সাধারণত কমুনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গী থেকে (ট্যাবোরাইটদের মতো) রাজনৈতিক সংস্কারকে
সংজ্ঞায়িত করেছেন। তারা আর্থ-সামাজিক পুনঃসংগঠনের কথা বুঝিয়েছেন। প্রকৃতির রাজ্যে
কোনো শাসক এবং সম্পত্তির কোনো ব্যক্তিগত মালিকানা নাই। সিসেরো মারফত জানা যায়, প্রথম ধারণাটি দ্বিতীয় ধারণাটিকে রক্ষা করতে অর্থ্যাৎ,
শাসকের ধারণাটি ব্যক্তিগত মালিকানাকে রক্ষা করতেই উদ্ভুত হয়েছে। তাই উভয়কেই একসাথে
বিলোপ করতে হবে।[68] কিন্তু
মুতাজিলীয় অরাজপন্থীগণ সামাজিক সংগঠনের পুনঃপ্রতিষ্ঠাকে কখনো আমলেই নেন নাই। তারা সাম্যবাদ
অথবা কমুনিজমের ধারণার অনুসারীও ছিলেন না।
তবে মুতাজিলীয় সাধকগণ শাসক এবং সম্পত্তির মাঝের
সম্পর্কটির একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তবে, তাদের বক্তব্যের মানে এই নয় যে, শাসক
এবং সম্পত্তি দুটোই অগ্রহযোগ্য। তবে
সেগুলো ইসলামিক আইনের উপর ভিত্তি করে না হলে অগ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে তারা
বেশীদিন স্থির ছিলেন না। তাদেরই একজন ঘোষণা করলেন যে, ইসলামের ঘর অবিশ্বাসীর ঘরে
পরিণত হয়েছে। অর্থ্যাৎ, সামাজিক জীবন আর নৈতিক ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে নাই।[69] অবৈধ শাসকদের শাসন সকল প্রকার
সম্পত্তিকে দূষিত করেছে। সত্যিকার ইমাম না আসা পর্যন্ত সকল মালিকানাই আসলে
দখলদারিত্বেরই ফলাফল। তাই, বেচাকেনাসহ যেকোনো উপায়ে জীবিকা অর্জনই বর্জনকরলেন
তারা। কেবলমাত্র চরম প্রয়োজনে
ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত উচ্ছিষ্ট ছাড়া সকল উপার্জনকেই পাপাচারপূর্ণ ঘোষণা
করা হলো (এখানে তারা জমিজমা থেকে কিভাবে জীবিকা নির্বাহ করতেন বলা হয়নি, স্পষ্টই
বোঝা যায় তারা ছিলেন শহরবাসী)।[70] তবে, যদি
রাষ্ট্রপ্রধান বৈধ হতেন তাহলে সম্পত্তি এবং উপার্জনও বৈধ হতো।
মুতাজিলীয়গণ যেভাবে সম্পত্তি এবং রাজনৈতিক
সমস্যাগুলোর মধ্যকার সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করেছিলেন, তাতে মনে হয়, তারা ভাবতেন অবৈধ
শাসক সম্পত্তিকেও অনৈতিক করে ফেলে। ভাবনাটা এরকম নয় যে, সম্পত্তির ধারণা নিজেই
অবৈধ শাসকের জন্ম দেয়। সাম্য সমাজ খেলাফতি স্বৈরশাসনের উৎস – তাদের এই ধারণার
মর্মোদ্ধার করলে জানা যায়, তারা সকলেই একে একটি বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবেই দেখতেন।
তাদের মতে, সমাজ তখনই সুন্দর হয়ে উঠবে যখন সমাজকে তার গতিতে চলতে দেওয়া হবে,
আইনকানুন প্রয়োগের ভার যখন দেশপ্রেমিক স্থানীয় নেতৃবৃন্দের হাতে থাকবে। তাদের
অরাজপন্থা কেবলমাত্র রাষ্ট্রপ্রধানকে এবং পরোক্ষভাবে তার সৈন্যসামন্তদেরও এড়িয়ে
চলার চিন্তায় সীমাবদ্ধ ছিলো। কেন্দ্রীয় সরকারব্যবস্থার বদলে আন্তঃপ্রদেশ ফেডারেশনভিত্তিক
ইমামতি বা স্থানীয়ভাবে নির্দিষ্ট সময়সীমার জন্য ইমাম নির্বাচনের ব্যবস্থা বা
কার্যনির্বাহী কমিটি তৈরি করা বা স্রেফ গোত্রপ্রধানদের নির্দেশে চলা কিংবা আত্মনির্ভরশীল
হয়ে চলা – এসবই ছিলো তাদের বিকল্প চিন্তা। কিন্তু, তাদের কেউই অরাজপন্থীদের মতো
রাষ্ট্রের মূলভিত্তির সমালোচনা করেননি। তারা জালিম শাসকের অস্তিত্বের কারণ নিয়ে
চিন্তা করেননি বরং, তার বিন্যাস নিয়েই চিন্তা করেছেন।
৯ শতকের খেলাফতি শাসনব্যবস্থার বিন্যাস সত্যিই
খুব ভারসাম্যহীন ছিলো। আব্বসীয়দের পূর্ব ইরান থেকে সৈনিক ও রাজ্যপাল নিয়োগ আর ইরাক
থেকে আমলা নিয়োগের দিকে ঝোঁক ছিলো। অন্য অঞ্চলের কোনো ব্যক্তি স্থানীয়ভাবে যতোই প্রভাশালী, ধনী এবং জ্ঞানী হোন না কেন তারা
উক্ত প্রশাসনিক পদগুলো থেকে বঞ্চিত হতেন। ৯ শতকের পরে মুসলিম সমাজকে কেন্দ্রীয়
সরকারের শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণে অনুৎসাহিত কারর জন্য যখন তুর্কিদের দাস হিসেবে
আমদানী করে সৈনিক এবং সরকারি চাকর হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হলো, তখন পরিস্থিতি
আরও খারাপ হয়ে গেলো।[71] আল-আসাম যখন লিখছেন তখনও এসব
ঘটেনি কিন্তু তখন সবে এসবের উপসর্গ দেখা দিয়েছিল। আর তার ফেডারেশন তৈরির ধারণাটিও
স্পষ্টত এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই লেখা। তিনি আরও বেশী স্থানীয় অংশগ্রহণ চেয়েছিলেন। অন্যান্য
মুতাজিলীয় অরাজপন্থীদের বেলায়ও এই একই কথা প্রযোজ্য।
অধ্যায় ৯
অরাজপন্থার চর্চা
কিভাবে রাষ্ট্রকে এড়িয়ে চলা যেতে পারে সে কথা
মুতাজিলীয়দের কেউই বলেন নাই। ডওসনের
(Dawson) ভাষায় প্রায় সকলেই লক্ষণীয়ভাবে কেবল “নিম্নস্তরের ইউটোপিয়া” রচনা করেছেন।
অর্থ্যাৎ, তাদের মৌলিক সংস্কারের কার্যক্রমের লক্ষ্য ছিলো, যতোটা পারা যায়
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা। তবুও তারমধ্যেই তাদের কার্যক্রম তৎকালীন প্রতিষ্ঠানগুলোর
সমালোচনা করতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল।[72] যেহেতু তারা সকলেই রাজনৈতিক
অভিজ্ঞতাশুন্য ছিলেন, তাই তারা এর ব্যবহার্যতার ভার অন্যদের উপরেই ন্যস্ত
করেছিলেন। আমরা এইসব অরাজপন্থীদের সামাজিক মর্যাদা অথবা আয়ের উৎস সম্পর্কে কিছুই
জানতে পারিনি। কিন্তু, তাদের বেশীরভাগই লক্ষ্যণীয়ভাবে অবৈধ বা উৎপীড়ক রাষ্ট্রপ্রদত্ত
সুযোগসুবিধা ভোগ করে সুখেই ছিলেন। হিশাম আল-ফুয়াতি সম্ভবত একজন ধনী ব্যবসায়ী
ছিলেন। শোনা যায়, তিনি নাকি বিচার-সালিশও করতেন।[73] শুধুমাত্র মুতাজিলীয় সাধক
সম্প্রদায়ই শাসক এবং জীবনযাপনের স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্য থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেন।
কিন্তু, তাদের এই বর্জনের চেতনা রাজনৈতিক সংস্কারবোধের চেয়ে আধ্যাত্মবাদ বা মুতাজিলীয়
সুফিবাদকেই ঘিরেই সীমাবদ্ধ ছিলো। বৈধ বা অবৈধ – কোনোপ্রকার বিদ্রোহে ইন্ধন দিতে তাদের কেউই আগ্রহ
দেখান নাই। এবং, আল-আসামও এসবকে নেতিবাচক দৃষ্টিতেই বাতিল করেছিলেন।[74]
তবুও একটা সুযোগ শেষপর্যন্ত এসেছিল। ৮১৭ সালে
বাগদাদের সরকারব্যবস্থা আপনাআপনিই ভেঙে পড়ে। নতুন খলিফা আল-মামুনের অনুপস্থিতিতে
গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তার রাজ্যপালেরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারেননি।[75] এর ফল হলো ভয়াবহ নৈরাজ্য, যার
সুযোগে জনৈক সাহাল ইবনে সালামা (Sahl ibn Salama) একটি জনপ্রিয় রক্ষীবাহিনী (vigilante
group) গড়ে তোলেন। এই বাহিনী সেই সময়ে খুবই কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল।
ইনি সম্ভবত বাগদাদের কোনো মুতাজিলীয় অরাজপন্থী ঘরানার লোক ছিলেন।[76] তার সংক্ষিপ্ত কার্যক্রম
অরাজপন্থীদের মনে অনিবার্যভাবে এক গভীর দাগ কেটেছিলো। আল-জাহিজ তাদের ব্যাপারে
বলেছেন, ‘যখন সরকারের পতন হলো এবং দুর্বৃত্তরা ক্ষমতা দখল করে নিলো.....আমরা
দেখলাম ন্যায়পরায়ণ মানুষের ছোট্ট একটা দল বিদ্রোহ করে বসলো। দুর্বলেরা যাতে আবারো
স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারে সেই লক্ষ্যে তারা ঘরে বাইরে, রাস্তাঘাট, সব অঞ্চল থেকে
দুর্বৃত্তদের প্রতিরোধ করতে দাঁড়িয়ে গেলেন।’[77] এটা বিকেন্দ্রীকরণেরই ফল। অরাজপন্থীরা বলে থাকেন, মানুষ
যখন স্বনির্ভর হতে বাধ্য হয় তখনই তারা তাদের ভিতর লুকিয়ে থাকা প্রতিভা আবিষ্কার
করতে পারে। মানুষের তাই জেগে উঠতে হবে, নয়তো সেই পুরোনো শাসক শক্তি সঞ্চয় করে
আবারো স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠবে।[78] সত্য-সত্যই সেই শাসক আবারো
শক্তি সঞ্চয় করেছিল আর বিদ্রোহেরও অবসান হয়েছিল।
অধ্যায় ১০
নাজদীয়গণ
এবারে আমরা নাজদীয়দের প্রসঙ্গে আসি। তাদের বরং
আরও সংক্ষিপ্তভাবে পর্যালোচনা করা সম্ভব।[79] প্রায় সুনিশ্চিতভাবে বলা যায়
নাজদীয়গণই ইমামতিকে সর্বপ্রথম অস্বীকার করেছিলেন। এর পেছনে যুক্তি হলো, তারা
বিদ্রোহকে একান্ত কর্তব্য হিসেবে দেখতে চাইতেন। জাতিগতভাবে তারা ছিলেন
সক্রিয়তাবাদী। অবৈধ খলিফার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সত্যিকার ইমাম নিয়োগ করতে হবে - এই
ছিলো তাদের বক্তব্য। এমনকি তারা সাত শতকের গোড়ার দিকে বিদ্রোহও করেছিলেন, যদিও
তাদের সেই বিদ্রোহকে দমন করা হয়েছিল। ফলে, তাদের মতবাদকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা অথবা সংশোধন করা ছাড়া আর
কোনো উপায় ছিলো না।[80] আমরা জানিনা ঠিক কোন সময়টায়,
কিন্তু, তারা শেষপর্যন্ত সংশোধনকেই বেছে নিয়েছিলেন। ইমামতির বিরুদ্ধে তাদের
অবস্থান ৯ শতকের পূর্ব পর্যন্ত লিখিত হয়নি।[81] কিন্তু, এর চর্চার পরিষ্কার
প্রমান পাওয়া গেছে। আইন যদি ইমামব্যবস্থাকে অনুমোদন না দিতো তাহলে বিদ্রোহের
প্রশ্নই আসতো না। ফলে, যে কেউ সত্যিকার ইমামতি প্রতিষ্ঠা না করে খারেজীয়দের মতো
বিনাবাক্যব্যয়ে চলতে পারতো, অবৈধ আব্বাসীয় খলিফাদের অধীনে দাসত্বের ঝুঁকি না নিয়েই
জীবন কাটিয়ে দিতে পারত।
কিন্তু, নাজদীয়গণ অতিদ্রুতই ইমামতির
প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করার কারণ আবিষ্কার করেছিলেন। তারা চান নাই কোনো ইমাম
তাদের উপর আইনকানুন চাপিয়ে দিক। আমাদের জানামতে এটাই তাদের যুক্তির দ্বিতীয়
ভিত্তি। মুতাজিলীয় অরাজপন্থীগণ শুধুমাত্র মনে করতেন যে, ইমামতি আর কোনোমতেই
চালানোর উপযোগী নয়। তাদের মতো নাজদীয়গণও এর অস্তিত্ব অস্বীকার করতেন। ইমাম হলেন সেই ব্যক্তি যার
উপর সকলেরই আস্থা আছে। কিন্তু তাদের মতে, পরিপূর্ণ আস্থা অর্জন যেহেতু তত্ত্বীয়ভাবেই
অসম্ভব তাই ব্যবহারিক দিক দিয়েও এটা অসম্ভব। আমরা সকলেই জানি, এমনকি প্রথম খলিফা
আবু বকরকেও (Abu Bakr) প্রতিপক্ষের
মোকাবেলা করতে হয়েছিলো। তিনি যদি ইমাম না হতেন তাহলে তিনি অবশ্যই একজন ভালো মানুষ
হিসেবেই বিবেচিত হতেন। তারা তাকে একজন নেতার (rais) দেখতেন। আর, এর থেকে তারা অনুমান করেন যে, ইমামতির বাধ্যতামূলক
চরিত্রটি আসলে অতিকথন ছাড়া আর কিছু নয়।[82]
ইমামতির ধারণাকে অস্বীকার করে তারা বললেন এটা আদৌ
ইসলামি শাসনব্যবস্থার একমাত্র উপায় নয়। এর ফলে নিজেদেরকে অরাজপন্থী বলে দাবী করার
সুযোগ আর রইলো না। কারণ, সঠিকভাবে পরিচালিত সর্দারি (chieftainship) তখনও তাদের কাছে একটি গ্রহণযোগ্য উপায়
হিসেবেই স্বীকৃত ছিলো। রাজনৈতিক সরকারব্যবস্থার প্রশ্নটি তাদের কখনো সেভাবে আগ্রহ
জাগায়নি। কারণ, ইমাম হিসেবে কাউকে স্বীকৃতি দেওয়া হোক বা না হোক, বিদ্রোহের পরেও তাদের
নিজেদের জন্য শাসকের প্রয়োজন বোধ করতেন। তাদের মতে, যদি কেউ নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ্য
হয়, তাহলে তাদের একজন শাসকও লাগবে, যদিও সেটা বাধ্যতামূলক নয়। তারা আরও বলেন যে,
সম্প্রদায়ের মাধ্যমেই এই শাসককে নির্বাচন, তত্ত্বাবধান এমনকি বিপথগামীতার সাপেক্ষে
ক্ষমতাচ্যুতও করা যেতে পারে। তিনি শুধুমাত্র সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবেই
দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু, ইমাম সম্পর্কে আদর্শ খারেজীয় মতাদর্শটিও এর সঙ্গে
সাদৃশ্যপূর্ণ (একে নাজদীয়গণও তাদের ‘সঠিকভাবে পরিচালিত নেতার’ ধারণার ক্ষেত্রে
কখনো কখনো ব্যবহার করতেন)।
ধর্মীয় দিক বিবেচনায় ইমামতির প্রতি তাদের যে অনাস্থা
দেখা যায় তা অবশ্যই অরাজপন্থী ধারা থেকেই উৎসারিত হয়েছিল। যদি শাসক হিসেবে কাউকে
রাখতেই হয়, তবুও তাকে তারা একজন নির্দেশক হিসেবেই মেনে নিতেন, ইমাম হিসেবে নয়। এর
অর্থ হলো, ধর্মীয় ক্ষেত্রে তিনি কারও চেয়ে শক্তিশালী নন। বিশ্বাসী নির্বিশেষে
ইজতিহাদ তত্ত্ব অর্থ্যাৎ উন্মুক্ত যুক্তির ভিত্তিতে আইনকানুন সংক্রান্ত মতামত
দেওয়ার সবাই সমান অধিকারী। বিশ্বাসীগণ যেন ‘চিরুনীর দাঁতের মতো’ অথবা ‘কোনো মাদী
উটবিহীন একশ মর্দ উটের সারির মতো।’ তারা কেন তাদের মতোই আরও একজনের চলার পথে বাধা হয়ে
দাঁড়াবে? যেহেতু ইমামতি প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট স্বাধীন সায় কখনোই অর্জন সম্ভব নয়,
তাই কখনো আইনকানুন প্রতিষ্ঠা করতেও যথেষ্ট স্বাধীন সায় অর্জন সম্ভব নয়। ইজমা (ijma) কখনোই আইনের
কোনো উৎস ছিলো না। ইবাদতের রাস্তায় প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ কাজের জন্য দায়ী।
নাজদীয় ইসলাম তাই নিজে পালন করার ইসলাম। রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিকভাবে একজন নাজদীয়ের
আল্লাহ ব্যতীত কোনো প্রভু থাকা চলবে না।
একে সহজাত মুক্তিপরায়নতা বলা যেতে পারে এবং এটা
যথেষ্ট মূল্যের বিনিময়ে অর্জন করতে হয়েছিল। নাজদীয়গণ কেবলমাত্র নিজেদেরকেই মুসলিম
হিসেবে বিবেচনা করতেন। অন্যান্যরা হলেন অবিশ্বাসী। যদি তারা শেষমেষ বিদ্রোহ করতে
রাজি না হয় তাহলে তাদের দখল করা, বন্দী করা এবং নির্মূল করাও নাজদীয়দের কর্তব্য।[83] বাস্তবে কিন্তু নাজদীয়গণ
তাদের তথাকথিত অবিশ্বাসী প্রতিবেশী গোত্রের সঙ্গে মিলেমিশেই থেকেছেন। কিন্তু তারা
তাদেরকে বহিরাগত হিসেবেই বিবেচনা করতেন। এর অর্থ হলো, তারা তাদেরকে নিজেদের
রাজনৈতিক চেতনার অংশীদার মনে করতেন না। তারা এমন সম্প্রদায়ের কথা বলে গেছেন যার পরিসর
আসলে ছোট্ট, যেখানে একজনের সঙ্গে অপরজনের ভালো জানাশোনা থাকবে। এতে সর্বোচ্চ
ঐক্যমত্য অর্জন সম্ভব হবে, ফলে, সর্বোচ্চ স্বাধীনতাও নিশ্চিত হবে। আর তারা
মুক্তিপরায়ণ রাজনীতির কথা এভাবে চিন্তা করতে পারতেন কারণ, তাদের নিজেদের কোনো
রাষ্ট্র ছিলো না। তাই, ভারত ও স্পেন পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল মুসলিম সাম্রাজ্যকে
কিভাবে ঐক্যবদ্ধ রাখা যায় সেই সমস্যার সমাধানে নাজদীয়দের দর্শন একেবারেই কার্যকর
কিছু ছিলো না।
অধ্যায় ১১
উপসংহার
এরিস্টটলের গ্রীক এবং প্রাচীন মুসলমানরা একই মাপকাঠিতে
এককথায় বলা যায়, রাজনৈতিক জীব ছিলেন। কারণ, উভয় জাতিই ভাবতেন, মানুষের জীবনের
সর্বোচ্চ স্বরূপ রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত সমাজের কার্যাবলীতে অংশগ্রহণের মাঝেই নিহিত
আছে। গ্রীকদের ক্ষেত্রে এটা হলো নগর-রাষ্ট্র (polis) আর মুসলমানদের ক্ষেত্রে হলো উম্মাহ (umma: মুহাম্মদের
প্রতিষ্ঠিত সম্প্রদায়)। গ্রীকদের মতে যেমন নগর-রাষ্ট্র
হলো একমাত্র সংগঠন যেখানে মানুষ স্বাধীন হয়ে উঠতে পারে, অনুরূপভাবে মুসলমানদের মতে
ইসলামের নবীর প্রতিষ্ঠিত সম্প্রদায়ই একমাত্র সংগঠন যেখানে মানুষ কেবল ঈশ্বরের দাস
হিসেবে বিবেচিত হয়, অর্থ্যাৎ, ইহকাল বা পরকাল সবখানেই একজন মানুষের অধীনতা থেকে
অপর মানুষ মুক্ত। উভয়ক্ষেত্রেই বিশ্ব বিজয়ের মাধ্যমে এই ধারণার অবলুপ্তি ঘটে। আলেক্সাজান্ডার
নগর-রাষ্ট্র গঠন করতে গিয়ে যা করেছিলেন, মুসলিম বিজেতারাও মদীনায় সেইরকম কাজই
করলেন। ফলে, দেখা গেল মানুষকে আবার সেই সাম্রাজ্যের অধীনেই বসবাস করতে হচ্ছে। নগর-রাষ্ট্রের সত্যিকার ধারণা
অবশ্য শুধুমাত্র আলেকজান্ডারের রাজ্যেই টিকেই ছিলো, তেমনিভাবে উম্মাহও মুসলিম
সাম্রাজ্যের মধ্যে টিকে ছিলো। কিন্তু, মানুষ যা ভেবে এসবের মধ্যে জীবনের অর্থ
খুঁজে পেয়েছিল তা আর সেরকম রইলো না। তখন সত্যিকার রাজনীতি বলতে আসলে সাম্রাজ্যবাদকেই
বুঝানো হতো এবং গ্রীক এবং মুসলিম উভয়েই শেষপর্যন্ত তারই দাসত্ব বরণ করে নিলো। তাই
তখন স্বাধীনতার আসল অর্থ দাঁড়ালো রাজনীতিকে অতিক্রম করে অন্যকোথাও জীবনের অর্থের
অনুসন্ধান করা।
এটাই অরাজপন্থীদের চূড়ান্ত ইতিহাস এবং এটাই তাদের
বিলুপ্তির অন্যতম কারণ। মুতাজিলীয়গণ রাজনীতিকে অতিক্রম করতে পারেননি। সিনিক (Cynics) এবং স্টোয়িকদের মতো তারাও বলতে পারেননি যে, সরকারের প্রতি মানুষের
দৃষ্টিভঙ্গীকে পরিবর্তন করা উচিত এবং নিখিল বিশ্বের চূড়ান্ত আইনের প্রেক্ষিতে এর
অপ্রয়োজনীয়তাকেও বোঝা উচিত।[84] কেবলমাত্র সুফীগণ এইরকম কথা
বলতেন। মানুষের উচিত সরকার পরিবর্তন করা - মুতাজিলীয়গণ এই কথাই বলতেন। আল-আসাম এবং
তার শিষ্যগণ ইমামতির সঙ্গে আপোষ করে হলেও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ফিরে পাবার আকাঙ্খায়
ছিলেন। নাজদীয়গণ
ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও তাদের বৌদ্ধিক সায়ত্তশাসন চাইতেন। উভয়েই ছিলেন পশ্চাৎমুখী
চিন্তাধারার অনুসারী।
মুতাজিলীয়গণ একদম সঠিকভাবেই অনুধাবন করেছিলেন যে,
ইমামতি আর মদীনার মতো করে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আল-আসামও রাজনৈতিক
বিকেন্দ্রীকরণের চিন্তায় একেবারে সঠিক ছিলেন। তার ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ীই ৯ শতকের
শেষের দিকে খেলাফত ভেঙে কিছু আধা-স্বাধীন শাসকের উদ্ভব হয়। অবশ্য তা পুরোপুরি তার
অনুমিত উপায়ে হয়নি। এই আধা-স্বাধীন শাসকেরা ছিলেন সামরিক নেতা। আল-জাহিজের
পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করতেন। এগুলো আল-আসাম যে খেলাফতকে
প্রতিস্থাপন করতে চাইতেন সেই খেলাফতেরই একেকটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংস্করণ বৈ কিছু নয়। ১০ শতকের মধ্যেই এই
শাসকেরা নিজেদের আনুষ্ঠানিকভাবে রাজা ঘোষনা করে বসলেন। ১২ শতকের সকল ইতিহাস জানান
দেয় যে, রাজা অবশ্যই দাসত্বের বলয় থেকে প্রজারা যাতে বের হয়ে না যায় তা নিশ্চিত
করবেন।[85] অরাজপন্থীরা ততোদিনে হয়তো
পুরোপুরি নির্মূল হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু, এরপরেও তাদের কেউ এই ব্যবস্থার সাথেই তাল
মিলিয়ে চলেছিলেন নাকি একেও অতিক্রম করতে চেয়েছিলেন তা জানা নাই, তবে অরাজপন্থার
মৃত্যু হয়েছিল তা নিশ্চিত। অন্তত ইসলামী দুনিয়ায় মুতাজিলীয় এবং নাজদীয়
অরাজপন্থীদের পতনের পরে কেউ রাজার অধীনে জীবনযাপনকে অস্বীকার করার চেষ্টা করেছিলেন
এমন সুস্পষ্ট কোনো প্রমান এখন পর্যন্ত আমি খুঁজে পাইনি।
প্যাট্রিসিয়া ক্রোন
ইন্সটিটিউট ফর এডভান্সড স্টাডি,
প্রিন্সটন
[1] See, most recently, Aziz Al-Azmeh, Muslim Kingship (London, 1997), 115, voicing the Islamicist consensus; Peter Marshall, Demanding the Impossible: A History of Anarchism (London, 1993), 86, where Mazdakand' Al-Qurramitta' (i.e. theQaramita) are the nearest we get to forerunners of anarchism in the Middle East, both on grounds of communism.
[2] Nashi'
(attrib.), in Fruhe mu'tazilitische Haresiographie, ed.
Josef van Ess (Beirut, 1971)
(hereafter Ps.-Nashi'), §82; trans. In Josef van Ess, Theologie und
Gesellschaft im2.
Und 3. Jahrhundert Hidschra, 6 vols. (Berlin, 1991-7) (hereafter TG), v, 329. For the authorship, see W.
Madelung, 'Fruhe mu'tazilitische Haresiographie. Das Kitab al-Usul des Ga'farb.
Harb?’, Der Islam, lvii(1980). His proposal has been generally accepted.
[3] Van
Ess, TG, ii, 408 ff.; J. van Ess, 'Une lecture a rebours de l'histoire du
Mu'tazilisme', Revue des etudes islamiques, xlvii (1979), 21ff.; J.van Ess,
'Al-Asamm', in Encyclopaedia of Islam, 2nd edn (Leiden,1960- ) (hereafter
Encycl. Islam 2), suppl.
[7] →
P. Crone, 'A Statement by the Najdiyya Kharijites on the Dispensability of the
Imamate', Studia Islamica, lxxxviii (1998).
[8] Al-Jawabat fi
'l-imama',in his Rasa'il, ed. 'Abd al-Sallam Muhammad Harun, 4 vols. (Cairo,
1964-79), iv, 285ff.; cf. C. Pellat,'L'Imamat dans la doctrine de Gahiz', Studia
Islamica, xv (1961), 38ff. (based on Sandubi's edition, where it forms part of K.
wujub al-imama). There is also a reference to anarchists in al-Jahiz, al Hayawan,
ed. 'Abd al-Sallam Muhammad Harun, 8 vols. (Cairo, 1938-45), i, 12 (trans.in Pellat,
'Imamat', 38). Pellat, who actually uses the term 'anarchists', took them to be
Zaydis,which is not entirely wrong; cf. below, n.38
[9] Cf. van Ess,
TG, ii, 409 n. 2. Like al-Asamm, they held it equally lawful to have
one imam, none or several.
one imam, none or several.
[11] Cf.
Marshall, Demanding the Impossible, 91 ff. At a less popular level, see N.
Cohn, The Pursuit of the Millennium (London, 1970), 214 ff., on the Taborites;
and G. Woodcock, Anarchism (Cleveland, Ohio, 1962), ch.2, where the family tree
of anarchism is severely pruned.
[12] Thus the
contributors to the Jl Chinese Phil., x (1983), entirely devoted to that
question. For a good discussion, see A. C. Graham, Disputers of the Tao
(Chicago, 1989), 170 ff., 299 ff. (drawn to my attention by Michael Cook).
[13] একই
কথা বহু বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, নস্টিক এবং সাধকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, যারা
রাষ্ট্রহীনতার চেয়ে রাষ্ট্রকে এড়িয়ে চলার বা অতিক্রম করার চেষ্টা করতেন।
[14] People were assumed originally to have lived as scattered individuals devoid of any social or political organization – thus Democritus (c.460 BC); cf. W. K. C. Guthrie, A History of Greek Philosophy, 4 vols. (Cambridge,1962-81), ii, 473- or as scattered households ruled by patriarchs, like Homer's Cyclopes (Plato, Laws, iii, 680; Aristotle, Politics, i, 1252b). Either way, they gradually came together as a polis. There are
many variations on the theme in Plato's works (not to mention later writings, in which people sometimes
start by leading a herdlike existence; cf. T. Cole, Democritus and the Sources of Greek
Anthropology (Cleveland,Ohio,1967),80,83); but the primitive polls constructed
by Plato in his Republic, 369 ff., is not a stateless society: what we are asked to think away is
luxury, not governmental institutions.
[15] Thus the
lost Republics of Zeno (d. 263BC) and Chrysippus (d. 207BC); cf. D.
Dawson, Cities of the Gods: Communist Utopias in Greek Thought (NewYork,1992),
166 ff., where the sources are quoted in full (this is in general an
illuminating book)
[16] Differently
A. Erskine, The Hellenistic Stoa: Political Thought and Action (Ithaca, NY,
1990), ch.1, esp. p. 29. Here, as in Malcolm Schofield, The Stoic Idea of the
City (Cambridge, 1991) and Dawson, Cities of the Gods, ch.4, the Stoic vision
is accepted as a genuine utopia; but see below, n.84.
[17] Thus
Panaetius (d. 109 BC) as reflected in Cicero, De Officiis (but see Dawson, Cities of the
Gods, 228-9, according to whom Panaetius did not idealize the early period);
and Posidoni us (d. c.50BC) as reconstructed from Seneca (d. AD 64) and
other sources (G. Rudberg, Forschungenzu Poseidonios (Uppsala, 1918), 51
ff.).Rudberg conjectures (p. 64) that Posidonius saw warfare as going back to
the days of the sapientes with reference to Manilius (wrote c. AD 10),
Astronomica,i, 89; but it is difficult for an outsider to see why Maniliusis
assumed to have drawn on Posidonius here: history is one of straight forward
progress from ignorance to civilizaton, with kings and priests rather than
philosophers as culture heroes, and with nothing resembling the golden age
described by Seneca, who explicitly says that weapons were not used (Letter
90,41).
[18] Notably the
Institutes and Digest, with the result that twelfth-century lawyers would speak
of a natural state of liberty and communal ownership (cf. P. E. Sigmund,
Natural Law in Political Thought (Cambridge, 1971), 37-8).
[19] In the Greek
Church Fathers the Stoic tradition seems to lose its socio political content.
The interest is in inner man, the slavery which appears with the Fall is
metaphorical, and John Chrysostom (d. 405) stands out when he says that common
ownership is inaccordance with nature (Erskine, Hellenistic Stoa, 112). In
Nemesius of Emesa (before 400) the Fall is combined with sociopolitical
naturalism: the needs engendered by the Fall cause humans to congregate because
man is a sociable and political animal by nature, no one person being
self-sufficient (De Natura Hominis, ed. M. Morani (Leipzig, 1987), i, 52 = N.
Teller (trans.), Cyril of Jerusalem and Nemesius of Emesa (London, 1955), 243;
cf. Aristotle, Politics, i, 1253'; Schofield, Stoic Idea of the City, 71). That
man, though sociable by nature, was not originally meant to dominate other men,
only beasts, goes unmentioned (contrast Augustine (d. 430), City of God, xix,
15; cf. R. A. Markus, Saeculum: History and Society in the Theology of St
Augustine (Cambridge, 1970), app.B). Natural law is not a prominent concept in
the Syriac tradition, and it is not associated with freedom or equality (cf.
the attestations in S. Pines, 'La Loi naturelle et la societe: La doctrine
politico-theologique d'Ibn Zur'a, philosophe chretiende Baghdad', Scripta
Hierosolymitana, ix; repr.in his Studies in the History of Arabic Philosophy,
ed. S. Stroumsa (Jerusalem,1996),
159 ff.).
159 ff.).
[20] Sexual
communism does not appear in any version of the golden age myth, Stoic or
Christian. When Lactantius (d. c.320) argues against it , he is taking issue
with Plato (The Divine Institutes, iii, 21; trans. M. F. McDonald
(Washington,1964); Lactantius did not like communism in respect of property
either, cf. v, 5, where he dismisses the absence of private property in the
golden age as a poetic figure, though the golden age itself' is not poetic
fiction, but truth')
[21] For
innumerable attestations of this idea, see R. W. Carlyle and A. J. Carlyle, A History of
Medieval Political Thought in the West, 6 vols. (London,1903-36), esp. vols. i
and iii, where the sources are often quoted at length; for a systematic survey
and discussion, see W. Sturner, Peccatum und Potestas. Der Sindenfall und die
Entstehung der herrscherlichen Gewalt immittelalterlichen Staatsdenken
(Sigmaringen, 1987).
[22] Philippe
Buc, L'Ambiguite du livre: Prince, pouvoir, et people dans les commentaires de
la Bibleau Moyen Age (Paris, 1994) (I am indebted to Amy Remensnyder for
drawing my attention to this work).That the introduction of Aristotelian
thought marked less of a break than used to be believed is also the message of
C. J. Nederman, 'Nature, Sin and the Origins of Society: The Ciceronian
Tradition in Medieval Political
Thought', Jl Hist. Ideas, xlix (1988); but the political naturalism postulated for early medieval Europe here mostly seems to be social.
Thought', Jl Hist. Ideas, xlix (1988); but the political naturalism postulated for early medieval Europe here mostly seems to be social.
[24] Cf. F. E.
Manuel and F. P. Manuel, Utopian Thought in the Western World (Cambridge,
Mass., 1979), 737.
[26] For the
angelic wars against the jinn who occupied the earth before the creation of
Adam and a detailed account of the Fall, see al-Tabari, Ta'rikh al-rusul
wa'l-muluk, ed. M. J.de Goeje and others, 3rd ser.(Leiden,
1871-1901), i, 81 ff.= The History of al-Tabarl, 39 vols. (Albany, NY,
1989-98), i, trans. Franz Rosenthal, 252 ff. Muslim views on Paradise and the
significance of the Fall for human history still await a monograph.
[27] Things went
wrong as soon as the Prophet died, or whenthe third caliph took power, or six
years into his reign, or when he was killed and the first civil war broke out
in 656.
[28] Practically
all sources on the Prophet and the Rashidun,'the rightly guided caliphs', in
Medina are written along these lines, but the subjects till has not found its
Carlyles.
[30] Cf.
Herodotus, History, 3, 88; Diodorus Siculus, Library of History, ii, 1,5-6; ii,
48,4; xix, 94, 2 ff. For the proclivity of the Greeks and Romans to cast
tribesmen as people who preserved virtues that they themselves had lost, with
the Scythians as star performers, see A. O. Lovejoy and G. Boas, Primitivism
and Related Ideas in Antiquity (Baltimore, 1955).
[31] Again, there
is no monograph. For some examples, see 'Amr b. Kulthum, Mu'allaqa, verse25;
'Abid b. al-Abras, in C. Lyall (ed. And trans.), The Diwans of 'Abid Ibn
al-Abras, ofAsad, and 'Amir Ibn at-Tufail, of 'Amir IbnS a'sa'ah (London,
1913),4, 14
[33] Thus
Ps.-Nashi', §108; similarly al-Ash'ari, Maqalatal-islamiyyzn,ed. H.
Ritter (Istanbul,1929-33), 451 (in the context of evil doers in general rather
than rulers in particular). Compare also M. Cook's monograph on al-amr
bi'l-ma'ruf wa'l-nahy'an al-munkar provisionally entitled The Voice of Honest
Indignation (Cambridge, forthcoming), 34 ch.9.
[34] Ash'ari in
the preceding note; W. M. Watt, The Formative Period of Islamic Thought
(Edinburgh, 1973), ch.1; P. Crone and F. W. Zimmermann, The Epistle of Salim b.
Dhakwan (Oxford, 2000), ch.5, all in the context of evildoers in general rather
than rulers in particular.
[35] Cf. B.
Lewis, 'On the Quietist and Activist Traditions in Islamic Political Writings',
Bull. School of Oriental and African Studies, xlix (1986).
[36] e.g. al-Hasan
al-Basri (d. 728), in Ibn Sa'd, Kitab al-tabaqatal-kabir, ed. E. Sachau et al.,
8 vols. (Leiden, 1904-21), vii,1, 119.
[38] This is
implied by the behavior of Sahl ibn Salama, assuming that he was an anarchist:
he ended up by offering the imamate to an 'Alid (Crone,' Statement by the
Najdiyya', 74; cf. below, n.76 on Sahl). Compare also the fact that many
Baghdad Mu'tazilites were Zaydis, and compare the Shi'ite tone in the account
of the sufiyyat al-mu'tazila in Ash'ari, Maqalat, 467 = van Ess, TG, v, 330.
[39] Ash'ari,
Maqalat, 460, 6; al-Baghdadi, Usul al-din (Istanbul, 1928), 287, 5 = van Ess,
TG, v, 203, with discussion at ii, 408-9.
[40] Ps.-Nashi',
§§99-102 = van Ess, TG, v, 204-5, where the true caliphs include Mu'awiya, but
not 'Ali. That he saw size as the problem is suggested by his proposal to have
several imams (below, n.60).
[41] There may be
a reference to a future imam in the report that he rejected armed combat
against evildoers except under the leadership of a just imam (Ash'ar1, Maqalat,
451, 12). This could be construed as a legitimation of revolt against unjust
rulers under the leadership of a just one to appear in the future (thus van
Ess's translation in TG, v, 207, no.31). But it may also have been meant to
endorse the forcible
suppression of rebels by imams in the past while ruling out armed self-help in the present (cf.Ash'ari, Maqalat, 278 = van Ess, TG, v, 198, no. 13; he wrote against those ‘who believe in the sword': van Ess, TG, ii, 409). Either way, it seems to contradict this view of the imam as a person governing by consensus, but he clearly did not envisage consensus as unanimity (pace al-Shahrastani, al-Milalwa'l-nihal, ed. W. Cureton (London, 1846), 51 = Livre des religions et des sectes, trans. J. Jolivet and G. Monnot (n.p., 1986-93), 251), for he can hardly have denied that there was opposition to Mu'awiya (661-80), whose imamate he accepted (see n.40).
suppression of rebels by imams in the past while ruling out armed self-help in the present (cf.Ash'ari, Maqalat, 278 = van Ess, TG, v, 198, no. 13; he wrote against those ‘who believe in the sword': van Ess, TG, ii, 409). Either way, it seems to contradict this view of the imam as a person governing by consensus, but he clearly did not envisage consensus as unanimity (pace al-Shahrastani, al-Milalwa'l-nihal, ed. W. Cureton (London, 1846), 51 = Livre des religions et des sectes, trans. J. Jolivet and G. Monnot (n.p., 1986-93), 251), for he can hardly have denied that there was opposition to Mu'awiya (661-80), whose imamate he accepted (see n.40).
[42] He rejected
the imamate of 'All (656-61), unlike that of Mu'awiya, on the grounds that
there had not been agreement on him (see n.40); and his presumed pupils held
that the imam could be an Arab or a non-Arab alike (Jahiz,'Jawabat',
Rasa'il,iv, 285).
[43] Al-Baghdadi,
al-Farq bayn a'l-firaq, ed. M. Badr (Cairo, 1910), 149-50 = van Ess, TG, vi,
234, no.39, with further references; similarly Ibn Hazm, in van Ess, TG, vi,
269, where the statement is attributed to 'Abbad ibn Sulayman. Compare
Baghdadi's formulation in his Usul, 271-2: when the members of the community
disobey and kill their imam,' it is not obligatory (lamyajib) for the righteous
people among them to setup an imam'.
[44] Ash'ari,
Maqalat, 459, 467 = van Ess, TG, vi, 269-70, nos. 106-7.In 'Abbad's opinion
'Ali was the last imam, and this will almost certainly have been Hisham's
opinion too. Hisham's claim that no imamate was possible when the community
sinned and killed its imam was not meant to imply that the imamate came to an
end with 'Uthman's death, asal-Baghdadi and others believed, inferring that
Hisham's intention
had been to denigrate 'Ali's position (cf. W. Madelung, Der Imam al-Qasim ibn Ibrahim und die Glaubenslehre der Zaiditen (Berlin, 1965), 42).
had been to denigrate 'Ali's position (cf. W. Madelung, Der Imam al-Qasim ibn Ibrahim und die Glaubenslehre der Zaiditen (Berlin, 1965), 42).
[46] Ash'ari,
Maqalat, 460, 9-10; Baghdadi, Usul, 271; Ibn Abi'1-Hadid, in van Ess, TG, v,
207, no.33, with further references; 'Abdal-Jabbarandal-Mas'udi, in Crone,
'Statement by the Najdiyya', nn.21-2; al-Shahrastani, Kitab nihayat al-iqdam fi
'ilm al-kalam,ed. (withsummarytrans.)A. Guillaume (London, 1934), 481; trans.
and discussed in Crone, 'Statement by the Najdiyya’.
[48] Ash'ari,
Maqalat, 459 = van Ess, TG, vi, 269-70, no. 106, presenting the doubts as
having arisen after the death of 'Ali, the last caliph he himself recognized as
legitimate.
[50] On huquq allah,
see
B. Johansen, 'Eigentum, Familie und Obrigkeit im hanafitischen Strafrecht', Die
Welt des Islams, new ser., xix (1979); B. Johansen, 'Sacred and Religious
Elementsin Hanafite Law', in E. Gellnerand J.-C.Vatin (eds.), Islam et
politique au Maghreb (Paris,1981), 289, 297 ff.
[51] 'Abd al-Jabbar
cites his shaykh as making that very point: the fact that amputation is prescribed
for theft in the Qur'an (5: 38) means that the imamate is obligatory by
explicit command (nass), for only the imam is authorized to carry it out (al-Mughnz, xx/1, ed.
'A.-H. Mahmud and S. Dunya (Cairo, n.d.), 41).
[52] Ps.-Nashi;
§85 (al-imam huwa alladhi yu'addibu 'I-ummawa-yu' arrifuha ma'alim diniha),
with reference to Mu'tazilites who believed the imamate to be obligatory. But
al-Asamm clearly saw the imam as a teacher too (see below, n.59).
[54] If somebody
apostatized from Islam without there being an imam to execute him, anyone able
to kill him without attracting attention to himself should do so (thus Hisham
al-Fuwati according to al-Khayyat, Kitab al-intisar, ed. and trans. A. N. Nader
(Beirut, 1957), 51 = 57 (inaccurate); van Ess, T G,vi, 233, no.38). Posterity
summarized this as a doctrine that it was lawful arbitrarily to assassinate
opponents and take their property (Khayyat, where this is rejected; further
sources in van Ess, TG; Ash'ari, Maqalat, 465, on 'Abbad ibn Sulayman= van Ess,
TG, vi, 270, no. 108). Since Hisham's formulation presupposes the presence of
some public authority from whom one must try to protect oneself in the
execution of one's duty, it is hardly surprising that posterity should have
taken him and his pupil to have endorsed assassination; but what Hisham and
'Abbad were saying was undoubtedly that people must practice 'enjoining right
and forbidding wrong' (al-amrbi'l-ma'ruf wa'l-nahy'an al-munkar), a duty
incumbent tone very believer, to the point of taking over the hudud from imams
who fail to uphold the law (thus van Ess, in TG, iv, 14; cf. also Cook, Voice
of Honest Indignation, ch.9).
[58] Ash'ari, Maqalat, 467 = van
Ess, TG, v, 209, no.35, where al-Asamm's pupil Ibn 'Ulayyais of the same
opinion. Van Ess strangely translates yuqzmu al-ahkamas 'propose laws' (Gesetze
aufstellen) and takes the passage to refer to legislation (TG, ii, 414;
similarly 'Une lecture', 24). One would normally translate it 'uphold the
laws', and the passage comes in a rubric on whether there can be any amputation
of thieves' hands, infliction of retaliation or infadh al-ahkam, execution of
the laws, without an imam.
[62] I.
Goldziher, 'Hellenistischer Einfluss auf mu'tazilitische Chalifats - Theorien',
Der
Islam,
vi(1916), with reference to J. Lippert (ed.), De Epistula Pseudoaristotelica
Peri Basileias Commentatio (Halle, 1891), §2. The Greek original is lost. For a
re-edition and translation of the famous section predicting the political unity
of mankind, see S. M. Stern, Aristotle on the World State (Oxford, 1968). For a
new edition and
translation of the entire letter, see J. Bielawskiand M. Plezia (eds. and trans.), 'Lettre d'Aristotea Alexandre sur la politique envers les cites', Archiwum filologiczne, xxv (1970), who argue that the letter is authentic.
translation of the entire letter, see J. Bielawskiand M. Plezia (eds. and trans.), 'Lettre d'Aristotea Alexandre sur la politique envers les cites', Archiwum filologiczne, xxv (1970), who argue that the letter is authentic.
[64] Bielawski
and Plezia, 'Lettre', 30, 39 = 57, 63 (2, 1; 7, 7). Goldziher only adduced the
first passage. Compare Isocrates (d. 338BC), Nicocles , 22-6, on how monarchy
is more efficient in war than other forms of government. The second argument
seems to summarize Aristotle's case for and against 'theking who acts in all
matters according to his own will', where it is observed that 'some people
think it entirely contrary to nature for one person to be sovereign over all
the citizens where the polis consists of men who are alike' (Politics,1287a).
[65] M.
Grignaschi, 'Les "Rasa'il 'Aristatalisa 'ila-l-Iskandar" de Salim
Abu-l-'Ala'et l'activite culturelle a l'epoque omayyade', Bulletin d'etudes
orientales, xix (1965-6); M. Grignaschi, 'Le Roman epistolaire classique conserve
dans la version árabe de Salim Abu-l-'Ala", Le Museon, lxxx (1967).
[66] 'Al-Risala
fi'1-sahaba', in Ibnal-Muqaffa': "Conseilleur" du calife, ed. and
trans. C. Pellat (Paris, 1976), §§13-14; in al-Majmu'a al-kamila li-mu'allafat'
Abdallah b. al-Muqaffa' (Beirut,1978), 195-6, where some people hold that the
imam is no different from any one else in that he must be obeyed when he
follows God and disobeyed when he goes against Him, whereas others say that he
must be obeyed in all circumstances because his subjects cannot sit in
judgement of him. Here, as in the letter to Alexander, the adherents of the
first view sound more anarchist than they are likely to have been. (The
similarity between the formulations in the two works was first noticed by
Anthony Black.)
[68] Cf. Neal
Wood, Cicero's Social and Political Thought (Berkeley, 1988), ch.4.
Dawson persuasively argues that this goes back to Panaetius (CitiesoftheGods, 252
n. 14).
Dawson persuasively argues that this goes back to Panaetius (CitiesoftheGods, 252
n. 14).
[70] Ps.-Nashi',
§83 = van Ess, TG, v, 330; Ash'ari, Maqalat, 467 = van
Ess, TG, v, 330; cf. also vanEss, in TG, iii, 130 ff. They were well aware that
the scraps they received by begging had been acquired in sinful ways as well,
but they argued that necessity legitimated their consumption: one may eat
carrion and other things prohibited by the law if the alternative is starving
to death (thus Ash'arl, who dismisses their prohibition on making a living,
known as tahrzmal-makasib, as an excuse for laziness).
[71] Cf .P.
Crone, 'The Early Islamic World', in K. Raaflaub and N. Rosenstein (eds.), War
and Society in the Ancient and Medieval Worlds (Cambridge, Mass.,1999), 323
ff.; Patricia Crone, Slaves on Horses: The Evolution of the Islamic Polity
(Cambridge, 1980), app.5; Dominique Sourdel, Le Vizirat abbaside, 2 vols.
(Damascus,1959-60).
[72] Dawson,
Cities of the Gods, 7. Whether their programme was as comprehensive as Dawson's
definition of utopian writing requires is another question: the chances are
that they only discussed the imamate, not political and social institutions in
general.
[73] See van Ess,
TG, iv, 1-2, minimizing (but not denying) the court attendance implied by the
sources cited at 1 n.3.
[76] W. Madelung,
'The Vigilante Movement of Sahl b. Salama al-Khurasani and the
Origins of Hanbalism Reconsidered', Jl Turkish Studies, xiv (1990, Festschrift
Fahir Iz), 331; van Ess, TG, iii, 173 ff. (superseding I. M. Lapidus, 'The
Separation of State and Religion in the Development of Early Islamic Society',
Internat. Jl Middle East Studies, vi, 1975)
[80] For their
revolt, see 'Abd al-Ameer' Abd Dixon, The Umayyad Caliphate 65-86/684-705
(London, 1971), 169ff.
[81] In
al-Nawbakhti, Firaq al-shi'a, ed. H. Ritter (Istanbul,1931),
10(Ps.-Nashi"s account of them breaks off in the middle)
[84] This surely
was the message of the Cynic and Stoic Republics alike. None of them was
construed in a utopian vein (pace the authors above, n. 16), not even in a
'high utopian' vein after the fashion of Plato's Republic (cf. Dawson, Cities
of the Gods, 7, 186). To say that a particular institution (e.g. slavery) did
not exist according to natural law was much the same as saying that it did not
exist in the eyes of God: the message was that the institution had no moral
value, not that it ought to be abolished. The deliberately outrageous tone
characteristic of both the Cynic and the Stoic works is consistent with a
desire to change perceptions, not with one for institutional reform; and unlike
Plato, the Stoics were perfectly happy with the fact that their ideal city
could never exist: the status of wise man was practically unattainable, as they
readily declared, without excepting themselves. But whereas the Cynics took the
moral worthlessness of conventional institutions to mean that one should reject
society (to live in a tub or the like), the Stoics held that one should
continue to live in it while keeping the moral indifference of conventional
institutions in mind: the wise man should marry, as Zeno and Chrysippus said,
no matter how communist sexual relations might be according to natural law; he
just should not attach too much importance to it. (Both attitudes reappear in
Sufism.)
[85] Nizamal-Mulk,
in A. K. S. Lambton, 'The Dilemma of Government in Islamic Persia: The Siyasat-nama
of
Nizamal-Mulk', Iran, xxii (1984), 59.