Organized vengeance called ‘justice’
Pierre Kropotkine
“ন্যায়বিচার” নামক সংঘবদ্ধ প্রতিহিংসা
পিটার ক্রপোৎকিন
অনুবাদ: ইস্ক্রা
অনুবাদ: ইস্ক্রা
এই অনুবাদকর্মটির কোনো কপিরাইট নাই।
১৮৩৭ সালে এডল্ফ ব্লাঙ্কোয়া (Adolphe Blanqui: একজন বৈপ্লবিক নেতার ভাই, যার নামানুসারেই তাঁর অনুসারীরা
“ব্লাঙ্কুইস্টস” নামটি গ্রহণ করেন) “The History of Political Economy” নামে একটা বই লিখেছিলেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন
রাজনৈতিক সংগঠনের এবং একইসাথে
অধিকার, নীতিবোধ এবং দর্শনের বর্তমান ধারণা নিরুপণ করতে গিয়ে মানব ইতিহাসে অর্থনীতির
গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন। ষাট বছর আগে, লিবারেল এবং র্যাডিকেলরা
রাজনীতির প্রতি মনোযোগ দিতে শুরু করেন। তারা ছিলেন নতুন
শিল্প ব্যবস্থা সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ। পুরোনো শাসনব্যবস্থার ভাঙনের ফলে এই
শিল্প ব্যবস্থা তখন রূপান্তরের পর্যায়ে/পথে ছিলো। ব্লাঙ্কোয়ার কাছে তখন স্বাভাবিকভাবেই মনে হয়েছিল, অর্থনীতি এবং
ক্রমবর্ধমান সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করতে হলে অর্থনীতির উপর
ভিত্তি করেই পুরো ইতিহাস রচনা করা প্রয়োজন। (তার মনে হয়েছিল) কিছু একপেশে চিন্তা পরিত্যাগ
না করাই শ্রেয়, বরং, কিছুক্ষেত্রে কাম্যও বটে। ইতিমধ্যেই আমরা জানি, অন্যান্য বিষয়গুলো
বিবেচনায় এনে সেগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন তিনি বোধ করেননি। এবং, তাঁর সকল
যুক্তিতর্কই এযাবৎকালে অজ্ঞতা প্রসূত বলে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
সমাজ উন্নয়নের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোকে বেমালুম ভুলে জার্মান
স্কুল অফ সোশাল-ডেমোক্রেটরা ব্লাঙ্কোয়ার রঙ-চড়ানো তত্ত্বের অনুসারী হয়। আমরা,
অর্থ্যাৎ, এনার্কিস্টরা অন্যান্য বিষয়গুলোকে, যেমন: রাষ্ট্রকে বেশী প্রাধান্য দেই। তাই, আমাদের
দায়িত্ব হলো সমাজের উপরে রাষ্ট্রের
প্রভাবকে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা।
যাহোক, রাষ্ট্র কর্তৃক চর্চিত কেন্দ্রীভূত হুজুরতন্ত্র,
জ্যাকোবিন এবং স্বাধীনতা পরিপন্থী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানাতে গিয়ে আমরা “ন্যায়বিচার”
নামক তত্ত্বটির সমালোচনা করতে বেমালুম ভুলে গেছি। এই প্রবন্ধটি এই তত্ত্বটির প্রতি বিশেষ
মনোযোগ আকর্ষণ করতে এবং আলোচনার মাধ্যমে এ ব্যাপারে আলোকপাত করার জন্যই লিখছি।
***
সামাজিক উন্নয়নের চিত্র ভালোভাবে লক্ষ্য করলে একটি বিষয় আমাদের
ভাবতে বাধ্য করে যে, রাষ্ট্র এবং ন্যায়বিচার হলো এমন দুটি প্রতিষ্ঠান যারা সমাজে
কেবলমাত্র সহাবস্থানই করে না, এরা একে অপরের কার্যকরণে পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। আইনভঙ্গকারীদের
দণ্ডবিধানের জন্য পৃথকভাবে নিযুক্ত মানুষদের প্রয়োজনীয়তা আমরা সকলেই মানি। আইন
প্রণয়ন, সেগুলোকে সংরক্ষণ কিংবা দণ্ডের মাত্রা নির্ধারণের জন্যও একটা পর্ষদ গঠন
জরুরী। এজন্য আইন তৈরি এবং ব্যাখ্যাদানে পারদর্শী এমন বিশেষ শিক্ষায়তন গঠনও জরুরী।
এমনকি আমার এও মানি যে, রাষ্ট্রের জন্য জেলখানা, জেলার, পুলিশ, জল্লাদ এবং
সেনাবাহিনী গঠনেরও দরকার আছে।
প্রাচীন গোষ্ঠীগুলো মূলত সমাজতান্ত্রিক (Communist) ছিলো। তারা বিচারক নামক কোনো পদের কথা জানতো না। কারণ, তাদের নিজেদের ভিতরে
চুরি, প্রতিহিংসা, খুন ইত্যাদি ছিলো না। প্রচলিত প্রথাগুলোই সেগুলোকে প্রতিরোধ
করার জন্য যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু অত্যন্ত বিরল কিছুক্ষেত্রেই কোনো সদস্য কোনো পবিত্র
রীতিকে অবজ্ঞা করলে পুরো সম্প্রদায় মিলে তাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলত। এক্ষেত্রে সম্প্রদায়ের
প্রত্যেক সদস্যকেই পাথর ছোঁড়ায় অংশগ্রহণ করতে হতো যাতে করে এই শাস্তিদান কোনো
নির্দিষ্ট ব্যক্তির হাতে না থাকে। পুরো সম্প্রদায়ের
পক্ষ থেকে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করাই ছিলো এর উদ্দেশ্য।
কিন্তু অন্যকোনো সম্প্রদায়ের লোক তাদের অনিষ্ট করলে সেই
অনিষ্টকারি ব্যক্তির কৃতকর্মের জন্য পুরো সম্প্রদায়ই দায়ী থাকতো। পুরো
সম্প্রদায়কেই দায়ী করা হতো কারণ, যাতে ক্ষতিগ্রস্থ সম্প্রদায়ের যেকোনো সদস্য
অনিষ্টকারী সম্প্রদায়ের যেকোনো সদস্যের উপর সুযোগ বুঝে প্রতিশোধ নিতে পারে। জীবনের
বদলা জীবন, দাঁতের বদলা দাঁত, যতটুকু জখম হয়েছে ততটুকু জখম প্রতিপক্ষকে করতে হবে -
এই ছিলো প্রতিশোধের মূলনীতি এবং শস্যদানা ছিলো জখম পরিমাপের একক। আর এই ছিলো ন্যায়বিচারের
আদিম ধারণা।
পরবর্তীতে, আমাদের যুগে, প্রথম শতাব্দীতে গ্রামীণ জীবনের এইসব
ধারণা পরিবর্তন হয়ে গেল। কিন্তু প্রতিহিংসার ধারণা কৃষিজীবি সমাজে সন্তর্পনে থেকেই
গেল। এখনো যোদ্ধাদের মাঝে এই ধারণা রয়েই গেছে। এখন ক্ষতিপূরণের
ধারণা অর্থ্যাৎ, ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি বা তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ধারণা
প্রবর্তিত হয়েছে। পিতৃশাসিত পরিবারব্যবস্থার উদ্ভবের
সাথে সাথে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও ক্ষতির ধরণভিত্তিক মূল্যায়নের দিকে পরিবর্তিত হয়। ফলে, অনিষ্টকারীর পদমর্যাদা
ভেদে ক্ষতিপূরণের মূল্যও ভিন্ন হতে শুরু করে। যেমন: কোনো কৃতদাসকে
হত্যার ক্ষতিপূরণ একরকম, সাধারণ লোক ক্ষতিগ্রস্থ হলে একরকম আবার কোনো গোত্রপ্রধান
ক্ষতিগ্রস্থ হলে ক্ষতিপূরণ অন্যরকম হয়। বর্বরযুগের আইন থেকেই ক্ষতিপূরণের এই মাত্রা পরিমাপের উদ্ভব হয়েছে। ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য গ্রাম সম্প্রদায়ের নির্দিষ্ট লোকজন একত্রে বসতো
এবং মূল ঘটনা উদঘাটনের জন্য প্রত্যেক পক্ষ থেকে ৬ বা ১২ সদস্যের জুরিবোর্ড গঠন করা
হতো। প্রধানত যাদের উপরে সবার ভরসা
আছে এমন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করতেন। কখনো কখনো এ কাজের জন্য
বাইরে থেকেও কাউকে আমন্ত্রণ করে আনা হতো।
কিন্তু ধীরে ধীরে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক অভিবাসনের ফলে বহু মুক্ত
সমাজ দাসত্বে আটকা পড়তে আরম্ভ করলো। দখলদারেরা যে স্থানে বাস করতো সেই স্থানকেই
দখল করে নিতে শুরু করলো। এরপরেই বিশপ-যাজকদের নামক ভয়ংকর গুনিনদের উদ্ভব হয়। এবং ধীরে ধীরে জুরিবোর্ড,
বয়োজ্যেষ্ঠ মধ্যস্থতাকারীদের বদলে বিশপ অথবা স্থানীয় নৃপতিদের দ্বারা নিযুক্ত প্রতিনিধিরাই
ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের কাজ করতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে ক্ষতিপূরণের তুলনায় জরিমানা
আদায়ই মুখ্য বিষয় হয়ে পড়লো। সম্প্রদায়ের ভাগে জরিমানার অংশ
শুন্যের কোঠায় গিয়ে দাঁড়ালো এবং পুরো অর্থই সম্প্রদায় প্রধানেরা পকেটতস্থ করতে
শুরু করল। ওল্ড টেস্টামেন্ট তার প্রতিনিধিদের বহু ধরণের চিরায়ত বিচার দৃষ্টান্তের
উদাহরণ যোগাড় করে দিলো। তাই আজ আমরা দেখি যেমন করে পল্লীসমাজ থেকে সামন্তবাদের
উদ্ভব হয়েছিল তেমন করেই নির্বাচিত জুরি ব্যবস্থা থেকেই আধুনিক বিচারক নিয়োগের পদ্ধতিও
চলছে। এভাবেই অন্যান্য ধারণাগুলোকে অতিদ্রুত তাড়িয়ে দিয়ে দণ্ডদানের ধারণা জন্মলাভ করে। হিব্রু পূর্বসুরীরা
বিশেষত, চার্চ ব্যবস্থার মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি করেই রাজত্ব কায়েম করতে চেয়েছিল। একজন যাজক মার খেলে একজন মানুষ মার খেলো – এরকম আর ভাবা হতো না। বরং, ধরে নেওয়া হতো যাজককে মারা ধর্মের উপরেই আগ্রাসনের নামান্তর। এবং, কোনো শাস্তির মাধ্যমেই এমন গুরুতর
আগ্রাসনের বিচারের জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে, সময়ের সাথে সাথে বিচারের নিষ্ঠুরতা বাড়তেই থাকলো এবং ধর্মনিরপেক্ষ ক্ষমতার
আদলে যাজকতন্ত্রের ক্ষমতার বিকাশ ঘটলো।
দশম এবং একাদশ শতকে
মধ্যযুগ শুরু হয়। শহরে শহরে বিপ্লবের
মাধ্যমে বিশপ, জোতদার, রাজাদের বিচার হঠিয়ে
দেওয়া হয়। শহরগুলো সংঘবন্ধ
হয়। প্রথমেই তারা শপথ করল যে, প্রতিশোধপরায়ণ (lex talions) বিবাদকে তারা বর্জন করবে এবং, নতুন বিবাদগুলোকে
মেটানোর জন্য বাইরের কোনো মাতব্বরের কাছে না গিয়ে নিজেরাই সমাধান করবে। এই ব্যবস্থার পূর্বে গিল্ড (the
guild), প্যারিস (the parish) এবং টাউন কমুনিটি
– এই তিন ধরণের বিচারব্যবস্থা ছিলো। গিল্ড, স্ট্রিট, প্যারিস অথবা টাউন মনোনীত বেইলিরা (Bailies) যেকোনো অপরাধের জন্য জরিমানা নির্ধারণ করতো। গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে গিল্ড, স্ট্রিট, প্যারিস অথবা টাউন সালিস বসিয়ে শাস্তি
নির্ধারণ করতো। এছাড়াও, জনগণ, গিল্ড, প্যারিস
বা টাউনের মাঝে সালিসি সভার ব্যাপ্তি আরও বৃদ্ধি পেয়েছিলো।
কিন্তু এই ব্যবস্থা
মাত্র কয়েক শতাব্দী টিকতে পেরেছিল। খ্রীস্টধর্ম এবং রোমান আইনের নয়া পাঠ যৌথভাবে মানুষের
মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। যাজকেরা অবিরাম ঈশ্বরের ঘৃণা ও রাগের বাদ্য বাজাতে থাকে। তাদের সেই মন পছন্দ
যুক্তি - “চার্চের বিরুদ্ধে কথা বললে স্রষ্টার চিরস্থায়ী
গজব পড়বে” আমাদের যুগে
আজও ধর্মগ্রন্থের দোহাই দিয়ে প্রয়োগ করা হয়। চার্চ সবসময়ই অপরাধীর
ভিতরে একটি পিশাচের অস্তিত্বের কথা বলে এবং এই পিশাচকে তাড়াতে সে নির্যাতনের নিত্যনতুন
রাস্তা বের করে। অবশেষে তাকে পুড়িয়ে ফেলা হয় যেন সে আর ফিরে আসতে না পারে। একদম শুরু থেকেই যাজক
এবং রাজা মিলেমিশে কাজ করতো। এমনকি যাজকও প্রায়শই রাজা হতো, যেমন: পোপ একজন রাজা। ফলে, কেউ দেশের আইন অমান্য করলেও ধরে নেওয়া হতো সে চার্চের বিরুদ্ধে
কাজ করছে। যাজকীয় ক্ষমতা এবং দেওয়ানি ক্ষমতা – দুটোই হাতে হাত মিলিয়ে চলতো। যাজকীয় ক্ষমতা অবশ্য
সামান্য এগিয়ে ছিলো কারণ, এর নির্যাতনের হিংস্রতা
খুব দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছিল। পোপ ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারক। তিনি রোমান ও সামন্ত
আইন বিশেষজ্ঞ আইনজ্ঞ পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতেন। কাণ্ডজ্ঞান, প্রথা ও রীতিনীতিলব্ধ জ্ঞান, মানুষের প্রবৃত্তিকে
পর্যবেক্ষণ ইত্যাদির চর্চা একে একে বন্ধ হয়ে গেল। এগুলোকে অনিষ্টের ধারক
এবং সকল শয়তানি কর্মকান্ডের জনক বলে আখ্যা দেওয়া হলো। “নজিরকে (Precedent)” আইনের মর্যাদা দেওয়া
হলো। ফলে, পূর্বতন বিচারের রায় সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ
ও বাধ্যতামূলক হয়ে গেল। এবং, রোম
সাম্রাজ্যের এবং হিব্রু বিচারকদের রায়গুলোকে “নজির” হিসেবে আমদানি করা শুরু হলো।
বিশপ, সামন্তপ্রভু, রাজা, পোপদের আগমনে ধীরে ধীরে সালিসি প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেল। ধর্মীয় এবং দেওয়ানী
ক্ষমতার মিত্রতার ফলে ঝগড়া-কলহের বোঝাপড়ামূলক নিষ্পত্তি
নিষিদ্ধ হলো। দোষীপক্ষের জন্য জরিমানা ধার্যের রীতি বিলীন হয়ে গেল। খ্রিস্টান সৃষ্টিকর্তা
অথবা রোম সাম্রাজ্যের নামে প্রতিহিংসার বিচারই মুখ্য হয়ে উঠল। একইসাথে শাস্তির নৃশংস
চরিত্র এতোটাই প্রকট হয়ে উঠেছিল যে সেই সময়ের বিচারিক প্রক্রিয়াটি কেমন ছিলো তা বর্ণনা
করা এখন প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার।
সব সমাজের ক্ষেত্রেই
প্রযোজ্য ন্যায়বিচারের এমন মৌলিক তত্ত্বগুলো একাদশ ও দ্বাদশ শতকে এভাবেই পরিবর্তিত
হয়েছিলো। “দ্য
স্টেট এন্ড ইটস হিস্টোরিক রোল” শীর্ষক প্রবন্ধে আমরা ব্যাখ্যা
করতে চেষ্টা করেছিলাম রাষ্ট্র কেমন করে স্বাধীন শহরগুলোকে দখল করে নিয়েছিল। আমাদের বর্তমান অবস্থাও
একই কথা বলে। বিবর্তনের ধারায় মুক্ত নগরগুলো রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার
অব্যবহিত পরেই গোত্রগুলোর মধ্যে বোঝাপড়ামূলক নিষ্পতি এবং জরিমানার ধারাটি আক্ষরিক অর্থেই
উঠে গিয়েছিলো। অথচ, একাদশ শতকে এগুলোই ছিলো
প্রচলিত ন্যায়বিচারের মূল সত্ত্ব। রাষ্ট্রব্যবস্থার আবির্ভাব হওয়ামাত্র
পুরোনো ধারণাটি পুরোপুরি হারিয়ে গেল। ততদিনে খ্রিস্টবাদ এবং রোমান আইন মুক্ত শহরগুলোকে
নিয়ে রাষ্ট্র গঠন করে ফেলেছিল। রাষ্ট্রের পরবর্তী করণীয় কাজটি এককথায় ছিলো দখলকৃত
শহরগুলোর উপর কেবলমাত্র তার সাম্রাজ্য ও কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে শুরু করা।
অবশ্যই, গত পাঁচ শতকের অর্থনৈতিক
পরিবর্তন কেমন করে ঘটলো, ব্যবসাবাণিজ্য কতদূর এগোলো, ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক ঋণব্যবস্থা কেমন করে তৈরি হলো, যুদ্ধ, উপনিবেশায়ন এবং পুঁজিবাদী উৎপাদন কেমন করে সামাজিক
উৎপাদনকে প্রতিস্থাপন করলো এবং এগুলোর সাথে ন্যায়বিচারের ধারণা কেমন করে পাল্টে গেল
তা যথেষ্ট কৌতুহলোদ্দীপক পাঠ। এসব নিয়ে মুক্ত শহরগুলোর ঐতিহাসিকদের করা কিছু চমকপ্রদ
গবেষণাপত্র হয়তো এখানে সেখানে পাওয়া যেতে পারে। খ্রিস্টবাদ এবং রোমান
আদর্শের প্রভাব নিয়ে কিছু মৌলিক গবেষণাপত্র আজও টিকে আছে (যদিও এই এর পর্যবেক্ষণগুলো জটিলতায় ভরপুর এবং প্রচলিত মতের বিরোধী)। কিন্তু, সবকিছুকেই কেবলমাত্র অর্থনীতির আলোকে চিন্তা করাটা ভুল হবে। যেমনটা ভুল হবে উদ্ভিদবিজ্ঞান
পড়তে গিয় আর্দ্রতা, আলো এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ
বিষয় বাদ দিয়ে গাছের জীবনের জন্য শুধু যদি তাপের প্রয়োজনীয়তাই হিসাব করি।
ইতিহাসের এই
সারসংকলনটিতে ছোট পরিসরে হলেও দেখানো হয়েছে কেমন করে রাষ্ট্র এবং বিবর্তিত প্রতিহিংসা
বা ন্যায়বিচার একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং কেমন করে যুগ যুগ ধরে এরা একে অপরকে
সমর্থন করে আসছে।
একটু ঠান্ডা
মাথায় চিন্তা করলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে কোন যুক্তিতে এই দুই প্রতিষ্ঠান একত্রে জুড়ে
থাকে, কেমন করে উভয়েই একই উৎপত্তিস্থল থেকে উদ্ভুত
হলো। কর্তৃপক্ষকে সামাজিক নিরাপত্তা রক্ষার এবং আইন ভঙ্গকারীর উপর
প্রতিশোধ নেওয়ার দায়িত্ব অর্পন করা হয়। আপনি যদি বিচারকদের সমাজের মধ্য থেকে বিশেষভাবে বাছাইকৃত
সদস্য বলে মেনে নেন, যাদের হাতে প্রচলিত বিধিবিধানকে
প্রয়োগ করার ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে; তাহলেই রাষ্ট্রের আদিমূলটি
পেয়ে যাবেন যাকে কেন্দ্র করে অন্যান্য ক্ষমতাগুলো উদ্ভুত হয়েছে। অপরপক্ষে, আপনি যদি রাষ্ট্র নামক কেন্দ্রীভূত কাঠামোটিকে মেনে নেন,
তাহলে দেখবেন এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ন্যায়বিচার প্রদান করা,
যা বিচারকদের হাতে ন্যস্ত।
কিন্তু, জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত বিচারক পাওয়া কি সম্ভব? চলুন দেখা যাক এই প্রশ্ন আমাদের কোথায় নিয়ে যায়। প্রথমেই বলা যায়, মনুষ্য সৃষ্ট “আইনের” ধারণাকে কখনো গভীরভাবে খতিয়ে দেখা হয়নি। অবধারিতভাবে জ্ঞানীগুণী
ব্যক্তিদের উপরেই সেগুলোর খসড়া প্রস্তুত করার ভার থাকে। এরপর আইনগুলোকে ব্যাখ্যা
করার জন্য, পূর্বতন আইনের সঙ্গে এর সম্পর্ক অথবা
তুলনা করার জন্য বিচারক এবং আইনপ্রণেতারা (Legislator) ছাড়াও অন্যান্যদের দরকার হয়। পুরো সমাজের প্রতিভূ
হিসেবে আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা তাদের সামাজিক প্রথা এবং আইনি
ভাষার চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে আইনগুলোকে ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু সেগুলো বিচারকদের
কাছে বাড়তি সহায়ক ছাড়া বেশীকিছু হিসেবে গণ্য হয় না। একদিকে তাদেরকে সৈন্যবাহিনী, পুলিশ, পতিতা, গুপ্তচর
ইত্যাদি প্ররোচনা দেয়, অন্যদিকে, কারাপাল
(Gaoler), জল্লাদ
আর অন্যান্য অসচ্চরিত্রবান লোকেরা তাদের ঘিরে থাকে। শেষপর্যন্ত, এই পুরো ব্যবস্থাটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য দরকার হয় একটি তত্ত্বাবধায়ক
দল গঠন করা হয়। অতি অবশ্যই তাদের ভরণপোষণের জন্য পয়সা দেওয়া কথা ভুললে চলবে
না। সংক্ষেপে, রাষ্ট্রের এমন কোনো উপায় নাই যার
মাধ্যমে আমরা সত্যিকার বিচারক নিয়োগ করতে পারি, হোক সে জনগণের
দ্বারা নির্বাচিত অথবা অনির্বাচিত।
কিন্তু বিধিবদ্ধ
আইন সম্পর্কে কি বলা যায়? বিধিবদ্ধ সকল আইনই বিভিন্ন
প্রথা, পুরোনো ধারণা থেকে ধার করা চিন্তার সমাবেশ। এই পুরোনো ধারণাগুলো
বর্তমান সামাজিক ধারণাগুলোর পুরোপুরি পরিপন্থী্। এগুলো মূলত আমাদের দাসত্বপূর্ণ
অতীতকাল থেকেই টিকে আসছে। তাই, এগুলোর কাজ, বক্তব্য এবং চিন্তাও দাসত্বপূর্ণ। কোনো আদর্শিক চিন্তায়
আমাদের মতামত গৃহীত হলেও তা খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারে না। যখনই কোনো তথাকথিত ভালোকাজ
না করার জন্য শাস্তির হুকুম হয় তখন আর আমাদের কিছুই করার থাকে না। বিধিবদ্ধ আইন হলো অতীতের
বাঁধাধরা নিয়ম যা মানবজাতির অগ্রগতির পথকে আগলে ধরে।
প্রতিটি আইনসম্মত
দণ্ডই একেকটি আইনসম্মত প্রতিহিংসার প্রকাশ। প্রতিহিংসা এখানে বাধ্যতামূলক। এবং, আমাদের নিজেদের অবশ্যই প্রশ্ন করা উচিত এই প্রতিহিংসা কেন প্রয়োজন?
এটা কি সামাজিক প্রথা পালনে সাহায্য করে? এটা কি
কখনো কোনো ভালো প্রথা ভঙ্গকারী ছোট্ট দলকেও প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছিল? কক্ষনো না। অপরদিকে, প্রতিহিংসার
দায়িত্ব হলো স্রেফ সমাজ পরিপন্থী প্রথাসমূহকে টিকিয়ে রাখা। কেবলমাত্র সমাজের প্রতি
পুলিশের নোংরা নষ্টামির কথাই চিন্তা করুন। এগুলো যেকোনো দুষ্কৃতিকারীদের কৃতকর্মের
চেয়েও ভয়াবহ। দৃষ্কৃতিকারীদের কাছ থেকে সত্য বের করে আনতে ম্যাজিস্ট্রেটরা
“সদুদ্দেশ্যে যে মিথ্যাকথাগুলো” বলে সেগুলোর কথাই ধরুন। আমাদের চারপাশে যাকিছু ঘটছে সেগুলোর কথা চিন্তা করুন। তাহলেই বুঝতে পারবেন
কেন নৈরাজ্যবাদীরা নির্দ্বিধায় কেন বলেন দণ্ড, অপরাধের
চেয়েও ক্ষতিকর। এবং, যেকেউ ঐ প্রশ্নগুলো নিয়ে
চিন্তা করতে গিয়ে যত গভীরে যাবেন একই উপসংহারে পৌঁছুবেন এবং, অনিষ্টকারীদের হাত থেকে সমাজকে বাঁচাতে নতুন উপায় খোঁজার চেষ্টা করবেন।
যোকোনো সালিসি
দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলতে বেশীরভাগ সময় দুইপক্ষের মনোনীত মাতব্বরই যথেষ্ট। আপনারা সকলে একমত হবেন
যে, রাষ্ট্র যখন থেকে শৃঙ্খলা রক্ষাকেই সবচেয়ে সুবিধাজনক
রাস্তা হিসেবে বুঝতে পারলো তখন থেকে অহস্তক্ষেপের নীতিই সবচেয়ে বড় বদঅভ্যাস বলে চিহ্নিত
হলো।
বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী বা পথচারীরা প্রকাশ্য হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বহুবিধ সংঘর্ষ
প্রতিরোধ করতে শুরু করতে পারে। দুর্বলকে সাহায্য করা, বিবাদমান মানুষের মাঝে হস্তক্ষেপ করা সকলেরই দায়িত্ব হলে কোনো
পুলিশবাহিনী র প্রয়োজনই থাকবে না।
গত কয়েক শতক
ধরে ঘটে চলা দুটি সমান্তরাল উন্নয়নের ধারা সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা তাড়িত না হয়ে পারেন
না। একদিকে আইনগত দণ্ডবিধি এবং প্রতিশোধপরায়নতা ক্রমেই কম রক্তাক্তময় হয়ে উঠেছে, অবশ্য একে এখনো কোমল বলা যাবে না। একদিকে নির্যাতন বিলুপ্ত
হয়েছে অপরদিকে সমাজবিরোধী কার্যকলাপ কমে গেছে। এখন আমাদের পূর্বসুরীদের
তুলনায় আমাদের জীবনের অনেক বেশী নিরাপত্তা আছে। এইসব অনেকগুলো বিষয়
এই সহজীকরণে সাহায্য করলেও দণ্ডবিধিকে শিথিলকরণ এদের অন্যতম প্রধান বিষয়। আমাদের কি এভাবে চালিয়ে
যাওয়া উচিত নয়? নাকি, কোনো
সোশালিস্ট বা কমুনিস্ট সমাজ অথবা কোনো পুঁজিবাদী সমাজই এখনো কাম্য?
উৎপাদনের ক্ষেত্রে
যেমন করে কোনো মাতব্বর ছাড়াই আমরা চলতে পারি তেমনি বিচারক ছাড়াও আমাদের সমাজও চালিয়ে
নিতে পারব।
উপসংহার:
তথাকথিত “ন্যায়বিচার” হলো অতীতের ব্যক্তিস্বার্থেরই
টিকে থাকা একটি অংশ যা মূলত বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে। রোমান আইনে এ হলো দৈব-প্রতিশোধ।
সমাজের ইতিহাসে
ন্যায়বিচারের নামে প্রতিশোধপরায়ন প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে
একে অপরকে সাহায্য করে। এরা একইসাথে উদ্ভুত, বিকশিত
হয়েছে এবং একইসাথে ধ্বংসপ্রাপ্তও হবে।
ভূমিদাসত্বের
অতীতকাল থেকে উদ্ভুত হয়ে এটি বর্তমানেও পুলিশ, কারাগারের
মাধ্যমে ভূমিদাসত্বের বীজ বপন করছে। এটা যেন একটা খোলা, দগদগে পুঁজভর্তি ক্ষত। এই গলিত পুঁজের স্রোতধারা
সমাজে নিরন্তর বয়ে যাচ্ছে। যে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে এটি যুদ্ধ করছে বলে মনে হয়
এটি তার চেয়েও বড় অশুভ শক্তি।
আমাদের চেয়েও
উৎকৃষ্ট অর্থনীতির যেকোন সমাজ অবশ্যই মানতে বাধ্য হবে যে, দণ্ডমূলক প্রতিষ্ঠান চালানো নিতান্তই হঠকারী সিদ্ধান্ত।
এদেরকে ছাড়াই
চলার রাস্তা স্বেচ্ছাসেবামূলক সালিস পদ্ধতিতে পাওয়া যাবে যা শক্তিশালী শিক্ষামূলক উপায়ে
অনেক সফল সংহতি সৃষ্টি করতে পারে। এভাবে সমস্যার সমাধান হলে জনগণের নীতিবোধ সমুন্নত
রাখার ভার পুলিশবাহিনীর উপরে ছেড়ে দেওয়ার প্রয়োজন থাকবে না।